বিশ্ব এখন করোনা-কণ্টকিত! প্রতিদিন কাজে ঢুকলেই আতঙ্ক হয় আজ আবার আইসোলেশন এরিয়ায় কজন মরণাপন্ন রুগীর মুখ দেখে শিফটটা শুরু হবে ! তাই সপ্তাহের শেষে যখন একটু সময় পেয়ে গুরুচন্ডালি খুলে বসি তখন স্বাভাবিকভাবেই মন চায় একটু হালকা পরিবেশ| কিন্তু সে গুড়েও বালি| ইন ফ্যাক্ট এর আগে আমি নিজেই দুটো বেশ গুরুগম্ভীর ব্লগ লিখে ফেলেছি! কাজেই দোষ প্রধানত আমারই|
সুতরাং ফিজিশিয়ান হীল দাইসেল্ফ এই নিয়মানুযায়ী ভেবে দেখলাম যে করোনা অতিমারীর সময় যে অন্য ধরণের অভিজ্ঞতা হয় নি এমন তো নয়; অতএব তাই নিয়েই লিখি না কেন?
গত কয়েক মাসের দুটি ঘটনা মনে এমনই দাগ কেটেছে যে তা সহজে ভোলাবার নয়| প্রথম ঘটনাটি একটি রুগীকে কেন্দ্র করে তাই নাম ধাম ইত্যাদি গোপনীয় রাখতে হচ্ছে| ঘটনাটিও আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য , কিন্তু যখনি আমার সমগোত্রীয় কোনো ডাক্তারের কাছে বলেছি তাঁরা বিনা বাক্যব্যয়ে "এমন তো কতোই হয়" ভাব দেখিয়ে মাথা নেড়েছেন , আর সেই সাথে নিজেদের কোনো অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন!
গপ্পের আগে নিজের একটু পরিচয় দিই; আমি আপৎকালীন চিকিৎসক| বঙ্কিমচন্দ্রের "বিপদ আর আপদের" গল্প যাদের কাছে সুপ্রচলিত তাঁরা "আপদ" কি জিনিস সেটা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন| সহজ ভাষায় বললে , ছোটবেলায় হুড়োহুড়ি করে খেললে দাদু বলতেন "করিস না , ব্যাথা পাবি| তখন ব্যাথার উপর মারবো|" অর্থাৎ , আকাশ ফাটিয়ে চ্যাঁচাবো; তখন খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ ফেলে উঠতে হবে , সে এক আপদ! বড়ো হয়ে পঞ্চাশোর্ধে (বনে না গিয়ে ) এই আপদ নিয়েই ঘর করতে হয় আমাকে|
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে একদিন ডিপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি সোফি (আমাদের সিনিয়র নার্স ) হাপুস নয়নে কাঁদছে আর আরো তিনজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ! কাছে গিয়ে বুঝলাম , সোফি কাঁদছে না! হাসছে! আর এমনই হাসছে , যে দুচোখ থেকে অঝোরে জল গড়াচ্ছে , এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না! তিনজন নার্স ওকে ধরে রেখেছে! কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে হাসির দমকের মধ্যে কোনোমতে হাত বাড়িয়ে কিউবিকলের ভেতরে দেখিয়ে দিলো! ভিতরে একটি সাহেব পুঙ্গব ট্রলিতে উপুড় হয়ে বিরাজমান , তাঁর দুগজ চামড়াকে কোনোমতেই "সাদা" বলা চলে না ! কটির ধটি হিসেবে একটি সামান্য অন্তর্বাস| দুচোখের চারদিকটা দেখলে জমির আদত রংটি আন্দাজ করা যায়| বাকি পুরো সর্বাঙ্গ একটা অদ্ভুত লাল টুকটুকে অবস্থা| ছেলেটা যন্ত্রনায় সারাক্ষন আহা-উহু করছে!
ব্যাপার কি ? এ ব্যাটা এই রকম ঝলসানো গলদা চিংড়ির মতো চেহারা করলো কি করে? আর এতো হাসাহাসির হয়েছে কি?
হিস্ট্রি নিয়ে বোঝা গেলো , ব্যাপার গুরুতর! ছেলেটির দু দিন আগে সামান্য সর্দি হয়; করোনা পরীক্ষাও হয়েছে , নেগেটিভ! কিন্তু সেই ছেলেটির সে সব সামান্য পরীক্ষায় বিশ্বাস নেই ; তাই করোনা ভাইরাসএর মোক্ষম চিকিৎসা সে নিজের ওপর শুরু করেছে! দুদিন আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তৃতায় শুনেছে যে আল্ট্রাভায়োলেট লাইট করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে গুগল খুলেও সে সেই তথ্যই পেয়েছে , আর অপেক্ষা কিসের ? ব্যবস্থাও ভালোই কারণ তার গার্লফ্রেন্ডের সান ট্যান সালোন এর ব্যবসা , সে ব্যবসা লকডাউনের জন্য বন্ধ আছে| এই ছেলেটি সান ট্যান ল্যাম্পের তলায় দু ঘন্টা শুয়েছিল সর্বাঙ্গকে ভাইরাস মুক্ত করবার জন্য! লজ্জা নিবারণের জন্য (এবং সম্ভবত ফ্যামিলি জুয়েল যাতে অক্ষত থাকে সেই জন্য )একটি অন্তর্বাস , আর আই শিল্ড ছাড়া বাকি সর্বাঙ্গ ছিল সম্পূর্ণ নিরাবরণ ; আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি যাতে ভালো ভাবে কাজ করতে পারে|
কাজ চমৎকার হয়েছে , সারা দেহে সান বার্ন! জেলোনেট ইত্যাদি দিয়ে সর্বাঙ্গ ড্রেসিং হলো ; তার চেহারাখানাও হলো খোলতাই! মিশরীয় মমিও দেখে লজ্জা পাবে| তার গার্লফ্রেন্ড এসে ব্যাপার দেখে হাসতে আরম্ভ করলো ( ওই সোফি'র মতোই )| বললো "তুমি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কথা বিশ্বাস না করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বিশ্বাস করেছো?"
তার দু দিন আগেই ট্রাম্প বলেছিলেন আল্ট্রাভায়োলেট লাইট আর ব্লিচ দিয়ে করোনা ভাইরাসএর চিকিৎসা সম্ভব হলেও হতে পারে!
উপরোক্ত ঘটনাটি সর্বৈব সত্য , যদিও সিভিলিয়ানরা সহজে বিশ্বাস করতে চান না! বিশ্বাস করেন শুধু ইমার্জেন্সি ফিজিশিয়ানরা তাঁরা এর চেয়েও বড়ো মূর্খদের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদের নিজেদের মুর্খামির হাত থেকে!
দ্বিতীয় ঘটনাটির ভুক্তভোগী আমি নিজে | এই করোনা অতিমারীর সময় জুন মাসের শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্যান্টিন থেকে দিবারাত্র করোনা - যোদ্ধাদের বিনাপয়সায় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল| সেটা নাকি সারা ব্রিটেনের বাসিন্দাদের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন| সবাই বিশেষত যাঁরা লেট শিফট করতেন তাঁরা খুবই উপকৃত হতেন| অন্তত সেই রকমই ধারণা ছিল| আমি হাসপাতালের পাশেই থাকি , সুতরাং আমি বাড়ি থেকেই নৈশ আহারটি নিয়ে যেতাম| এক দিন পারিনি| সেটা ছিল শুক্রবার , আমার লেট শিফট; মানে বিকেল চারটে থেকে রাত বারোটা| সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় একটা হয়ে যায় , এবং বাড়ি ফিরেই সোজা বিছানা!
সেদিন মেনুতে ছিল ফিশ এন্ড চিপস|
সাহেবদের এই সুখাদ্যটির সঙ্গে যাঁদের পরিচিতি নেই তাঁদের বলি , প্রায় দেড় বিঘৎ লম্বা চার ইঞ্চি চওড়া ও ইঞ্চি দেড়েক পুরু একটি কড মাছের টুকরোকে ব্যাসন জাতীয় একটি ব্যাটারে ডুবিয়ে ভাজা হয় , যাতে তার থেকে তেল চুঁইয়ে পড়ে! আর সেই সঙ্গে যে মহিলা সার্ভ করেন তিনি বলেন , " ডু ইউ ওয়ান্ট সাম চিপস উইথ দ্যাট লভ !" বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে একটা বেলচার মতো জিনিস দিয়ে হুড় হুড় করে চর্বিতে ভাজা মোটা মোটা চিপস ঢেলে দ্যান! সেই দেবদুর্লভ দৃশ্য দেখলেই , দেখতেও হবে না , তার কথা ভাবলেই কোলেস্টেরোলে করোনারি আর্টারিগুলো বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়| সে চিপসের পাহাড় বেড়াল কেন , চিতাবাঘও ডিঙোতে কষ্ট পাবে!
ক্যান্টিনে সামাজিক দূরত্ব বজায়ের ঠেলায় বসে খাবার জো নেই| খাবারের বাক্স আর প্লাস্টিকের কাঁটা-চামচ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সবাইকে|
বাক্সটা হাতে নিয়েই মনে হলো এতো হালকা লাগছে কেন?
ডিপার্টমেন্টের স্টাফ রুমে বসে বাক্সের ঢাকনা খুলে চোখ চড়কগাছ!
কুল্লে ষোলোটি চিপস সেই বাক্সে বিরাজমান , আর তার উপরে যে "ফিশ" টি রয়েছে সেটা দেখে প্রথমটা মনে হয়েছিল গোল্ডফিশ! তারপর মনে হলো , না অতটা নয়! তবে ছোটবেলায় সাদার্ন মার্কেটে যে ছোট ছোট মাছ নিয়ে আসা হতো (আমাদের চক্ষুশূল ছিল) যাকে দাদু বলতেন " লাফাইন্যা মাছ " এটা সেই গোত্রীয় কিছু! মোটামুটি ট্যাংরা মাছের সাইজের একটুকরো মাছ ভাজা তার মধ্যেও ব্যাটারের অংশই বেশি| প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো , ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাক্স খালি হয়ে গেলো , কিন্তু পাকস্থলীর অবস্থা পৃথিবীর মতো - এক ভাগ স্থল! বাকিটাও মা ধরিত্রীর মতই - জল দিয়ে ভরতি করতে হলো!
পরে জেনেছিলাম কলেজ জীবনে মাসের শেষে শিবুদাকে বলতাম তিনটে চা'কে পাঁচটা করতে , এটা একটা মাছের টুকরোকে আট পীস করা হয়েছে!
কোনোমতে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলাম - সেই পৌনে একটাই বাজলো| তখন হেঁশেল উঠে গেছে| অনেক খুঁজে পেতে এক প্যাকেট বিস্কুট পেয়ে মনে হলো স্বর্গের এক ধাপ নিচে পৌঁছে গিয়েছি! সামান্য মিয়োনো বিস্কুট যে অতো ভালো খেতে হতে পারে তা চোদ্দ পুরুষের জন্মেও ভাবতে পারিনি!
অবশ্য এর জন্যে কারুর থেকে কোনো সিম্প্যাথি পাইনি; প্রত্যেকে (বন্ধু , আত্মীয় সবাই ) একবাক্যে বলেছিলেন " আরো যাও মিনিমাগনার খাবার খেতে! সারা সকাল বাড়িতে বসে ছিলি খাবার বানিয়ে নিতে পারিস নি ?"
সত্যি দেয়ার ইজ নো জাস্টিস ইন দিস ওয়ার্ল্ড!
(পুনশ্চ :- এই দুটি দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করলাম , সুধী পাঠক দরদ দিয়ে পড়বেন এই আশায়! আর সেই সঙ্গে মনে রাখবেন , দেয়ার আর নো ফ্রি লাঞ্চেস , এই আপ্তবাক্যটি অবশ্যই সত্যি| আমার সেই শিক্ষা হাড়ে হাড়ে হয়েছে|)
এই কোরোনার চক্করে আমি ডিটারজেন্ট দিয়ে সব সবজি ধুয়ে নিচ্ছিলুম। একদিন দেখি ফ্রাই প্যানে শুধুই ফেনা যত হাতা দিয়ে নেড়ে দি তত ফেনা !!!! পুরো তরকারি কমোডে চালান দিলুম :(((
সেই থেকে আর ডিটারজেন্ট নয় খাবার সোডা দিয়ে ধুচ্চি :|
ওই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ব্লীচ দিয়ে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা!