ভোটের কাঠি পড়লে কি আর মাথা ঠিক থাকে? ছেলেবেলায় স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজলে যেভাবে পড়িমরি করে আমরা দৌড়তাম খেলার মাঠে, তারচেয়েও দ্রুতগতিতে রাজনীতির সেবাইতরা তাদের কথার পসরা নিয়ে মানুষের মাঝে, অলিতে গলিতে, বিশাল জনসভায় এসে হাজির হয়। এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে তারা যেন মানুষের কাছে ‘আমাকে দেখুন’ মার্কা অবয়ব নিয়ে আসতে উদগ্রীব। তবে কেবল আমাকে দেখুন বলেই এরা ক্ষান্ত হতে পারে না। কারণ নিজের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। সে নিজেও জানে আজ আমি যে দলে আছি, কাল সেই দলে নাও থাকতে পারি। নিজের প্রতি যার এত অনাস্থা, তার বিশ্বাস এর পরিসর কখনোই বিরোধীদলকে স্পর্শ করতে পারে না। এখানেই ঘটে বিপত্তি। হাজার হাজার কথার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের মন ভরে না। মানুষকে তারা তাদের ‘মন কি বাত’বলেই চলে।হাঁটু,কোমরের বাত মুখে উঠে আসে। সেই কথকথা শুনতে শুনতে নরনারায়ণ কখন যে ক্লান্ত হয়ে গেছি সেদিকেও হুঁশ থাকে না। না থাকাই স্বাভাবিক, অবিশ্বাসের তো কোন প্রান্তরেখা থাকেনা।
নির্বাচন এবং তাকে ঘিরে এই এত কথার ফুলঝুরি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আমরা শুনে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন, মানব সভ্যতা এক সংকটজনক অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। করোনা মহামারী এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে তার ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। করানার জন্য কি কি করা উচিত তা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। মুখে মাস্ক পরা থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা- এক বছর আগেই আমরা শিখে গেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই শেখা কেবলমাত্র নিজের তথ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে রেখে দিয়েছে,তা না হলে এই মহামারীর মধ্যেও প্রতিশ্রুতির ভাঙা রেকর্ড রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে সমাজকে, তথা যাদের সেবা করার জন্য রাজনীতিবিদদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা তাদের কেও বিপদে ফেলছে কোন অজ্ঞানতায়?দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি, তখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে প্রচার খানিক কম করলে মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যেত? জনগণ কি এতই নির্বোধ (যদিও তারা বলে মানুষ নাকি সব বোঝে) যে নেতাদের মনে জমে থাকা প্রতিশ্রুতি তারা বুঝতে পারত না? আসলে এর পিছনে লুকিয়ে আছে সেই অবিশ্বাস। একটি বহুল প্রচলিত প্যারাডক্স, যা প্রিজনার্স প্যারাডক্স নামে খ্যাত এই বিষয়টিকে আমাদের বুঝতে কিছুটা সাহায্য করবে।
ধরা যাক দুই কয়েদি ‘ক’ আর ‘খ’ দুটি পৃথক কক্ষে বন্দী। তারা দুজনেই একই ঘটনার কারণে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, যদিও পুলিশের কাছে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। পুলিশ প্রথমে ‘ক’ এর কাছে গিয়ে বলল, সে যদি ‘খ’এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তাকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে, যদিও ঐ সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে ‘খ’ এর ৫ বছরের জেল হয়ে যাবে। অন্যদিকে ‘ক’ যদি চুপ থাকে, আর ‘খ’ ‘ক’ এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, তবে ‘ক’ এর ৫ বছরের জেল হয়ে যাবে ‘খ’ বিনা বিচারে ছাড়া পেয়ে যাবে। যদি ‘ক’ এবং ‘খ’ দুজনই দুইজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে দুইজনেরই ৩ বছরের জেল হবে। আর যদি দুজনেই চুপ থাকে, তবে দুজনেরই ১ বছরের জেল হবে। সাধারণভাবে মনে হতে পারে, চুপ করে থাকাটাই তাদের জন্য ভালো, কারণ সেক্ষেত্রে দুজনেরই ১ বছরের জেল হবে। কিন্তু দুজনেই আলাদা ঘরে বন্দী, তাদের ‘ঘড়ি’ ‘বাড়ি’ আলাদা, তাই একজনের পক্ষে জানা সম্ভব নয় অন্যজন কি বলছে, বা ভাবছে, অথচ তাদের ভাগ্য শুধু নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে না, অপরজন কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে একইসাথে তার উপরও নির্ভর করবে। এখানেই এক অজ্ঞানতা, এক অবিশ্বাস। তারা জানে না কে কি বলবে, বিশেষ করে দুজনই যেখানে অপরাধী। তারা কি একে অপরের উপর ভরসা রাখতে পারবে? কি নিশ্চয়তা আছে যে, দুজনেই চুপ করে থাকবে? কেউতো বেশি লোভে অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে দিতেই পারে, যেন সে মুক্তি পায়। সেক্ষেত্রে অন্যজন ৫ বছর পর্যন্ত জেলে থাকবে। এখানেই অজ্ঞানতা, ভয় মিশ্রিত ভবিষ্যতের ছায়া। শুধু নিজের ভবিষ্যৎ কে সুরক্ষিত করার জন্য, অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে নিজের ৫ বছরের কারাদণ্ড কে বাঁচাতে গিয়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড কে সুনিশ্চিত করবে তারা, যদিও মাত্র ১ বছরের কারাদণ্ড এক অন্ধকার স্থান-কালের মোড়কে তাদের হাতেই ছিল।
নিজেদের মধ্যে সামান্য পারস্পরিক বিশ্বাস থাকলে তাদের কাঙ্খিত সুখের জন্য সাধারণ মানুষকে নিজের প্রাণ বলি দিতে হতো না। যদিও একথা ঠিক কেবল সভা-সমিতি কম করলেই করনা বিলুপ্ত হত না। কিন্তু মানুষের সেবায় যারা নিয়োজিত, তারা অন্তত এইটুকু বলতে পারতো যে আমরা একটা প্রচেষ্টা করেছিলাম অন্তত। মানুষের প্রাণ বলিত হলো কিন্তু এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে সুখ তুমি চেয়েছ সে সুখ কি তুমি পাবে? আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি একাধিক নির্বাচন প্রার্থী এই করোনার জন্য গত হয়েছেন এবং আরো অনেক প্রার্থী এখনো করণা আক্রান্ত। তাদের সকলের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি, কিন্তু সুখ!! সে কি তোমার হাতে, তোমার মতন করে ধরা দেবে? তবেতো আগে জানতে হবে সুখ কি?একটি গল্প বলা যাক
…সদ্য পঞ্চম কন্যার পিতা হওয়া এক গরীব মানুষকে তারই এক ধনকুবের বন্ধু বলে বসলো, তোমার মতন সুখী এখন আর কে আছে বলও।স্বভাবতই কথাটি ওই গরীব পিতার কানে শ্লেষের মতন শোনায়। আশ্চর্য হয়ে সে জানতে চায় যে মানুষটির এতো বিত্ত, সে সুখী না হয়ে কোন যুক্তিতে এই অভাবী কন্যার পিতা সুখী হলও?...আশা করি তোমার চাওয়ার শেষ ঘটেছে,উত্তরে ওই ধনকুবের মুচকি হেসে বলতে শুরু করলো, কিন্তু আমার তো এখনো চাওয়ার শেষ হয়নি, বিত্তের বাসনা এখনো আমায় আকুল করে, এবারে তুমি বলো তাহলে সুখী কে?
গল্পে কিছুটা আদিরসাত্মক ব্যঞ্জনা থাকলেও, সুখ কে চেনার যে ইঙ্গিত এখানে রয়েগেছে তা অনেকাংশেই মহাভারতের বন পর্বের বক ও যুধিষ্ঠির মধ্যের কথোপকথনের সেই অংশের কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে বক যুধিষ্ঠির কে যখন প্রশ্ন করেছিলো জগতে সুখি কে? আমরা জানি যুধিষ্ঠিরের কথায় যে ব্যক্তি অঋণী, নিজ গৃহে দিনান্তে সামান্য শাকান্ন গ্রহণ করতে পারে সেই সুখী। সুখ এক রকমের ভিত্তি ভুমি(ground state), সাম্যাবস্থা, সব চাওয়ার শেষ(ধনকুবেরের যুক্তি)। বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলতে গেলে জগতে সকল বস্তুরই এক স্বাভাবিক প্রবণতা নিম্ন শক্তিস্তরে নিজেকে স্থাপন করা(তারাও কি সুখ খুঁজছে?)। আমরা যখন একটি বস্তুকে মাটির থেকে উঁচু কোনও স্থানে বসাই, তখনই সে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে, আর সেই শক্তি খরচ করে নীচে, ঐ ভিত্তি ভুমিতে সে আসতে চায়। কেবল স্থূল বস্তু নয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরমাণুর জগতেও এই জাতীয় ঘটনা নিদর্শন আছে। পরমাণুর কেন্দ্রে ধাকা নিউক্লিয়াসের চারপাশে পাক খেয়ে চলা ইলেকট্রনের প্রবৃত্তিই হলও নিম্ন শক্তিস্তরে থাকা।সকল জড় “নিয়ম মেনে” সুখি হতে চায়, কিন্তু সম্ভবত দেহধারী মানুষের মধ্যেই এর ব্যাতিক্রম দেখা যায়। এই কসমোপলিটনের যুগে(যেখানে নিবাস একটা অর্থহীন কথা প্রায়) পকেটে ক্রেডিট কার্ড রেখে, নামিদামী রেস্তোরাঁয় ভোজন করে সুখ পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছি এবং সেই সুখকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন রকম ওষুধও সেবন করে চলেছি।নানা ভাবে চেষ্টা- যদি আরও একটু সময় সুখ থাকে! কিন্তু থাকে না।আকাঙ্ক্ষার অভিস্মৃতির বদলে অপস্মৃতি ঘটে। নতুন সুখ কে পেতে গেলে আগে দুঃখ কে স্পর্শ করতে হয়, কারণ প্লেটোর মতে সুখ কে সুখ না বলে দুঃখের নিরসন বলাই শ্রেয়, যেমন আবার ন্যায় মতে ২১ রকমের দুঃখের অন্তিম রূপটি হলও সুখ।তোমরা কি তেমনই সুখ চাও, টেলিভিশনের পর্দায় লাগাতার মৃত্যু সংবাদ আমাদের কেন জানি সেই ভাবনার দিকেই নিয়েচলেছ।‘মৃতের নগরীতে তুমি কার রাজা হবে অয়দিপাউস’।
তাহলে সুখের মাপকাঠি কি? কিভাবে সুখ আসে? সুখবাদ অনুযায়ী সুখের চালিকা শক্তিকে আমরা তিনটি তত্ত্বের আলোয় দেখতে পারি ১) সেট পয়েন্ট তত্ত্ব, ২) তুলনার তত্ত্ব এবং ৩) অনুভূতির তত্ত্ব। সেট পয়েন্ট তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্কে সুখের একটি সাম্যবিন্দু(equilibrium point)থাকে। আমরা যতই অতিরিক্ত সুখ কিংবা দুঃখ পাই না কেন, সময়ের সাথে সাথে আমাদের সেই অনুভূতি ক্রমশ হ্রাস প্রাপ্ত হতে থাকে।যে ব্যক্তি হঠাৎ লটারি পেল, কিম্বা যে মনে প্রচণ্ড আঘাত পেল, দুজনেরই সুখ বা দুঃখর অনুভূতি প্রথমে সাম্যাবস্থা থেকে ছিটকে সরে গেলেও, ক্রমশই তা আগের থেকে তৈরি থাকা সুখ-বিন্দুর(সেট পয়েন্ট) অভিমুখে চলতে থাকে। হঠাৎ পাওয়া একরাশ অর্থও আমার সুখানুভূতির ঐ বিন্দু কে চিরকালের জন্য স্থানচ্যুত করতে পারেনা। সময় তাকে তার মূল বিন্দুতে আবার ফিরিয়ে আনে, আমরা আবার আগের আমি হয়ে যাই-‘ন বিত্তেন তৰ্পণীয়ে মনুষ্যো’।
তোমরাও যখন ভোটে জিতে সিংহাসনে বসবে, তখন কি সেই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবে? না হবে না, তোমায় নতুন সুখের সন্ধান করতে হবে।কে কোন মন্ত্রী হলে, কে মন্ত্রিত্ব পেলে ন্ সেই চিন্তায় আবার হাহুতাশ জন্ম নেবে। নিজেরই অজান্তে তখন হয়তো বলে ফেলবে ‘এতো বছর দল করে এই পেলাম?’ তোমার সুখ উধাও হবে, আবার দম বন্ধ করা পরিস্থিতি, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু সুখ কৈ? তখন কি মনে পরবে সত্যিই অক্সিজেনের অভাবে দম নিতে না পারা মুখ গুলো। এই ভাবে যাদের আপনজন চলে গেল তাদের সমষ্টিগত বেদনার ভার কি তোমার ক্ষনিকের আনন্দ বহন করতে পাড়বে? এই ক্ষতিকে পূরণ করার ‘দম’ বা ‘হিম্মত’ তোমার সুখের আছে? নেই, কারণ যে সুখ তোমার ক্ষণিকের সঙ্গী, দুঃখের ভার সে কি করে বহন করবে? তাহলে এক মুহূর্তের ক্ষণিক তৃপ্তির জন্য এতো এতো প্রাণ, শুধু তোমাদের অবিশ্বাসের স্বীকার, এ তুমি কেমন রাজন।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই এখন সুখ। আয়রনি
Prisoners’ dilemna অধিকাংশ সামাজিক সমস্যারই মূল। কমিউনিটি , ট্রাস্ট , কোঅর্ডিনেশন ইত্যাদি ছাড়া সমাজে সামগ্রিক ভারসাম্য , বৃহত্তম মোট সামাজিক উপযোগ ও জনকল্যাণ সম্ভব নয়। তাতে প্রতিটি সদস্যের সঠিক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।