অ্যাকাডেমিক ইতিহাসের কাছে যে নৈর্ব্যক্তিকতা প্রত্যাশা করা যায়, স্মৃতিকথা বা সাংবাদিকের প্রতি বেদন সেই মাপকাঠিতে বিচার্য নয়। আবার নয় বলেই এই সমস্ত লেখায় এমন অনেক বিষয় জীবন্ত হয়ে ওঠে যাকে কার্ল মার্ক্স ‘মানবতার মুহূর্ত’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন সব যুগের মরমী শিল্প সাহিত্যে। হ্যাঁ, ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতা আর শিল্পের বিষয়ীগত অবস্থানের মাঝখানে প্রলম্বিত থাকতে পারে এই ঘরানার লেখাগুলি।
কাশ্মীর প্রসঙ্গে এরকম কয়েকটি বইকে নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করলে কি কোথাও আমরা কাশ্মীরকে কিংবা তার অধিবাসীদের ভাগ্যবিড়ম্বিত ইতিহাসকে আরেকটু ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারব? ধরুন, রাহুল পণ্ডিতার আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস যার একটি চমৎকার বাংলা অনুবাদ হয়েছে ‘একে চন্দ্র দুইয়ে পক্ষ’ নাম দিয়ে(অনুবাদক অভীক মুখোপাধ্যায়,প্রকাশক দ্য কাফে টেবল)। ১৯৮৯ পরবর্তী কালের জঙ্গী উৎপাতে আক্রান্ত,বিপন্ন এবং উচ্ছিন্ন কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারগুলির উদবাস্তু হয়ে যাওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনী। কিন্তু এই বইটিকে মিলিয়ে পড়া উচিত বাশারাত পীরের ‘কার্ফিউড নাইট’ নামক আর এক আখ্যানের সঙ্গে যেখানে স্মৃতিচারণ আর সাংবাদিকতা হাত ধরাধরি করে থাকে পণ্ডিতার বইয়ের মতই। আর সেই অবসরে কাশ্মীরের অধিবাসীদের যন্ত্রণাদীর্ণ অস্তিত্ব, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রবল প্রতাপের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কাহিনী ভাষা পেতে চায়। তবে কাশ্মীরের ভূরাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই আখ্যানগুলিকে বুঝে নিতে হবে।
রাহুলের বই অন্তর্গত রক্তক্ষরণ থেকে, আঘাতের বিমূঢ়তা থেকে,বিশ্বাসের হনন থেকে মানবতার মৃত্যুকে দেখে ফেলেছে। তারপর আমাদের অধোবদন থাকতে হয় পাঠক হিসেবে যখন কাশ্মীর উপত্যকায় হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায়ের উপর সংগঠিত আক্রমণের ইতিহাস আমরা পড়ি। সেটা তখন আর ইতিহাসের নীরস কথামালা থাকেনা, জ্বলন্ত অঙ্গারের টুকরো হয়ে আমাদের সত্তার ভিতরটা পুড়িয়ে দেয়। কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি যদি ন্যায়সঙ্গতও হয় তার জন্য পণ্ডিতদের মরতে হবে কেন বা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে ক্লিন্ন উদবাস্তুর জীবন যাপন করতে হবে কেন লেখকের এই সরল প্রশ্নের কোনো জটিল উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ দিয়েছেন বলে জানি না। পণ্ডিতরা ডোগরা রাজবংশের শাসনকালে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী ছিলেন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু হরি সিংহের রাজ্যপাট শেষ হয়ে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পর আর সে অভিযোগ খাটে না। তার পরেও চল্লিশ বছর কেটে যাবার পর পণ্ডিতদের উপর এই আক্রমণের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা হয়ত আছে, কিন্তু বৈধতা নেই কোনো। নিরীহের রক্তপাতের কোনো বৈধতা হয় না। এই সত্যকে, ইতিহাসের এই পূতিগন্ধময় অন্ধকার বিবরগুলিকে স্বীকার করেই আমাদের চলতে হবে। এই স্বীকরণের সঙ্গে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো বিরোধ নেই। তাঁর মানে এই নয় যে আমরা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতগুলি খতিয়ে দেখব না। এমন নয় আমরা এ কথা বিস্মৃত হব যে আখ্যানের সার্বিক নিরপেক্ষতা একটি কল্পিত বিষয় । সচেতন বা অচেতন ভাবেই লেখকের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় তাঁর পক্ষপাত ছায়া ফেলতে পারে।রাহুলের বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা মনে রাখা সর্বাংশে জরুরী।
রাহুলের এই বই লেখার পেছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে এবং তিনি তা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে কাশ্মীরে নিপীড়ন বলতে আমরা সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকেই বুঝে এসেছি। তুলনায় কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের উপর উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ এবং জঙ্গীবাদের নিপীড়ন বিশেষ আলোচিত হয় নি।এই বিশেষ অনালোচিত দিকটিকে উদ্ঘাটিত করে রাহুল অনেকের চোখ খুলে দিয়েছেন, তথাকথিত রাজনৈতিক সঠিকতার নামে আংশিক সত্যদর্শনের অনুশীলনকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন।এই বিশেষ উদ্দেশ্যমূলকতা সত্যের আরেকটি দিককে আমাদের দেখায়। আরেকটি দিক,কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সত্যকে নয়।
এখানেই এই লেখার সীমাবদ্ধতা। ধরুন,এই বইয়ের শেষে একটি সময়রেখা দেওয়া আছে যেখানে ১৮৪৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশেষ ঘটনাগুলির উল্লেখ আছে, বিশেষত ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত উগ্রবাদীদের দ্বারা অসংখ্য খুন এবং গণহত্যার কালপঞ্জী।কিন্তু উল্লেখ নেই যে ঐ পর্বে রাষ্ট্র কর্তৃক বেশ কিছু গণহত্যার কথা ,যেমন গাওকাদাল গণহত্যা বা বিজবেহেরা গণহত্যা। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটেছিল রাষ্ট্রপতি শাসনে রাজ্যপাল হিসেবে জগমোহন কাশ্মীরের দায়িত্ব নেওয়ার পর। এই জগমোহনের প্রতি তাঁর পছন্দের মনোভাবকে রাহুল কোথাও গোপন করেন নি। অথচ এই বইতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, পরবর্তী কোনো সময়ে কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘনের বিরোধিতা করতে গিয়ে টিভি বিতর্কে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তার সঙ্গে তাঁর বাক্যবিনিময়ের কথা। আসলে যে তিক্ততার স্বাদ রাহুল পেয়েছেন, যে বিভীষিকা তাঁকে উদবাস্তু জীবনের শূণ্যতা উপহার দিয়েছে , তাকে নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে পরাজিত করার চেষ্টা করতে করতেই তিনি এই বই লিখেছেন। সেই সৎ প্রচেষ্টাটা পাঠকের নজর এড়িয়ে যায় না বলেই এই বইটি পাঠককে স্পর্শ করে, আনুকূল্য পায়।
কার্ফুড নাইট, বাশারাত পীর
এই একই সততা বাশারাত পীরের বই ‘কার্ফুড নাইট’ এ আছে বলে তিনি লিখতে পারেন যে অনন্তনাগ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেও অধিকাংশ কাশ্মীরির মতই ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতা তার ছিল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীকগুলি যেমন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত বা ক্রিকেট দল--- কোনোকিছুর সঙ্গেই তারা নিজেদের সম্পর্কিত করতেন না।
রাহুল পণ্ডিতা এবং বাশারাত, দুজনের লেখাতেই সেই শারজা ম্যাচের কথা আছে, যেখানে মিঁয়াদাদ চেতন শর্মার শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। পাকিস্তান জেতায় এবং তার চেয়ে বেশি ভারত হারায়(কারণ কাশ্মীরের বুকে অনুষ্ঠিত একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওয়েস্ট ইণ্ডিজের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়েও ভারতীয় দলকে প্রবল দর্শক বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল) কাশ্মীরের মানুষদের স্বাভাবিক উল্লাসের বিবরণ দুটি বইতেই হুবহু এক। মনে রাখতে হবে তখনও কাশ্মীরে ১৯৮৭ সালের নির্বাচনী কারচুপি হয় নি বা সশস্ত্র উগ্রপন্থার উথ্বান হয় নি। কিন্তু কাশ্মীরিরা সাধারণভাবে ভারতভুক্তিকে মেনে নিতে পারে নি এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। অথচ জিন্নার দ্বিজাতিত্ত্ব কাশ্মীরে ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর শেখ আবদুল্লা ভারতভুক্তির পক্ষে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর অনুগামীদের সহ। তাহলে ঠিক কবে থেকে কাশ্মীরিদের এই বিচ্ছিন্নতা শুরু তার অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
হতে পারে যে শেখ আবদুল্লার গ্রেপ্তার এবং দীর্ঘ কারাবাস পর্বেই এই মনোভঙ্গীর বিস্তার ঘটে সবিশেষ প্রকারে। কারণ যাই হোক, এই বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্বকে তো অস্বীকার করা যাবে না।কারণ এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৮৮ বা তৎপরবর্তী সশস্ত্র জঙ্গীবাদের বিস্তার। জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের তরুণ সদস্যরা কিভাবে সীমান্ত পেরিয়ে অস্ত্রচালনার ট্রেনিং নিয়ে আসত, তারপর কালাশনিকভ নিয়ে ঘুরত আর প্রায় নায়কোচিত সম্মান পেত তা বাশারাত খোলাখুলি বর্ণনা করেছেন।অবশ্যই এদের প্রেরণা যুগিয়েছিল ইরানের ইসলামিক বিপ্লব, যাতে ছাত্রদের একটা বড় ভূমিকা ছিল এবং আরো বেশি করে ধরলে আফগানিস্থানে মুজাহিদীনদের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত সুপার পাওয়ারের পশ্চাদপসরণ। তাই এই সমস্ত অস্ত্রধারী কাশ্মীরি তরুণদের ধারণা হয়েছিল যে দু’এক বছরের মধ্যেই কাশ্মীর স্বাধীনতা অর্জন করবে(নিশ্চয়ই আমাদের বাংলায় সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার সশস্ত্র সংগ্রামের কথা মনে পড়বে)।
পাশাপাশি পাকিস্তানের রপ্তানীকরা জঙ্গী সংগঠন লস্কর এ তৈবা বা হিজবুল মুজাহিদীনের দৌরাত্ম্য এবং স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী জামাত ই ইসলামি অব জম্মু কাশ্মীরের সমর্থন তো ছিলই। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র হিসেবে কিছু সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে শুধু সামরিক সমাধানের কথা ভাবায় সাধারণ কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতাবোধ কমে নি,বেড়েছে অনেক গুণ।রাহুলের মত বাশারাতও ভারতের মূল ভূখণ্ডে পড়াশোনা করেছেন, দিল্লীতে সাংবাদিকতা করেছেন। তখনই বাশারাত জানতে পারেন যে ভারী বুটের আওয়াজ ছাড়া, বারুদের গন্ধ ছাড়া, দেহতল্লাসির ঘনঘটা ছাড়াও একটা ভারতবর্ষের অস্তিত্ব আছে,গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ।
২০০১ সালের পর থেকে বাশারাত সাংবাদিকতার প্রয়োজনেই বারবার তাঁর জন্মভূমিতে যেতে থাকেন। আর তাঁর কলমে উঠে আসতে থাকে কাশ্মীরের বিভিন্ন মুখ। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে গাওকোদাল গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ইঞ্জিনীয়ার ফারুক ওয়ানির বিবরণ শুনতে শুনতে আমাদের অবাক লাগে একটি সেতুর উপর স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতে আসা একটি মিছিলের উপর কিভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল সি আর পি এফ, কিভাবে পুলিস ট্রাকে করে মৃতদেহ চালান করা হয়েছিল।পাকিস্তানপন্থী জঙ্গীদের হাতে নিহত হন শ্রীনগরের প্রধান মৌলবী ফারুক। আশ্চর্য কাণ্ড, তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যে শোকমিছিল বের হয় তার উপর ভারতীয় বাহিনী গুলি চালায়। মৌলবীর মৃত্যুশোক ভুলে মানুষ ভারতবিরোধিতায় ফুঁসে ওঠে।
বাশারাত লেখেন পারভীনা আহাঙ্গারের কথা, ১৯৯০ সালের সামরিক রেইডের সময় যাঁর বোবা ছেলে জাভেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং যে আর ফিরে আসে না।চল্লিশোর্ধ গৃহবধু পারভিনা এক আইনজীবী পারভেজ ইমরোজের সহায়তায় গড়ে তোলেন অ্যাসোসিয়েশন ফর পেরেন্টস অব ডিসঅ্যাপিয়ারড পার্সনস যাঁর লড়াইয়ের কাহিনী আন্তর্জাতিক স্তরেও পৌঁছে গেছে।নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরের কুখ্যাত অন্তরীণ তথা নির্যাতন কেন্দ্র পাপা—২ থেকে বেঁচে ফেরা শফি,আনসার বা হুসেনের জবানবন্দীও নথিভুক্ত করেছেন লেখক।ভয়ঙ্কর লাগে পড়তে মুবিনা ঘানির কথা যিনি ১৯৯০ সালের মে মাসে বিয়ের কয়েক ঘন্টা পরে আধা সামরিক বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হন। লেখক যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ঘটনার প্রায় বারো বছর পরে তখনও তিনি এবং তাঁর পরিবার গ্রামের প্রতিবেশীদের কাছে ব্রাত্য কারণ মুবিনা তাদের কাছে দুর্ভাগ্যের বাহক কারণ ঐ আক্রমণে শুধু মুবিনা এবং তাঁর পরিচারিকা ধর্ষিতা হন তাই নয়, বরযাত্রী দলের একজন প্রাণ হারান এবং দশজন আহত হন।
এই সমস্ত যন্ত্রণার বিবরণ বলা কঠিন, শোনাও কঠিন।তাই উত্তর কুপওয়ারা জেলার কুনান পুশপোরা নামে দুটি গ্রামে ১৯৯০ সালে যে গণধর্ষনের অভিযোগ উঠেছিল এবং যার সত্যাসত্য নিয়ে বিবাদ চলেছে দীর্ঘদিন, বাশারাত সেখানে যেতে চেয়েও পারেন নি শেষ পর্যন্ত।মনে পড়ে রাহুলের বইতে বিনোদ ধরের কথা যিনি রাহুলকে সাক্ষাৎকার না দিয়ে ক্রমাগত ঘোরাচ্ছিলেন। আসলে তাঁকে তো বলতে হবে ১৯৯৮ সালের ২৫শে জানুয়ারীর কথা যখন এক রাতে উগ্রপন্থীদের হাতে তাঁর পরিবার এবং প্রতিবেশী তিনটি পরিবার সমেত ২৩ জন খুন হন গান্ধারবল জেলার ছোট্ট গ্রাম ওয়ান্ধামায়।চোদ্দ বছরের বিনোদ ঘুঁটের বস্তায় লুকিয়ে বেঁচে যান। পরের দিন তাঁকে ঐ তেইশ জনের মুখাগ্নি করতে হয়েছিল।
রাহুলের লেখায় একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগ আছে যে হিন্দু নিধনের সময় মুসলিম প্রতিবেশীরা তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন নি। বাশারাতের লেখায় একটা সাফাই আছে যে ঐ অগ্নিগর্ভ সময়ে মুসলিমরাও তাঁদের নিজেদের অস্তিত্বের সংকট নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। হবে হয়ত।রাহুলের লেখায় কোন মুসলিম প্রতিবেশীর কথা বিশেষ ভাবে না থাকলেও বাশারাতের লেখায় কিন্তু তাঁর দাদুর দুই হিন্দু বন্ধুর কথা, তাঁর স্কুলের প্রাক্তন অধ্যক্ষের কথা উঠে এসেছে। এই প্রাক্তন অধ্যক্ষর সঙ্গে জম্মুর উদবাস্তু শিবিরে দেখা করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় গৌরীর যাকে বাশারাতের বাবা নিজের বোনের মত দেখতেন। বছর বিশেকের গৌরী যখন পুলওয়ামায় শিক্ষকতার কাজ পান তখন গৌরী সেই কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি নিজের পরিবারের থেকে পেয়েছিলেন এই শর্তে যে বাশারাতের বাবা তাঁকে পৌঁছে দেবেন। সন্ধ্যেবেলা বাশারাত যখন তাঁর বাবাকে এই সাক্ষাতের বিবরণ দিচ্ছেন তখন তিনি ফোনের ওপারে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকেন। বাশারাতের মনে হয় তিনি যেন কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন।শ্রীনগরে ঝিলমের ওপর তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে,আকাশ লালে লাল।
বাশারাতের ঠাকুমা তাঁকে ছোটোবেলায় বলতেন,যখনই কোনো নির্দোষ লোককে হত্যা করা হয়, আকাশ লাল হয়ে যায়। কাশ্মীরে প্রায় প্রতিদিনই আকাশ লাল থাকে। ১৯৯৪ সালের পর থেকে কাশ্মীরে জঙ্গীবাদ মূলত পাকিস্তানি লস্কর এ তৈবা এবং জৈশ ই মহম্মদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে স্থানীয় স্বাধীনতাপন্থী জে কে এল এফের বদলে।স্বাধীনতার স্বপ্ন লুঠ হয়ে যায়।তারপর বাকি ইতিহাস গুমরে কাঁদে। আমরা শুধু বুঝতে পারি মানুষের যন্ত্রণার কোনো হোয়াটঅ্যাবাউটারি হয় না। রাহুলের বইতে আঠাশ বছরের গিরজা টিকুর মুসলিম উগ্রবাদীদের হাতে ধর্ষণের পর কাঠচেরাই কলে জীবন্ত ফেলে হত্যার বিবরণ পড়তে গিয়ে যেমন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে আমাদের, তেমনই বাশারাতের বইতে যখন হতদরিদ্র ঘরের দশম শ্রেণীর ছাত্র সফিকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার হাতে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেনেড ধরিয়ে দিয়ে জঙ্গীদের দ্বারা অবরুদ্ধ বাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়ার বিবরণ পড়ি তখন মনে হয় মানবতার ভাবমূর্তিটা যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে।অথচ কত গল্প তো ইতিহাসের আড়ালে রয়ে যায়।
এই যেমন রাহুল উল্লেখ করেছেন, আমরাও কিছুটা জানি ১৯৪৮ সালের পাঠান অনুপ্রবেশকারীদের হাতে বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর সংঘটিত হত্যা,ধর্ষণ ও লুঠপাটের কথা। কিন্তু একই সময়ে জম্মুর সংখ্যালঘু প্রধান অঞ্চলে হাজার হাজার মুসলমানের হত্যা এবং বিতাড়ণের মাধ্যমে সেখানকার জনবিন্যাস পালটে দেওয়ার ইতিহাস কতটুকু জানি আমরা? নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে উদবাস্তু শিবিরে বাস করছেন প্রায় ত্রিশ হাজার কাশ্মীরি মুসলমান যাঁরা ১৯৯০ সালের পর দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন নানা কারণে সেই তথ্যটিও গুরুত্বপূর্ণ।ভারত ও পাকিস্তান সরকার কাশ্মীরের ওপর তাঁদের দাবী জানিয়ে এসেছেন বরাবর। কাশ্মীরিরা কী ভাবছেন সেটি বিবেচনার মধ্যে আসেনি তেমন। এত বেদনাকে স্বীকার করার পরও কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, বাস্তবমুখী কোনো ভাবনাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে তাঁদের। কালরাত্রির অবসানের অপেক্ষায়,যখন ভূস্বর্গ হেসে উঠবে বাস্তবিক।
কাশ্মীর,পাকিস্তানপন্থা ও ইসলাম আলোচ্য বই ঃ দ্য গ্রেট ডিভাইড , আনম জাকারিয়া
ছোটবেলা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে যে লেখাগুলো পড়ে আসছি তাতে মাঝে মাঝেই বাঙালি ট্যুরিস্টদের বীরত্বের কাহিনী পড়ে শিহরিত হয়েছি। গল্পগুলো সব একই রকম। কাশ্মীর ভ্রমণকালে কোনো শিকারাওয়ালা বা ড্রাইভার বা দোকানদারের মুখ ফসকে উক্তি,”আপলোগোকে ইণ্ডিয়ামেঁ…” ব্যস কথা না শেষ হতেই বাঙালি বীরপুঙ্গবের জাতীয়তাবাদী ব্যাঘ্রগর্জনে প্রতিবাদ,’ ক্যা ইন্ডিয়া তুমকো দেশ নেহী হ্যায়? হামারা খাতা হ্যায়,পরতা হ্যায়, আউর দেশ কো নেহী মানতা হ্যায়’ ইত্যাদি। অতঃপর স্থানীয় কাশ্মীরিটির অধোবদনে নিরুত্তর থাকা ইত্যাদি। ওই মৌনতা মানে যে পরাজয় স্বীকার নয়,আসলে রণকৌশল মাত্র তা বোটু(বোকা ট্যুরিস্ট) ছাড়া কে না জানে।বাশারাত পীর তাঁর বই’ কার্ফুড নাইট’ এ জানিয়ে দিয়েছেন যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক যেমন জাতীয় পতাকা,জাতীয় সঙ্গীত বা ক্রিকেট দলের সঙ্গে কাশ্মীরিরা একাত্মবোধ করেন না। ভারতীয় হিসেবে এটা আপনার খারাপ লাগতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তবতা। কারণ আপনি তো দেখছেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নিরিখে। কিন্তু সেই জাতীয়তাবাদের গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে কাশ্মীরের ১৯৪৭ পূর্ব ইতিহাসের যোগ কতটুকু? ডোগরা রাজা হরি সিং এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের কুশাসন, অত্যাচার এবং অবদমনে অতিষ্ঠ একটি জনগোষ্ঠীর কী দায় থাকে হঠাৎ করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তাল মেলানোর? তবু যে কাশ্মীর উপত্যকা বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারত রাষ্ট্রে তার অন্তর্ভুক্তিকে মেনে নিয়েছিল তার কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি গজিয়ে ওঠা কোনো ভক্তি নয়, সেটি ছিল কাশ্মীরের মানুষের একটি শর্তাধীন এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত। জিন্নার মুসলিম লীগ বা নেহরুর কগ্রেসের সঙ্গে কাশ্মীরের মানুষের নৈকট্য বিশেষ ছিল না। কাশ্মীরের জনগণ তাঁদের অবিসংবাদী নেতা শেখ আবদুল্লার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এটুকু বলা যায়। ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই ভারত রাষ্ট্রের প্রতি কাশ্মীরিদের আনুগত্য পোষণের বাধ্যবাধকতা কেটে যায়।কাশ্মীরের মানুষের পাকিস্তান প্রীতির কতকগুলি বাস্তব কারণ আছে। প্রথমত, কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে পাকিস্তানের ভৌগোলিক নৈকট্যর কারণে ব্যবসায়িক যোগাযোগ সহজ। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে ভারত রাষ্ট্রের যে চেহারা প্রোথিত হয়ে আছে সেখানে বিশ্বাসহননের অভিযোগ যতটা আছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ততটা নেই। তাহলে আপনি কীভাবে কাশ্মীরিদের ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে টেনে আনবেন? নাকি অনিচ্ছুক জনগোষ্ঠীকে যেন তেন প্রকারেণ নিজের তাঁবে নিয়ে আসাটাই জাতীয়তাবাদ। তাহলে কি জাতীয়তাবাদী আখ্যানেও বন্দুকের নলই শক্তির উৎস? সন্দেহ হতে পারে যে ধর্মীয় নৈকট্যও একটি কারণ। কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ ইসলামের প্রতি সনিষ্ঠ হলেও অচেনা পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে চান নি বলেই স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখেছিলেন বেশি। সেই স্বপ্নের একটা প্রতিস্থাপন ছিল ৩৭০ ধারার মধ্যে।কিন্তু দিল্লীর শাসকরা কাশ্মীরের স্বশাসনের বদলে সেখানে অনুগত শক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে বরাবর সক্রিয়তা দেখিয়েছেন, প্রয়োজনে নির্বাচনী কারচুপির মাধ্যমেও। আশ্চর্যের কিছু নয় যে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারেও গল্পটা মোটামুটি একই।
কেমন আছেন নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারের কাশ্মীরিরা? তাঁরা কি পাকিস্তানের শাসনে খুশি?
পাকিস্তানের মহিলা সাংবাদিক আনম জাকারিয়া তাঁর ‘বিটুইন দ্য গ্রেট ডিভাইড’ বইতে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সাক্ষাৎকার এবং ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে।তাতে একটা কথা বোঝা যায় পাকিস্তানের শাসকরা ভারতে তাঁদের প্রতিপক্ষদের মতই কাশ্মীরে গণতন্ত্র এবং স্বশাসনের প্রশ্নটিকে অবহেলা করেন।কাশ্মীরের স্বশাসন নিয়ে কথা বলা পাকিস্তানেও নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে বই লিখলে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পাক শাসিত কাশ্মীরে হিন্দু বা শিখ সংস্কৃতির চিহ্নগুলি সযত্নে মুছে ফেলা হয়। মংলা বাঁধ নির্মাণে ৮১০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সব রাজস্ব ইসলামাবাদ নিয়ে যায়। পাক শাসিত কাশ্মীর কিছু পায় না। কাশ্মীরের শাসনের দায়িত্বে থাকেন পাক সরকারের অনুমোদিত কর্তাব্যক্তিরা। যেন নিয়ন্ত্রণরেখার এপারের প্রতিচ্ছবি। জঙ্গীবাদ প্রসঙ্গেও একই কথা খাটে। কাশ্মীরিদের লড়াই যেখানে ভারতীয় ‘আধিপত্যবাদ’ এর বিরুদ্ধে, সেখানে পাকিস্তান পোষিত লস্কর এ তৈবা প্রমুখ সংগঠনের লড়াই ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠার।তবে পাক শাসিত কাশ্মীরে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের পর হাফিজ সইদের জামাত-উদ –দাওয়া(জইশ- ঈ-মহম্মদের ফ্রন্টাল সংগঠন) দারুণ ত্রাণকার্য করে অধিবাসীদের মন জিতে নিতে পেরেছিল অনেকটাই।কিন্তু সেই অধিবাসীরা এখনও মেনে নিতে পারেন না ১৯৪৮ সালে উপজাতিদের ঢুকিয়ে দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা দখলের পাক নীতির ভ্রান্তিকে। তাঁদের মতে ওই ঘটনাই ভারতকে কাশ্মীরে সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ এবং বৈধতা দেয় এবং একটি স্থায়ী সঙ্কটক্ষেত্র তৈরী করে।পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক আছে কাশ্মীর বিষয়ক। তাঁরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পাক শাসিত কাশ্মীরে সহিংস বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়েছে।তবু সাময়িক কিছু ছাড় দিলেও সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ঐ একই বছরে কাশ্মীর পরিষদ গঠন করে এবং সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একগাদা মনোনীত সদস্যকে বসিয়ে পাকিস্তান সরকার পাক শাসিত কাশ্মীরের স্বশাসনের অধিকারকে চূর্ণ করে। এ থেকেই বোঝা যায় যে কাশ্মীরিরা মনে করেন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে তাঁদের গণতান্ত্রিক চাহিদার পূর্তি ঘটবে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ১৬ টি বই যেগুলি পাক শাসিত কাশ্মীরের মীরপুরের একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অজুহাত দেখিয়ে ২০১৬ সালেই নিষিদ্ধ করা হয়।এমনকি মকবুল ভাটের জীবনীর পুস্তিকাও নিষিদ্ধ হয়। হ্যাঁ, ইনিই সেই মকবুল ভাট, যাঁকে ১৯৬৬ সালের এক অপরাধের অভিযোগে ভারত সরকার ১৯৮৬ সালে ফাঁসি দেওয়ায় কাশ্মীর উত্তাল হয়ে উঠেছিল। মকবুল ভাট ছিলেন আজাদ কাশ্মীরের প্রবক্তা, যা ভারত ও পাকিস্তান দুই সরকারের অধীনতাকেই অস্বীকার করে।এই মতের অনুসারীরা পাকিস্তানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করার আগে তাঁদের মুচলেকা দিতে হয় যে তাঁরা পাকিস্তানের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের প্রশ্নে পাকিস্তান যে শেষ বেঞ্চে বসে থাকা ব্যাড বয় সেকথা শেখ আবদুল্লা ঠিকঠাকই বুঝেছিলেন।
এবার আমরা একটু বিচার করে দেখব সীমান্তরেখার এপারের কাশ্মীরের মানুষদের পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত কতটা এবং তার কতটা ধর্মীয় কারণে। স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীরে যে সংগঠনটি সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সওয়াল করে এসেছে তার নাম জামাত ই ইসলামি। এদের মূল তাগিদটা ছিল ধর্মীয়। কাশ্মীরে দরগাহ কেন্দ্রিক যে উপাসনা পদ্ধতি তার বিরোধিতা করে ধর্মীয় সংস্কারের নামে শরিয়তী আইন ,জীবনযাত্রা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা হল জামাতের কাম্য। মতাদর্শগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ তাদের কাছে পরিত্যাজ্য। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই শিক্ষিত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জামাত প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। অনেকটা সংঘ পরিবারের কায়দায় ভালো স্কুল ও গ্রন্থাগার চালানো, জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মউদুদির শরিয়তপন্থী চিন্তার প্রচারপুস্তিকার
(২)দি ইমার্জেন্স অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য জামাত ই ইসলামি অব জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর(১৯৪০-১৯৯০)ঃ বিতরণের মাধ্যমে প্রভাববিস্তারের কাজ তারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে চালিয়ে যায়। কাশ্মীরে ইসলামের যে সুফিপন্থী ঘরানা তার ওপর সুকৌশলে পরিবর্তনের কাজটা জামাত করে প্রয়োজনে অন্তর্ঘাতী কায়দায়। আশ্চর্যের এটাই যে এই জামাত নেতৃত্বের বেশির ভাগটাই এসেছেন বড় বড় সুফী পীরদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে যারা দেওবন্দ বা অনুরূপ উচ্চতর জায়গা থেকে ইসলামের পাঠ নিয়ে এসেছেন। জামাত ই ইসলামি কিন্তু দীর্ঘদিন নির্বাচনে অংশ নিয়েও বিশেষ সাফল্য পায় নি। কারণ কাশ্মীরের কৃষক সম্প্রদায়ের সমর্থন তারা পায় নি। শ্রীনগরেও দরগাহর প্রাধান্য থাকায় সূফীকেন্দ্রিক মতাদর্শকে পরাস্ত করা যায় নি। এই জামাত কিন্তু ,নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং সাংবিধানিক উপায়ে কাশ্মীরের জন্য সংগ্রামের কথা বলে এসেছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট লস্কর এ তৈবার মত সংগঠনের চাপে অবশ্য তারা মত পাল্টাতে বাধ্য হয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সমর্থন করে। ততদিনে অবশ্য জে কে এল এফের মত সংগঠন ,যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা বলত ভারত পাক দ্বিত্বের বাইরে দাঁড়িয়ে, তারাই উপত্যকায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে বাইরের জঙ্গীদের চাপে।
সমস্ত দিক বিবেচনা করে অনেকেই হতাশভাবে মেনে নিয়েছেন যে রক্তপাতের এই ইতিহাসই কাশ্মীরের বিধিলিপি। এটা ঠিক যে কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রণোদনার পিছনে ধর্মীয় আবেগের একটা ভূমিকা আছে। ভারতকে ‘হিন্দু ভারত’ হিসেবে দেখার একটা দৃষ্টিভঙ্গী সেখানে কাজ করে। পাশাপাশি ভারত রাষ্ট্রও তো কাশ্মীর উপত্যকাকে মুসলমানদের দেশ হিসেবেই দেখে এবং দেখায়। ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি তাই বাকি দেশে ‘কাশ্মীরের মুসলমানদের টাইট দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।বর্তমান বাস্তবতা এটাই যে,কাশ্মীর উপত্যকার মানুষকে বুঝতে হবে স্বাধীন রাষ্ট্র বা গণভোট আর সম্ভব নয়। ধর্মীয় পরিচয় এক হলেও রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হতে দ্বিধা করে না তার উদাহরণ পাক শাসিত কাশ্মীরের ইতিহাস থেকেও তাঁরা পাবেন(বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস তো ছেড়েই দিলাম)। এই পরিস্থিতিতে ভারত রাষ্ট্রের মধ্যেই আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই তাঁদের লড়তে হবে, যতটা সম্ভব অহিংস ভাবে। কারণ হিংসার পথে গেলে সেই অজুহাতে বিপুল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তাঁদের ওপর নেমে আসে। বলতে পারেন , দিল্লীর শাসকদেরও তো এব্যাপারে অনেক দায়িত্ব আছে,সে ব্যাপারে কিছু বললেন না? না, বললাম না। কারণ তাঁদের ভরসা করিনা,বিশ্বাস করি না। বরং বিশ্বাস আর ভরসা করি সাধারণ মানুষকে, কাশ্মীরের অধিবাসীদের। মুখে বলব কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আর সেখানকার নাগরিকদের একটুও বিশ্বাস করব না—এই দ্বিচারিতা যতদিন থাকবে, কাশ্মীর সমস্যাও ততদিন থাকবে।