সবাক চিত্রের শুরু
তিরিশের দশকে, ভারতে যখন বাঙ্ময় চলচ্চিত্র বা 'টকি' চালু হচ্ছে, সে সময় থেকে বাংলার চলচ্চিত্রের পতাকা ছিল মূলত নিউ থিয়েটার্সের হাতে। সে সময় বড় স্টুডিও ছিল তিনটে, যারা পরবর্তীতে ভারতীয় সিনেমায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। পুনার প্রভাত (১৯২৯), বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠিত কলকাতার নিউ থিয়েটার্স (১৯৩০) এবং বোম্বের হিমাংশু রাইয়ের বোম্বে টকিজ (১৯৩৪)। (১)
তিরিশের দশকের অন্তত প্রথম ভাগ ছিল বাংলার ভদ্রলোক সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। যদিও দেশবন্ধু গত হয়েছেন ১৯২৫ সালে, বাংলার কংগ্রেসের মধ্যে দলাদলি প্রবল, কিন্তু তার মধ্যেও সুভাষচন্দ্র বসু তারকা হিসেবে উদীয়মান, সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তাঁর উত্থান পরিদৃশ্যমান। রবীন্দ্রনাথ অবিসম্বাদিত ব্যক্তিত্ব হিসেব সাহিত্যে ভাস্বর। ১৯২৯ এ শেষের কবিতা প্রকাশ করে পুনর্যৌবন প্রাপ্ত হয়েছেন বলা যায়। সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলার প্রভাব প্রবল। এই উত্থান কিছুটা ধাক্কা খাবে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা এবং পুনা চুক্তির পর। ১৯৩২ সালে গান্ধি বাংলার ভবিষ্যৎ সরকারে ভদ্রলোকদের আধিপত্য সীমিত করে দেবন পুনায় বসে, যে সিদ্ধান্তে কোনো বাঙালি ভদ্রলোক নেতার মতামত নেওয়া হবেনা। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ফজলুল হক প্রাদেশিক সরকার গঠন করবেন ১৯৩৭ সালে। কিন্তু তারপরেও সুভাষ পরপর দুইবার সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হবেন, দ্বিতীয়বার গান্ধির সর্বাত্মক বিরোধিতাকে উড়িয়ে দিয়ে। তাঁকে অবশ্য অচিরেই পদত্যাগ করতে হবে তিরিশের দশকের শেষে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে দেশনায়ক উপাধি দেবেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি 'জাতিয়তাবাদী' এবং 'ভদ্রলোক' এই দুই ধারারই অংশ হিসেবে ১৯৩০ সালে নিউ থিয়েটার্সের জন্ম। এর আগের দশক থেকেই কলকাতার সিনেমা চর্চার ঘরানায় জাতিয়তাবাদী ধারা প্রবল ছিল। বিশের দশকে পার্শি ম্যাডান কোম্পানি বাংলার সিনেমায় ছিল প্রায় সর্বেসর্বা। তাদের বিরুদ্ধে ভদ্রলোকীয় সমালোচনার একটা বড় বর্শামুখ ছিল, যে, সিনেমাগুলি যথেষ্ট 'বাঙালি' নয়। ম্যাডান যে অবাঙালি প্রতিষ্ঠান, এবং শিল্পগতভাবে বাঙালির সংবেদনশীলতাকে ধরতে পারেনা, এ মোটামুটি সর্বসম্মত মতামত ছিল।(২) ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস প্রযোজিত 'ফ্লেমস অফ ফ্লেশ' নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায় কাছাকাছি সময়েই। বাংলার একটি পত্রিকা এই সিনেমার সমালোচনা করে লেখে "বাঙালি কোম্পানির প্রযোজনায় তৈরি সিনেমার অন্তত একটা বাংলা নাম দেওয়া উচিত ছিল। লোকে একে 'কামনার আগুন', বা 'লালসাবহ্নি', যে নামে খুশি ডাকছে, কিন্তু পর্দায় সেসব নামের কোনো চিহ্ন নেই। অবশ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের আনুগত্য যে ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের প্রতিই থাকবে এ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার"। (৩)
যে ঘরানা থেকে এই সমালোচনা লেখা, নিউ থিয়েটার্স মূলত সেই ঘরানারই প্রতিনিধিত্ব করত। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ভদ্রলোক, বাঙালি এবং জাতিয়তাবাদী। প্রসঙ্গত নিউ থিয়েটার্সের চিত্রা প্রেক্ষাগৃহ উদ্বোধন করেন সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং।
বাঙালিত্বের উত্থান
বাংলা সিনেমার ৩০ এর দশক মোটামুটি ভাবে নিউ থিয়েটার্স তথা বাঙালি ভদ্রলোকের উত্থানের সময়। এই উত্থানের কয়েকটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল, যার কিছু চেনা, কিছু অচেনা। এই সেই সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ মধ্যগগনে, শরৎচন্দ্র খ্যাতির শীর্ষচূড়ায়, এবং বাঙলার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ নিয়ে বাঙালি ভদ্রলোকের মনে কোনো সন্দেহ নেই। কাছাকাছি সময়েই রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তির ডাক দিয়েছেন, তৈরি হচ্ছে নানা বাঙালি প্রতিষ্ঠান। এই উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে নিউ থিয়েটার্স নিয়ে আসে সিনেমায়। বাঙালি সাংস্কৃতিক এলিটদের সঙ্গে নিউ থিয়েটার্সের সম্পর্ক ছিল গভীর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'নটীর পূজা' নৃত্যনাট্যটি শুট করেন এই সময়েই (১৯৩১)।
এখানে যে ব্যাপারটি কৌতুহলোদ্দীপক, যে, নটীর পূজা নিয়ে এলিট বঙ্গসমাজ বা অন্তত তার একাংশ উচ্ছ্বসিত হলেও এবং সিনেমাটি প্রবল হইচই করে মুক্তি পেলেও (১৯৩২), একেবারেই সাফল্যের মুখ দেখেনি। একই সময় একই ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে শিশির ভাদুড়ি পরিচালিত এবং শরৎচন্দ্র বিরচিত 'পল্লীসমাজ'। নিউ থিয়েটার্সের প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার পরবর্তীতে লেখেন, শিশির ভাদুড়ির পক্ষে তাঁর নাট্যচর্চার বৈশিষ্ট্যকে বর্জন করা একেবারেই সম্ভব হয়নি। সিনেমাটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি মঞ্চের চলচ্চিত্রায়ন। একই কথা নটীর পূজা সম্পর্কেও প্রযোজ্য ছিল। বীরেন্দ্রনাথ সরাসরি অবশ্য সে কথা লেখেননি। কিন্তু এ বোধ তাঁর অবশ্যই হয়েছিল, যে, সিনেমা একটি সম্পূর্ণ আলাদা মাধ্যম। সম্পূর্ণ আলাদা খেলার মাঠ। সেখানে উৎকর্ষ বা বাঙালিত্ব, যাই দেখাতে হোক, শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।
আন্দাজ করা যায়, এই দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যই নিউ থিয়েটার্স তৈরি করেছিল তার নিজস্ব 'আত্মশক্তি' এবং উৎকর্ষের কেন্দ্র। স্টুডিওটি ছিল অত্যুৎকৃষ্ট। কর্মসংস্কৃতি ছিল অসাধারণ। নিউ থিয়েটার্সের শব্দগ্রহণ ব্যবস্থার তদারকি করতে নিয়ে আসা হয়েছিল মার্কিন শব্দবিশেষজ্ঞ উইলফোর্ড ডেমিংকে। তিনি বোম্বে ঘুরে কলকাতা আসেন। তাঁর নিজের কথায় "বোম্বের তাড়াহুড়ো, আধাখ্যঁচড়া কাজকর্মের উল্টোদিকে, কলকাতা আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়েছিল। আমি দেখলাম এক ব্যবস্থার ভ্রূণ, যা একটা সত্যিকারের প্রোডাকশন ইউনিটে পরিণত হয়েছিল"। শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে, কিন্তু বস্তুত নিউ থিয়েটার্স সিনেমা উৎপাদন ব্যবস্থাটিই বদলে দিয়েছিল। শিল্পের মানোন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়েছিল স্ব-স্ব ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের, যাঁরা শুধু পদ্ধতিটি আয়ত্ত্ব করেননি, সে নিয়ে গবেষণা করতেও সক্ষম। ডেমিং কলকাতা ছাড়ার পর মুকুল বসু হয়েছিলেন শব্দগ্রহণের প্রধান, যিনি জগদীশচন্দ্র বসুর আত্মীয়, বসুবিজ্ঞানমন্দিরে রীতিমতো গবেষণা করেছিলেন এবং প্রথাগত প্লেব্যাক সঙ্গীত, তাঁর হাত ধরেই আসে ভারতবর্ষে। ক্যামেরার প্রধান ছিলেন নীতিন বসু। সঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন রায়চাঁদ বড়াল। ছিলেন তিমিরবরণ, পঙ্কজ মল্লিক। গানের সঙ্গে পশ্চিমী অর্কেস্ট্রা ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গত, এবং বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চমকপ্রদ ব্যবহার, তাঁরা যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে উচ্চতায় পরবর্তীতে খুব এক-আধবারের বেশি পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে বলে জানা নেই। একই সঙ্গে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব আসে টেকনোলজির হাত ধরেই। চড়া, উচ্চকিত সংলাপের বদলে নিম্নতারের সংলাপ, স্বরের ওঠানামা (সঙ্গীত এবং সংলাপ দুইয়েই)র যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীর মূলধারার ভারতীয় সিনেমা বছর পঞ্চাশেক সেসব আর ব্যবহার করেনি। এর সঙ্গে ছিলেন দেবকী বসু বা প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো মানুষেরা, যাঁদের পরিচয় নতুন করে দেওয়া বাতুলতা মাত্র।
মুক্তি ছবিতে রবীন্দ্রগান। দুটি জিনিস লক্ষ্যণীয়, ১। ব্যাকগ্রাউন্ডে ওয়ালজ ছন্দ এবং পাশ্চাত্য ধরণে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার। ২। গায়কী এবং সূক্ষ্ণ কাজ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এ গান বিশ্বভারতীর ছাড়পত্র পেত কিনা সন্দেহ।
সব মিলিয়ে সিনেমা যে শুধু শিল্প, অর্থাৎ মুনাফামুখী বাণিজ্য নয়, শিল্প অর্থাৎ কারুশিল্পও, এবং বহু শিল্পী, যাঁরা সিনেমারই শিল্পী, নাটকের বা কবিতার নন, তাঁদের এক যৌথ প্রকল্প, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এই ব্যাপারটি নিউ থিয়েটার্স আত্তীকরণ করতে সমর্থ হয়েছিল, সেই ৩০ এর দশকেই। এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাঙালি উৎকর্ষ ও সংবেদনশীলতার শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, এক কথায় সেই সময়ের ভদ্রলোকীয় সংস্কৃতি। এই দুটির মিশেলই বাংলায় নিউ থিয়েটার্সের সাফল্যের মূল ভিত্তি। সমসময়ের সিনেমার এবং ভদ্রলোকের সংস্কৃতির যা-যা দোষ ও গুণ, সবই এর মধ্যে ছিল। উচ্চবিত্ততা ছিল প্রকট, ভদ্রলোকের চিন্তার ধরণকেই গোটা বাংলার চিন্তার ধরণ হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা ছিল প্রবল, স্টুডিও নির্ভরতা তো অবশ্যম্ভাবী ছিল, এর প্রতিটি নিয়েই পরবর্তীতে সমালোচনা বা বিদ্রোহ সবই হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এলিটীয় শিল্পসাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে, তাকে একটুও লঘু না করে এলিট এবং সাধারণ মহলে একই সঙ্গে জনপ্রিয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার, সবই হয়েছিল এই আমলেই, যার ফলশ্রুতি চন্ডীদাস, দেবদাস বা মুক্তির মতো সিনেমা, যা একাধারে এলিট-প্রশংসিত এবং জনমোহিনী। রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র এই প্রকল্পে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁরা এর কেন্দ্রে ছিলেননা। সিনেমার জগতে তৈরি হচ্ছিল তার নিজস্ব আইকন। প্রাথমিক ব্যর্থতার পর নিউ থিয়েটার্স তৈরি করে গেছে একের পর এক সুপারহিট ছবি, এবং সঙ্গে তৈরি করে গেছে বঙ্গীয় সিনেমার নিজস্ব প্রতীকও। বস্তুত ভদ্রলোকের বাংলার সর্বপ্রথম সিনেমা-আইকন সেই সময়ের নায়িকা কানন দেবী, যিনি একাধারে অভিনয়ে জনতাকে মুগ্ধ করেছেন, এবং ফ্যাশানেরও রানী।
ব্যবসার কাঠামো
কিন্তু শুধু ভদ্রলোকের বাঙালিত্ব দিয়ে তো বাংলার বাজারের বাইরে পা রাখা মুশকিল। নিউ থিয়েটার্স সর্বভারতীয় বাজারে পা রেখেছিল এবং সেই বাজারে তার দখলদারিও কম ছিলনা। মুক্তি হোক, বা স্ট্রিট সিঙ্গার, এরা সবাই সর্বভারতীয় বাজারে বিপুল হিট। নিউ থিয়েটার্সের এই বিরাট সাফল্যের কারণ ছিল তার ব্যবসায়িক কাঠামো। খুব সংক্ষেপে, কাঠামোটি হল, অনেক ভাষায় একই সিনেমা। বাংলা ভাষার হিট সিনেমা চন্ডীদাসের হিন্দুস্তানি রিমেক বানানো হয় ১৯৩৪ সালে, এবং উত্তর ভারতে সিনেমাটি হিট করে। এর পর থেকেই নিউ থিয়েটার্স একই সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় একই সিনেমা তৈরি শুরু করে। তখনও ডাবিং প্রযুক্তি আসেনি, একই সেটে একাধিক ভাষায় একই সিনেমার চিত্রগ্রহণই ছিল সস্তা সমাধান (অনেকে এখন আক্ষেপ করেন, যে, বাংলা সিনেমা কেন অন্য ভাষায় ডাব হয়না, কিন্তু ডাবিং আবিষ্কারের আগেই এই পদ্ধতি বাংলা সিনেমা সাফল্যমন্ডিতভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছে)। প্রতিটি বিখ্যাত সিনেমাই এরপর একাধিক ভাষায় নির্মিত হয়। সে মুক্তিই হোক বা স্ট্রিট সিঙ্গার। আঞ্চলিকতা ভেদে দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার ভিন্নতার কথাও এক্ষেত্রে মাথায় রাখা হত। দেবদাসের বাংলা সংস্করণে যেমন নায়ক ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, কিন্তু হিন্দুস্তানিতে নায়ক হয়েছিলেন সায়গল। স্ট্রিট সিঙ্গারেও সায়গল ছিলেন, তাঁর 'বাবুল মোরা' এখনও হিন্দুস্তানী সিনেমায় ব্যবহৃত আধা-শাস্ত্রীয় গানের মধ্যে শ্রেষ্ঠগুলির একটি।
বিভিন্ন সংস্করণের সিনেমার বিপননেও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দেওয়া হত। বাংলা সিনেমার প্রচারে জোর দেওয়া হত দারুণ অভিনয়, দুর্ধর্ষ নির্দেশনা, এই সমস্ত বিষয়ে। আর হিন্দুস্তানি সংস্করণে জোর দেওয়া হত ঝকমকে উপস্থাপনার উপর। কোনো কোনো সিনেমায় হিন্দুস্তানি সংস্করণে কিছু অতিরিক্ত আবেগী উপাদান যোগ করা হত। যেমন 'দেবদাস'এ যোগ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি গান।
এই পদ্ধতিটি শুধু সেযুগে নয়, এখনও অভাবনীয়। আঞ্চলিকতাকে টপকে 'সর্বভারতীয়' বাজার ধরার এই পদ্ধতিটির এখনও পর্যন্ত একমাত্র সফল প্রয়োগকারী হল বাংলা সিনেমা। যদিও তেমনটি হবার কথা নয়, কারণ বহুভাষিক রাষ্ট্রে সর্বভারতীয় চরিত্র এমনটাই হবার কথা। কিন্তু স্বাধীন ভারতর্ষে এই সাধারণ-বোধ লুপ্ত হয়। কিন্তু তখনও সর্বভারতীয় বাজার দখলের এই একটি কার্যকর পদ্ধতিই আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই কারণেই কলকাতায় সে সময় অন্য ভাষার সিনেমাও প্রচুর তৈরি হত। এই পদ্ধতিতেই অন্যান্য ভাষাভাষি নায়ক-নায়িকাদের কলকাতায় আনাগোনা। সায়গল থেকে দুর্গা খোটে এভাবেই কলকাতায় অভিনয় করেছেন। সায়গল রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন, দুর্গা খোটে শোনা যায় দেবকী বসুর গালাগাল বোঝার জন্য বাংলা শিখেছিলেন। উল্টোদিকে, অর্থাৎ কলকাতা থেকে বোম্বে যাবার গতি ছিল খুবই সীমিত।
শুধু নিউ থিয়েটার্সই এই রাস্তায় হেঁটেছিল তা নয়। নিউ থিয়েটার্স ছিল সে সময়ের আইকন। কিন্তু বাংলার অন্যান্য ক্ষুদ্রতর ফিল্ম স্টুডিওদেরও পথ বিশেষ আলাদা ছিলনা। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও একই জিনিস করেছিল, এখন যাকে বলা হয় বি-গ্রেড সিনেমার ক্ষেত্রে। ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি একই জিনিস করেছিল বাংলার সঙ্গে আলাদা সংস্করণের তামিলে এবং তেলুগু সিনেমা বানিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ ভারত।
এ ছিল তিরিশের দশক। বাংলা সিনেমার সত্যিকারের স্বর্ণযুগ। একাধিক সংস্করণের কলকাত্তাইয়া সিনেমা ভারতবর্ষ জয়ের দিকে এগোচ্ছে। বোম্বের ফিল্মইন্ডিয়া পত্রিকা সতর্ক করে লিখছে, নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে বাকিদের প্রতিযোগিতা হল "গুণমানের সঙ্গে পরিমানের" প্রতিযোগিতা। বোম্বে থেকে অফার আসায় প্রমথেশ বড়ুয়া তখন নাকি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে বলেছিলেন, "ওই বাজারের মধ্যে কে যাবে"। তাতে আশ্চর্যর কিছু ছিলনা। বোম্বে মানেই সর্বভারতীয়, আর কলকাতা মানেই আঞ্চলিক, এই বোধই তখনও তৈরি হয়নি। কলকাতার অশ্বমেধের ঘোড়া তখন গোটা ভারতবর্ষে দৌড়চ্ছে। ভারতবর্ষ, অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতবর্ষ।
বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর
৪০ এর দশকে অবস্থা ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিতাড়িত হলেন। ১৯৪০ এ দেশ ছাড়লেন। ১৯৪১-৪২ এ নিউ থিয়েটার্সের সুখের সংসারে ভাঙন ধরল। এনটি ছেড়ে নীতিন, মুকুল, দুই বসু বোম্বে পাড়ি দিলেন। প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবীও নিউ থিয়েটার্স ছাড়লেন, যদিও কলকাতা ছাড়েননি। দুজনে মিলে এমপি প্রোডাকশনকে দিলেন তাদের সবচেয়ে বড় হিট ছবি 'শেষ উত্তর' এবং তার হিন্দি সংস্করণ 'জবাব'। 'জবাব'এই কানন দেবী গাইলেন তাঁর সুপার-ডুপার হিট গান 'তুফান মেল'।
এই ভাঙনের পিছনে নানা ব্যক্তিগত সমীকরণ, রাগ-অভিমান, এসব ছিল, সেসব এখানে আলোচ্য নয়। বাংলা সিনেমার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে এর খুব বড় প্রভাব পড়েনি। নিউ-থিয়েটার্সের দিক থেকে ব্যাপারটি সমস্যাজনক ছিল নিঃসন্দেহে। কারণ এর ফলে বাংলা সিনেমা মানেই নিউ থিয়েটার্স, এই ব্যাপারটিই আর রইলনা। নানা ছোটোখাটো বা মাঝারি প্রতিষ্ঠান উঠে এল প্রতিযোগিতায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নাম ছিল, নিঃসন্দেহে প্রমথেশ বড়ুয়া এবং মুরলিধর চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত এমপি প্রোডাকশান, যার নাম আগেই বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় এই, যে, তারা নিউ থিয়েটার্স থেকে বেরিয়ে এলেও, ব্যবসার কাঠামো কিন্তু বদলায়নি। সর্বভারতীয় ব্যবসার ছক তখনও সেই দ্বি বা ত্রিভাষিক ছবি। সেগুলি তখনও সুপারহিট।
নিউ থিয়েটার্সও বাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে একেবারেই না। কানন-প্রমথেশের অভাবে থেমে না থেকে তারা নিয়ে এসেছে, নতুন জুটিকে -- অসিতবরণ এবং ভারতী দেবী। সেই জুটিও সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে হিট। বিমল রায় তৈরি করেছেন হিট ছবি উদয়ের পথে, সেটিও দ্বিভাষিক। এ সবই ঘটে চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন। ফিল্ম উৎপাদনের সংখ্যার উপর সরকারি বিধিনিষেধ এসেছে। বোম্বে সিনেমার সংখ্যায় তখনও এক নম্বরে। নিউ থিয়েটার্স বাংলার প্রতিনিধিত্ব করার একচেটিয়া অধিকার হারিয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলা ছবির বিশেষ সমস্যা হয়নি। গুণমান এবং হিট ছবির প্রশ্নে কলকাতায় নির্মিত ছবি তখনও সর্বভারতীয় বাজারে একই জায়গায়। অর্থাৎ স্থিতাবস্থা বজায় আছে। যে শিল্পীরা কলকাতা ছেড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ফিরে আসবেন এর পর, কেউ কেউ ফিরবেননা। কিন্তু সেটাও তখনও পর্যন্ত সাধারণ চলাচলের নিয়মই, যে নিয়মে সায়গল বা অশোককুমার কলকাতা বোম্বে যাতায়াত করছেন, সেই একই নিয়ম। আলাদা করে বোম্বের অর্থনৈতিক শক্তি, বা অধিক সর্বভারতীয় পরিচিতি, এমন কিছু ঘটে যায়নি। একদম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, মাঝে ব্যাপক মন্বন্তর সত্ত্বেও এই জিনিস চলবে। বোম্বে-কলকাতা -- এই দ্বিমেরু ব্যবস্থার শক্তির স্থিতি বজায় থাকবে।
এর একদম প্রত্যক্ষ্য প্রমাণ দিয়েছেন শর্মিষ্ঠা গুপ্তু। বোম্বে থেকে অশোককুমার কলকাতায় এসে দেবকী বসুর দ্বিভাষিক সিনেমা চন্দ্রশেখর-এ অভিনয় করেন, যা মুক্তি পায় ১৯৪৭ সালে। অশোককুমার তাঁর জীবনী জীবননাইয়া-তে লিখেছেন, তিনি এর জন্য সেই সময়ের নিরিখে অকল্পনীয় অঙ্কের পারিশ্রমিক পান। টাকার অঙ্কে আড়াই লাখ। টাকা দেয় পাইওনিয়ার পিকচার, যা তুলনামূলকভাবে নতুন প্রতিষ্ঠান। ওই একই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য কানন দেবী প্রতীকী এক টাকা বেশি পারিশ্রমিক চান এবং পাইওনিয়ার পিকচার তাও দেয়। এর আগে বোম্বের আনন্দ পিকচার্স কানন দেবীকে দুই লক্ষ টাকা দেবার প্রস্তাব দেয়, টাকার এত বড় অঙ্কও এর আগে শোনা যায়নি।
এই প্রমাণসহ শর্মিষ্ঠা লিখেছেন, সিনেমার কেন্দ্র হিসেবে বোম্বের পাশাপাশি কলকাতার অবস্থান তখনও অটুট।(৫) অর্থনীতির বিচারে একই ভাবে টক্কর দিচ্ছে। বোম্বের উৎপাদনের যদিও নিউ থিয়েটার্সের চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু কলকাতার সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার লক্ষ্য কিছু বদলায়নি। এটি কলকাতার ফিল্ম শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা, বলাবাহুল্য নিউ থিয়েটার্সের প্রশ্নাতীত প্রাধান্য আর নেই। এটা ১৯৪৭ সালের কথা।
দেশভাগ
বোম্বে নয়, বাংলা সিনেমার উপর আঘাত এল সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ঘটল সেই কান্ড, যার নাম দেশভাগ। বাংলার উপর দেশভাগের প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। চটশিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, খাদ্যাভাব, সবকিছু সংকটেরই একটি বড় কারণ দেশভাগ। কিন্ত তাৎক্ষণিক ভয়াবহ প্রভাব, সে ব্যাপারে সিনেমাই সবার উপরে থাকবে।
জয়া চ্যাটার্জি দেখিয়েছেন, বাংলা ভাগের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের একমাত্র মাথাব্যথা ছিল স্বাধীন পশ্চিমবাংলায় ভোটে জেতা।(৬) অবিভক্ত বাংলার উপর দিয়ে একটি লাইন টেনে দু-টুকরো করে দেবার সময় তাঁরা স্রেফ ভোটের হিসেব মাথায় রেখেছিলেন, যাতে নির্বিঘ্নে জেতা যায়। আর কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাননি। এবং এই টুকরো করার ব্যাপারে জনতার কোনো মতামত কখনই নেওয়া হয়নি। হৈমন্তী রায় দেখিয়েছেন, এ ব্যাপারে আমজনতার মধ্যে বিভাজনের পক্ষে তীব্র মতানৈক্য ছিল।(৭) পূর্ব এবং পশ্চিমের বাঙালি নেতাদের একটা অংশ অখন্ড বাংলার পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতই তাঁরা মেনে নেন। শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের বড়দা শরৎ বসুই টিকে ছিলেন অখন্ড বাংলার দাবীতে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গণভোট হলে, এই বিভাজন হবেনা। কিন্তু সে গণভোট কখনও হয়নি।
ফলত, দেশভাগ হয় সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাদের ইচ্ছেয়। এবং ঠিক তার পরই বাংলা সিনেমা আবিষ্কার করে, তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। সর্বভারতীয় হওয়া তো দূরস্থান, তার নিজের ভাষার সিনেমা বিক্রিরই আর জায়গা নেই। যে সমস্ত হলে সিনেমা দেখানো হত, তার ৫০% ই চলে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানে সিনেমা দেখানো এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আওতায়। পাকিস্তানি সরকার ভারত থেকে সিনেমা আমদানির উপর বিধিনিষেধ জারি করে। আর ভারত সরকারও চাপায় শুল্ক। হঠাৎ যদি একটি বাড়ন্ত বাচ্চার একটি হাত এবং একটি পা কেটে ফেলে তাকে দৌড়তে বলা হয়, অবস্থা দাঁড়ায় সেরকমই। অবস্থা কতটা ভয়াবহ ছিল তার নিখুঁত পরিমাপ পাওয়া যায় বেঙ্গল মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির লেখায়ঃ " মোটামুটি হিসেব করলে দেখা যায়, যে, বাংলার স্টুডিওগুলি তিন শিফটে কাজ করলে বছরে অন্তত ১৫০টি কাহিনীচিত্র তৈরি করতে পারে, কিন্তু রিলিজের এখন যা সুযোগসুবিধা, তাতে আমরা বড়জোর ৫০টি ছবিকে আঁটাতে পারি... দেশভাগের কারণে পূর্ব বঙ্গের বাজার এখন বাংলা সিনেমার হাতছাড়া"। (৮)
দেশভাগের দ্বিতীয় যে মারাত্মক প্রভাব বাংলায় পড়ে তা হল অর্থের যোগানের সমস্যা। সিনেমাশিল্পের উপর এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ, কিন্তু সে নিয়ে আলোচনা তেমন নজরে পড়েনা। দেশভাগের আগে কলকাতা ছিল অর্থনৈতিক কারবারের বড় কেন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং মন্বন্তরের পর সেই অর্থনৈতিক জোর কমে আসে। কিন্তু দেশভাগের প্রভাব, ব্যাংকিং শিল্পের উপরেও প্রায় সিনেমাশিল্পের মতোই তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। দেশভাগের ঠিক আগে অবিভক্ত বাংলায় ছিল ১৮ টি ব্যাংকের প্রধান কেন্দ্র। দেশভাগের ফলে পঞ্চাশের দশকে এর এক তৃতীয়াংশ (৭টি) সরাসরি ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে ১৯৫০ সালে নাথ ব্যাংকের পতন, কলকাতার ব্যাংকিং-কাঠামোকেই ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছিল। বাকি এক তৃতীয়াংশ আদালতের দ্বারস্থ হয়, তাদেরও কেউ কেউ উঠে যায়, কেউ কেউ অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোনোক্রমে টিকে থাকে। এর মধ্যে মাত্র একটি ব্যাংকই অবিকৃত অবস্থায় আজও টিকে আছে (এলাহাবাদ ব্যাংক)। (৯)
মোট কথা দেশভাগের ফলে বাংলার ব্যাংকিং শিল্পে প্রবল সংকট আসে। কলকাতার সিনেমা শিল্পের চরিত্রই এমন ছিল, যে, দ্রুত ফিনান্সের জন্য তারা ব্যাংকের উপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল। ফলে ব্যাংকের সমস্যা সরাসরি সিনেমা শিল্পের সমস্যা হিসেবেই দেখা দেয়। এই সংকট কত বড় ছিল, তা একটি ঘটনা দিয়েই বোঝা যাবে। ১৯৫৪-৫৫ সালে ক্যালকাটা ন্যাশানাল ব্যাংক উঠে যায় (১৯৪৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ১৭ টি শাখা ছিল)। এই ব্যাংকই ছিল নিউ থিয়েটার্সের মূল অর্থ যোগানদার। সেই ধাক্কা, এমনকি নিউ থিয়েটার্সের মতো প্রতিষ্ঠানও সামলাতে পারেনি। তাদের ফিল্মোৎপাদন, কাছাকাছি সময়েই কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
অর্থাৎ, যুগপৎ দুটি সমস্যা একসঙ্গে বাংলা শিল্পের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদিকে বাজার হয়ে যায় অর্ধেক। অন্যদিকে পুঁজির যোগানও এসে ঠেকে তলানিতে। মনে রাখতে হবে, এসব কোনো অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, শিল্পগত অদক্ষতা, বা বাজারের চলনের ফলাফল নয়। এর একমাত্র কারণটি রাজনৈতিক, যার নাম দেশভাগ।
বোম্বে এই সমস্যায় পড়েনি। পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বাজার তাদের হাতছাড়া হয়েছিল বটে, কিন্তু পূর্ব বাংলার বাজারের তুলনায় ভগ্নাংশের হিসেবে তা ছিল যৎসামান্য। অন্য দিকে অর্থের যোগানের কোনো সমস্যা তো আদৌ ছিলই না, বরং বিশ্বযুদ্ধের অকল্পনীয় মুনাফার অংশ বিনিয়োগ করা হচ্ছিল বোম্বের সিনেমা শিল্পে। বিনিয়োগের প্রশ্নে দক্ষিণও এগিয়ে আসছিল। বাংলা হঠাৎ করে, আচম্বিতে তলিয়ে যাচ্ছিল অতলে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি যেভাবে বদলায়, তাকে নাটকীয় বললেও কম বলা হয়। ৪৭ সালে চন্দ্রশেখর-এ অশোক কুমারকে রেকর্ড অর্থ প্রদান করা হয়েছিল। আর ৪৮ সালে রূপমঞ্চ বাংলার সিনেমার বাজেট কমিয়ে আনার পক্ষে সওয়াল করে। কত কম? ৭০ হাজার টাকা, পারলে ৫০, যাতে করে বাংলার বাজার থেকে টাকাটা উঠে আসে। বাংলার বড় বাজেটের সিনেমা চন্দ্রশেখরেই শেষ, ৪৭ সালে। আর ৪৮ এই দক্ষিণের জেমিনি স্টুডিও নিয়ে আসে তাদের চমকপ্রদ হিন্দুস্তানি ছবি চন্দ্রলেখা, যার বাজেট ছিল ৩ লাখ টাকা। পরের বছরই তৈরি হয় ভারতের প্রথম টেকনিকালার ছবি মেহবুব খানের আন। বড় বাজেটের চমকপ্রদ হিন্দি ছবির একটি ঘরানা তৈরি হয়। বাংলার তখন সর্বভারতীয় আকাঙ্খার আর কোনো জায়গাই নেই। নিজের বাজারে কোনোমতে টিকে থাকার জন্য লড়ছে। এই সময়ের বাংলা ছবিগুলিতেও সেই লড়াই স্পষ্ট। বাংলায় পরপর তৈরি হতে থাকে জীবনী ছবি। অন্য একটি ঘরানাও তুমুল জনপ্রিয় হয়, তা হল দেশপ্রেম। ৪৮ এ তৈরি হয় ভুলি নাই, ৪৯ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ৫১ সালে বিয়াল্লিশ। এক আধটি হিন্দি ছবিও হচ্ছেনা তা নয়, যেমন, ৫০ সালে পহেলা আদমী। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কম বাজেট ছাড়াও এদের প্রতিটিরই মুখ্য দিক হল বাঙালি আবেগের মন্থন। সর্বভারতীয় যে আর হওয়া যাবেনা, লড়াইটা আঞ্চলিক ভাবে টিকে থাকার, দেশভাগের পরের বছরই সেই দেয়াল লিখন পরিষ্কার হয়ে যায়। সর্বভারতীয় এবং বাংলা সিনেমা কোন কক্ষপথে চলবে, সেটাও ওই সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলা সিনেমা হবে কম বাজেট। সে বাঙালি আবেগের কাছে আবেদন রাখবে। তার নিজের যে জোরের জায়গা সে ধরে রাখবে, তা হল একরকমের 'রিয়েলিজম', বাস্তবতাকে নির্মাণ করা হলেও, তা হবে কাহিনী, স্ক্রিপ্ট এবং অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে। অর্থাৎ তার 'শিল্প'এর জায়গাটি সে ধরে রাখবে ( এই কারণেই বিয়াল্লিশ বা ভুলি নাই দেখলে এখনও 'অনাধুনিক' মনে হয়না)। আর সর্বভারতীয় সিনেমা চলবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, চমক তৈরি, তারকা ব্যবস্থার উপরে অত্যধিক জোর দেবার পথে। রিয়েলিজম থেকে সে সরে যাবে, তার মুখ্য উদ্দেশ্য হবে আনন্দদান। এই ঘরানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই এবার গড়ে উঠবে সমতল এক ভারতীয়ত্ব।
বাংলা সিনেমার সর্বভারতীয় যাত্রা এখানেই শেষ হলেও, শিল্পীদের আকাঙ্খা তো শেষ হয়নি। তাঁরা এর পরেও সর্বভারতীয় পরিচিতি চেয়েছেন, সঙ্গে বেশি অর্থও নিশ্চয়ই চেয়েছেন। তার জন্য ভাষা বা ঘরানা পরিবর্তনে তাঁরা দ্বিধা করেননি। প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল ৪৭- ৫০ সালের মধ্যেই বাংলা ছাড়েন বিমল রায় সহ অন্তত জনা পঞ্চাশেক শিল্পী। তাঁরা প্রতিভাবান ছিলেন, ছিলেন প্রশিক্ষিত। সব চেয়ে বড় ব্যাপার, দ্বিভাষিক সিনেমায় কাজ করার জন্য তাঁদের বেশিরভাগকেই হিন্দুস্তানি শিখতে হয়েছিল নিখুঁত করে। সেটাই ছিল অন্তত নিউ থিয়েটার্সের চালু নিয়ম। ফলে বোম্বেতে কাজ পেতে কারও কোনো অসুবিধে হয়নি। অসুবিধে হয়নি সাফল্য পেতেও। ১৯৫০ এই শুরু হয় মস্তিষ্কের এই একমুখী মহানিষ্ক্রমণ, যার শেষ এখনও হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার
বলাবাহুল্য, দেশভাগের মূল কারিগর যাঁরা, তাঁরা কখনই এই বিপর্যয়ের দায় নেননি। রাজনীতিকরা চাপে না পড়লে কখনই নেননা। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই সমস্ত তথ্য জানার পরেও দেশভাগের হোতাদের রাজনৈতিকভাবে কখনও চেপে ধরা হয়নি। না আন্দোলনে, না তত্ত্বে। ব্যাপারটি অত্যন্ত বিস্ময়কর, কারণ, এ নাটকের এখানেই শেষ নয়। কারণ, এইটুকুতেও সন্তুষ্ট না হয়ে সর্বভারতীয় ঘরানায় বোম্বের প্রাধান্যকে নিশ্চিত করতে এবার আসরে নামে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতীয় সিনেমার অবস্থা খতিয়ে দেখতে ভারত সরকার একটি কমিটি বানায়। ১৯৫১ সালে তার রিপোর্ট বেরোয়। অন্যান্য সমস্ত কিছুর সঙ্গে এই রিপোর্টে দেশভাগের ফলে বাজার ছোটো হয়ে যাবার সমস্যাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হয়। সমাধান হিসেবে সিনেমা রপ্তানি করার উপরে জোর দেয়। পাকিস্তানে তো বটেই কিন্তু শুধু পাকিস্তানেই বা আফ্রিকায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। এবং সিনেমা রপ্তানির জন্য একটি স্ক্রুটিনি কমিটি তৈরি করার কথা বলা হয়।(১০)
এই ১৯৫১ সালেই বোম্বে থেকে মুক্তি পায় রাজ কাপুরের বিখ্যাত ছবি আওয়ারা। পরের বছর মুক্তি পায় দেব আনন্দের রাহি। এই দুটি সিনেমা বোম্বের চলচ্চিত্রের গতিপথকেই সম্পূর্ণ অন্য এক উচ্চতায় তুলে দেয়। কারণ, এরা শুধু সর্বভারতীয় হিট ছিলনা, ছিল আন্তর্জাতিকভাবে সফল। সোভিয়েত সহ পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকার কিছু অংশ, মধ্যপ্রাচের নানা জায়গায় সিনেমাদুটি ভীষণ সফল হয় এবং রাজ কাপুর ও দেব আনন্দ, বস্তুত দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের বহু জায়গায় পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।
কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার এই, যে, সরকারি দূর বিদেশে রপ্তানি করা প্রথম যে ভারতীয় সিনেমার নাম জানা যায়, সেটি বাংলা। নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল।(১১) শোনা যায় উদ্যোগটি ছিল স্বয়ং পুদভকিনের, কিন্তু সরকারি উদ্যোগ বলে আলাদা করে বলা হল, কারণ সেটি ৫০ এর দশক। সোভিয়েতের সমস্ত সিনেমা হলই তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত, ভারত এবং সোভিয়েত কোনো দেশেই সরকারি অনুমতি ব্যতিরেকে ফিল্ম রপ্তানি এবং প্রদর্শন সম্ভব ছিলনা। স্তালিনের রাশিয়ার সঙ্গে নেহরুর ভারতের এ নিয়ে সম্পর্কে টানাপোড়েনও ছিল (তার একটি বড় কারণ হল স্তালিনের রাশিয়া ভারতবর্ষকে তাত্ত্বিকভাবে ইউরোপের মতো বহুজাতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব হিসেবে দেখত, কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্য)। স্তালিন মারা যাবার পর, ৫৩ সালে ক্রুশ্চেভ এবং নেহরু একটি বোঝাপড়ায় আসেন, এবং সোভিয়েতে ভারতীয় সিনেমা দেখানো শুরু হয়।
সোভিয়েতের ছিন্নমূলের প্রদর্শনের মধ্যে আশ্চর্যজনক কিছু ছিলনা, কারণ তখনও ভারতীয় সিনেমার দুটি বড় কেন্দ্রের মধ্যে একটি হল কলকাতা। কলকাতা এবং বম্বের সিনেমা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চমকপ্রদ ঘটনা এই, যে, বাংলা সিনেমা হিসেবে ছিন্নমূলই শুরু এবং শেষ। কোনো জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখানো হয়নি। উল্টোদিকে শোনা যায়, রাহি এবং আওয়ারার ৮০০ করে প্রিন্ট পনেরোটি সোভিয়েত রাজ্যে দেখানো হয়েছিল।(১২) এর পর থেকে ভারতীয় সিনেমা বলতে সোভিয়েতে কেবল হিন্দুস্তানিরই রাজত্ব। বস্তুত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর ভারতীয় স্লোগান ছিল 'হিন্দি-রুশি-ভাই-ভাই'।
সরকারের পক্ষ থেকে বোম্বের মার্কেটিং ও খুবই ভালো হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় সরকার মস্কো, ভেনিস এবং বেজিংএ ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করতে যে ফিল্মি প্রতিনিধিদল পাঠায়, তা ছিল বোম্বে বোঝাই। ছিলেন রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং নার্গিস। পরের বছর নিজের বিদেশ সফরে ভারতীয় আইকন হিসেবে নেহরু সঙ্গে নিয়ে যান তিন ভারতীয় নায়ককে, দিলীপকুমার, রাজ কাপুর এবং দেব আনন্দ। বোম্বের সিনেমার জন্য এর চেয়ে বড় করে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন করা সম্ভব ছিলনা।
কী কারণে পশ্চিম-ইউরোপ বা আমেরিকায় নয়, বিশ্বের কিছু 'অনুন্নত' এলাকায় বোম্বের সিনেমা জনপ্রিয় হল, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এখানে সেসব করার মানে নেই। এখানে পয়েন্ট একটিই। সহজ ভাষায় বলতে হলে, সরকারি উদ্যোগে ভারতের দুটি বৃহৎ সিনেমা কেন্দ্রের একটিকে বিশ্বসভায় প্রোমোট করে, এমন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, অন্য কেন্দ্রটির পক্ষে তার ধারেকাছেও আর পৌঁছনো সম্ভব ছিলনা। কলকাতা নামক কেন্দ্রটি এমনিতেই তখন বাজার ও পুঁজির অভাবে ভুগছে। সরকারি ঠেকনা পেলে তার পক্ষে হয়তো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হত। কিন্তু রাজ কাপুর বা দেব আনন্দরা যে সুযোগ পেয়েছেন, সেসময় বা পরবর্তীর ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, মাধবী বা সৌমিত্র তা পাননি। সরকারি ঠেকনার এই দ্বৈত চরিত্রই ছিল বাংলা সিনেমার কফিনে সরকারি পেরেক।
প্রসঙ্গত আরও একটি ধারার ছবিকে বিদেশে, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে, সরকারি উদ্যোগে দেখানো হত। সেটি তথাকথিত আর্ট ঘরানার। সেই সূত্রে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ইত্যাদি অন্য ঘরানার চলচ্চিত্রকারদের কিছু সিনেমাও দেখানো হয়েছে। কিন্তু মূল ধারার জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা একটিও না। যা দেখানো হয়েছে, বলাবাহুল্য তাতে জনপ্রিয়তার উপাদান ছিলনা। লিপকভ লিখেছেন, আক্ষরিক অর্থেই, এইসব সিনেমা দেখে লোকে হল ছেড়ে মাঝপথে উঠে বেরিয়ে যেত।
১৯৫৫-৫৬
খন্ডিত বাজার, পুঁজির অভাব, এবং ভারত সরকারের দ্বিচারিতা, এই তিনটি বস্তু বিভক্ত বাংলায় সিনেমার সামনে অলঙ্ঘনীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ বিচারে সবকটিই ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করে। এই সমস্যাগুলির কোনোটিই বাজার অর্থনীতির বা কুশলতার নয়। সবকটিই চরিত্রে রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক ত্রিফলা আক্রমণ সামলানো সম্ভব ছিলনা বাংলার শিল্পের পক্ষে। ফলত 'সর্বভারতীয়' হয়ে ওঠার আকাঙ্খায় ইতি টানা হয়ে যায় ১৯৫৫তেই। ব্রিটিশ ভারতে যে শক্তি বেড়েই চলছিল 'জাতিয়তা'র আকাঙ্খা নিয়ে, স্বাধীনতার ১০ বছরের আগেই তাকে পরিণত করা হয় 'আঞ্চলিক' এক শক্তিতে। 'আঞ্চলিক' হয়ে কোনোমতে টিকে থাকা ছাড়া বাংলা সিনেমার আর কোনো বিকল্প ছিলনা। নিউ থিয়েটার্স যেভাবে শেষ হয়ে যায়, তা এক্ষেত্রে একদম প্রতীকী। ক্যালকাটা ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক উঠে যাবার পর কার্যত নিউ থিয়েটার্সের সিনেমা বানানোয় দাঁড়ি পড়ে যায়। ১৯৫৫ সালে ম্যানেজমেন্ট চলে যায় জনৈক কংকারিয়ার হাতে। এবং ১৯৫৬ সালে নিউ থিয়েটার্সে তালা পড়ে যায়। ভারতলক্ষ্মী এবং অন্যান্য বড় স্টুডিও, যাদের সর্বভারতীয় আকাঙ্খা ছিল, তারাও ঝাঁপ ফেলে একই সময়। এই ব্যাপারে চটশিল্পের চেয়ে বাংলা সিনেমার পরিণতি আলাদা কিছু নয়। কেবল সিনেমার ক্ষেত্রে প্রভাবটি ছিল চটজলদি। চটশিল্পে একই সঙ্গে সবকটি বড় চটকলই ঝাঁপ ফেলে দেয়নি।
বাংলা সিনেমার তথাকথিত স্বর্ণযুগ অবশ্য তখনও বাকি। উত্তম-সুচিত্রা জুটি সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বাংলা 'অন্য' সিনেমার উত্থানও বাকি। সত্যজিৎ রায় সদ্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিচয় পেয়েছেন। কিন্তু সেই 'অন্য' সিনেমার উত্থান বাংলা জনপ্রিয় সিনেমার ভবিতব্যে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, সম্ভবও ছিলনা। আর অসিত সেন, অজয় কর, অগ্রগামী এবং অগ্রদূত খচিত তথাকথিত স্বর্ণযুগও, তার প্রবল বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও, বস্তুত একটি আঞ্চলিক শক্তির টিকে থাকার গল্প। এরা সব ছোটো ছোটো আঞ্চলিক ইউনিট, সর্বভারতীয় হবার সমস্ত সম্ভাবনা বিলুপ্ত হবার পরে এবং বিলুপ্ত হবার কারণেই যাদের জন্ম। যে কারণে পরিচিতি পেতে মহানায়ক ও মহানায়িকাকেও দৌড়তে হয় বোম্বেতে। বোম্বে এবং কলকাতা, ওই পঞ্চাশের দশকেই তাদের গতিপথ ঠিক করে ফেলেছিল। বোম্বে চলবে পেশিশক্তির জোরে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, আড়ম্বরের উদযাপন এবং আনন্দদানের দর্শনের উপর নির্ভর করে। অভিনয় এবং উচ্চারণ হবে উচ্চকিত, চিত্রনাট্যে জটিলতা এবং মনোবিশ্লেষণ থাকবে কম, জোর থাকবে ঘটনা এবং অ্যাকশনের উপর। তৈরি করা হবে মোটাদাগের একটি সমতল ন্যারেটিভ। উল্টোদিকে, পুঁজির অভাবে কলকাতার সিনেমা হবে অনুজ্জ্বল, প্রযুক্তির প্রয়োগ হবে কম। জোরের জায়গা হবে, তার পুরাতন কারুশিল্প, অর্থাৎ 'বাস্তবমুখী' অভিনয়, কাহিনী এবং চিত্রনাট্যে সূক্ষ্ম মানসিক জটিলতার পরত। ঘটনা এবং অ্যাকশন থাকবে কম। বোম্বে, এক কথায়, নিজের মতো বাস্তবতাকে তৈরি করবে, এবং রূপকথার মতো লোকে তা গিলবে। কলকাতাও বাস্তবতাকে বানাবেনা বা তৈরি করবেনা তা নয়, সিনেমা মানেই তো কল্পনা, কিন্তু জোরটা থাকবে কুশলতা দিয়ে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে।
এই অসম প্রতিযোগিতা চলবে কয়েক দশক ধরে, তথাকথিত স্বর্ণযুগ বেয়ে, যতদিন না আশির দশকের শেষে কলকাতার পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধটি জেতা অসম্ভব ছিল, তার পিছনে কেবল সরকারি ঠেকনার বৈষম্য, পুঁজির এবং বাজারের অভাবই দায়ী নয়। এগুলির সঙ্গে ছিল আরেকটি ব্যাপারও। আগেই লেখা হয়েছে, বাংলায় একই সিনেমার একাধিক ভাষায় তৈরি সংস্করণের একটি ঐতিহ্য ছিল। শুধু কলাকুশলীরা নন, দর্শকও এতে অভ্যস্ত ছিল। দর্শকরা বাংলার পাশাপাশি হিন্দুস্তানি সিনেমা দেখতেন। বিচিত্র কিছু ব্যাপার নয়, বাংলার বাইরে কিছু হিন্দুস্তানি এলাকায়ও বাংলা সংস্করণ দেখা হত। এই সুযোগটি নেয় বোম্বের জায়মান পেশিশক্তি। ১৯৫০ এর দশক থেকেই শোনা যায়, বাংলায় বাংলা সিনেমা আর প্রেক্ষাগৃহ পাচ্ছেনা। পুঁজি এবং বাজারের অভাবের সঙ্গে এই নিয়েও লেখালিখি হয়, যেমন হয় 'বোম্বে স্টাইল'এর সমালোচনা। পুঁজি এবং বাজারের অভাব নিয়ে আগেই বলা হয়েছে, বোম্বে এবং কলকাতার স্টাইলের তফাত নিয়েও, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ বেদখল হবার একটি সহজ কারণ ছিল, বাঙালি দর্শক হিন্দুস্তানি ছবির দেখার ক্ষমতা। এইটি না থাকলে বোম্বের বৃহৎ পুঁজির পক্ষেও বাংলার বাজার দখল করে ফেলা অত সহজ হতনা, যেমন হয়নি দক্ষিণে।
এমতাবস্থায়, এই নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা জনপ্রিয় সিনেমা, সেটুকু করেইছিল, যেটুকু তার পক্ষে সম্ভব ছিল। উত্তম-সুচিত্রা যুগের প্রায় পুরোটাতেই সে ফিরে যায় সাদা-কালোয়। অ্যাকশন এবং ঘনঘটার উপর জোর না দিয়ে জোর দেয় কাহিনী এবং রোমান্সে। কিন্তু স্রেফ এই শৈল্পিক দক্ষতা, দ্বিভাষিক সিনেমার বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিলনা। ফলত বাজার ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে হতে ৭০ এর শেষে এমন জায়গায় আসে, যখন সে অন্যত্র মন দেয়। বোম্বের অনুকরণে টিকে থাকা যায় কিনা চেষ্টা করে। এই চেষ্টা এর আগেও হয়নি তা নয়, কিন্তু ৮০র চেষ্টার সঙ্গে তার গুণগত তফাত ছিল। একই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় জনপ্রিয় সিনেমার 'কলকাতা স্কুল', যাকে স্বাধীন ভারতবর্ষ 'আঞ্চলিক' তকমা দিয়েছিল।
উপসংহার
এই লেখা কোনোভাবেই বাংলা সিনেমার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা নয়। সময়কালের হিসেবে এর বিস্তার ১৯৩০ থেকে ১৯৫৫। তার মধ্যেও কিছু জিনিস বাদ গেছে। এবং এই লেখায় এমন একটি কথাও লেখা হয়নি, যা ইতিপূর্বের সিনেমা আলোচকদের অজানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই লেখাটি লিখতে হল, তার কারণ, এর একটি সহজ প্রতিপাদ্য আছে। সোজা চোখে দেখলে, বাংলা সিনেমা একরকম করে যে ধ্বংস হয়েছে, তার কারণ বাজার নয়, কারণটি রাজনৈতিক। বস্তুত একটি পদ্ধতিগত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলা সিনেমার 'কলকাতা ঘরানা'টিকে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর তাঁত শিল্পের সর্বাঙ্গীণ ধ্বংসসাধন সম্পন্ন হয়েছিল ৩০ বছরের মধ্যে। সঙ্গে ছিল মন্বন্তর, এবং কিছুদিনের মধ্যেই হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পর, ৩০ বছরের মধ্যে সিনেমা শিল্পের সর্বাঙ্গীণ ধ্বংসসাধন হয়ে গেছে, এবং একটু আগে থেকে হিসেব করলে মন্বন্তর, বঙ্গভঙ্গ, সবই ছিল সঙ্গে, শুধু কালানুক্রমটি একটু উল্টে পাল্টে গেছে। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পিছনে না থাকলে এটা সম্ভব নয়। সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটিই এখানে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এবং এই প্রক্রিয়াটি শুধু সিনেমা শিল্পের ক্ষেত্রে ঘটেছে একেবারেই তা নয়। সিনেমা শিল্পকে যদি সাংস্কৃতিক আখ্যানের অংশ ধরা যায়, তবে একই ভাবে ১৯৩০-৫৫ এর অন্য নানারকম আখ্যানও লেখা যায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক। সেই আখ্যান লিখলেও দেখা যাবে, যে, আখ্যানগুলি সমান্তরাল এবং প্রায়শই একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। এবং সিনেমার মতই বাকি ক্ষেত্রেও বিষয়গুলির কোনোটাই অজানা না হলেও অস্বস্তিকর সহজতম ন্যারেটিভকে কখনও সোজা করে ধরা হয়নি। এর কারণও অবশ্য সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। কারণগুলি, আন্দাজ করা যায়, বহুমুখী। প্রথমত, ভারতের প্রতিটি মূলধারার রাজনৈতিক শক্তি দেশভাগকে সমর্থন করেছিল। তার পাপের তারা চিরকালই এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। এবং ইতিহাসের ন্যারেটিভ তারাই তৈরি করেছে, ফলে সেখানে, অর্থাৎ, সর্বভারতীয় ন্যারেটিভে এই পাপের কোনো অস্তিত্ব নেই। দ্বিতীয়ত, ভারতের সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভে বহুজাতিক শব্দটিকে মুছে দিয়ে সর্বভারতীয় এবং জাতীয় -- এই বর্গদুটিকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। ভারতের যে র্যাডিকাল অংশ অর্থাৎ কমিউনিস্টরা এই সমার্থককরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ১৯৫৩ সালের পর তারাও মূল ধারায় যোগদান করে এবং 'সর্বভারতীয়=জাতীয়' এই সমীকরণের উল্টোদিকে যাওয়াকেই ক্রমশ পাপ এবং অপ্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলা হয়। ফলে সিনেমার কেন, সমস্ত ইতিহাসেই তার প্রভাব পড়বে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই লেখার 'প্রগতিশীল' হবার কোনো দায় নেই। এবং তাত্ত্বিক হবারও। এর একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আছে। সেটিও খুব সোজা। দেশভাগ এবং কেন্দ্রীয় নীতি দুটিই বাংলার প্রতি জঘন্য পাপ। এর প্রতিকার চাই। রাজনৈতিক ভাবেই, কারণ এর সমাধান বাজার-অর্থনীতি দিয়ে সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালে আর ফেরত যাওয়া সম্ভব না, তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিকার এখনও সম্ভব। প্রথমত বোম্বেকে এবং হিন্দুস্তানিকে গত ৭০ বছর ধরে ভারতীয় ইউনিয়নে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, এবার সেটা বন্ধ হওয়া দরকার। 'আঞ্চলিক' সংস্কৃতির নিরাপত্তা চাই। বোম্বের সিনেমার উপর, সর্বভারতীয় চ্যানেলের উপর শুল্ক বসিয়ে হোক, বা অন্য কোনো ভাবে। দ্বিতীয়ত, বাংলার সাংস্কৃতিক বাজার এখনও খন্ডিত। সেটাকে জোড়া দরকার। রাজনৈতিক ভাবে জুড়ে যাওয়া অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। অন্তত অর্থনৈতিক ভাবে জোড়া দরকার। ভারতীয় উপমহাদেশের সংযুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল বানিয়ে বা কনফেডারেশন মডেলে গিয়ে, যেভাবেই হোক। তৃতীয়ত, বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা, 'জাতীয়' সংস্কৃতির ছায়ায় নিরাপদে না জিরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় জাতি এবং রাষ্ট্রকে এক না করে দিয়ে, অন্তত এবার জিরাফকে জিরাফ, দেশভাগকে দেশভাগ, এবং বোম্বে সিনেমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের ঠেকনায় নির্মিত বলে অভিহিত করতে শুরু করুন।
সূত্রঃ
১। Bollywood - A History -- মিহির বোস
২। Bengali Cinema: 'An Other Nation' -- শর্মিষ্ঠ গুপ্ত
৩। An Appeal beyond Aesthetics: Exploration of the Iconicity of New Theatres -- শর্মিষ্ঠা গুপ্ত
৪। Talking Pictures In India -- Wilford Deming
৫। Bengali Cinema: 'An Other Nation' -- শর্মিষ্ঠ গুপ্ত
৬। Spoils of Partition -- জয়া চ্যাটার্জি
৭। Partition of Contingency -- হৈমন্তী রায়
৮। Rising Costs and Crushing Taxes -- এমডি চ্যাটার্জি (এই লেখায় গুপ্তর বই থেকে উদ্ধৃত)
৯। Anticipating Independence, No Premonition of Partition. The Lessons of Bank Branch Expansion on the Indian Subcontinent, 1939 to 1946 -- Viet Nguyen, Susan Wolcott
১০। Report of the Film Enquiry Committee -- 1951
১১। India's Bollywood in Russia -- ALEXANDER LIPKOV and Thomas J. Mathew
১২। Bollywood Affair: How Indian Cinema Arrived in the U.S.S.R. -- Deepa Bhasthi
ঈশানদা, আমার মতে এইটা আপনার সেরা লেখা। সব বাঙালীর, দুইদিকেরই, পড়া উচিত।
আমি কিন্তু মনে করি যে বাজার অর্থনীতি দিয়েই এর প্রতিকার করতে হবে। আপনি যেমন বলেছেন যে ১৯৪৭ এ ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় বা রাজনৈতীকভাবে দুই দেশ জুড়ে দেওয়া সম্ভব নয়, সেইরকম বাজার অর্থনীতিকে অস্বীকার করাও এখন আর সম্ভব নয়।
হ্যাঁ 'আঞ্চলিক' সংস্কৃতিগুলোর সুরক্ষা চাই। রাজনৈতীকভাবে বাঙলাকে হিন্দিবলয়ের মধ্যে টেনে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা চলছে। আসাম আর উড়িষ্যাতে যেটা অনেকাংশে সফল হয়েছে। ফোঁস না করলে এখন আর উপায়ই নেই।
দুদিকের বাজারকে জোড়া দেওয়ার কাজ তো করতেই হবে। এইটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ন। ইনফ্যাক্ট সিনেমা দিয়ে শুরু করে সাফল্য পেলে হয়ত দেখা যাবে অন্য ইন্ডাস্ট্রিতেও সেই সাফল্য আসবে। কোলাবোরেশান, নট কম্পিটিশান।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে দিই। অনেকেই হয়ত জানেন। সাউথের সিনেমার সাফল্যের একটা বিশেষ কারণ হল ওখানে একই সিনেমা বিভিন্ন ভাষায় তৈরী হয় (কিছু সিনেমা বাংলায়ও)। ফলে প্রোডাকশান কস্ট কম রাখা যায়।
দেশভাগের এই দিকটা কখনো ভাবিই নি। জানতামই না আসলে, সিনেমা আমার অগ্রহের বিষয় নয় বলেই সম্ভবত কখনো ভেবেও দেখি নি।
হুঁ রাজনৈতিক দাবীই ওঠা দরকার। যদিও কোনও রাজনৈতিক দল এই দাবী তুলবে এমন ভরসা করি না।
একটা সময় বাংলা তার সংস্কৃতি কে ভারতের দরবারে সফল ভাবে রপ্তানি করতে পেরেছিল বলেই সে সাফল্য লাভ করেছিল, মার্কেট ধরেছিল। জমি ফেরত পেতে হলে আবার সংস্কৃতি র অঙ্গনে ভাগ বসাতে হবে। বোম্বে এভাবেই ভারত দখল করেছে। তাই বাঙালি রাও আজ লজ্জা না পেয়ে শর্মিন্দা হয়। সাউথ ই একমাত্র কিছুটা আটকাতে পেরেছে এবং তা পেরেছে তাদের তীব্র হিন্দি বা অর্যাবর্ত বিরোধী মনোভাবের জন্যই। বাংলা লিবারেল হতে গিয়ে আগে ইংরেজি ও পরে হিন্দির কাছে জমি খোয়াচ্ছে।
লেখাটা খুবই ভালো লাগলো। রাজনৈতিক কারণটা ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। স্টুডিও পাড়ায় বাড়ি বলে জানি, কীভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরো বহু ব্যবসার জন্ম দেয় ও বাঁচিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে আমাদের অঞ্চলের প্রচুর লোক স্টুডিওতে কাজ করেন। সেই ইন্ডাস্ট্রি দুম করে ফেল করে গেলে মানুষ না খেয়ে মরবে।
অতি অবশ্যই আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে দেশভাগ ও বঞ্চনার শিকার বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য।
ইতিহাস যা তা তো ইতিহাস !! এখন ..এই মুহূর্তে আমার মনে হয় বাংলা সিনেমা তে ট্যালেন্ট এর অভাব নেই কিন্তু হিন্দি সিনেমা তে যে trend টা আছে ।..মানে ..টেকনোলজি ।..হিন্দি .ভাষার সার্বজনীন আবেদন ..নতুন নতুন বিষয় বস্তু নিয়ে সিনেমা করা..অসম্ভব ভালো কিছু অভিনেতা /অভিনেত্রী থাকা ..যারা প্রতি নিয়ত নিজেদের শিল্প কর্মকে আরো আরো শানিত করে চলেছেন ।...পরিচালক রা বিভিন্ন বিষয় বস্তু নিয়ে ছবি করছেন ।...ইত্যাদি .....সেগুলো এই বঙ্গে নেই বললেই চলে !!বাঙালি সন্তান রা বলিউড গিয়ে কারিশমা দেখাচ্ছে ।..অথচ বাংলা সিনেমা করতে আসছে না ।।.এটাই তো প্রমান যে কেনো বর্তমান বাংলা cinema সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে !!একটা "থ্রি ইডিয়ট "বা একটা "দাবাং " বা একটা "পিঙ্ক" কি করা যায় না এই বাংলায় ??"স্ট্যানলি কে ডাব্বা " ।."দৃশ্যম""...বা "গেস্ট ইন লন্ডন " ???খুব করা যায় ! অভিনব চিন্তা।..সাহিত্য কর্ম থেকে রসদ নিয়ে তাকে সিনেমায়িত করা।... এবং স্মার্টলি ।..সেটা হচ্ছে না !! ভালো গান নেই।.. ভালো সুরকার নেই।..দক্ষিণী সিনেমার ব্যর্থ অনুকরণ।.. অতি নিম্ন রুচির গান ।..লেখা ।। যা তা করে একটা নাচন কোদান ।..কেন দেখবে লোক ? মনেহয়.. ৬০-৭০ দশকের পরে এই রুচি ,কৃষ্টি ইত্যাদির মান তলানিতে ঠেকেছে !! এর সঙ্গে আরেক টা ব্যাপার আছে.. সিঙ্গেল স্ক্রিন এর বিয়োগ এবং মুক্ত অর্থনীতির দৌলতে বা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ / অভিশাপ যাই বলি ..মোবাইল নামক (তাও স্মার্ট ) অতিথি র আগমন ।..সাধারণ মানুষ ওতেই তো সিনেমা দ্যাখে !!এই সব আর কি !!!
ব্যাপারটা তো ঠিক দুইয়ে দুইয়ে চার নয় যে নেহরু দিলীপ-দেব-রাজকে বগলে পুরে চললেন আর হিন্দি সিনেমা ফুলে ফেঁপে উঠল। ব্যাপারটা এমনও নয় যে দেশভাগের জন্য বোম্বে পাঞ্জাবের একটা বিশাল অংশের বাজার হারায়নি। হিন্দি সিনেমার একটা বাজার পূর্বাবধি ছিল, যেটি বাংলা চলচ্চিত্রের চেয়ে কিঞ্চিৎ বড়ই।
১) প্যারাডাইস ক্যাফেতে আড্ডা মারা সবাই (বংশী গুপ্ত বাদে) যে বোম্বে গেলেন বা যেতে বাধ্য হলেন বাঙালির বিখ্যাত ল্যাং মারামারির জন্য, সেই প্রসঙ্গটা গোটা লেখাটিতে অনুচ্চারিত থাকল কেন? মধুমতীর স্ক্রিপ্ট কার? সুর কার? তাঁদেরকে তাড়ানো হয়েছিল? তাঁরা কলকাতায় থাকলে কল্কে পেতেন?
২) খণ্ডিত বাংলার সিনেমা হলে হিন্দি ছবি প্রদর্শনের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য বাংলার সরকার কোনও দিন কোনও ভূমিকা নিয়েছে? বাংলার বিশ্ববরেণ্য পরিচালকরা 'জাতীয়' পুরস্কার যখন পেয়েছেন তখন তো নিয়েছেনই, যখন 'আঞ্চলিক' ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন - সেসব জীবনে প্রত্যাখ্যান করার ধক দেখাতে পেরেছেন?
৩) হিন্দি প্যারালাল সিনেমার সূত্রপাত ভুবন সোমের হাত ধরে, 'জাতীয়' দূরদর্শনের জন্য বানানো প্রথম ছবি সদগতি। আর সব দোষ কেন্দ্রের!
হ্যাঁ হিন্দি সিনেমা এই মুহুর্তে খুবই ভালো পজিশনে। একদিকে যেমন জঘন্য মানের কমার্শিয়াল সিনেমার জন্য পুঁজির অভাব নেই, তেমনি ভালো কন্টেন্ট করার জন্য ভালো কলা-কুশলীরও অভাব নেই। তবে গুরুদত সাহাব মারা যাওয়ার পর ৬০ এর দশক থেকে এই গত দশকের মাঝামাঝি অবধি হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যে একটি নিম্নমানের আস্তাবল ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অথচ এই সময় ধরে সেইসব নিম্নমানের খাজা সিনেমাগুলোতে পুঁজির বিনিয়োগ তো কম হয়নি। হ্যাঁ ৮০র দশক থেকে বাঙলা সিনেমার মানও একইভাবে নেমে যায়। সেটা যে সম্পূর্ণভাবে শুধু পুঁজির অভাবে হয়েছিল, তা নয়। আমার মনে হয়েছে এই দুই জায়্গাতেই কিছু নিম্নমানের লোকজন ক্ষমতা কায়েম করে রেখেছিল এবং ভালো সিনেমা হতে দিচ্ছিলো না।
আঞ্চলিক ভাষায় তৈরী চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কারের জন্য হিন্দী ভাষাকেও আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১৮ সালে অন্ধাধুন হিন্দী ভাষার সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। আর স্বর্ণকমল পেয়েছে একটি গুজরাতি ছবি। কাজেই আঞ্চলিক ভাষায় ছবি তৈরীর জন্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের যুক্তি দেখি না। যে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে পুরস্কার দেওয়া হয় সেগুলো ছাড়াও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বরং সওয়াল করা যায়।
পুরস্কারের জাতীয়-আঞ্চলিক থাকবে কেন? ওটা তো অলসো র্যান ক্যাটেগরি। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাকডোর দিয়ে পাইয়ে দেওয়া। এবং জুরিদের জোরাজুরি। আজ থেকে নয় তো। নাহলে সৌমিত্র না হয়ে অজয় দেবগণ জাতীয় অভিনেতা হয় কোন যুক্তিতে?
আর বাংলা ছবির প্রযোজক ও ব্যবসার ধরণ নিয়ে সর্বাধিক জোরালো থাপ্পড়টি মেরেছিলেন ঋত্বিক। সেটা লেখাতে উল্লিখিত হয়নি যদিও। আগে ছিল রঞ্জিতমল কাংকারিয়া-আর ডি বনশল, এখন সেটা ভেঙ্কটেশ-এসভিএফ। মধ্যিখানে চিটফান্ডের মালিকবর্গ। বাকি সবই এক।
শেষ হিন্দি সিনেমা স্বর্ণকমল পেয়েছিল পান সিং তোমার ২০১২ সালে। তারও আগে ২০০৪ সালে পেজ থ্রী। বিগত ৩০ বছরে ৩টে। বাংলা সিনেমা ৭টা। তবে মোদি সরকার উড়ির মতন একটা খাজা সিনেমার পরিচালককে সেরা পরিচালনার পুরষ্কার দিয়েছে।
স্বর্ণকমল ধুয়ে জল খাবে? মৃগয়ার পরে মিঠুন দু বছর কোনও ছবি পায়নি। ইন্দ্রাণী হালদারেরও একই হাল। কিংবা সুদীপ্তা চক্রবর্তীর। ওটা গ্যালারি শো। খেলা অন্য মাঠে হয়, অন্য ভাবে হয়।
ব্যাপারটা অতটাও ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নয়। এই নিয়ে এখানে আলোচনার মানে হয়্না।
"আর বাংলা ছবির প্রযোজক ও ব্যবসার ধরণ নিয়ে সর্বাধিক জোরালো থাপ্পড়টি মেরেছিলেন ঋত্বিক।"
সম্পূর্ণ বাজে কথা। সদ্যপ্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক প্রযোজকদের দালাল হয়ে গিয়েছিল। মাতাল ঋত্বিককেই বরং ঘুষি মেরেছিলেন সৌমিত্র।
পুরস্কারে জেলা স্তর, রাজ্য স্তর, জাতীয় স্তর থাকতেই পারে। ভারতের মত এত বড় দেশে সেটা থাকাই উচিত। পছন্দের লোককে প্রাইজ দেওয়ার ব্যাপারটা কোরাপশন। কোরাপশন আছে বলে প্রাইজ দেওয়া উঠিয়ে দিতে হবে এমন দাবী একটু অদ্ভুত। তবে কোনো আর্ট ফর্মকে প্রাইজ দিতে গেলে পার্সোনাল বায়াস এসেই যাবে। ওটা এড়ানোর উপায় নেই।
তাছাড়াও মনে হয় দেশভাগ পরবর্তী বাংলা সিনেমার যে স্বর্ণযুগ সেখানে পুরস্কারের আশায় কেউ ফিল্ম বানাতেন না। বা পুরস্কারের ওপর ভর করে ইন্ডাস্ট্রি চলত না এটাও বলা যায়। ১৯৫৪ সালের সিনেমা "ওরা থাকে ওধারে"। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। কিছুই জানি না এনার সম্পর্কে। সদ্য দেশভাগের বিপর্যয় পার করে আসা দুটি নিম্নবিত্ত কেরানী পরিবার। তারা মুখোমুখি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। তাদের নিয়ে অনবদ্য কমেডি। অথবা ১৯৫৮ এ "যমালয়ে জীবন্ত মানুষ"। পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী। এনার সম্পর্কেও কিছু জানি না। কিন্তু এ সিনেমা আজকে রিলিজ করলে সিডিশানের চার্জে ব্যান হত। এটাও ভরপুর কমেডি। গরীব মানুষ, জীবন যন্ত্রণা কিচ্ছুটির ঘাটতি নেই। কিন্তু কোনো বিবেক এসে হলুদ মার্কার দিয়ে আন্ডারলাইন করে দিচ্ছে না। পূর্ব ইউরোপিয়ান কমেডির মত হাসি-গানে ভরপুর ছবি। যখন দেখি মনেই হয় না সত্তর বছর আগে বানানো হয়েছে। এসব ছবি কোনদিন পুরস্কার পেয়েছে বলে জানি না। তেমন করে আর্কাইভ করা হয়েছে বলেও জানা নেই।
সব সিনেমাকেই পুরষ্কার পেতে হবে, তার কোনও মান নেই। কিন্তু একটা ইন্ডাস্ট্রি যখন সর্বভারতীয় পুরষ্কারের ক্ষেত্রে ডমিনেন্স দেখায়, তখন সেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার লোকজন বাড়ে। অনেকে অন্য ইন্ডাস্ট্রি থেকে বা পয়সা ছাড়াও কাজ করতে আসে। পারিশ্রমিক অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এখনও বহুলোকজন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসে যাদের আসল টার্গেট ঠিক প্রচুর টাকাপয়সা নয়। ৯০এর দশকের অনেক হিট বলিউড হিরোদের দেখি আজকাল বেশ হতাশই হয় যে ভালো সিনেমায় কাজ না করায় বিভিন্ন রাউন্ডটেবিল ইত্যাদিতে জায়্গা পায় না। জানে যে কালের নিয়মে লোকে তাদের আর মনে রাখবেনা। সেটা ঐ কয়েকশো কোটি টাকা দিয়েও চাপা রাখতে পারেনা।
তবে সিনেমা তৈরী করতে ফান্ড তো লাগে বটেই।
অসাধারন লিখেছেন। স্যালুট।
২৬ নভেম্বর ২০২০ ০২:১০
এইটি হচ্ছে ঋত্বিকের থাপ্পড় — “আমাদের দেশে ছবি করার ব্যাপারটা এমনই যে তাকে একটা ফুটো চৌবাচ্চার সঙ্গে তুলনা করা চলে। ... ছবিঘরের মালিক তিসির ব্যবসা করবেন, চালকল করবেন, ছেলের সুবিধের জন্যে সুইজারল্যান্ডে বাড়ি করে দেবেন, কিন্তু ফিল্মে? নৈব নৈব চ। ও বড়ো ঘোঁটালো ব্যাপার। পয়সা চোট খেয়ে যেতে কতক্ষণ? যদিও পয়সাটা আসছে ঐ চোট খাওয়ার জায়গা থেকেই। তার ওপরে এমন লাভ তো কোনো ব্যবসায় নেই। ... একমাত্র গোলাগুলির কারখানা আর ছবিঘরে শতকরা ছয়শো-সাতশো শতাংশ লাভ। ভাবা যায়? তার ওপরে এই একটা ব্যবসা, যেখানে নিম্নতম লাভের অঙ্ক বাঁধা ...। আবার এই ছবিঘরগুলোর অন্যান্য আয়ও আছে যেগুলো শুল্কের আওতায় পড়ে না। যেমন Slide দেখানো, বিজ্ঞাপনের ছবি দেখানো, ... আমদানি এ-সবেও মন্দ হয় না। এরাই প্রধানত ছবি তৈরির রুচি তৈরি করে দেন। আর এঁদের সাথে হাত মিলিয়ে চলেন এই ব্যবসার কুসীদজীবীর দল। ... সাধারণত প্রযোজক এবং পরিবেশক হচ্ছেন ঠুঁটো জগন্নাথের দল — ফালতু ফড়ে।”
তিনি প্রযোজকদের ‘দালাল’? দালালির বিনিময়ে কী পেয়েছিলন তিনি? প্রচুর ছবির অফার? আর ‘মাতাল’ ঋত্বিককে মেরে কোন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন সৌমিত্র? তাঁর ক্ষমতা হয়েছিল ওই ‘ছবিঘরের মালিক’দের ঘুসি মারার?
সৌমিত্র বাবু গত হয়েছেন তাই রীতি অনুযায়ী বদনাম করতে নাই কেউ মরে গেলে !!কিন্তু ওই ঋত্বিক কে ঘুসি মারা কেস টা সোনার পর থেকে আমার ওনার সম্বন্ধে (সৌমিত্র বাবুর ) একটা বিশ্রী ধারণা জন্মেছে !!খোলাখুলি বললাম ! তোষামোদি কথা বলতে পারি না !!কি এমন হয়েছিল যে একজন ( ধরে নেয়া যাক ঋত্বিক বাবু মদ্যপ ছিলেন সেই সময় ) বিশ্ব খ্যাত সিনেমা পরিচালক কে ঘুসি মারতে হলো ?? আর ওই ট্যালেন্ট দের বম্বে গমন ।..তা "শিল্পী বাঁচলে শিল্প " এটা তো সত্যি কথা !!উৎপল বাবু তাই করে ছিলেন নয় কী ? কোন জমিদার বা তার নাতি রা ওনাদের পেটে ভাত জুগিয়েছে ??যত্ত সব ফালতু কথা !!
কিন্তু সন্তোষ বাবু, সৌমিত্র বাবুর আচার,আচরণ ইত্যাদি দেখে শুনে মনে হয়,উনি রগচটা লোক?
যাকে তাকে, ঘুঁসি মেরে বেড়াচ্ছেন? ঋত্বিক বাবু ট্যালেন্টেড লোক।কিন্তু মদের নেশায় আক্রান্ত। পরবর্তী কালে নেশার জন্য,মানসিক স্থৈর্য্য ও হারিয়েছেন।
উনি যদি প্রকাশ্যে কোন বিখ্যাত ব্যক্তি বা সৌমিত্রর আইডল কে গালি গালাজ শুরু করে দেন;তো কারো ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতেই পারে। উচিত অনুচিত এর কথা পরে আসে।গায়ে হাত তোলা সমর্থন যোগ্য কখনই নয়।
মাতালের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় হিট অফ দ্য মোমেন্টে কেও মেরে থাকতেই পারেন। কিন্তু এতো বছর পর ঋত্বিক প্রসঙ্গে সেই কথা তুলে সৌমিত্র চূড়ান্ত কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন। একজন অভিনেতাকে মানায় না।
সৌমিত্র ঋত্বিকের জীবদ্দশায় এর থেকেও বেশি কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন কোমল গান্ধার নিয়ে। লিড রোল তাঁর করার কথা ছিল। যাক, এই থ্রেড সৌমিত্রের নয়, ঋত্বিকেরও নয়। কেবল অচেনা নিকের আড়াল থেকে অজ্ঞতা প্রকাশের উত্তর হিসেবে ঋত্বিকের থাপ্পড়টিই যথেষ্ট। এই একটি থাপ্পড়েই বাংলা চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা ফুটে ওঠে স্পষ্টভাবে।
কি রকম কুরুচি? একজন পেশাদার অভিনেতা যদি মনে করেন প্রস্তাবিত পারিশ্রমিকটি হাস্যকর এবং অভিনয় না করেন সেটা কুরুচিকর কেন?
মন্তব্যটি লেখার আগে তিনি যে 'হাস্যকর পারিশ্রমিক'-এর জন্য ছবিটি করেননি, সেটি প্রমাণ করার দায় মন্তব্যকারীর থাকে। অ্যানেকডোট আউড়ালে চলে না। আগে তার পক্ষে প্রমাণ পেশ হোক, পরে গুচ্ছের পাল্টা প্রমাণ হাজির করা যাবে।
পারিশ্রমিকের ব্যাপারটি সৌমিত্রর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। তিনি সত্য বলেছেন কিনা তার প্রমাণ নেই। তবে খামোখা তাঁকে মিথ্যাবাদী ভাববোই বা কেন! বিশেষত চিত্রপরিচালক হিসেবে তিনি যেখানে ঋত্বিককে যথেষ্ট সম্মান করেন বলে জানিয়েছেন। সৌমিত্রের কুরুচি বিষয়ক মন্তব্যটি আপনি আগে করেছেন। কি কারণে এমন কথা বললেন সেটা লেখেন নি। প্রমাণ পেশ করার কথা যখন উঠল, সেটা আপনার যুক্তি অনুযায়ী আপনাকে দিয়েই শুরু হোক।
এলেবেলের কথা বুঝছি না। ব্যবসায় এথিকসের অভাব, শিল্পের প্রতি অশ্রদ্ধা, সুশীল সমাজের ল্যাং মারামারি - এ বাঙালীর একচেটিয়া না। ওইসব নিয়েই বাজার, বাণিজ্য চলে। কিন্তু দেশভাগটা একা বাঙালীর। (আর পাঞ্জাবীদের, তবে দণ্ডকারণ্য বনাম দিল্লি, পুনর্বাসন বনাম ফিরে যাক - সেসব তো সবাই জানে।)
এলেবেলে লিখছেন 'ব্যাপারটা এমনও নয় যে দেশভাগের জন্য বোম্বে পাঞ্জাবের একটা বিশাল অংশের বাজার হারায়নি', আর সৈকতদা লিখেছে 'বোম্বে এই সমস্যায় পড়েনি। পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বাজার তাদের হাতছাড়া হয়েছিল বটে, কিন্তু পূর্ব বাংলার বাজারের তুলনায় ভগ্নাংশের হিসেবে তা ছিল যৎসামান্য।'
এটা নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান আসতে পারে বোধয়।
দেশভাগের চোট সর্বক্ষেত্রেই পড়েছিল সেটা লেখাতেই আছে, এবং সেটা বাস্তব । সেটা র জন্যে ক্ষতিপূরণ দাবি পুরো অন্য রাজনৈতিক আলোচনা। আর যে ভাষায় বেশি লোক কথা বলে তার বাজার ন্যাচারালি বড়ো হবে। সেই হিসেবে তো ফ্রেঞ্চ বা জার্মান , স্প্যানিশ জাপানি মুভির বাজারও হলিউডের থেকে অনেক ছোট। এই দেশগুলো ও মারাত্মক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে। তাহলে কি ভালো মুভি তৈরী হয়না ওসব ভাষায় ? হলিউডের বেশির ভাগ হরর মুভি জাপানি থেকে কপি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো হিন্দির এতো এতো কেন্দ্রীয় প্রোমোশন সত্ত্বেও ১৯৬০-৭০ এর দশকে সিম্পল রোমান্টিক বা পারিবারিক গল্প আর ভালো মিউজিক এর ওপর বেস করে বাংলা সিনেমা সেকালে হিন্দি সিনেমাকে সমানে সমানে টক্কর দিলো কিভাবে ? রাজ্ কাপুর বা দেব আনন্দের সিনেমা থাকা সত্ত্বেও পাশাপাশি উত্তম সুচিত্রা-সুপ্রিয়া -সৌমিত্রর ছবি লোকে লাইন দিয়ে ভিড় করে টিকেট কেটে দেখেছে । কলকাতায় বহু সিনেমা হলে শুধু তখন বাংলা সিনেমাই দেখানো হতো কারণ সেগুলো ও ভালোই বিসনেস জেনারেট করতে পারতো হিন্দির সাথে একুয়াললি পাল্লা দিয়ে। এমন নয় যে হিন্দি ছবি কেন্দ্র সরকার থেকে কলকাতায় সিনেমা হলে বিনা পয়সায় বা কম পয়সায় দেখানো হতো যেটাকে অসম প্রতিযোগিতা বলা যায়।
শুধু বিগ বাজেট বা অ্যাকশন মুভির জন্যে দর্শকের রুচি বদলে যাওয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ ৭০-৮০ র দশকেও অ্যাকশন মুভির পাশাপাশি বলিউড এ ঋষিকেশ মুখার্জী বাসু চ্যাটার্জী , গুলজার এনারা বা আরো অনেকে গাদা গাদা লো -বাজেট সিম্পল রোমান্টিক মুভি বানিয়েছিলেন যেগুলো দারুন ভাবে বাণিজ্য সফল. সেই ধরণের মুভি কলকাতায় আর বানানো যায়নি কেন ? এখনো বলিউডে প্রতি বছর অনেক লো বাজেট মুভি দারুন ব্যবসা করে জাস্ট গল্পের জোরে.
তাহলে দেশভাগ র এতো বিশাল ক্ষতি সত্ত্বেও বাংলা সিনেমা সেসব সামলে সুমলে নিয়ে তার ১০-২০ বছরের মধ্যে ১৯৬০-৭০-এর দশকে এ রকম একটা স্ট্রং প্ল্যাটফর্ম এ পৌঁছে গেলো. কিন্তু তারপর হটাৎ করে কি এমন পাল্টে গেলো যে সেখান থেকে ৮০-৯০ এর দশকে হটাৎ করে একটা সার্বিক অধঃপতন হয়ে গেলো যে আজও উঠে দাঁড়ানো গেলোনা বা আর পাল্লা দেওয়া গেলোনা ? তার দোষ কতটা বাইরের, কতটা কেন্দ্রীয় বঞ্চনা আর কতটা টলিউডের নিজের দোষ বা ট্যালেন্টের ঘাটতি -? দেশভাগ আলাদা করে ৩০-৪০ বছর পরে কি এমন প্রভাব ফেললো যেটা আগে হয়নি ?
হুতো, সৈকত লিখেছেন "বোম্বে এই সমস্যায় পড়েনি। পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বাজার তাদের হাতছাড়া হয়েছিল বটে, কিন্তু পূর্ব বাংলার বাজারের তুলনায় ভগ্নাংশের হিসেবে তা ছিল যৎসামান্য।" এর দুটো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে।
প্রথমটা, যেহেতু হিন্দি সিনেমার বাজার প্রথম থেকেই বাংলার সিনেমার বাজারের থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল, তাই পাঞ্জাব টেরিটরির ক্ষতি সে পুষিয়ে নিতে পেরেছিল। দ্বিতীয়টা, পূর্ববঙ্গে সিনেমা হলের সংখ্যা বা দর্শকসংখ্যা পশ্চিম পাঞ্জাবের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আমার কাছে প্রথম ব্যাখ্যাটা যথাযথ মনে হয়েছে। এবং এটাই আমি লিখেছি। প্রসঙ্গত লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কারণে যাঁরা বোম্বে আসেন বা আসতে বাধ্য হন, তাঁরা হলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর-দিলীপকুমার-দেবানন্দ। নেহরু এঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তার একটা অন্য ব্যাখ্যাও সম্ভব।
hu, হাওয়ায় তলোয়ারটি ঘোরানোর আগে কোমল গান্ধার নিয়ে সৌমিত্রের পরস্পরবিরোধী একাধিক সাক্ষাৎকার আগে পড়ে নিন। সেখানে যে নিছক 'হাস্যকর পারিশ্রমিক' কোনও কারণ ছিল না, তা নিজেই বুঝে যাবেন। আমি এই প্রসঙ্গটা এখানে আনতে চাইছি না।
ঈশানের লেখামে দম হ্যায়। এটা নিয়ে পরে লিখতে হবে, কারণ আমার কতকগুলো হাঞ্চ কনফার্ম করতে হবে। কিন্তু আপাততঃ এই বলি।
ঈশান বলছে তিনটে শক্তি কাজ করেছে স্বাধীনোত্তর বাংলা ছবি লাটে ওঠার পেছনে - ১) দেশভাগের ফলে বাজার কমে যাওয়া ২) ব্যাংকের হেড অফিস বম্বেতে চলে যাওয়ায় পুঁজির টান আর ৩) ভারত সরকারের সক্রিয়ভাবে হিন্দি ছবি প্রোমোট করা। এখানে কোন দ্বিমত নেই। আমি আর একটা কারণ বলব, সেটা যে ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে।
যেটা নিয়ে ঈশানের সঙ্গে আমার মত মিলছে না, সেটা হল এই তিনটে শক্তির তুলনামূলক প্রভাব। ঈশান স্পষ্ট করে না বললেও, সে মনে করে তিনটের প্রভাব তুল্যমূল্য। আমি মনে করি প্রথমটাই আশি ভাগ দায়ী বাংলা ছবির লাটে ওঠার। যদিও আমি মনে করি বাংলা ছবি লাটে সত্যি উঠতে আরম্ভ করেছে সত্তরে, লাটে ওঠা কমপ্লিট করেছে আটের দশকে।
যুদ্ধ পূর্ববর্তী - মানে টকি আসা থেকে যুদ্ধ আর দেশভাগ অব্দি - বাংলা ছবির জমিটা যদি দেখি, তাহলে সে বাজার দেখব যে কোন নতুন টেকনোলজি মার্কেটের সমতুল্য। লেখায় নিউ থিয়েটার্সের কথা এসেছে, আর এসেছে অল্প ম্যাডানের কথা। ম্যাডান টকি-পূর্ববর্তীযুগে ছবির বাজারের একচ্ছত্র সম্রাট ছিল। কিন্তু টকি আসার পর-পরই কম্পিটিশানে দাঁড়াতে না পেরে সরে যায়। এখন এই কম্পিটিশান কার থেকে? নিউ থিয়েটার্স? শুধু নিউ থিয়েটার্স নয়। নিউ থিয়েটার্স ছাড়াও তখন অন্তত পনেরো-কুড়িটা প্রোডাকশান হাউজ/স্টুডিওর নাম করতে পারি যারা বাজারে ছিল। শুধু ছিল নয়, নিয়মিত ছবি করত। আমি পনেরো-কুড়িটার নাম বের করতে পারি। ছিল তার অনেক বেশি। এবং এদের অধিকাংশই কোন-না-কোন সূত্রে কলকাতার ভীষণরকম জ্যান্ত পাবলিক থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। প্রথমদিকের বাংলা ছবিকে ট্যালেন্ট সাপ্লাই করত পাব্লিক স্টেজ। গিরিশ ঘোষ মারা গেছেন, কিন্তু তখনও স্টার, মিনার্ভা, রঙমহল ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে অভিনয় করছেন গিরিশপুত্র দানীবাবু, শিশির ভাদুড়ী, অহীন চৌধুরী থেকে সব তাবড় তাবড় অভিনেতারা। অমৃতলাল বসু তখনও সক্রিয়। শুধু অভিনেতা বা স্ক্রিপ্ট-রাইটারই নয়, টেকনিশিয়ানরাও আসছেন স্টেজ থেকে।
আর এদের কাজে লাগাচ্ছে কে? শুধু নিউ থিয়েটার্স নয়, এই সব ছোট বড় স্টুডিওগুলো। তাদের মধে বড় হাউজ ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার এমপি পিকচার্স, অরোরা স্টুডিও। এমপি বেশিদিন চলেনি। বন্ধ হয়ে যায় আরও অনেক সব ছোট স্টুডিওগুলো। তার কারণ একটাই। বাংলা ছবির বাজার অত বড় ছিলনা, যাতে এতগুলো প্রোডাকশান হাউজকে সাপোর্ট করতে পারে। ফলে, ইন্ডাস্ট্রির ভাষায়, কনসলিডেশন হল, এবং বিজয়ী হল নিউ থিয়েটার্স, অরোরা ধরণের গুটিকয় হাউজ। ঠিক এরকম ব্যাপার হয়েছিল অটোমোবাইল আসার পরে অ্যামেরিকায়। প্রথমে প্রচুর অটোমোবাইল কোম্পানি হয়েছিল। কিন্তু বাজারের পরিমাণ সীমিত হওয়ায় কনসলিডেশন হয়ে শেষ পর্যন্ত টিঁকেছিল তিনটি - ফোর্ড, জিএম আর ক্রাইসলার। ব্যবসার ইতিহাসে এরকম নজির অনেক আছে। এখনও হয়ে চলেছে।
যাকগে, মোদ্দা কথা হল বাজারের ডিম্যান্ড আর সাপ্লায়ের একটা সামঞ্জস্য যখন এল তখন গোটা দুত্তিন বড় হাউজ ছাড়া আর কেউ টেঁকার জায়গায় নেই। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজার আর্ধেক হয়ে যাওয়ায় বড় হাউজগুলোর নাভিশ্বাস উঠে বাংলা ছবি লাটে উঠল। এটাই আশি ভাগ কারণ বলে আমি মনে করি।
দ্বিতীয় যে কারণ - ব্যাংকের সঙ্গে পুঁজির পলায়ন, সেটার প্রভাব এত অল্প, যে অলমোস্ট নন-রিজন বলা যায়। ব্যাংক কোনদিনই ছবিতে টাকা ঢালতে উৎসাহী ছিল না। কারণ একটাই ছবির ব্যবসায় ঝুঁকি অসম্ভব বেশি, প্রায় ফাটকার মতন। ব্যাংক রিস্কি লোনের রাস্তায় হাঁটতে চায়না, যদি না তাদের ইনভেস্টমেন্ট আর্ম থাকে। ঠিক এই কারণেই সরকারকে ফিল্ম ফাইন্যান্সিঙে আসতে হয় - যা শেষে এনএফডিসি হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই ব্যাংকের চলে যাওয়ায় ছবির পুঁজিতে সরাসরি টান পড়েনি। ছবির টাকা আসত প্রাইভেট ফান্ড থেকে। দেশভাগে ব্যাবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের কালোবাজারে আবার প্রচুর নতুন পুঁজিও ঢুকেছিল - কাজেই পুঁজিটা ব্যাপার নয়।
তৃতীয় কারণ - ভারত সরকারের সক্রিয় প্রোমোশন সেটা ঠিক, কিন্তু সেটা কোনরকম ষড়যন্ত্র হিসেবে শুরু হয়েছিল - এটা ভাবা কষ্টকর। যেটা হল সেটা এই - আদতে ছবি তৈরির জায়গা ছিল মূলতঃ দুটো কলকাতা আর বম্বে। কলকাতা বম্বের থেকে এগিয়ে। ভেবে দেখুন দক্ষিণী ছবি - তামিল, তেলেগু - ছবি তৈরী হচ্ছে কলকাতায়। অহীন চৌধুরী লিখেছেন তিনি, ভাষা না জেনেও, স্রেফ টেকনিকাল বিদ্যেয় একাধিক দক্ষিণী ছবি পরিচালনা করেছেন কলকাতায় বসে। পরে যখন বম্বে ইডাস্ট্রি শক্তিশালী হল এই ছবি কলকাতায় না এসে বম্বেতে গেল - কারণ দূরত্বের হিসেবে আর খরচের হিসেবে সাশ্রয় হত। ভারত সরকারের পলিসির ফলে বম্বে যতই কসমোপলিটান শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, কলকাতা ততই প্রভিন্সিয়াল হয়ে পড়ল। এর ফলে বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ তৈরি হতে থাকল অনেক বেশি। সারা ভারত থেকে ট্যালেন্ট চলল বম্বেতে। অন্য মেজর সেন্টার হিসেবে কলকাতার ঘাড়ে কোপ পড়ল সবথেকে বেশি। এই হল বাংলার শিল্পীদের বম্বে যাওয়ার ইতিহাস। এই যাওয়া শুরু হয়েছে যুদ্ধের আগে। বিমল রায় গেছেন, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় গেছেন, শচীন দেব বর্মন গেছেন। গেছেন মানে গিয়ে পাকাপাকি থেকে গেছেন। আরও অনেকে গেছিলেন, ফিরে এসেছিলেন। অহীন চৌধুরী গেছিলেন চারমাসের জন্যে। যদ্দুর মনে পড়ছে ভীষ্মদেবও গিয়েছিলেন। এর সঙ্গে যুদ্ধের পরে আস্তে আস্তে বাংলার পাবলিক থিয়েটারে অধোগতিতে শিল্পী-টেকনিশিয়ান সাপ্লাইও কমে গেছিল। গণনাট্য ও তৎপরবর্তী নবনাট্য আন্দোলন বাংলা সিনেমাকে তত শিল্পী সাপ্লাই করেনি আদর্শগত কারণেই। একটা তুলনাই যথেষ্ট হবে - সাবেক স্টেজের স্টলওয়ার্ট শিশির ভাদুড়ী, অহীন চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস - এনার সবাই ছবির নিয়মিত অভিনেতা। নবনাট্যের শম্ভু মিত্র কোনদিনই নিয়মিত ছবি করেননি। উৎপল দত্ত নিয়মিত ছবি করতে শুরু করেন সাতের দশকে।
কাজেই, বাংলা ছবি লাটে ওঠার প্রধান কারণ আমি মনে করি বাজার। প্রধান মানে প্রায় একমাত্রই বলা যায়।
এই আপাততঃ।
এলেবেলে, ওকে, আমার পড়া আমি করে নেব। ভুলবশত ধারণা হয়েছিল আপনার বুঝি কিছু বলার আছে। দুঃখিত।