কয়েক সপ্তাহ আগে, ডিপার্টমেন্টের একাডেমিক মিটিঙে যার জার্নাল ক্লাবে বক্তৃতা করার কথা ছিলো, তিনি হঠাৎ ডুব মেরেছিলেন। ফলে সমস্ত দায়-দায়িত্ব পড়েছিল এই শর্মার ঘাড়ে! হাতে সময় ছিল কুল্লে সাঁইত্রিশ মিনিট। মহা মুস্কিল, একেই বলে শিরে সংক্রান্তি। কি ভাগ্যিস যখন করোনাভাইরাস হয়ে বিছানায় পড়েছিলাম, তখন আশংকা হয়েছিল প্রাণে বাঁচবো কি না। ফলে প্রতিদিন তিনটে করে জার্নাল আর্টিকেল পড়তাম। অবস্থাটা এমনই দাঁড়ায় যে সহধর্মিনী শেষ মেশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, বলেছিলেন এই পাগলামি বন্ধ না করলে আমার মৃত্যুর কারণ করোনাভাইরাস হবে না!
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা! যে পেপারটি মনে দাগ কেটেছিল সেটি কিন্তু আপৎকালীন চিকিৎসার ধরে কাছেও যায় না! সেটা সম্পূর্ণভাবে ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি সংক্রান্ত। বাদুড়ের দেহে বিভিন্ন জীবাণু ভাইরাস কিভাবে বাসা বাঁধে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চালায় এই পেপারের নির্গলিতার্থ ছিল তাই। আর একটি ব্যাপার মনে দাগ কেটেছিল পেপারটির প্রধান অথর এক বাঙালি - অরিঞ্জয় ব্যানার্জী|
সুধী পাঠক একটা ভাইরাসের কথা কল্পনা করুন। সে ভাইরাসটি বাসা বাঁধে প্রধানত বাদুড় আর শেয়ালের দেহে; তার কারণে এই দুটি প্রাণীর মৃত্যুও হয়। মানুষের দেহেও তার সংক্রমণ হয় প্রধানত লালার সাহায্যে অর্থাৎ বন্য বাদুড় বা শেয়ালের কামড়ের মাধ্যমে। মানুষের ক্ষেত্রে রোগটি ১০০% মারাত্মক - একবার হলে রোগী কোনোমতেই বাঁচবে না! মানুষের ক্ষেত্রে আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হয় , রোগীর গায়ে জোরে হাওয়া দিলে বা জলের আওয়াজ হলেই প্রবল খিঁচুনি আরম্ভ হয়ে যায় যার ফলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। ভাইরাসটি নিউরোট্রপিক অর্থাৎ নার্ভ কোষের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে এনকেফেলাইটিস জাতীয় একটি অসুখের সৃষ্টি করে। ইনি প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেন স্কটল্যান্ডের একটি গুহা থেকে। ডেভিড ম্যাকরী নামক এক বনকর্মী গুহায় ঢুকে বাদুড়ের কামড় খান, এবং শেষ পর্যন্ত মারা যান। ইনিই এই অসুখের বলা যেতে পারে, Index কেস।
একটু চেনা চেনা লাগছে কি অসুখটাকে? লাগবার কথা; যিনি আমাদের সুপরিচিত rabies, মানে জলাতঙ্ক!
আসল কথা, বাদুড় প্রাণীটা (অবশ্য একটা প্রাণী নয়; বেশ কিছু distinct জাত আছে বাদুড়দের) খুব বিচিত্র। তাদের দেহে বিভিন্ন জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে কিন্তু বাদুড় রোগগ্রস্ত হয় না। Ebola, Marburg, Zika, ইত্যাদি ভাইরাস, SARS-1, HENDRA, MERS, এবং অবশ্যই সার্স-কোভ-২; এঁরা সবাই বাদুড়ের দেহে বাসা বাঁধেন এবং সময়ে- অসময়ে সেখান থেকে লাফ মেরে মানুষের দেহে আসতেও দ্বিধা করেন না! কিন্তু আশ্চর্য্য ব্যাপার এঁরা কেউই বাদুড়কে বিঁন্দুমাত্র রোগগ্রস্তও করেন না!
ব্যাপারখানা কি? বাদুড়ের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মোধ্যেই কি COVID ১৯ এর চিকিৎসার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে? দেখা যাক!
অন্য সব প্রাণীর মতো বাদুড়েরও রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে। তার প্রথম অংশটা অন্তর্নিহিত (innate immunity)| এই ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছে বাদুড় উড়তে শুরু করার পর থেকে। কয়েক লক্ষ বছরে আগে। আমাদের চোখে আকাশে ওড়া ব্যাপারটা অনায়াস মনে হলেও এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আমাদের সবার ক্ষেত্রেই "মা যে হয় মাটি তার" আর এই মায়ের কল ছেড়ে বেরোনোটা খুবই শক্তিনির্ভর। যাকে বলে energy dependent| আর এই শক্তির অনেকটাই খরচ হয় তাপ উৎপাদন করতে গিয়ে। আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্সএ যাঁদের উৎসাহ আছে তাঁরা জানবেন যে ম্যারাথন দৌড়ের পর দৌড়বীরদের টেম্পারেচার প্রচুর বেড়ে যায় এমনকি ৪১ সেলসিয়াস পর্যন্ত। বাদুরের খেত্রে এই ব্যাপারটা হয় আরো অনেক বেশি। বাদুড়ের তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৪৭ সেলসিয়াস অব্দিও ওঠে যেতে পারে। অটো বেশি জ্বর হলে মানুষ সাধারণত বাঁচে না কিন্তু বাদুড়ের কাছে ইটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে একটা ব্যাপার হয়। এই তাপমাত্রায় ভাইরাস বার্তা পাড়ে না! তা ছাড়া আছে বিভিন্ন ধরণের ইন্টারফেরন; সেগুলোও ভাইরাস মাল্টিপ্লিকেশনে বাধা দেয়। সহজ ভাষায় বাদুড়ের ক্রমবিবর্তনগত ভাবে একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে রোগ প্রতিরোধ করবার।
এখন যদি তাই হবে তাহলে মানুষের তা থাকতে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধেটা কয়েক লক্ষ বছরের! ন্যাচারাল সিলেকশন ব্যাপারটা কয়েক দিন বা কয়েক মাসের মধ্যে কাজ করে না। সম্ভবত সেই জন্যেই হার্ড কমিউনিটি কথাটা মানুষের ক্ষেত্রে নেহাত মুখের কথাই থেকে যাবে!
ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। যে কোনো সংক্রমণ বা আঘাতেই আমাদের শরীরে একটি রিঅ্যাকশন হয়। তার নাম ইনফ্লামেশন। সংক্ষেপে আছাড় খেয়ে পড়লে গোড়ালিতে যে ব্যাপারটি হয় সেটা দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে। গোড়ালি ফুলে ঢোল হয়; লাল হয়ে যায়; ব্যাথা করে; জায়গাটা গরম হয়ে যায়; সর্বোপরি ঠিক কাজ করেন বলে ল্যাংচানো শুরু হয়। ইংরিজিতে বললে এই redness, heat, pain, swelling আর loss of function এর সমাহারই ইনফ্লামেশন। সাধারণত শরীর এই প্রক্রিয়াটি চালায় নিজেকে সরিয়ে টুলবার জন্যে; তবে মাঝে মাঝে এই চেষ্টাটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন আমাদের ঊপোসীরা গুলো থেকে রক্তের জলীয় অংশটা বেরিয়ে আসে ( মানে আক্ষরিক অর্থে শরীরের রক্ত জল হয়ে যায়! ) প্রচন্ড জ্বর আসে; রক্তচাপ সাংঘাতিক কমে যায়। এর নাম Systemic Inflammatory Response Syndrome (SIRS)| অত্যন্ত মারাত্মক রিঅ্যাকশন এই ব্যাপারটা।
করোনাভাইরাস ইনফেকশনে যারা মারা যান তাঁদের বেশির ভাগই মারা যান এই সমস্যাটির জন্যে।. ওই যে ফুসফুসে পেঁজা তুলোর মতো চেহারাটা যেটা আমরা আজকাল অনেকেই ঘষা কাঁচের মতো বলে চিনি, সেই বস্তুটি হয় এই ক্যাপিলারি থেকে সিরাম লিক করার জন্যে। সেই সাথে ব্লাড প্রেসার কমে যায় , যার ফলে ব্রেন এবং অন্যান্য প্রত্যঙ্গগুলো অক্সিজেন পায়না। এটা ইমিয়ান রিঅ্যাকশন , কিন্তু মারাত্মক আকারে! (Dexamethasone জাতীয় স্টেরয়েড সম্ভবত এই জন্যেই করোনাভাইরাস জনিত নিউমোনিয়ার কাজ করে। )
বাদুড়ের ক্ষেত্রে কিন্তু এই ঘটনাটি দেখা যায় না।
মানুষের শরীরের সমস্ত কোষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধকারী কোষ প্রায় ৭%। বাদুড়ের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা অনেক কম! সাড়ে তিন শতাংশ। ফলে ইতিপূর্বে যে কারণগুলোর কথা লিখেছি তার জন্যে বাদুড়ের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে ভাইরাল রোগ প্রতিরোধ করবার; প্রথমত তাদের শরীরে ভাইরাস ভালো করে রিপ্রোডিউস করতে পারে না , তাই ভাইরাসের সংখ্যাটা অনেক কম; তার মধ্যে যারা আছে তারা বিরাট কিছু অসুখও শুরু করতে পারে না। কিন্তু প্রতিরোধকারী কোষের সংখ্যাটা কম হবার ফলে ভাইরাস ভাইরাসের মতোই থাকে, adapted হয়ে। ইমিউন রেসপন্সটা হয় অনেক কম। বাদুড়ের যে কোনো RNA ভাইরাস ইনফেকশন হলেই তাদের ইন্টারফেরন রেসপন্সটা খুব শক্তিশালী , কিন্তু ইনফ্লামেশন জাতীয় রেসপন্সটা পরিমানে অনেক অল্প। ফলে ভাইরাসও মরেনা অথচ বাদুড় থাকে অক্ষত! প্রকৃতির আশ্চর্য্য লীলাখেলায় স্নান হয় কিন্তু বেণী ভেজে না!
ইমিউনিটি থেকে আসা যাক মানুষের সংক্রমণে। বোগোতো প্রায় তিরিশ বছরে বেশ কিছু RNA ভাইরাস - নিপাহ, হেন্ডরা , সার্স , মের্স ,এবং অবশ্যই নভেল করোনা বাদুড়ের থেকে অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়েছে। মের্স এর ক্ষেত্রে আরবি উট , হেন্ড্রার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার ঘোড়া ইত্যাদি। সব ক্ষেত্রেই বাদুড়েরা তাদের নিজস্ব বন জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ইন্দোনেশিয়া ,ভারত , ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাস যেমন একটা অজানা ব্যাধির রূপ নিয়ে মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করতো; এই করোনাভাইরাস তেমনি হয়তো অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। (প্যাংগোলিন -তথ্যটা সম্ভবত ঠিক নয় - তাই এই বিশেষ পিপীলিকাভুক প্রাণীটির উল্লেখ করছি না। ) তবে সব ক্ষেত্রেই একটা ব্যাপার মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় - এই spillover infection এর অন্যতম কারণ বন্য বাদুড়ের পরিধিটা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা। সেটার জন্যেও দায়ী মানুষই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বোন জঙ্গল ধ্বংস করা হয়েছে উন্নতি আর প্রগতির নামে| ফলে ozone লেয়ারে ফুটো ; man made climate change ইত্যাদির সঙ্গে আমরা আজ সম্মুখীন নানান অজানা-অচেনা ভাইরাসের সঙ্গে , তার বেশির ভাগই এখনো কোনো রেনফরেস্টের মধ্যে ( সম্ভবত ) কোনো বাদুড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে। সে বাদুড় কেনিয়ার কিটুম গুহায় মধ্যে থাকতে পারে। অলরেডি সেখানে মারবুর্গ ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া গেছে। ব্রাজিলের আমাজানের রেইনফরেস্ট প্রেসিডেন্ট বলসানারও কেটে সাফ করার চেষ্টা করছেন বহুদিন; প্রতিদিন এক-একটি ফুটবল মাঠের পরিমান জঙ্গল হাওয়া হচ্ছে সেখানে!
Sir Peter Medawar ভাইরাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন "ভাইরাস হচ্ছে প্রোটিনে ঘেরা এক টুকরো দুঃসংবাদ! " এই দুঃসংবাদ এড়ানো সম্পূর্ণ আমাদের হাতে। আমাদের বেশী দূঃসাহস করাটা বোধহয় উচিৎ নয়।
References:-
1. The Proximal origin of SARS-CoV-2.Nature Medicine; https://doi.org/10.1038/s41591-020-0820-9
2. Novel Insights Into Immunology of Bats. Immunology 24/01/2020. A Bannerjee et al. https://doi.org/10.3389/fimmu.2020.00026
3. Greta Thunberg : How Dare You speech to UN General Assembly.
এখনো কম্পিউটারে টাইপ করাটা সড়গড় হলো না! হার্ড কমিউনিটি নয়, হার্ড ইমিউনিটি! পরে এডিট করার চেষ্টা করব।
খুব দরকারি তথ্য। ভাষা সাবলীল ও সহজ। আমার মত সাধারণ পাঠক ও পড়ে বুঝেছে।