আমরা কথায় বলি, যুদ্ধবিগ্রহ। অর্থাৎ, যুদ্ধ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে হাজার সামাজিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট। রাজনৈতিক সঙ্কট। অসুস্থ মানুষ, অসহায় মানুষ, শরণার্থীর ঢল। বাংলাদেশ, মেক্সিকো, সালভাডোর, গুয়াটেমালা, সোমালিয়া, আজকের ইয়েমেন, এবং ইউক্রেন। পরশুর ভিয়েতনাম, কালকের ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান।
যুদ্ধবিগ্রহ।
সাধারণ মানুষ এইভাবে কথাটা বলেন, কারণ সবাই জানেন যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান করেনা। বরং আরো যুদ্ধ ডেকে নিয়ে আসে। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার বর্বর আক্রমণ এবং ওয়ার ক্রাইম একদিকে যেমন বিশ্বজুড়ে মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী যুদ্ধ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা, এবং পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার দখল, তেমনই আর একদিকে বর্ণবিদ্বেষী ইউক্রেন মিলিটারি ও পুলিশের হাতে আফ্রিকান ও ভারতীয়-বাঙালি-জাতীয় কালো চামড়ার ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতন।
অবশ্য, ভারতীয় ও বাঙালিরা নিজেদের এতদিন উচ্চবর্ণের শ্বেতাঙ্গ বলেই মনে করে এসেছেন। ওখানকার লাথিঝাঁটার কথাটা তাঁরা বেমালুম চেপে যাবেন। তারপর, বাড়ি ফিরে এসে নিজেদের হিন্দু মুসলমান, উচ্চনীচ তক্তাপোশে আবার ভূতের নৃত্য করতে শুরু করে দেবেন।
যাক যে ওসব আজেবাজে কথা। যুদ্ধ নামক বিগ্রহের কথা একটু বলা যাক।
হিটলার, মুসোলিনি, পুতিন, সতীন এদের কথা আমরা জানি। তাদের বর্বরতা, যুদ্ধ, গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার, গণতন্ত্র ধ্বংস, এবং অলিগার্কির সঙ্গে শয্যাগ্রহণ। বলা হচ্ছে পুতিন হয়তো আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। জেফ বেজোস, বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, সৌদি রাজপরিবার, কিংবা আম্বানি আদানির থেকেও ধনী কিনা, তা আমরা জানিনা। কিন্তু প্রচণ্ড ধনী, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই অলিগার্কির হাতেই রাশিয়ার সম্পদ চলে গেছে, এবং তার মালিকানা এখন ইয়েলৎসিনের হাত ঘুরে পুতিনের হাতেই।
এদের কথা আমরা জানি। কিন্তু আমরা মিডিয়াতে কখনো নেটো (NATO) বা মার্কিন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কথা শুনিনা। তাদের অস্ত্রভাণ্ডার, তাদের মজুত অর্থের পরিমাণ, তাদের সঙ্গে পৃথিবীর বিশালতম ব্যাঙ্ক ও ওয়াল স্ট্রীটের এক বিছানায় সঙ্গম। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যে কী বস্তু -- খায় না মাথায় দেয় -- তাই আমরা জানিনা।
ভারত বা বাংলার কথা ছেড়েই দিন, মার্কিনিরাই জানেনা। আমি অন্ততঃ কুড়ি বছর ধরে আমেরিকার রাস্তায় নেমে "চলবেনা চলবেনা" আন্দোলন করলাম, তার মধ্যে আবার রামের চোদ্দ বছরের মতো আমার কর্মজীবনের শেষ চোদ্দ বছর নিউ ইয়র্কের পঞ্চম বৃহত্তম শ্রমিক ইউনিয়নে শিক্ষকতার কাজ। তিরিশ হাজার স্টুডেন্ট। তার মধ্যে মোটামুটি কুড়ি হাজার শ্বেতাঙ্গ, আট হাজার কৃষ্ণাঙ্গ, বাকীরা হিস্প্যানিক, চীনা, ক্যারিবিয়ান, ইত্যাদি। ফর-প্রফিট মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স বা ফর-প্রফিট প্রাইভেট প্রিজন ইন্ডাস্ট্রি এসব বাক্য শুনলে তাদের নব্বই শতাংশকেই বাক্যহীন হয়ে থাকতে দেখেছি।
আর যুদ্ধ একটা লেগে গেলে ঠিক আমাদের দেশের মতোই আর সব যা আছে ছাইপাঁশ হয়ে যায়। পৃথিবীর এই "শ্রেষ্ঠ দেশে" কেন আজ দশ লক্ষ মানুষ (আজকের হিসেবে ৯,৮৪,০২০ -- সূত্র: covidvisualizer.com) কোভিডে মৃত, শুধু ২০২০-২০২১'এই দশ লক্ষ স্মল বিজনেস এই খোদ মার্কিন মুলুকে জিসাস উল্টেছে।
কেলাইমেট চেনজ? সেডা আবার কেডা? কখনো তো শুনি নাই!
সেসব আলোচনা আগেও খুব কম ছিল, আর আজ এই যুদ্ধের বাজারে একেবারেই স্তব্ধ। ঠিক যেমন আমাদের পুলওয়ামা-বালাকোটের বাজারে আর সব বিষয়ের আলোচনাই ছাইপাঁশে পরিণত হয়েছিল।
যুদ্ধের বিগ্রহ এমনই এক শ্রেষ্ঠ দেবতা আজকের পৃথিবীতে। তিনি তাঁর মায়ায় আর সবকিছুকেই ম্যাজিকের মতো ছায়া করে দিতে পারেন। বা আমাদের ভাষায় বলতে পারেন, হাওয়া।
আজকের নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি, রামরাম ফক্স ইত্যাদি প্রভৃতি নব্য গোয়েবলসিও মেশিন ঠিক আমাদের গরিব দেশের হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি বা আই টি সেলের মতোই যুদ্ধ নামক বিগ্রহকেই পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসিয়ে পিশাচপুজোতে দিবারাত্র ব্যস্ত। প্রতিদিন শোনা যাচ্ছে তাদের হ্রিং ক্রিং হুম হুম মন্ত্র, আর টিভিতে দেখা যাচ্ছে নরকরোটি থেকে মুহুর্মুহু কারনবারি পান।
"নীলচোখ আর সোনালী চুলের সভ্য মানুষেরা ইউক্রেনে আক্রান্ত।" -- ওই যেমন বিবিসি, এবিসি, সিবিএস, আর সব বিএস চ্যানেলের বিখ্যাত সাংবাদিক আর সাংবাদিকারা বলেছেন। এ এম রেডিও, ব্রাইটবার্ট বা নিউজম্যাক্স এদের কথা বলে আর লজ্জা বাড়ালাম না। এ তো আর সোমালিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা ভিয়েতনামের জংলী অসভ্য মানুষ নয়।
কঙ্গোতে সিস্টেমিক গ্যাংরেপ চলেছে এই মুহূর্তে। কিন্তু ওসব অসভ্য দেশে হয়েই থাকে। তাছাড়া, "নিজের দেশ জানেন না, আবার অ্যাফরিকা!"
অবশ্য ইয়েমেন এখনো চলেছে, আর আমেরিকার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ইউক্রেনকে সাম্প্রতিকতম উপন্যাস, আই মীন, অস্ত্রের রফতানি পাঠানোর আগেই সৌদি আরবকে একঝাঁক বোমারু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর কী কী যেন সব পেটিয়ে দিয়েচে। তা, অন্য সব ইতিহাসের মতোই ওগুলো এখন "জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন" করে দিলেই চলবে। তার মানে হলো, আছে কিন্তু নেই। নেই তাই খাচ্চো, থাকলে কোতায় পেতে?
এখন যুদ্ধ, দেশপ্রেম, সভ্যতার সঙ্কট, রাশিয়া নামক শত্রু, এবং পুতিন নামক নতুন "ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট" হিটলার। কিংবা, তৈমুর লং, চেঙ্গিস, বা আইভ্যান দ্য টেরিবল। যা কাজে লাগে এই বাজারে।
এতো ভালো বিগ্রহ আর কোথায় পাবেন?
জয় বাবা যুদ্ধবিগ্রহের জয়।
_________
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।