বাড়ির দেওয়ালে খোপ-কাটা তাকের সারির একেবারে উপরের তাকে রাখা থাকতো ফিলিপ্স কোম্পানির টেপ রেকর্ডার, আমার নাগালের অনেক দূরে। সেই তাকে টেপ রেকর্ডারের একপাশে থাকতো ঠাকুরের ধূপদানি, 'শিপ' দেশলাইয়ের একটা বাক্স, আর অন্যপাশে থাকতো কয়েকটা ক্যাসেট। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলোই চালানো হতো মাঝেসাঝে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে এভাবেই প্রথম শোনা আমার।একটা হলদেটে ক্যাসেট, তাতে ধেবড়ে যাওয়া নীল কালিতে ছাপা 'এ লিজেন্ড অব গ্লোরি' -- তারপর এ পিঠের গান আর বি পিঠের গানও লেখা ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে, যথাযথ পিঠে। সে প্রায় পড়া যায় না, তাও চেষ্টা করে উদ্ধার করেছিলাম, এ পিঠের তৃতীয় গানটি -- 'কান্দো কেনে মন রে'!
স্মৃতি যতদূর যায়, আমার জীবনের প্রথম মনে রাখা গান এইটি। গানটির কথা বোঝার বয়স সে সময় আমার হয়নি স্বাভাবিকভাবেই, কারণ খুব বেশি হলে আমি তখন সাড়ে তিন বা চার। কিন্তু গানটি ভালো লাগতো খুব অদ্ভুত কিছু কারণের সমন্বয়ে। গানটি শুরু হতো ঢিমে, মনখারাপের একটা সুরে; তারপরেই অন্তরায় চলে আসতো খুব ধীর, আনন্দের ছন্দ ও সুর। অবাক লাগতো -- গানটা শুনতে শুনতে এত তাড়াতাড়ি মনখারাপ থেকে মনভালো হয়ে যেত, আবার মনখারাপ হতো! আরও একটা ব্যাপার ছিল -- রেকর্ডিংয়ের মান খুব ভালো না হওয়ায় খুব স্পষ্ট ছিল না গানের কথাগুলো, শুনলে মনে হতো কত পুরোনো দিন থেকে ভেসে আসছে। অথচ যাঁর কণ্ঠ, সেই কণ্ঠ কী তরুণ! আনন্দের জায়গাগুলো যেন ছোটদের মতো হেসে হেসে গাইছেন। অবশ্যই এতসব পরে, বড় হয়ে অনুমান করা -- যে এমন কিছু বৈপরীত্যের সমন্বয়ে গানটি বসে গিয়েছিল আমার মনে।
হেমন্ত-অনুরাগী যাঁরা, তাঁরা হয়তো স্বীকার করবেন, গোটা গোটা গান ভালো লাগার অতীতেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কীর আরেকটি জিনিসে নেশা লাগে মানুষের। তা হলো, তাঁর গলার জমিন, যাকে আমরা texture বলে থাকি। হেমন্তের কণ্ঠকে অনেকে বলেন 'মখমলি', অনেকে বলেন 'silky'; আমার এর কোনোটাই মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, তাঁর কণ্ঠ ছিল granulous, কিন্তু জমাট-বাঁধা, নমনীয়; ঝুরো নয়। আখিগুড় যেমন -- জমাট, সেমি-সলিড বিষয়টিকে মুখে দিলে আপনি জিভ ও তালুর মাঝে কিচকিচে প্রতিটি দানা অনুভব করতে পারবেন, আপনার মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে, হেমন্তের কণ্ঠও তেমনই। যে কারণে রফি সাহাব বা কিশোর কুমারের অমুক গান আমাদের পছন্দ, বা তমুক গান আমাদের মনে না-ও ধরতে পারে; কিন্তু হেমন্তের কণ্ঠ কেউ ভালোবেসে থাকলে গানের কথা, সুর সেখানে গৌণ হয়ে ওঠে। নরম তাঁতকাপড়ে আমরা হাত বোলাই তার রঙ বা ডিজাইন নির্বিশেষে। হেমন্তের গান শোনা আসলে সেই তাঁতের স্পর্শ, আখিগুড় আস্বাদন।
জীবনের শেষভাগে এসে তাঁর কণ্ঠের এই বৈশিষ্ট্যটি হারিয়ে গিয়েছিল অনেকটাই, বয়স ও অসুস্থতার কারণে। অতি মোলায়েম কণ্ঠে গাওয়া সে সময়ের অনেক গান, বা লাইভ অনুষ্ঠানে গাওয়া নিজেরই পুরোনো সব কালজয়ী গান শোনার অভিজ্ঞতা হয়তো অতটা সুখকর নয় আমাদের অনেকের কাছেই। কিন্তু সে সময়ে তিনি ঠিক-ভুল, ভালো-খারাপের ঊর্ধ্বে; বাংলা সঙ্গীতজগতে একচ্ছত্র আধিপত্য তাঁর, কী কণ্ঠে কী সুরে! ধুতির সঙ্গে হাফ শার্ট, বা ফুল শার্ট হাতা গুটিয়ে পরা, মোটা কালোফ্রেমের চশমা পরা মানুষটির কোনও বিকল্প নেই বাংলায়, জনপ্রিয়তা ও অভিজ্ঞতায় তিনি অপরিহার্য।
শুধু সিনেমার গান নয়, আধুনিক নয়, সাধারণত সিনেমার বা আধুনিক গানের শিল্পীরা যে পরিসরে তেমন চলাচল করতেন না সে সময়ে, সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ কয়েক দশক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গ উঠলো যখন, বলতেই হয়, দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলিতে non-puritan, গ্রহিষ্ণু বাঙালির ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা। আজকের দিনে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বেলেল্লাপনাও যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনই অস্বস্তিকর ছিল (এবং এখনও আছে) বিশ্বভারতী-অনুমোদিত 'কুলীন' গায়ক-গায়িকাদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি, যন্ত্রানুষঙ্গ, এমনকি প্রাণহীন, যান্ত্রিক উচ্চারণ নিয়ে রক্ষণশীলতা। দেবব্রত বিশ্বাস বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর গুরুত্ব হয়তো এখানেই -- তাঁরা ব্যাকরণবিধি আর অরাজকতার মধ্যবর্তী একটি পথ বার করেছিলেন, যাতে রবীন্দ্রগানের শ্রী ও ভাব 'violated' হয় না, এবং আনুষ্ঠানিকতার বাইরে রবীন্দ্রনাথও একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
এই সমস্ত কার্য-কারণ, জটিল আলোচনাকে প্রচ্ছন্নে রেখে আমাদের অনেকের বাড়িতেই টেপ রেকর্ডারে বেজে গেছে হেমন্তের গান, একের পর এক। কখনও ঘোরের মধ্যে শুনেছি, কখনও বহুদিন পর, কখনও কিছুদিনের তফাতে। কিছুটা আলো-আঁধারের গান গেয়েছেন হেমন্ত; কখনই শোকে সম্পূর্ণ নিমজ্জন নেই সেই কণ্ঠে, আবার আনন্দের পাল তরতরিয়ে ছুটেছে, এমনও নয়। একটি একটি করে গান গাইতে গাইতে তিনি এগিয়েছেন, জড়িয়ে গেছে আশেপাশে কত নাম তাঁর সঙ্গে। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ বললেই এঁদের মানিকজোড় নামটি হেমন্তের; এমনকি মহানায়ক উত্তমকুমার বললেও হেমন্তই মহানায়কের কণ্ঠ। উত্তমকুমারের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একটি ক্যাসেটে ভাষ্যপাঠ করেছিলেন গায়ক; তাঁর কথায় বি-পিঠের শেষে উত্তমকুমারের মৃত্যুসংবাদ আসতো যেখানে, বারবার করে শুনতাম একসময়। তারপরেই ছিল ক্যাসেটের শেষ গান, "কাছে রবে, কাছে রবে"। যদিও 'চৌরঙ্গী' ছায়াছবিতে চিত্রায়নে গানটি আসলে বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে স্থান পায়, ওই ক্যাসেটে, ওই ভাষ্যপাঠের শেষে গানটি আমার কাছে আজও উত্তমকুমারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর নির্জন স্মৃতিতর্পণ হয়ে থেকে গেছে। তথাকথিত জনপ্রিয় গানগুলির আড়ালে 'পথ হারানো তেপান্তরে', 'আমি হতে পারিনি আকাশ', 'এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে', 'আজও হৃদয় আমার পথ চেয়ে', 'সবাই চলে গেছে, শুধু একটি মাধবী' গানগুলি -- এই যে এখন লিখছি, সঙ্গে সঙ্গে গুনগুনিয়ে চলেছি। রবীন্দ্রগানের মধ্যেও কিছু কিছু গান যেমন এক একজন শিল্পীর কণ্ঠেই মনে থেকে যায়, তেমনই 'প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায়', 'হে মাধবী দ্বিধা কেন', 'কেন পান্থ এ চঞ্চলতা', 'অরূপ তোমার বাণী', 'যৌবনসরসীনীরে', 'যদি তারে নাই চিনি গো' হয়ে উঠেছে হেমন্তসঙ্গীত।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের তেত্রিশ বছর পেরিয়ে আজ আবার তাঁর জন্মদিন। চারপাশের অসহায়তাকে একটুখানি অপেক্ষা করতে বলে, যদি নির্ভার হয়ে একবার আকাশের দিকে তাকানো যায়, কলকাতার দিনটিও আজ 'এই মেঘলা দিনে একলা' শোনার মতো। আজ তাঁর জন্মদিন না হলেও আমরা অনেকেই শুনতাম, গুনগুন করে গাইতাম, নিশ্চিত; অন্যান্য ঋতুতেও যেমন গাই, অনেক সময়ে, তাঁর অনেক অনেক গান।
সুন্দর লেখা, ওঁর কণ্ঠের টেক্সচার সম্পর্কে উপমাটি এক্কেবারে যথাযথ! শুধু একটা ছোট বানান ভুল রয়ে গেছে, "যন্ত্রানুষঙ্গ"।
হ্যাঁ ভাই। আর বলিস না! এইমাত্র চোখে পড়লো। ছি ছি। ঠিক করে দিয়েছি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সত্যিই এক কিংবদন্তী শিল্পী। তবে ওনার গাওয়াা "কে জাগে" গানটি প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। সজনীকান্ত দাসের লেখা কবিতায় সুর দিয়ে তিনি এই অসাধারণ উপস্থাপনা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন বিগত শতকের সত্তরের দশকে।
মাধব বাবু, ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। 'কে জাগে' গানটি আমিও শুনিনি, মনে হচ্ছে। এবার অবশ্যই শুনবো।