এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • এই আবিষ্কারের কাহিনিতে আছে চিকিৎসাবিজ্ঞান-গবেষণার যাবতীয় ক্ল্যাসিকাল উপাদান

    বিষাণ বসু
    আলোচনা | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি | ১১ অক্টোবর ২০২০ | ২৯২৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • হেপাটাইটিস-সি। বিশ্বে আনুমানিক সাত কোটি মানুষ এই রোগে ভুগছেন। তাঁদের মধ্যে কুড়ি শতাংশেরও কম মানুষ হেপাটাইটিস-সি সম্পূর্ণ সারিয়ে ফেলার মতো ওষুধ পেয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে এ বছর হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তিন বিজ্ঞানী হার্ভে অল্টার, মাইকেল হটন এবং চার্লস রাইস। এই গবেষণায় তাঁদের অবদান কী? আলোচনায় চিকিৎসক বিষাণ বসু


    সারা বিশ্ব যখন এক ভাইরাসের দাপটে আতঙ্কিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়—এবং যে সময়ে এ ধরনের বক্তব্যও রীতিমতো মান্যতা পাচ্ছে, যে, সামান্য একখানা ভাইরাসের ঠেলায় মানবসভ্যতার টলমলে অবস্থা, অ্যাদ্দিনে না পাওয়া গেল কোনো ওষুধ, না এল কোনো টিকা, তাহলে আর চিকিৎসাবিজ্ঞান এগোল কোথায়—ঠিক সেই সময়ে নোবেল কমিটি এই বছরে স্বীকৃতি জানাতে চাইলেন একটি ভাইরাসের আবিষ্কারকে। হ্যাঁ, এই দু-হাজার কুড়ি সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তিন বিজ্ঞানী—হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য।

    তিন চিকিৎসাবিজ্ঞানীর নাম—হার্ভে অল্টার, মাইকেল হটন এবং চার্লস রাইস। হটন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ—বাকি দুজন মার্কিন নাগরিক। এই তিন বিজ্ঞানী বা তাঁদের গবেষণা প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, তাঁদের গবেষণার প্রেক্ষিত এবং তাৎপর্য বোঝার জন্যেই, একটু হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস বা তজ্জনিত অসুখটা নিয়ে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।




    হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের একটি কণা। (ছবি সৌজন্য কোয়ান্টা ম্যাগাজিন)



    নামেই মালুম, হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস ভাইরাস-জনিত যকৃত বা লিভারের অসুখের কারণ। সি থেকেও অনুমান করা যায়, ভাইরাস-জনিত হেপাটাইটিসের একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ কারণ ইনি নন—পাঁচরকম ভাইরাস, এ, বি, সি, ডি, ই-এর অন্যতম মাত্র। এখানে-সেখানে জল খেলে জন্ডিস হবে-র হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস বা যে হেপাটাইটিসের জন্যে টিকা নিয়ে থাকেন, সেই হেপাটাইটিস-বি-র থেকে এই ভাইরাস আলাদা—এবং এই ভাইরাসের কারণে যে হেপাটাইটিস হয়, তার প্রকৃতিও ভিন্ন।

    সমস্যা হল, এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হলেও সবার ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-এর উপসর্গ হয় না। হলেও যেটুকু হয়, প্রাণঘাতী পর্যায়ে পৌঁছায় না। এক-তৃতীয়াংশ (বা এক-চতুর্থাংশ) মানুষের ক্ষেত্রে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমই ভাইরাসের মোকাবিলা করার জন্যে যথেষ্ট। তাহলে? হ্যাঁ, বাকি যে দুই-তৃতীয়াংশ (বা তিন-চতুর্থাংশ) মানুষের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস শরীরে বাসা বাঁধে, তাদের শরীরে এই ভাইরাস পাকাপাকি ভাবে রয়ে যায়। তাদের রক্ত থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে অন্যের শরীরে। এবং, যাদের শরীরে ভাইরাস রয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ যারা ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি-তে আক্রান্ত, তাদের কমবেশি এক-চতুর্থাংশ আক্রান্ত হতে পারেন অনারোগ্য সিরোসিস-এ, এমনকি যকৃতের ক্যানসারে।

    অতএব, হেপাটাইটিস-সি অসুখখানা খুব একটা সহজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০১৭ সালে বিশ্বে এই ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি অসুখে ভুগছেন সাত কোটিরও বেশি মানুষ। বছরে মারা যান কমপক্ষে চার লক্ষ—ওই সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে। না, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কার্যকরী কোনো টিকা এখনও অবধি নেই। কিন্তু, যেহেতু এই ভাইরাস ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে, তাই হেপাটাইটিস-সি আটকানো যেতে পারে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা গেলে—আর, ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি-এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু কার্যকরী ওষুধ রয়েছে, যার প্রয়োগে রোগাক্রান্তদের মধ্যে অন্তত পঁচানব্বই শতাংশকেই পুরোপুরি ভাইরাস মুক্ত করে ফেলা যায়। কাজেই একদিকে এই সাবধানতা অবলম্বন, এবং আর-এক দিকে তড়িঘড়ি রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা—এই দুই পথ ধরেই হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। লড়াইটা বিশ্বব্যাপী। আমাদের দেশও লড়াইটা লড়ছে—লক্ষ্য দু-হাজার তিরিশ সালের মধ্যে এ দেশ থেকে হেপাটাইটিস-সি-কে নির্মূল করে ফেলা।

    এবার ফ্ল্যাশব্যাক।

    গত শতকের চল্লিশের দশক নাগাদই বোঝা গেল, জীবাণুবাহিত হেপাটাইটিস মূলত দু-রকম। একটি জলবাহিত (বা খাবারবাহিত)—যাতে বাড়াবাড়ি রকমের জন্ডিস হয়, কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠা গেলে আর বিপদের ভয় নেই (হেপাটাইটিস-এ)। দ্বিতীয়টির ধরনটা একটু আলাদা—আপাত সুস্থ হয়ে গেলেও (এমনকি, আদৌ অসুস্থ হয়ে না পড়লেও) এই জীবাণু মানুষের শরীরে রয়ে যেতে পারে, এবং দীর্ঘমেয়াদে বড়ো ক্ষতি করতে পারে (হেপাটাইটিস-বি)। সিরোসিস, লিভার ক্যানসার ইত্যাদি। এই হেপাটাইটিস ছড়ায় রক্ত বা অন্যান্য দেহরসের মাধ্যমে।

    গত শতকের ষাটের দশকে বারুখ ব্লুমবার্গ আবিষ্কার করেন এই দ্বিতীয় প্রকৃতির হেপাটাইটিস রোগের কারণ ভাইরাসটি—হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে রোগের কারণ যে জীবাণু, সেটিকে না জানা অবধি কাজ এগোনো মুশকিল। ব্লুমবার্গের আবিষ্কারের পথ ধরেই এসে যায় হেপাটাইটিস-বি রোগের নির্ণয় পদ্ধতি—আসে একটি কার্যকরী টিকাও। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্যে ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান বারুখ ব্লুমবার্গ।

    ব্লুমবার্গের নোবেল প্রাপ্তির কাছাকাছি সময়েই মার্কিন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথে কাজ করছিলেন হার্ভে অল্টার। তিনি গবেষণা করছিলেন, মূলত, ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পর হেপাটাইটিসের প্রকোপ নিয়ে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস বিষয়ে জানাশোনা হওয়ার পরে এই ধরনের হেপাটাইটিস কমে এল অনেকখানিই—কিন্তু, পুরোপুরি নির্মূল হল না। প্রায় হেপাটাইটিস-বি-এর মতোই এই অজানা হেপাটাইটিসেও অনেক মানুষ ভুগছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্রনিক অসুখেও ভুগছেন। ইতিমধ্যে হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসের জন্যেও ডায়াগ্নোস্টিক টেস্ট বাজারে এসেছে। অল্টার দেখলেন, না, এই হেপাটাইটিসের কারণ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস নয়, আবার হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসও নয়। কিন্তু, কারণটা তাহলে কী?

    গবেষণায় দেখা গেল, যেমন আন্দাজ করা হচ্ছিল, সেটাই ঠিক। এই হেপাটাইটিস ছড়াচ্ছে রক্তের মাধ্যমে—আক্রান্ত রোগীর রক্ত শরীরে গেলে সুস্থদের মধ্যেও অসুখ ছড়াচ্ছে। আরও জানা গেল, মানুষ বাদে সেই রক্তের মাধ্যমে এই একই অসুখে আক্রান্ত হতে পারে আরও একটি মাত্র প্রজাতি—শিম্পাঞ্জি। হার্ভে অল্টার এই জীবাণুঘটিত হেপাটাইটিসের নাম দিলেন—নন-এ-নন-বি হেপাটাইটিস।

    কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও এই নন-এ-নন-বি হেপাটাইটিসের কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আন্দাজ করা হচ্ছিল, হেপাটাইটিস-এ বা হেপাটাইটিস-বি-এর মতো এর কারণও কোনো ভাইরাসই হবে—তবু, সেই বিশেষ ভাইরাসকে আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে আলাদা না করতে পারা অবধি কিছুই নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছিল না। অল্টারের কাজের পর, এক নতুন ভাইরাসঘটিত হেপাটাইটিসের অনুমান পাওয়ার পর পার হয়ে গেল একটি দশক—বাজার চলতি সব পদ্ধতিই প্রয়োগ করে দেখা গেল—ভাইরাসের খোঁজ মিলল না।

    সেসময় মাইকেল হটন গবেষণা করছিলেন বড়োসড়ো ওষুধ কোম্পানি শিরন-এর ল্যাবরেটরিতে। তাঁরা ধরলেন এক নতুন পথ। আক্রান্ত শিম্পাঞ্জির রক্ত থেকে জোগাড় করা হল ডিএনএ—নিউক্লিক অ্যাসিডের টুকরো—হ্যাঁ, সে ডিএনএ-র অধিকাংশটাই শিম্পাঞ্জির নিজস্ব হলেও হটন অনুমান করলেন, তার মধ্যে একটু হলেও মিশে থাকবে ভাইরাসের ছাপ। আবার সংক্রামিত মানুষের দেহে, অনুমান করা যায়, থাকবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি। অতএব, রোগীর সিরামে প্রাপ্ত অ্যান্টিবডি এবং শিম্পাঞ্জির রক্ত থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ-র ছোটো-বড়ো টুকরো মিলিয়ে দেখা শুরু হল। এধরনের মিলিয়ে দেখার পদ্ধতিতে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে বেশ কম—এবং এই রাস্তা ধরে এগোতে প্রয়োজন প্রায় অমানুষিক ধৈর্য ও অধ্যবসায়। কিন্তু, সাফল্য এল এই পথেই। শিম্পাঞ্জির রক্তে পাওয়া নিউক্লিক অ্যাসিডের টুকরো থেকে ক্লোন করে পাওয়া গেল ফ্লেভি ভাইরাস পরিবারের এক আরএনএ ভাইরাস (ভাইরালজিনোম)—দেখা গেল, সংক্রামিত মানুষের দেহে যে অ্যান্টিবডি, তা আদতে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধেই ক্রিয়াশীল। খোঁজ মিলল হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের।

    তবুও একটা ফাঁক রয়ে গেল। হেপাটাইটিস আক্রান্ত মানুষের ভাইরাস-যুক্ত রক্ত অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হলে তিনিও হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলেন—ভাইরাস-সংক্রামিত শিম্পাঞ্জির শরীর থেকে ক্লোন করে পাওয়া গেল সেই ভাইরাস—রোগীর শরীরে মিলল সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি—কিন্তু, এই ভাইরাসই (বা আরও ঠিক করে বললে, এই ভাইরালজিনোমই) যে মানবদেহে ঢুকে সংখ্যা বৃদ্ধি করে হেপাটাইটিস ঘটাতে পারে, তার অব্যর্থ প্রমাণ মিলল কই?

    সে কাজটিই করে দেখালেন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে চার্লস রাইস। হেপাটাইটিস-সি ভাইরালজিনোমের কিছু অংশ বাদ দিয়ে প্রজননক্ষম অংশটুকু বেছে নিয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে প্রজননক্ষম জিনোম তৈরি করা হল। সুস্থ শিম্পাঞ্জির যকৃতে প্রবেশ করানো হল সেই জিনোম। দেখা গেল, অনতিবিলম্বে শিম্পাঞ্জি আক্রান্ত হচ্ছে হেপাটাইটিস রোগে—শিম্পাঞ্জির যকৃতে রোগজনিত পরিবর্তন হেপাটাইটিস-আক্রান্ত মানব যকৃতেরই অনুরূপ।

    অতএব, তিনটি ধাপ -

    ১. হার্ভে অল্টার জানালেন, অজানা ভাইরাস ঘটাচ্ছে হেপাটাইটিস—যে হেপাটাইটিস রক্তবাহিত, কিন্তু হেপাটাইটিস-বি থেকে ভিন্ন—জলবাহিত হেপাটাইটিস-এ থেকেও ভিন্ন।

    ২. প্রচলিত পদ্ধতিতে রক্ত বা যকৃত থেকে ভাইরাস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে, মাইকেল হটন এক নতুন পদ্ধতিতে আলাদা করতে সক্ষম হলেন ভাইরালজিনোম—নাম দিলেন হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস।

    ৩. চার্লস রাইস প্রমাণ করলেন হেপাটাইটিস-সি অন্য কারও সহযোগিতা ছাড়াই, সম্পূর্ণ একক দক্ষতায় হেপাটাইটিস ঘটাতে সক্ষম।

    (একটু বলে রাখা যাক, এখানে প্রতিটি ধাপই অতিক্রম করা গিয়েছে টিমওয়ার্কের সুবাদে। হার্ভে অল্টার, মাইকেল হটন বা চার্লস রাইস ছিলেন নিজ নিজ টিমের লিডার—পুরস্কারের স্বীকৃতি তাঁদের মিললেও, আদতে স্বীকৃতিটি টিমেরই। নোবেল কমিটিও তাঁদের প্রেস রিলিজে প্রতিটি ধাপের বিবরণে অল্টার এবং তাঁর সহযোগীরা, রাইস এবং তাঁর সঙ্গীরা এরকম করেই উল্লেখ করেছেন।)




    হেপাটাইটিস-সি কীভাবে সংক্রমিত হয় সে বিষয়ে তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর কাজের সারসংক্ষেপের চিত্ররূপ (ছবি সৌজন্য উইকিপিডিয়া)



    এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা।

    চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেও, তিনজনের মধ্যে হার্ভে অল্টার বাদ দিয়ে বাকি দুজন কিন্তু চিকিৎসক নন—দুজনেরই বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি। অল্টার বয়োজ্যেষ্ঠ—এখন তাঁর বয়স পঁচাশি।

    চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা, বিশেষত যে গবেষণার প্রায়োগিক দিকটা আশু জরুরি, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ বা ডাক্তারের অবজার্ভেশন। চিকিৎসক যেহেতু সরাসরি আক্রান্তকে দেখেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ ও তজ্জনিত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অসীম। এই ভাইরাস আবিষ্কারের কাহিনি খানিক বিশদে বললাম এ কারণেই, কেন-না, এর মধ্যে মেডিকেল রিসার্চের ক্ল্যাসিকাল উপাদান সবই রয়েছে—চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তারের মনে প্রশ্ন জাগা, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে এক উদ্ভাবনী প্রতিভার ছকভাঙা পদ্ধতির সন্ধান, এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে হাইটেক গবেষণার পথে রহস্যের শেষে পৌঁছানো—চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য তিনটিই জরুরি। (শুধু টেকনোলজির মোহে আটকে থাকলে চিকিৎসা বা চিকিৎসাবিজ্ঞান, কোনোটাই এগোবে না।)

    আর এই তিনের মধ্যে যিনি মার্কিন নাগরিক নন, সেই মাইকেল হটনের জীবন নিয়ে আলাদা করে দু-কথা না বললেই নয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন ট্রাক-ড্রাইভার। ছেলেবেলায় লুইপাস্তুরের জীবনী পড়ে ভেবেছিলেন, মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করবেন। শেষমেশ বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে পড়লেও জীবাণুবিদ্যার সাথেই তাঁর আজীবন সংসার। হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস বা ভাইরালজিনোম আবিষ্কারের সুবাদেই এল তাঁর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি—পাশাপাশি মনে রাখা যাক, হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাসের জিনোমের অন্যতম আবিষ্কর্তাও তিনিই (হেপাটাইটিস-সি জিনোম আবিষ্কারের বছর তিনেক আগেই)।

    মাইকেল হটন নিয়ে পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম, এ দেশে ট্রাক-ড্রাইভারের ছেলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করলেই আমরা ধন্য ধন্য করি… আসলে, প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্ব, মূল ফারাকটা ওই সুযোগের… বাজার-টাজার নিয়ে হইচই করার আগে, ওই সুযোগের সাম্যটুকু নিশ্চিত না করা গেলে, বাজার-বিজ্ঞান-পুঁজি-সাম্যবাদ সবই কেমন একটা আধা খ্যাঁচড়া হয়ে যায়।

    থাক সে কথা। আরও একবার মনে করাই, এই ত্রয়ীর আবিষ্কারের হাত ধরেই এসেছে হেপাটাইটিস-সি থেকে মুক্তির দিশা। হেপাটাইটিস-বি বা এইচআইভি-র মতো ব্লাডব্যাংকে সংগৃহীত রক্তে হেপাটাইটিস-সি পরীক্ষাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—ব্লাড ট্রান্সফিউশন থেকে হেপাটাইটিস-সি ছড়ানো আটকানো গিয়েছে অনেকখানিই। ভাইরালজিনোম আবিষ্কৃত হলে তার বিরুদ্ধে ওষুধের গবেষণা এগোতে পারে দ্রুত—খুবই কার্যকরী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও এখন রয়েছে হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের বিরুদ্ধে। আজ যে আমরা হেপাটাইটিস-সি-মুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখছি, তার উৎস কিন্তু অল্টার-হটন-রাইসের এই গবেষণা।

    কিন্তু, যে কথা আগে বলছিলাম, ওই সুযোগের অসাম্য—সে সুযোগের তালিকার মধ্যে চিকিৎসা করাতে পারার সুযোগও ধরতে হবে বইকি!! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, আনুমানিক যে সাত কোটি মানুষ হেপাটাইটিস-সি রোগে ভুগছেন, নিজের অসুখের ভয়াবহতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল তাদের মধ্যে কুড়ি শতাংশেরও কম—এবং আনুমানিক পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ হেপাটাইটিস-সি সম্পূর্ণ সারিয়ে ফেলার মতো ওষুধ পেয়েছেন—হ্যাঁ, সাত কোটির মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ। এর জন্য অবশ্য গবেষকদের দায়ী করার মানে হয় না। গবেষণার ফসল সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া গেল কিনা, সে নিশ্চিত করার দায় বিজ্ঞানীদের নয়। সে দায় যাঁদের, তাঁরা যদি বিজ্ঞানীদের মতোই দায়বদ্ধ হতেন, তাহলে দুনিয়াটাই অন্যরকম হতে পারত। আর, তার কিছুটা দায় কি আমাদের মতো আম নাগরিকেরও নয়?




    গ্রাফিক্স: স্মিতা দাশগুপ্ত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১১ অক্টোবর ২০২০ | ২৯২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | ১১ অক্টোবর ২০২০ ০২:৫৬98246
  • "কিন্তু, যে কথা আগে বলছিলাম, ওই সুযোগের অসাম্য—সে সুযোগের তালিকার মধ্যে চিকিৎসা করাতে পারার সুযোগও ধরতে হবে বইকি!! "

    ওষুধ আর চিকিৎসা পদ্ধতির পেছনে যতটা অর্থ ও আলোচনা গবেষণার সময় সামর্থ্য ব্যয় করা হয় সমাজে, তার ন্যূনতম সময় ও যে কে কিভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন, তার পিছনে দেওয়া হয় না। হলে হয়ত অন্যরকম হত। এই যে স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে লোকে বলে, সে ব্যাপারটা মূলত চিকিৎসার নাগাল পাবার অধিকার।  সুযোগের অসাম্য একটা বড় সমস্যা। 

  • সমুদ্র সেনগুপ্ত | 2409:4060:201d:51ba::c9f:***:*** | ১১ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৫৬98250
  • "সুযোগের অসাম্য" প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ভাইরাল হেপাটাইটিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালু হয়েছে আমাদের দেশে ও আমাদের রাজ্যে। বিশদ জানতে।


    https://www.nhp.gov.in/national-viral-hepatitis-control-program-(nvhcp)_pg

  • বিষাণ বসু | 2409:4060:20f:6d4c:ad59:fb56:f191:***:*** | ১১ অক্টোবর ২০২০ ০৯:২২98252
  • জানি সমুদ্রদা।


    দুহাজার তিরিশের মধ্যে হেপাটাইটিস-সি নির্মূল করার লক্ষ্যমাত্রার কথাটা ওখান থেকেই নিয়েছি।

  • Chaitali Chattopadhyay | 122.175.***.*** | ১১ অক্টোবর ২০২০ ১০:৪৯98256
  • বিষাণ বসু-র লেখাটি নিয়ে এত ভালো তত ভালো মন্তব্য না করে, আমূল কৃতজ্ঞ হয়ে বসে থাকতে হয় এই আন্তর্জাতিক তথ্যগুলি জানানোর জন্য।


    কী সহজ সুস্বাদু ভাষায় এই পরিবেশন!

  • শিবাংশু | ১২ অক্টোবর ২০২০ ১১:৪৪98327
  • কিছু জানতুম। অনেকটাই জানতুম না। অনেক ধন্যবাদ। 

  • বনমালী সাহা | 2401:4900:16c1:7443:74d2:52b8:b2ab:***:*** | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ১২:২৫98569
  • গুরু গম্ভীর বিষয়ে কত প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা যায় হেপাটাইটিস সি ও নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলোচনা থেকে তা বোঝা যায়।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন