এই গল্পে জানার থেকে না-জানার অন্ধকার বেশি। আর কোথা থেকে যে শুরু করব তাও জানি না। এর শুরু কি সেই ষষ্ঠদশ শতকের অ্যান্টোনিও মহোদয়কে দিয়ে, যিনি পর্তুগালের রাজার হুকুমে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন? পর্তুগীজ সামাজ্য বিস্তারের রাজকীয় স্বপ্নে বিভোর হয়ে আলবুকার্কের নেতৃত্বে যুদ্ধে মেতে উঠেছিলেন? না, থাক, মানুষ-মারা যুদ্ধবাজদের কথা অন্যসময়। আজ একটু অন্য রকম যুদ্ধের গল্প হোক।
আমাদের গল্পের যবনিকা যখন উঠছে, তখন অ্যান্টোনিওর বংশধরদের রক্তের অন্তর্গত যুদ্ধের কল্লোল স্তিমিত। অবস্থার প্যাঁচে পড়ে। পর্তুগীজ প্রভুত্বের দিন শেষ ভারতে। এ দেশে তখন ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়েছে। আর আগের দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রভুরা এখন সব খুইয়ে ইংরেজদের তাঁবেদারি করছেন। আর পর্তুগীজ পদবিখানা এখনও বজায় থাকলে কী হয়, তিনশ বছরের বেশি ভারতবাস এঁদের রক্তের ইউরোপীয়ান বিশুদ্ধতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে এক মিশ্ররক্তের জাতের। সেই আমলের ভাষায়, ইউরেশিয়ান। মান্যিগন্যি ইংরেজদের চোখের কাঁটাও বটে, আবার অন্য একদিক দিয়ে বড় ভরসার জায়গাও বটে। এঁরাই তো সচল রাখেন রেলওয়ে, পোস্টের মত সব অত্যাবশ্যক সার্ভিস। খেটে খাওয়ার কাজে এঁদের জুড়ি নেই। এই রকমই একজন রেলওয়ে কর্মী ছিলেন জন রিচার্ড ডি আব্রু।
ততদিনে অ্যান্টোনিওর বংশের লোকজন ভারতময় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি শাখা এসে খুঁটি গেঁড়েছে কলকাতায়। সেই বংশে জন রিচার্ডের জন্ম, ১৮২৬ সালের কলকাতায় । জন বিয়ে করেন আমেলিয়া মারি ব্লন্ডকে। ন’টি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমেলিয়া মারা যান। ১৮৬৫ সাল। এলেন বারবারার বয়স তখন মাত্র দুই এর আশেপাশে।
এলেন জন্মেছেন ১৮৬৩ সালে, ঢাকায়। সেখানে তখন জমজমাট ইউরেশিয়ান কলোনি। তবে ঠিক কী সূত্রে অ্যামেলিয়া তখন ঢাকায় ছিলেন তার হদিশ পাইনি। এরপর একটা বড় ফাঁক - এলেনের এরপরের খবর আসছে কানপুর থেকে। কানপুর তখন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের এক জমজমাট রেলশহর, বেশ বড়সড় এক রেল কলোনিও আছে সেখানে। এলেন সেখানে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। ১৮৭৯ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পাসের তালিকায় দ্বিতীয় বিভাগে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। গোটা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এর আগে মাত্র দুটি কন্যা এই কৃতিত্বের ভাগীদার। চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী। এলেন যে স্কুলের থেকে পরীক্ষা দিলেন, তার নাম কানপুর গার্লস স্কুল। এই স্কুল নিয়ে এই ফাঁকে দুকথা বলে নিই। এটা তৈরির কৃতিত্ব এক আমেরিকান মিশনারি মহিলার। ইসাবেলা থোবার্ন। আমেরিকার উইমেন্স ফরেন মিসনারি সোসাইটির তরফ থেকে তিনি ভারতে আসেন ১৮৭০ সালে। তখন ভারতে মেথডিক্যাল চার্চের কাজকর্মের একটা বড় কেন্দ্র হল লক্ষ্ণৌ। সেখানেই কাজ শুরু করলেন ইসাবেলা। কিন্তু তখন কাজ বলতে জেনানা মিশনের কাজ। তাতে মন উঠল না মেমসাহেবের। তাঁর মনে হল ইংরেজি যাদের কথ্যভাষা, সেই ইউরোপিয়ান ও ইউরেশিয়ান মেয়েদের শিক্ষার জন্য কিছু করা দরকার। তারা যাতে পরবর্তী জীবনেও মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। ব্যস খুলে ফেললেন স্কুল। ছ’জন বালিকা নিয়ে যাত্রা শুরু, তার দুজন আবার ইউরেশিয়ান। কিছু পরে আরেকটি ইংলিশ গার্লস স্কুল খোলা হল কানপুরে। প্রথম ক’বছর ইসাবেলাই লক্ষ্ণৌ-কানপুর যাতায়াত করে দুটো স্কুলই চালাতেন। তারপর কানপুরের স্কুলের দায়িত্ব নেন মিস ইস্টন। এঁর আমলেই, এলেনের দৌলতে কানপুর গার্লস স্কুলের নাম উঠল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায়। অনেক মিশনারিদের লেখাতেই অবশ্য পড়ছি যে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে মেয়েদের মধ্যে এলেনই প্রথম এন্ট্রান্স পাস করেছেন বলে। তখনকার অফিসিয়াল রেকর্ড অনুসারে সেটাই সত্য যদিও। দেরাদুনের চন্দ্রমুখী সবার হয়ে দুয়ার খোলালেন, তবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতিতে তাঁর জীবদ্দশায় সামান্য স্বীকৃতিটুকু পেলেন না। আমরা অবশ্য চন্দ্রমুখীকেই পথিকৃত হিসেবে জানব।
এলেন যখন স্কুলে পড়ছেন, ততদিনে মেয়েদের সেবাময়ীর ভূমিকাটি বেশ দৃঢ়প্রোথিত হয়ে গেছে। মেয়ে-শিক্ষিকা চাই, মেয়ে স্বাস্থ্যকর্মী চাই। আমাদের মেয়েরা শিক্ষিকা হোক, নার্স হোক। শিক্ষাদানের মাধ্যমে, শুশ্রূষাদানের মাধ্যমে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া – এই তো আদর্শ মেয়েদের কাজ। মেথডিস্ট চার্চের মিশনারি মহিলাদের মুখে মুখে এই কথা ঘোরে। এলেনও নিশ্চয় শুনেছেন। কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন? তা বোঝার কোন উপায় নেই কোন। তেমনই আমরা জানতে পারব না এলেন কেন উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হলেন। কেন আর দশটা ইউরেশিয়ান মেয়ের মত একটু পড়তে শেখা, একটু সেলাই-ফোঁড়াই , একটু নাচতে শেখা এই যা সব নিয়ে সাধারণ ইউরেশিয়ান মেয়েরা সন্তুষ্ট থাকত,এলেন কেন তার সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে তাকাতে চাইলেন?
তখনকার সাধারণ চাকুরিজীবি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাড়িতে কি খুব পড়াশোনার চর্চা ছিল, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে? ১৮৮২ সালের তথ্য থেকে পাই তার থেকে দেখা যায় যে ইউরোপিয়ান আর ইউরেশিয়ানদের মধ্যে, অন্তত কলকাতায়, প্রাইমারি বিভাগে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের প্রায় দ্বিগুণ। খুবই আশ্চর্য তথ্য। তবে মিডল স্কুলে গিয়েই এই অনুপাত উলটে যাচ্ছে। বিভিন্ন আংলো-ইন্ডিয়ান স্মৃতিকথার টুকরো-টাকরা যা হাতে এসেছে, তার থেকে এও ধারণা করা যায় যে ইউরেশিয়ান মেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দরকার এই অবধি ঠিক আছে, তবে তার থেকে খুব বেশি শিক্ষার দরকার বলে কেউ ভাবেন নি সেই সময়। ওই প্রাইমারি স্কুলই ঢের। অবশ্য এই জনগোষ্ঠীর ছেলেরাও যে খুব বেশি দূর পড়াশোনা করতেন এমন তো নয়। আলাদা করে শ্রেণিবিভাগ করা থাকত না বলে একদম সঠিক করে বলা শক্ত, তবে এলেন যে বছর এন্ট্রান্স বা এফ এ পাস করেছেন সেই সেই বছরের তার সহপাঠীদের তালিকায় কিন্তু সাহেবি নামের ছাত্রের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোণা।
ইন্ডিয়ান রেলওয়ে অবশ্য তখন ছেলে-মেয়ে উভয়ের শিক্ষার জন্যেই কিছু কিছু স্কুলকে অনুদান দিত। আর এমনিতে মোটামুটি কিছুটা পড়াশোনা করলে আর খেটে খেতে জানলে সাধারণতঃ ইউরেশিয়ান ছেলেদের তখন চাকরির অভাব হত না। কিন্তু মেয়েদের জন্য উনবিংশ শতকের শেষের দিকে সদ্য চাকরির বাজার খুললেও, সে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি তখনও। একেবারে হতদরিদ্র ইউরেশিয়ান বাড়ির মেয়েদের কথা আলাদা, তাঁদের জন্য রয়েছে ব্রিটিশরাজের ছোঁট-বড়-মাঝারি সাহেবদের বাড়ির ‘ডোমেস্টিক সার্ভিস’। কিন্তু তা বাদে বাকি ইউরেশিয়ান মেয়েদের তখনও টিঁকে থাকার, আরও একটু উন্নত জীবন পাওয়ার একমাত্র উপায় বিবাহ। আর কে না জানে বিয়ে করে সংসার চালাতে আর যাই হোক বই-পড়া বিদ্যের দাম নেই। মানে লোকে তেমনই ভাবে। এই সব মিলিয়ে রেলওয়ে কলোনির মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা তখনও তেমন একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি।
এলেনের পারিবারিক পরিবেশের খবরও তেমন মেলে না। তাই বলা মুশকিল সতেরটি সন্তান নিয়ে জন রিচার্ড ঠিক কেমন সংসার পেতেছিলেন কানপুরে? এলেনের দিদি-বোনেরা ঠিক কেমন ছিলেন, তাঁরা কতটা মোটিভেট করেছিলেন এলেনকে এই সবই অজানা। খুব সম্ভবত এলেনকে নিজেই নিজের পথ কেটে তৈরি করতে হয়েছিল। কতটা পরিশ্রমের ছিল সে কাজ? তবে তাঁদের পরিবারেরই আরেকজন, খুব সম্ভবত তিনি এলেনের খুড়তুতো ভাই, স্বনামখ্যাত জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ডি আব্রু প্রথমে স্কুলের শিক্ষক আর পরে নাগপুরের সেন্ট্রাল মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়েছিলেন। তাই ভাবতে ভাল লাগে যে হয়ত তাঁদের পরিবারে কিছুটা হলেও পড়াশোনার ধারা ছিল যা তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তবে সবই অনুমান।
এসব কোন ভাবনাই এলেনকে দমাতে পারে না। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেই এলেন থামলেন না। আরও পড়বেন তিনি। কিন্তু কানপুরে তো আর মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা নেই। অতএব আসতে হল কলকাতায়। বেথুন কলেজে। সেখানে এলেনের এক ক্লাস আগে পড়ছেন কাদম্বিনী। কাদম্বিনী ১৮৮০ সালে ফার্স্ট আর্টস বা এফ এ পাশ করলেন, আর ১৮৮১ সালে এলেন। এদিকে সে বছরই ( ১৮৮১ সালে) অবলা দাশ নামের একটি কন্যাও এন্ট্রান্স পাস করেছে।
এরপর এলেনের জীবন যে খাতে বইল, তাতে একটা বড় ভূমিকা কালের। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কিছুটা উপায় হওয়ার পরে বাংলার বিদ্যোৎসাহীদের এবার নজর পড়েছে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার দিকে। ক’বছর আগে থেকেই ইউরোপে মেয়েদের চিকিৎসাবিদ্যা শেখার বেশ চল হয়েছে। সেই দেখে এদেশেও কিছু প্রগতিশীল মানুষ খুব উৎসাহিত। ১৮৮২ সালের জুলাই মাসের বামাবোধিনী জানাচ্ছে, বাখরগঞ্জ হিতৈষণী, শ্রীহট্ট সম্মিলনী, বিক্রমপুর সম্মিলনী, ফরিদপুর সুহৃৎসভা এবং পশ্চিম ঢাকা হিতকরী সভা মিলে বাংলাদেশের শিক্ষাবিভাগের সভাপতি ক্রফট সাহেবের কাছে স্ত্রী-শিক্ষার উন্নতির জন্য আবেদন জানাচ্ছেন, সেখানে অন্যতম দাবী হল কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের ডাক্তারি শেখার ব্যবস্থা করা। সরকারেরও এই কাজে উৎসাহ আছে। কিন্তু কলেজ কাউন্সিলের সেই প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি।
অথচ মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ আগেই মেয়েদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। ইংরেজ দুহিতা Mrs. Mary Scharlieb, আর ইউরেশিয়ান Miss Dora White, Miss Beale ও Miss Mitchelle ১৮৭৫ সালে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন আর ১৮৭৮ সালে সসম্মানে পাস করে বেরিয়েছেন। সেখানেও কাজটা খুব যে সহজ ছিল তা না। মেয়েদের পড়ার ব্যাপারে সরকারী হুকুম যদিও বা মিলেছিল, এবং অবশ্যই কিছু প্রফেসরদের সমর্থনও তাঁরা পেয়েছিলেন, তবু আবার অন্য একদল প্রফেসরদের অসহযোগিতা সহ্য করতে হয়েছিল মেয়েদের। মেরির আত্মকথাতে পাই যে উইমেন্স হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট ডঃ ব্র্যানফুট তাঁদের বলেছিলেন, সরকার তাঁদের ওঁর কাছে পাঠিয়েছেন আর সরকারী কর্মচারী হিসেবে সে হুকুম মানতে তিনি বাধ্য। তাই তাঁদের হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ান তিনি ঠেকাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি তাঁদের কিছু পড়াবেনও না। এই হল তখনকার ছবি। ভারতের বলে শুধু নয় কিন্তু, খোদ ইংল্যন্ডেই অনেক বিরোধিতা সয়ে মেয়েদের মেডিক্যাল শিক্ষার কলেজ খোলা হয়েছে মাত্রই ১৮৭৫ সালে, যে বছর মেরিরাও এখানে কলেজে ঢুকলেন। একমাত্র আমেরিকাই একটু যা এগিয়ে। সেখানে ১৮৪৯ সালে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল এম ডি হয়েছেন।
মেরি তাঁর আত্মকথাতে বলেছেন যে তাঁরা এলএমএস ডিগ্রি পেয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী নথি অনুসারে তাঁরা সেকেন্ড ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলেন, সেই পড়া অ্যাপোথেকারি গ্রেডের জন্য। LMS পড়ার নূন্যতম যোগ্যতা হল ম্যাট্রিকুলেশন পাস। এই চার কন্যা কেউ তা ছিলেন না। সরকারি মতে Mrs. Alice Van Ingen হলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের প্রথম LMS ডিগ্রিধারী। মেরি এবং অ্যালিস দুজনেই অবশ্য পরে যথাক্রমে লন্ডন এবং ব্রাসেলস থেকে উচ্চতর পাঠ নিয়ে চিকিৎসার কাজে নিজেদের ডুবিয়ে দেন। অ্যালিস কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন সরকারি মেয়েদের হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে। পরে ইনি খুব সম্ভবত শ্রীলঙ্কায় চলে যান। মেরি ১৮৮৪ সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের বিভাগের ধাত্রীবিদ্যার লেকচারার হিসেবে যোগ দেন এবং ১৮৮৭ সালের গোড়া অবধি সেখানেই পড়াতেন। তারপর তিনি ইংল্যন্ডে চলে যান ও সেখানে প্র্যাকটিস করেন।
আমাদের গল্পে ফিরি। মাদ্রাজে মেয়েরা মেডিক্যাল কলেজে ডিগ্রির পড়ার জন্য ঢুকতে পারলেও, কলকাতার ডিগ্রি কোর্সে তখনও মেয়েদের প্রবেশ নাস্তি। মেয়েরা মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যা জানবে, যাতে দরকারে অদরকারে প্রসূতিকে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তার বেশি আবার কি দরকার? আর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডিগ্রি পেতে হলে ফার্স্ট আর্টস পাস করে তবেই ভর্তি হওয়া যাবে। আর সব থেকে বড় কথা কলেজ কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামি। মেয়েরা আবার ডাক্তারি করতে পারবে নাকি? আর কে-ই বা দেখাতে যাবে তাঁদের? তারা ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে অ্যানাটমির ক্লাস করবে? শব-ব্যবচ্ছেদ করবে মেয়েরা? ধুর ধুর এও আবার হয় নাকি! কোন যুক্তি,কোন উদাহরণই তাঁদের নিজেদের অবস্থান থেকে টলাতে পারে না। এই হল ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’ র নমুনা। বিদ্যোৎসাহীদের আরও রোখ চেপে গেল। মেয়েরা যে সুযোগ পেলে শুধু ধাই না, পুরো একটা গোটা ডাক্তার হতে পারে সেটা প্রমাণ করতেই হবে।
ততদিনে চন্দ্রমুখী, কাদম্বিনী, এলেন প্রমুখের একে একে এন্ট্রান্স, এফ এ পাস হয়ে গেছে। কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে মেয়েদের ভর্তি নিয়ে যুদ্ধ চলছে । কাদম্বিনী এফ এ পাশ করার পরেই আবার একদফা কথা উঠেছিল। সে চেষ্টা বিফল হয়েছে। কাদম্বিনী স্নাতক স্তরে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও যখন কলকাতায় মেয়েদের পড়ানোর ব্যস্থা করানো গেল না, তখন ঠিক হল মেয়েদের মাদ্রাজে পাঠিয়েই ডাক্তারি পড়িয়ে আনা হবে। তখনকার দিনের পক্ষে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এলেন আর অবলা এই গুরুদায়িত্ব নিলেন। তাঁদের দেওয়া হল বেথুন স্কলারশিপ। মাসে ২৫ টাকা। ১৮৮২ সালের অক্টোবরে দুজনে গিয়ে ভর্তি হলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে। এন্ট্রান্স পাস অবলা ভর্তি হলেন চার বছরের এল এম এস কোর্সে। আর এলেন এম বি কোর্সে। তাঁদের থাকার অসুবিধা দূর করতে এক দিনেমার মিশনারি নিজের বাড়ি ছেড়ে দিলেন তাঁদের।
দুই কন্যাকে নিয়েই শিক্ষকদের কোন অভিযোগ নেই। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের ১৮৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে অবলা সেই বছর মিডওয়াইফরির সেরা ছাত্রী হিসেবে ভারতলক্ষ্মী মেডেল পেয়েছেন। সেই রিপোর্টে এও পাচ্ছি যে Miss A. Das, who passed the first L.M. and S. examination successfully last year, will probably present herself next year for the second L.M.and S. examination. কিন্তু তার পরের বছরের রিপোর্টে আর অবলার কোন উল্লেখ নেই। অবলা শেষ অবধি এল এম এস ডিগ্রি পেয়েছিলেন কি পান নি সে নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্ব আছে। কেউ বলেন তিনি ডিগ্রি পেয়েছিলেন- এমনকি মাদ্রাজ মেদিকেল কলেজের ওয়েবসাইটও অবলাকে তাঁদের কলেজের ডিগ্রিধারীই বলে। আবার অনেকেই বলেন তিনি অসুস্থতার জন্য পড়া শেষ করতে পারেননি। তবে তিনি যে কোনদিন মেডিক্যাল প্রাকটিসের দিকে যাননি সেটা সবাই জানেন। ১৮৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে বিয়ে করেন। পরের জীবনে তিনি অন্য কারণে খ্যাত হন। একটা জিনিস লক্ষ্য করার যে দুর্গামোহন দাশের দুই কন্যার মধ্যে বড় সরলার বিয়ে হয় তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ঠিক আগে আর অবলার এই ঘটনা। এই ঘটনাই কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না যে এমনকি তথাকথিত ’এলিট’ বাঙ্গালী বাড়িতেওঁ নারীশিক্ষার জায়গাটা, বিশেষত প্রফেশনাল বিষয়ে নারীশিক্ষার জায়গাটা ঠিক কেমন ছিল? আর মেয়েরাও সেটা কেমন সুন্দর অন্তঃস্থ করে নিয়েছিলেন!
এলেন পড়া চালাচ্ছিলেন। M.B. and C.M. ডিগ্রির পড়া তখন পাঁচ বছরের। ১৮৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষের রিপোর্টে লেখা আছে যে পরের মাসে অক্টোবর ১৮৮৭ তে এলেন সেকেন্ড এম বি পরীক্ষায় বসবেন। ’৮৬-৮৭ সালে এলেনও মিডওয়াইফেরির সেরা ছাত্রী হিসেবে ভারতলক্ষ্মী মেডেল পেলেন। তারপর ইতিহাস চুপ। এলেন কি পাস করলেন? এম বি ডিগ্রি কী এল তার হাতের মুঠোয়? সেই খবর আর জোগাড় করতে পারি নি। তার পারিবারিক স্মৃতিকথায় তাঁকে ডাক্তার বলা হয়েছে,তাই ধরে নিচ্ছি যে তিনি এম বি পরীক্ষায় পাস করেছেন। তবে তার স্বপক্ষে কোন প্রাথমিক নথি জোগাড় করতে পারিনি।
অবশ্য ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। যদিও প্রচুর বিতর্ক ছিল তাঁর এই ফলকে ঘিরে। আনন্দীবাইও এই বছরেই তার ডিগ্রি পেয়ে গেছেন। আরও আরও মেয়েরা ভর্তি হচ্ছেন মেডিক্যাল কলেজে। কাজেই হয়ত বাঙালির কাছে তাঁর গুরুত্ব কমে গেছে। অবশ্য আগেও কি আর বাঙ্গালিরা এই ইংরেজি-ভাষী কন্যাকে নিজেদের কাছের লোক ভেবেছে, সে যতই তার বংশের ভারতে স্থিতি তিনশ বছরেরও বেশি হোক না। এলেনও কি আর নিজেকে ভারতীয় ভাবতেন? সে কথাও জানার তেমন উপায় নেই। যেমন আমরা জানতে পারব না যে এলেনের কেন ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা হয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিশ্চয় বেরিলির ক্লারা সোয়াইন নামের আমেরিকান মিশনারি ডাক্তারের কথা শুনেছিলেন। তিনিই কী এলেনের অনুপ্রেরণা ছিলেন? তবে অনুপ্রেরণা যিনিই হন, সে আমলের এক রেলওয়ে কলোনির ইউরেশিয়ান মেয়ের পক্ষে নার্স হওয়ার স্বপ্ন না, একেবারে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বেশ খানিকটা অন্যরকম বইকি!
এরপর এলেনের সম্বন্ধে খুব কম খবরই জানা যায়। শোনা গেছে যে ১৮৯১ সালে তিনি চেন্নাইতে নিজের ক্লিনিক খোলেন। প্রথমে ব্রডওয়েতে আর তারপর ট্রিপলিকেন এলাকায়। এইসময় নাগাদই তিনি মাদ্রাজের ড্যানিশ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। বলা শক্ত যে এই ক্লিনিক তাঁর ব্যক্তিগত নাকি তিনি ড্যানিশ মিশনের কর্মী হিসেবে এই ক্লিনিক চালাতেন। ১৮৯২ সালে ড্যানিশ মিশনের মুখপত্রে এলেনের একটি লেখা বেরোয়, যাতে প্রথম ভারতীয় সন্তানজন্মের পদ্ধতির কথা পশ্চিমের দুনিয়ায় পৌঁছায়। ১৮৯৪ সালে এলেন বিয়ে করেন ড্যানিশ মিশনেরই বিপত্নীক মিশনারি মর্টেন এন্ডারসেনকে। এরপর এলেনের জীবন কাটে মিশনারির স্ত্রী হিসেবে, মিশনের বিভিন্ন কাজে তিনি খুবই তৎপর ছিলেন। পরে মর্টেন মিশন ত্যাগ করার পরে, তাঁরা তামিলনাড়ুর ড্যানিশপেটে শেষ অবধি স্থিতু হন। তার পরিবারের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে তিনি নিজের সংসার সামলানোর পাশে পাশে চারপাশের নিতান্ত দরিদ্র প্রতিবেশিদের চিকিৎসার কাজেও পিছপা ছিলেন না।
তবে আরও একটা বিষয় ভাবলে একটু অবাক হতে হয়। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের থেকে অ্যাপোথেকারি পাশ করে বেরোন অন্য সব মেয়েরা যেখানে মাসে দুশ-তিনশ টাকার চাকরিতে যোগ দিচ্ছে, সেখানে এলেন এম বি পাশ করেও বেছে নিলেন মিশনারির স্ত্রীর জীবন। ঘোর দারিদ্র্যময় বলে যদি তাকে দাগিয়ে নাও দিই, কঠোর জীবনযাপন তো বটেই। অথচ স্বেচ্ছাতেই নিশ্চয় বেছে নিয়েছিলেন! এইখানেই এলেন অন্য অনেকের থেকে আলাদা হয়ে যান। এলেনকে বোঝার চেষ্টা ধামাচাপা দিয়ে রাখি - সাধারণ বিলাসী ভাবনার চৌহদ্দীতে তাকে আঁটানোর চেষ্টায় থই পাই না মোটে।
অনেক আশা করে এলেন আর অবলাকে বেথুন স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল এঁরা ডাক্তার হয়ে ফিরে এসে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানুষের উপকারে লাগবেন। সেই আশা অবশ্য পূরণ হয়নি। অবলা সব ছেড়েই দিলেন আর এলেন যদি বা চিকিৎসাবিদ্যা কাজে লাগালেন, তবু তা সরাসরি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কোন কাজেই লাগল না। সে না আসুক গে। চকমকি ঠুকলে আগুনের স্ফুলিঙ্গ যে ঠিক কোথায় উড়ে গিয়ে পড়বে তা কি আর কেউ বলতে পারে? শুধু জানে যেখানেই গিয়ে পড়বে সেখানেই আলো দেবে। টুকরো টুকরো আলোতে পথ দেখে এগোবে আরও কত মেয়ে। আলোর কি আর দেশি-বিদেশি হয়!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।