কিছু কিছু বই ইদানীং দেখলে কেমন গায়ে জ্বর আসে। সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। গুরুগম্ভীর কথার আড়ালে শুধুই ওপরচালাক ভাবনাচিন্তা। সত্যিকারের দেশ কাল সমাজের চিহ্নমাত্র ওসব বই-এ খুঁজে পাই না। দেবাশিস আইচের ‘দুঃসময়ের আখ্যান’ হাতে নেবার সময়, কেন জানি না তেমনই একটা ভাব মনে জেগেছিল, অস্বীকার করব না। কিন্তু দেবাশিসের বইটি নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে মুগ্ধ হয়ে নিজের পুরোনো স্নবারি থেকে বেরিয়ে এসেছি টেরও পাইনি।
দেবাশিস দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে সমাজকে যে দেখেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই বইটি পড়তে পড়তে। দেখেন বলা ভুল। বোঝা যায় অত্যন্ত সংবেদী মন নিয়ে ও সমাজকে ভালোবাসেন, গভীর দরদ দিয়ে। এ বইতে তিনি এদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপজ্জনক, সংঘ পরিবারের রাজনীতিকে যেমন তুলোধোনা করেছেন, তেমনই কাশ্মীরের জনজীবন বা অসমের মানুষজনের ব্যথাও অনুভব করেছেন।
তিনশো তিন পাতার ঝকঝকে ছাপা বইটি ভাগ করা হয়েছে একাধিক অধ্যায়ে। সাত পর্বের প্রথমেই আছে সঙ্ঘী ফ্যাসিবাদী অভিযান। দ্বিতীয়, অসমের নাগরিক পঞ্জি, তৃতীয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অর্থনীতি, চতুর্থ, এদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন। পরের তিন অধ্যায়ে পরপর এসেছে, বনবাসী অধিকার, বানভাসি জীবন সরেজমিনে দেখার অভিজ্ঞতা ও হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ।
২০১৬, ৮ নভেম্বর বিমুদ্রাকরণ ঘোষিত হওয়ার পরের দিন ব্যাংকের সামনে উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়।
বইটির ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন, এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যকারী, একাধিপত্যবাদী একটি সরকার বিগত সাড়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে (এখন তা আরও বেশি সময় পার করেছে) সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—মোদ্দা কথায় সামগ্রিক নাগরিক জীবনে একের পর এক প্রলয় নামিয়ে এনেছে। এত স্বল্পসময়ে এমন ভয়াবহতা এ দেশ কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। নোটবন্দি দিয়ে যার আনুষ্ঠানিক শুরু আপাতত ‘নাগরিক সংশোধনী আইন’ (সিএএ) দিয়ে যার শেষ। আধিপত্যবাদী এই সুনামির ধাক্কায় দেশটা যেন দিশেহারা। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে অসংখ্য মানুষের জীবন। অর্থনৈতিক সংকট চরমসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে।
দেবাশিস এও জানিয়েছেন যে এই বিপন্নতার আখ্যান কোনো একজনের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এই অন্ধকার সময় নিয়ে আরও অনেকেই লিখছেন। লিখবেনও। তাতেও সাংবাদিক সমাজকর্মী দেবাশিস আইচের ভূমিকা একতিলও খাটো হয়ে যাবে না। আজকের ভারতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে লড়াই যত প্রয়োজন, ঠিক ততটাই এখন দরকার তাত্ত্বিক বিতর্কের। দেবাশিস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই প্রয়োজনীয় কাজটি করে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই এ যারা অগ্রণী সেনানী তাদের হাতে আরও কিছু অস্ত্র তুলে দিয়েছেন।
প্রবন্ধ ধরে ধরে বইটি নিয়ে আলোচনা করাই যায়, কিন্তু তাতে এ লেখা এতই স্থূলকায় হবে যে এই বিশেষ পরিসরে সেটা অতিরিক্ত মনে হবে। তার চেয়ে আপনারা বইটি কিনে পড়ে ফেলুন। এক নিঃশ্বাসে যা শেষ করতে হবে, এটা নিশ্চিত বলতে পারি। এখানে বরং আমার নিজের খুব পছন্দের একটি লেখা নিয়ে দু-কথা বলি—এক ‘দেশদ্রোহী’ পাদরি ও রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী অভিযান। এটা হচ্ছে দেবাশিসের নেওয়া ফাদার স্ট্যানস্বামীর সাক্ষাৎকার। এমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাত্কার অন্তত বাংলা কাগজপত্তরে খুব কম দেখেছি।
ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে তাঁদের আন্দোলনে শামিল স্ট্যানস্বামী, এস জে
দেবাশিস লিখছেন, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের দিনগুলো থেকেই আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হন ফাদার ।পরে চলে এলেন পশ্চিম সিংভুমের এক গ্রামে । মিশে গেলেন আদিবাসীদের সঙ্গে । শিখলেন হো ভাষা। বুঝলেন কিভাবে আদিবাসীদের ঠকানো হয়। স্ট্যান সাহেবের ইন্টারভিউ পড়েই জানলাম যে, ২০০১থেকে ২০১০ অবধি ঝাড়খণ্ড এ তথাকথিত শিল্প স্থাপনের জন্য অন্তত একশো ‘মউ’ সই হয়েছে ।কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ১.৪ লক্ষ হেক্টর জমি।মনে রাখবেন এই ঝাড়খণ্ডে প্রায় চল্লিশ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করেন।খুব গুরুত্বপূর্ণ এই ইন্টারভিউ নিয়েই একটা বুকলেট বের করা দরকার ।
কত কত বিষয় উঠে এসেছে লেখকের কলমে। এদেশে রোজ তিরিশজন চাষি আত্মহত্যা করেন। প্রতিদিন যক্ষায় ১১৫৩ জন এদেশে মারা যান। ৫৮ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। যে মুসলিম-বিদ্বেষ রোজ বিজেপি ও সংঘ পরিবারের লোকজন জনমনে চারিয়ে দিচ্ছে তার মূল জিগির হচ্ছে ভারতে তথাকথিত ‘সংখ্যালঘু তোষণ নাকি সীমাহীন’। বাস্তবে সারাদেশে কর্পোরেট চাকুরে মুসলিম সংখ্যামাত্র ৪ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারি সংস্থায় সেই সংখ্যা সাত শতাংশ মাত্র। পশ্চিমবঙ্গে আরও কম—মাত্র দুই শতাংশ। মানব উন্নয়ন সূচকে যেখানে শ্রীলঙ্কার স্থান ৭৯। চিনের ৮৫ সেখানে ভারতের ১২৯ মোটে। অথচ পাশাপাশি দেশের বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ৯৫৩ জন। তাঁদের মাথাপিছু সম্পদ ২২০০ কোটি টাকা।
কাশ্মীর নিয়ে লেখা এমন মন ছুঁয়ে যায় যা পড়তে পড়তে দেবাশিসের ভেতরের এক কবিকে চিনে নিতে পাঠকের অসুবিধে হবে না। শুরুটা বেশ নাটকীয়— কেমন আছে কাশ্মীর? যেটুকু যা খবর এই অবরুদ্ধ রাজ্য থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পৌঁছাচ্ছে তা আশঙ্কা ও উদ্বেগকেই বাড়িয়ে তোলে। এই বাক্য দিয়ে শুরুতেই দেবাশিস বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে কাশ্মীর আজ অশান্ত।
ঠিক তেমনই অসমের এনআরসি-সিএএ নিয়ে লেখকের উদ্বেগ আমাদের অন্য এক ভারতের ছবি সামনে আনে। আর সেই ছবির পরছবির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই যে বই হালকা ভাবে পড়তে শুরু করেছিলাম তাই পড়তে পড়তে ক্রোধে যন্ত্রণায় চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ কোন্ ভারত? দেবাশিস ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে চমৎকার ভাবে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। যার সঙ্গে কী অদ্ভুত সাদৃশ্য এ দেশের বর্তমান শাসকদের। কর্পোরেট শক্তিকে নিরাপত্তা দেওয়া, মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা কিংবা নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম, ধর্ম ও সরকারের মেলবন্ধন সব ক-টি বৈশিষ্ট্য যা ছিল হিটলার মুসোলিনির রাজনৈতিক অস্ত্র, ঠিক তাই-ই আজ বিজেপি ও সংঘ পরিবারের মূল হাতিয়ার।
হতে পারে দেবাশিসের লেখা সময় সময় আমাকে একটু বেশির কম আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। তার কারণ হতে পারে দেবাশিসের লেখা পড়তে পড়তে চোখের সামনে আমার দেখা গুজরাত গণহত্যার স্মৃতি ভেসে উঠছিল। সেই আগুনে ঝলসে যাওয়া পাখির খাঁচা, বাচ্চা মেয়ের অর্ধদগ্ধ ইউনিফর্ম। হাহাকার, কান্না আর্তনাদ। টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার অসংখ্য কোলাজ।
স্মৃতিতে উঠে আসছে অসমের ছবিও। অসমের চল্লিশ লক্ষ লোক যখন বিদেশি বলে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিহ্নিত হলেন, ঘটনাচক্রে সেই সময় ছিলাম সীমান্ত অঞ্চল করিমগঞ্জে। সংখ্যাতত্ত্ব, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন—এসব ভুলে আমি তাকিয়েছিলাম সাধারণ মানুষের ভয়ার্ত, উদ্বিগ্ন মুখের দিকে। রাতে থমথমে করিমগঞ্জ। আচমকাই বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজার, থেমে যাওয়া বাস অটো, এমনকি যেন থমকে যাওয়া কুশিয়ারা নদী—সব মিলিয়ে শহরটা কেমন ভূতুড়ে চেহারা নিচ্ছিল। নদীর ওপারে সিলেটের আলো যেন আরও বেশি অন্ধকার করে দিয়েছিল করিমগঞ্জকে।
অসমে এনআরসি প্রক্রিয়ার সময় সরকারি দপ্তরে উদ্বিগ্ন আবালবৃদ্ধবনিতা
লালা, বদরপুর হায়লাকান্দি থেকে মিনিটে মিনিটে ফোন আসছিল। সাবধানে থাকুন বলে অনেকেই আমাকে সতর্ক করছিলেন। যাঁরা সতর্ক করছিলেন তাঁরা নিজেরা কিন্তু কেউই নিরাপদে নেই। এককলমের খোঁচায় তাঁরাও পরের সকালে ‘বিদেশি’ হয়ে যেতে পারেন।
দেবাশিসের গদ্য জটিল নয়। তবে কখনো-কখনো একটু আড়ষ্ট লাগে। প্রচুর খেটেখুটে অজস্র তথ্য দিয়ে চমৎকার গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে আমার মতে একটু যে খুঁত রয়ে গিয়েছে তা ওই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর যাপন নিয়ে দেবাশিসের অবস্থান। এখানে বাজার-চলতি যে ছক— ওই যে আমরা দুই সম্প্রদায়ের মৌলবাদের সমান বিরোধী বলে প্রাণপণে নিজেকে সেকুলার প্রতিপন্ন করার চেষ্টা দেবাশিসও সেই ছকের বাইরে যেতে পারেননি বাঁচাননি। ওঁর মুরশিদাবাদের বাউল-ফকির নিয়ে আলোচনা পড়ে আমার তেমনই খানিকটা মনে হয়েছে। আমি মনে করি এটি একধরনের ‘নরম হিন্দুত্ববাদ’, যা কিন্তু এদেশের হিন্দুত্ববাদেরই হাত শক্ত করে। দেবাশিস আইচের মতো আদ্যন্ত, প্রশ্নাতীত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ লেখকেরা এই কথা না বুঝলে আর কে বুঝবে!!!
শুধু ওই আপত্তিটুকু ছাড়া, তথাকথিত উজ্জ্বল ভারতের পাশাপাশি লেখক এক সত্যিকারের বিবর্ণ ধূসর ভারতের যে ছবি এঁকেছেন এ বইতে, বাংলা ভাষায় তেমন বই খুব বেশি অন্তত আমার চোখে পড়েনি। বইটি সময়ের এক দলিল হয়ে থেকে যাবে। দেবাশিস আইচকে কুর্নিশ। প্রকাশক অভিষেক আইচ ও অরিজিত ভদ্র এবং দ্য কাফে টেবল এইসময় এ বই ছেপে নিজেদের সমাজমনস্কতার পরিচয় আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছেন।
এই বইটার সফ্ট ভার্শন কেনা যাবে?
মূল বইটা পড়তে পারলে ভাল হত ।