প্রাক-ইসলামি বেদুইন আরব সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তবে সেই সমাজে নারীর বেশ কিছু ‘অধিকার’ ছিল, এবং নারীর উপর পুরুষের যৌন নিয়ন্ত্রণ সার্বিক ছিল না। বহুবিবাহের ব্যাপক চল ছিল সমাজে। নারীদের মধ্যেও ছিল বহু স্বামী-প্রথা। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের তাৎক্ষণিক উচ্চারণই যেমন যথেষ্ট বলে বিবেচিত হত, তেমনই মেয়েরাও ইচ্ছা করলে বিবাহ-সম্পর্কে ইতি টানতে পারত। যাযাবর উপজাতীয় সমাজের সঙ্গে মানানসই ছিল এই শিথিল পারিবারিক ও বিবাহ ব্যবস্থা—এমন সমাজে যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল না, তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য নারীর একগামিতার প্রয়োজন উদ্ভূত হয়নি। মক্কার স্থায়ী বসতি ভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল আলাদা। সেখানে পর্যাপ্ত বাণিজ্য-সম্পদ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা পাকাপোক্ত পারিবারিক ব্যবস্থা দাবি করছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করাও জরুরি ছিল; ফলস্বরূপ সমাজে পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরাল হয়। কোরানে বেশ কিছু আয়াতে প্রতিফলিত হয়েছে এই পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ‘নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য’। ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র’ (২: ২২৩)-এর মতো আয়াত যেমন আছে, তেমনই স্ত্রীকে অবাধ্যতার জন্য প্রহার করার কথাও সেখানে উল্লিখিত (৪: ৩৪)। তবে ইসলামে স্ত্রী ও নারী এমন কিছু অধিকারও পেয়েছিল যা ইতিপূর্বে অন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমত তাদের দেয়নি।
ইসলাম পরিবার ও দাম্পত্যকে স্থায়িত্ব দিতে সচেষ্ট হয়েছিল। বিবাহবিচ্ছেদে রাশ টেনেছে কোরান; বিচ্ছেদের পরে আরও তিন মাস পুনর্বিবেচনা বা বোঝাপড়ার কাল হিসেবে নির্ধারিত। বিবাহিত নারীর একগামিতা সুনিশ্চিত করেছে ইসলাম, তবে ‘নিষ্ঠুর আচরণ বা খারাপ ব্যবহার’-এর কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ দেবার অধিকার তার ছিল (৪: ১২৮)। বিবাহকে নারী ও পুরুষের ‘সম্মতি সাপেক্ষ একটি চুক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা-কে মানবিক করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক বিধবা বা অ-কুমারী নারীর প্রতি আদি ইসলামি সমাজ কোনও ‘কালিমা’ আরোপ করেনি, যা অন্য বেশ কিছু ধর্মমতের ক্ষেত্রে সত্য। বিবাহবিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পরে ইচ্ছা করলে পুনরায় বিয়ের অধিকার নারীর ছিল। ইসলামের প্রথম যুগে কোনও কোনও গুণী ও রূপসী নারীকে এইভাবে তিন, চার এমনকি ছয়বারও বিয়ে করতে দেখা গেছে। উম্মে কুলসুম প্রথমে মুহম্মদের পালিত সন্তান জায়িদকে, জায়িদের মৃত্যুর পরে জুবাইর-ইবন-আল-আওয়ামকে, আওয়ামকে বিচ্ছেদ দিয়ে আব্দেল রহমানকে, এবং রহমানের মৃত্যুর পরে আমর-বিন-আয়াস (মিশরের শাসনকর্তা)-কে বিয়ে করেছিলেন। এ-ও লক্ষণীয়, আয়েশা বাদে মুহম্মদের কোনও স্ত্রী-ই মুহম্মদের সঙ্গে বিবাহের পূর্বে ‘কুমারী’ ছিলেন না।
কোরানে পুরুষকে একই সঙ্গে সর্বাধিক চারটি স্ত্রী-রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে শর্তসাপেক্ষে (৪:৩) - প্রত্যেক স্ত্রীকে সমদৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হলেই কেউ এই অনুমতি পেতে পরে। কোরানের অন্য একটি আয়াতে (৪: ১২৯) বলা হয়েছে: যতই চেষ্টা কর, সকল স্ত্রীর প্রতি সমান আচরণ অসম্ভব। এই দুটি আয়াত পাশাপাশি রেখে আধুনিক বিশ্লেষকেরা কেউ কেউ বলেন, কোরান আসলে বহুবিবাহের বিরুদ্ধেই মত প্রকাশ করেছে। অন্যভাবে বলা যায়, বহুবিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না হলেও এক-বিবাহকেই শ্রেয় ও যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা বলে স্বীকার করে নিয়েছে কোরান। তবে এ-ক্ষেত্রেও একটি প্রশ্ন ওঠে। আজ আমরা কোরানের এমন ব্যাখ্যা দিলেও, তৎকালীন যুগের সামাজিক মূল্যবোধে কি বিষয়টি একইভাবে দেখা হত? নিশ্চয়ই না। সমাজ তখন আজকের মতো পুরুষের বহুবিবাহকে নিন্দার চোখে দেখেনি। বরঞ্চ পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে নারীর প্রতি মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদর্শনের সমার্থক রূপে বিবেচনা করা হত। প্রসঙ্গত লীইলা আহমেদের বিশ্লেষণ স্মর্তব্য। বহুবিবাহের (চার-স্ত্রী) আয়াতটি (৪: ৩) নাজিল হয়েছিল উহুদের যুদ্ধ (৬২৫)-এর পরে-পরে। এই যুদ্ধ বহু মুসলমান নারীকে বিধবা করেছিল। এদের বেশিরভাগই মক্কা ছেড়ে মদিনায় এসেছিল, ফলে মক্কায় নিজেদের গোত্রের আশ্রয়ে তাদের আর ফিরে যাবার উপায় ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ‘মুসলমান সম্প্রদায় বহুবিবাহ প্রণয়ন করে বিধবাদের সুরক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিল’।
হজরত মুহম্মদ অবশ্য নিজের জীবনে ‘চার-স্ত্রী নীতি’ মানেননি, কোরানের ৩৩ : ৫০ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল তাঁর চারের অধিক বিয়েকে অনুমোদন দিয়ে। ইসলামীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁর ‘তেরোজন’ (এ ক্ষেত্রে মতৈক্য নেই, তেরো থেকে পনেরো নানা সংখ্যা বলা হয়েছে) স্ত্রীর কথা জানা যায়। মুহম্মদের প্রথম স্ত্রী ছিলেন খাদিজা, যাঁর সঙ্গে তিনি পঁচিশ বছরের একগামী জীবন কাটিয়েছিলেন। খাদিজার মৃত্যুর পরে এবং মদিনায় ‘রাজনৈতিক জীবন’ শুরু করার পর তিনি বহু বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করেন, যেগুলির কিছু ছিল ‘রাজনৈতিক বিবাহ’, কিছু অসহায় বিধবাকে ‘আশ্রয় ও সম্মান প্রদান’, কয়েকটি হয়তো ‘পুত্রসন্তান লাভের ইচ্ছা থেকে’ (সৈয়দ আমির আলি) এবং আল তাবারি-র ব্যাখ্যা মানলে কয়েকটি অনুরাগ বা প্রেমের আকর্ষণে (যেমন জয়নাব, যিনি ছিলেন মুহম্মদের পালিত পুত্র জায়েদের স্ত্রী)।
ইসলাম-বিরোধী ও আজকের ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের একাংশের কাছে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়েছে মুহম্মদের বহুবিবাহ- বিশেষ করে সাত বছর বয়েসি আয়েশা ও পালিত পুত্রের স্ত্রী জয়নাবকে বিয়ে করার বিষয়টি। এই প্রসঙ্গে ডাব্লু এম ওয়াটের যুক্তি হল, আধুনিক মানদণ্ডের নিরিখে মুহম্মদের চরিত্র বিচার অগ্রহণীয়। ইসলামি তথ্যসূত্রে মুহম্মদের বিবাহ সংক্রান্ত তথ্যগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঢঙেই (‘কৈফিয়ত’ দেবার মত করে নয়) উল্লিখিত হয়েছে। মুহম্মদের একমাত্র ‘কুমারী’ স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে বিবাহের অনুষ্ঠান ছিল কেবলমাত্র বাগদান - ঋতুমতী হবার পূর্বে তাদের বৈবাহিক জীবনের সূত্রপাত হয়নি। আমরা লক্ষ করব, ইহুদি প্যাট্রিয়ার্ক আব্রাহাম বা জ্যাকব, নবি মোজেস বা হোসিয়া, ইজরায়েলের রাজা স্যল, ডেভিড কিংবা সলোমন, বাইজান্টাইন-খ্রিস্টান বা জরাথুস্ট্রীয়-সাসানীয় শাসকেরা সকলে, কিংবা আরবের শেখ (গোষ্ঠী সরদার)-রা- প্রত্যেকেরই বহু পত্নী বা উপপত্নী ছিল। সপ্তম শতকের আরবে একজন শেখের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে নির্ধারিত হত তার হারেমের আকার দিয়ে। রেজা আসলান বলেছেন, এই প্রেক্ষাপটেই মুহম্মদের বহুবিবাহ দেখা দরকার। তবে মুহম্মদ কন্যাপক্ষের উপর বিয়ের সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিতেন না। অন্তত একটি উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে বিয়ের ব্যাপারে মুহম্মদের সম্মতি সত্ত্বেও কন্যার পরিবারের আপত্তিতে তা সম্পন্ন হয়নি (ইবনে সা’দ)। মেয়েটি ছিল মদিনা-বাসী (আনসার)। ইসলামি তথ্যসূত্রে উমরের ভাষ্যে উল্লেখ আছে যে, মদিনার নারীরা অনেক 'স্বাধীনচেতা'-'মক্কায় যেমন স্ত্রীদের উপর স্বামী কর্তৃত্ব করত মদিনায় বিষয়টা ছিল উলটো’। সেই কারণেই সম্ভবত উক্ত মেয়েটির অভিভাবকদের মনে হয়েছিল যে বিয়ের পরে সে মুহম্মদের অন্যান্য স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য ভাগ করে নিতে পারবে না। সাক্ষ্যটি থেকে প্রমাণিত হয়, নবি হিসেবে মুহম্মদ বিশেষ সম্মানিত হওয়া সত্ত্বেও এবং উম্মার নেতা হলেও তিনি জোর করে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হতেন না।
আয়েশা ছিলেন ইসলামি ঐতিহ্য মতে মুহম্মদের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কিভাবে মুহম্মদের বহুবিবাহ (বহু গমন) ও তার সপক্ষে কোরানের নির্দেশকে দেখেছেন? এ ক্ষেত্রে একটি ‘ব্যতিক্রমী’ হাদিস (আল বুখারি, পুস্তক ৬০, ৩১১) প্রণিধানযোগ্য। আয়েশা মুহম্মদকে নাকি বলেছিলেন "… আপনার প্রভু আপনার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার পূরণে দেরি করেন না। "
ব্যক্তিগত জীবনে মুহম্মদ একজন নম্র, মৃদুভাষী ও সহৃদয় মানুষ হিসেবেই পরিচিত। মরোক্কোর নারীবাদী লেখিকা ফাতিমা মেরনিসি (১৯৪০-২০১৫) লিখেছেন, স্ত্রীদের সঙ্গে মুহম্মদের সম্পর্ক পরবর্তীকালের নারী বিরোধী কট্টর পিতৃতান্ত্রিকদের মত ছিল না; সেখানে লিঙ্গ বৈষম্যের মূল্যবোধ আপেক্ষিকভাবে কমই প্রতিফলিত হয়েছিল। আল তাবারি (মৃত্যু ৯২৩) জানিয়েছেন, কোরানের ‘অনুমোদন’ সত্ত্বেও (৪:৩৪) মুহম্মদ কখনও তাঁর স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেননি, বরং এই রকম আচরণকে নিন্দনীয় মনে করতেন। একবারই মাত্র স্ত্রীদের সমবেত ‘বিদ্রোহ’ বা ‘অবাধ্যতা’-র মুখোমুখি হয়ে তিনি ঘর ছেড়ে টানা ২৯ দিন গৃহ সংলগ্ন মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং ‘পরিণামে আল্লাহ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন’ (অর্থাৎ এই সময়কালে কোনও আয়াত অবতীর্ণ হয়নি, যা থেকে এ-ও অনুমান করা যায় যে তিনি মানসিকভাবে কতটা অস্থির ছিলেন)। লক্ষণীয়, এই সময়কালে মুহম্মদ তাঁর স্ত্রীদের ‘বিচ্ছেদের প্রস্তাব’ (বা মতান্তরে ‘প্রচ্ছন্ন হুমকি’) দিলেও শারীরিক বলপ্রয়োগের পথে হাঁটেননি।
কোরানের হিজাব সংক্রান্ত প্রত্যাদেশটি অবতীর্ণ হয়েছিল ৬২৭ অব্দ নাগাদ। প্রত্যাদেশটিতে (৩৩: ৫৩) উচ্চারিত হয়: বিশ্বাসীরা, নবির গৃহে প্রবেশ করো না... অনুমতি ছাড়া। যদি আমন্ত্রণ পাও... অতিরিক্ত সময় সেখানে অতিবাহিত করো না... যদি নবির স্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করো, হিজাবের পিছন থেকে করো। এটি তোমার ও তাঁদের উভয়েরই হৃদয়ের পবিত্রতা নিশ্চিত করবে... (ভাবানুবাদ)। মুহম্মদের গৃহ ছিল উম্মার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্র। বহু মানুষ প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসত। ৬২৬-২৭ নাগাদ উম্মা আর ক্ষুদ্র জনসমষ্টি ছিল না, ফলে অপরিচিত মানুষের জনসমাগমও বেড়েছিল। কিছু ইসলামি সূত্র দাবি করেছে, এই নতুন পরিস্থিতিতে মুহম্মদের গৃহে পর্দাপ্রথা চালু করার ব্যাপারে উমর (যিনি পরে দ্বিতীয় খলিফা হবেন) বেশ কিছুদিন ধরেই সক্রিয় হয়েছিলেন। পর্দাপ্রথা প্রবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছিল মুহম্মদের স্ত্রী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যা উম্মে সালামার কাছ থেকে। মুহম্মদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। আল তাবারি উক্ত আয়াত অবতরণের প্রেক্ষিত আলোচনা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, নবি মুহম্মদ সদ্য জয়নাবকে বিবাহ করেছিলেন। মুহম্মদের গৃহে সেদিন অনেক অতিথি। বেশিরভাগ অতিথি অল্প সময়ের ব্যবধানে চলে গেলেও তিনজন অতিথি বহুক্ষণ ধরে মুহম্মদের গৃহে গল্পগুজবে মেতে ছিলেন, যা মুহম্মদকে মনে মনে ‘বিরক্ত’ করেছিল, যদিও ‘ভদ্রতা বোধ’ থেকে মুহম্মদ তাদের সরাসরি কিছু বলতে পারেননি। এই রকম মুহূর্তেই আয়াতটি অকস্মাৎ নাজিল হয়, যা ছিল ‘আল্লাহ-র তরফ থেকে একজন ভদ্র মানুষের পক্ষ নিয়ে ভদ্রতা বোধ-পরিপক্ক-হয়নি এমন একটি সম্প্রদায়ের উদ্দেশে নির্দেশ প্রেরণ’। একটু ভিন্নভাবে বললে বলা যেতে পারে যে, ‘পর্দা’ প্রথার প্রবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহ বা মুহম্মদ ‘ঘর’ ও ‘বাহির’ বা আজকের পরিভাষায় ‘প্রাইভেট’ ও ‘পাবলিক’-এর মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছিলেন, যা আরব সমাজে পূর্বে প্রচলিত ছিল না।
উল্লেখ্য, আরবি ‘হিজাব’ কথার অর্থ ‘পর্দা’; আজকে যেমন ‘হিজাব’ বলতে নারীদের ব্যক্তিগত পোশাক বুঝি, আদি-ইসলামে তা বোঝাত না। মুহম্মদের গৃহকোণে হিজাব বা পর্দাপ্রথার নির্দেশ এলেও মুহম্মদের সময়কালে সাধারণ ঘরের মুসলমান নারীরা আদৌ পর্দানশীন থাকত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কোরানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই ‘দৃষ্টি অবনত রাখা’-র নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (২৪: ৩০-৩১)। লীইলা আহমেদ লিখেছেন, ‘বিশ্বাসী’ নারীদের মার্জিত পোশাক পরার কথা কোরানে বলা হয়েছে (৩৩: ৬০), অপরিচিত আগন্তুকদের সামনে ‘ব্যক্তিগত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ’ ঢেকে রাখার কথাও উচ্চারিত হয়েছে (২৪: ৩১-৩২), কিন্তু কোরানের একটি আয়াতেও সাধারণ নারীর বাধ্যতামূলক হিজাব (ব্যক্তিগত পোশাক অর্থে) পরিধানের নির্দেশ নেই। কোরান অনুযায়ী হিজাব বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র মুহম্মদের গৃহে ও মুহম্মদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কবে থেকে তা হলে চালু হল সাধারণ মুসলিম নারীর বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধান (ব্যক্তিগত পোশাক অর্থে)? লীইলা আহমদ লিখেছেন, ইসলাম সম্প্রসারিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পরে সেখানে প্রচলিত অনেক প্রথা ও রীতিনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল (সেখানকার সমাজ, লীইলা আহমেদের ভাষায়, আরবের চেয়ে বেশি পিতৃতান্ত্রিক ছিল সেই যুগে)। হিজাব বা পর্দাপ্রথাটিও সেই ভাবেই ইসলামের অংশ হয়। কিন্তু তখনও হিজাব প্রথা (ব্যক্তিগত পোশাক অর্থে) বাধ্যতামূলক ছিল না। আরও পরে, ইসলামি শাস্ত্রকাররা উম্মার সকল নারীর জন্য হিজাব পরিধান (ব্যক্তিগত পোশাক অর্থে) ‘বাধ্যতামূলক’ বলে রায় দেন, যদিও ইসলামের পাঁচটি অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় কর্তব্য বা রোকনের তা অন্তর্ভুক্ত নয়।
লীইলা আহমদ আরও লিখেছেন, কোরানের মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র ও বিপরীত ধারা প্রতিফলিত হয়েছে: একদিকে নারী ও পুরুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক, এমনকি জীবগত বৈশিষ্ট্যের (biological attributes) নিরিখে সমতার ধারণা। যেমন, কোরানে ‘original sin’-এর ধারণা নেই, আদমের ‘পতন’-এর জন্যে নারী-সঙ্গিনীকে দায়ী করাও হয়নি; কোরান মতে, নারী ও পুরুষ উভয়ের সৃষ্টি একই ‘অভিন্ন আত্মা’ (নাফস ওয়াহিদা) থেকে। কোরানের আর-একটি অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য নারী ও পুরুষ উভয়কে উদ্দেশ্য করেই ঐশী বাণী উচ্চারিত। কোরানে নারী ও পুরুষের শ্রমমূল্যেরও বিভাজন করা হয়নি (৩: ১৯৩)। দানশীলতা, সত্যবাদিতা, ধৈর্য, ধার্মিকতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসীরই কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। এই রকম সমতা বাদী ধারণার পাশাপাশি কোরানে স্থান পেয়েছে সমাজ বিন্যাস গত কিছু নির্দেশাবলী, যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও লিঙ্গ বৈষম্যের দর্শন (যেমন উপরিউক্ত ২: ২২৩ কিংবা ৪: ৩৪ আয়াতটি)। এই দুই প্রবণতার টানাপড়েন উত্তরকালের ইসলামি বিধান ও নির্দেশের মধ্যে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ও আব্বাসীয় আমল ছিল সপ্তম শতকের আরব ভূখণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি পিতৃতান্ত্রিক ও নারী-বিরোধী। নবম-দশক শতক নাগাদই শরিয়ত (সঠিকতর অর্থে ফিকহ্ বা ইসলামি আইনশাস্ত্র) রচনার কাজ সংগঠিত হয়। ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় ইসলামি ঐতিহ্যের প্রামাণ্য ছবি তুলে ধরারই চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সমকালের মূল্যবোধ, বিবেচনা ও দেশকালের প্রশ্নগুলির সাপেক্ষে সেই ঐতিহ্যকে নিজেদের মত করে গড়ে-পিটেও নিয়েছিলেন, আরোপ করেছিলেন নিজেদের ব্যাখ্যা (বহু ক্ষেত্রে অবচেতনভাবে)। পরিণামে আব্বাসীয় আমলে গঠিত ইসলামীয় শাস্ত্রে পুরুষ প্রাধান্যের ধারাটিই প্রকট হয়েছে। তবে আদি ইসলামের লিঙ্গ সাম্যবাদী ধারাটি সম্পূর্ণ চেপে দেওয়া সম্ভব হয়নি, বিকল্প ও বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরগুলি মাঝেমাঝেই তাদের ‘অস্তিত্ব’ জানান দিয়েছে। ‘কান পাতলে’ সন্ধানী ও সতর্ক পাঠক শুনতে পাবেন সেই কণ্ঠস্বর।
গ্রন্থ-ঋণ
Jawad, Haifa A., The Rights of Women in Islam/ An Authentic Approach, Macmillan Press Ltd., London, 1998
Leila Ahmad, Women and Gender in Islam Historical Roots of a Modern Debate, Yale University Press, London, 1992
Mernissi, Fatima, Women and Islam An Historical and Theological Enquiry (Translated by Mary Jo Lakeland), Basil Blackwell, 1991
Watt, W, Muhammad Prophet and Statesman, Oxford University Press, London: 1961