এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • কাঁটায় কাঁটায় 

    Arundhati Sarkar Santra লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২১ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩৬৫ বার পঠিত
  •  
    প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণির চাকরি, উলবোনার হবি আর সায়া বাঁধার দড়ির একটু নীচে একটা আধুলির মত শ্বেতীর নাছোড় দাগ এই নিয়ে জীবনের সঙ্গে শান্তিকল্যানে একরকম সন্ধিই করে নিয়েছিল সুলতা।
    সুলতা সন্ধি করতে পেরেছিল তার কারণ অবশ্য পরেশবাবুর ট্রেনিং। শ্বেতীর দাগটা তো আর একদিনে আধুলি হয়নি, সময় নিয়েছে।  শ্বেতীর দাগটা যখন তিলের মত দেখা দিয়েছিল তখন থেকেই পরেশবাবু দুই মেয়েকে একেবারে দুই ছাঁচে ঢেলে ফেলেছিলেন। 
    নরম ফরসা ছোটমেয়ে বিশাখার জন্য স্নো-পাউডার, গানের মাস্টার। সেই স্নো-পাউডারে সুলতা মাঝে সাঝে ভাগ বসালেও অঙ্কের দুটি মাস্টারের কাছে ছাড় ছিল না তার।
    বাজার থেকে ইলেকট্রিক মিটারের রোধ নির্ণায়ক ফিউজ বদলানো সবেতেই তিনি সুলতাকে সঙ্গে নিতেন। যেন জীবনের প্রতিরোধের জন্য সুলতাকে তৈরি করে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য।
    তবে এতো গেলো পরেশবাবুর ট্রেনিঙে ওদের জীবন গড়ার কথা।  
    এছাড়াও তো মেয়েদের হবির একটা ব্যাপার থাকে। বিশাখার ফরসা সুন্দর আদুরি মুখশ্রীর দৌলতে যখন পতঙ্গের মত পাড়ার, কোচিঙের ছেলেরা ওর শিখায় জীবন দান করে ধন্য হচ্ছে, তখন সুলতা যেন আক্ষরিক অর্থেই সেই পতঙ্গ, প্রজাপতি, ফুল, পাখি এঁকে ফেলতে লাগল দুটি কাঁটা আর পশমের বল দিয়ে। মায়ের কাছে শিখলেও সুলতার শেখার খিদে ওকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতো দক্ষ বুনিয়েদের কাছে। লাল, কালো, নীল উলের বলেরা আদুরে খরগোশের মত নেচে বেড়াত ওদের ঘরে, বারান্দায়। দুই কাঁটার আগে পিছে চলনে তারা সোয়েটারের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতো জটিল প্যাটার্নের অপূর্ব সব ডিজাইন। পড়াশোনার সময়টুকু ছাড়া সুলতাকে উলকাঁটা ছাড়া কেউ দেখেনি। কখনো কখনো সুলতার নিজেরই নিজের দুটো আঙ্গুলকে উলের কাঁটা বলে ভুল হয়ে যেত।
    সুলতা ওর মাকে বুনে দিল লালসাদার দাবাছকে উলের চাদর।
    বাবার জন্য পাঁশুটে মাফলার। বিশাখা ওকে দিয়ে বুনিয়ে নিল সোয়েটারের সাদা খয়েরি জমিতে হলদে লাল ক্রিকেটের ব্যাট বল। বিশাখার উদ্ধত যৌবনের ওপর যেন সেই ব্যাট বল যেন আদিম খেলার আহবান।
    কোন খেলোয়াড়কেই অবশ্য বিশাখা বেশিদিন টিমে রাখেনা। তার আবেদনের রসটুকু শুষে নিয়ে পরবর্তীর জন্য জায়গা খালি করে দেয়।     
    তবে এইসব উলেকাঁটায়, পাড়াতুতো আলতুসি প্রেমে তো আর বয়স থেমে থাকে না। পরেশবাবুর মেয়েদেরও বিয়ের বয়স বসে থাকে নি। শ্বেতীর দাগ শুদ্ধ কাঁটাহাতে সুলতা, আর রূপসী পতঙ্গভুক  বিশাখার দেখাশোনা একসঙ্গেই চলতে থাকে। 
    কিন্তু  দেখা গেল দুটোই সমান কঠিন।
    সুলতাকে কারো পছন্দ হয়না, একই সঙ্গে বিশাখার পছন্দসই পাত্র মেলা মুশকিল। 
    অবশেষে বিকাশের সঙ্গে সুলতার বিয়েটা ঠিক হয়েই গেল অগ্রহায়নের চোদ্দই। বিকাশ পুরসভার সামান্য চাকুরে। বিশাখার অবশ্য এত কমা পাত্রে মন উঠবে না। 
    বিকাশের জন্য সুলতা বুনছিল মোজেইক উলের জোড়াসাপওলা হাতকাটা পুলওভার।  
    আজ বিকাশ আসবে। ওর মাপটা একবার দেখে নিতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওপরে উঠছিল সুলতা। সিঁড়ির বাঁকে কানে এল আশ্লেষে জড়ানো বিশাখার গলা, “উমম, আজকেই আমার কথা বাবাকে বলবে বলো? নইলে ফুলশয্যার রাতে সায়ার দড়ি টানলেই কি দেখবে? ম্যা গো!”
    সুলতা আর ওপরে যায়নি। নীচের ঘরে বিকাশের ব্যাগে ও রেখে দিয়েছে বিশাখার প্রেমিকদের আদিরসাত্মক যৌনগন্ধী চিঠির চালাচালি।  
    সুলতা দেখে আজকেই প্রথম কিভাবে যেন  দুটো একটা ঘর সোজা উল্টো প্যাটার্নে গুলিয়ে গেছে ওর। জড়ানো সাপের  নকশা ঘেঁটে ছেতরে গিয়ে যেন কুলোপানা ফনা তুলেছে  সোয়েটারের পশমি  বিষধর।   
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২১ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :|: | 174.25.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:১৭515586
  • পাপ হে, চাঁপাফুলের গন্ধ, আর এই কাঁটায় কাঁটায় -- তিনটিই ভালো লেখা কিন্তু বিষয়বস্তু হিসেবে বড্ড বেশী রকমের প্রতিশোধ স্পৃহা। মন খারাপ করিয়ে দেবার মতো। বিশেষ করে শেষ গল্পটি পড়তে মেঘে ঢাকা নীতার কথার মনে পড়লো বলে আরওই দুঃখ হলো। সময় কি এতটাই বদলে গেছে? 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:৪৬515606
  • "দুই কাঁটার আগে পিছে চলনে তারা সোয়েটারের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতো জটিল প্যাটার্নের অপূর্ব সব ডিজাইন।"
    কাঁটায় কাটাঁয় কি দারুণ গল্প বোনা হল। ভীষণ মেধার স্বাক্ষর গল্পের উলে উলে।  
    "কিন্তু  দেখা গেল দুটোই সমান কঠিন।"
    যে অসাধারণ সত্যগুলো আবিষ্কৃত হয় গল্পে আর তাতিয়ে দেয় পাঠককে। 
     
  • &/ | 151.14.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৪515636
  • এই গল্প ভালো লাগল না। একটি মেয়ে যাকে অঙ্কে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, ইলেক্ট্রিক লাইনের কাজ পর্যন্ত শেখানো হয়েছে, ছোটো থেকে বাইরের কাজকর্ম শেখানো হয়েছে, সে কেন উলুউলু ঢুলুঢুলু আতুপুতু হয়ে একটা যেন তেন বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে? সে তো ক্রমাগত আরও ভালো আরও ভালো পজিশনে উঠতে থাকবে, সমস্ত বাধাবিপত্তি পার হয়ে জিততে থাকবে। বিয়ে টিয়ের মতন সিলি ব্যাপারে তার আগ্রহই বা থাকবে কেন? বিশেষ করে যেখানে তাকে "দয়া করে" বিয়ে করছে বলে বোঝানো হচ্ছে কারণ তার একটা শারীরিক ত্রুটি আছে? নাহ, এই গল্প পোষালো না আমার। (তবে মতামত নিতান্তই ব্যক্তিগত)
  • এস এস অরুন্ধতী | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:১০515679
  • গল্প যখন পাঠকের দরবারে হাজির, তখন তা একান্ত পাঠকের। তাঁর ব্যক্তিগত মতামতও লেখকের কাছে মণিমুক্তোই। সেইসব মণিমুক্তো কুড়িয়ে নিলাম। 
    তবে যে পাঠক আমার তিনটি গল্প এক রেখায় রেখে পড়লেন এবং মতামত জানালেন তাঁর প্রতি অনেকটা ভালোবাসা জানালাম। আমার মতে চাঁপাফুলের গন্ধ ঠিক প্রতিহিংসার গল্প নয়, একটি সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি, পা রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়ার গল্প। পাপ হে একটি বিষণ্ণতার কাহিনী। সেই অর্থে কাঁটায় কাঁটায়ই একমাত্র প্রতিহিংসার প্রেক্ষাপটে লেখা। যদিও পাঠকের কাছে গল্প যে ভাবে পৌঁছেছে তাই আসল গল্প। 
    @ &/ এ দেশের জটিল পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে বিয়ের ভূমিকা বিচিত্র। বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষ ও বিবাহ বিষয়ে অদ্ভুত আচরণ করে থাকেন। তবে আপনার কথা মাথায় রাখব।     
    মামুন ভাই ভালোবাসা।   
  • পাঠক | 24.206.***.*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ০০:০৮515814
  • অরুন্ধতী, আপনার লেখাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়লাম। সবই কি এক মানের - তা নয়, তবে সবগুলোই চমৎকার। লিখতে থাকুন - যাতে আমরা পড়তে পারি।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন