লকডাউনে বইয়ের ব্যবসা তো মার খেয়েইছিল, তারপর আবার আমপানের বৃষ্টিতে ঘরে-রাখা প্রচুর বই নষ্ট হয়েছে। শুভঙ্কর বৌ-ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, মাস তিনেক কাটিয়েছে ফ্রি রেশন আর ছেলের ইস্কুলের চাল-আলুর ভরসায়, তারপর শ্যামনগরের চটকলে মজুরের কাজের লেগেছে। তিনশো টাকা রোজে কাজের কথা বলে এক ঠিকাদার কাজে লাগিয়েছিল, দিন কুড়ি কাজ করিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। বহু ঘুরিয়ে শেষে দিনে দু’শো টাকা রেটে টাকা দিয়েছে, তা-ও বেশ খানিকটা বাকি রেখে। আর হ্যাঁ, দেওয়া টাকার থেকে ফের দু’শো টাকা নিয়ে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। মদ খাওয়ার জন্য ওই টাকাটা দেওয়া নাকি নিয়ম। অভিমানী শুভঙ্কর আর চটকল মাড়াচ্ছে না। সাইকেলের কেরিয়ারে বই বেঁধে দূরে দূরে যাচ্ছে ফিরি করতে। সরকারি রেট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের চটকলে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি শুরু দিনে ৩৭০ টাকা থেকে। সে জ্ঞানটা শুভঙ্করকে দিতে গিয়ে নিজেকে কেমন নিষ্ঠুর মনে হল। আপাতত যে বাইশশো টাকা এখনও দেয়নি ঠিকাদার, সেটা উদ্ধার করার চেষ্টায় আছে সে।
মালদহের মানিকচক ব্লকের মানসী একবার মিটিং-এ গিয়ে শুনেছিল, হাজার বিড়ি বাঁধলে ১৯০ টাকা, এই হল রেট। মানসীরা কোনও দিন পায়নি। আশেপাশের গ্রামে ১৪০ টাকা অবধি রেট শুনেছে, তাদের ধরমপুর গ্রামে কোনও দিন ১২০ টাকার বেশি ওঠেনি। আর এখন, লকডাউনের পর, সেই রেট নেমে এসেছে ৯০ টাকায়। যা বাঁধতে দেড় দিন লাগেই। ধরমপুরের অন্তত দু’শো মহিলা বিড়ি বাঁধেন। লকডাউনের পর বাজারে বিড়ির দাম বেড়েছে, দর কমেছে শ্রমের। মানসী ফোনে বলছিল, বোঝে তো সবই, কিন্তু করবে কী? মালিকের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি, দালালরা পাতা দিয়ে যায়, আবার সপ্তাহে পাঁচ টাকা কেটে নেয় নিজেদের জন্য।
সুন্দরবনের সন্দেশখালি, ন্যাজাটের বানভাসি গ্রাম বাউনিয়া। মেয়েরা এসেছিল মেডিক্যাল ক্যাম্পে ডাক্তার দেখাতে, তারই মধ্যে একটু ফাঁক পেয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসাল বেঞ্চিতে। পেট মোটা এক বিগ শপারে ঠাসা শাড়ি, এক মহিলা ঝুঁকে পড়লেন, অন্যরা বলতে লাগল, ‘বেগুনিটা নয় রে, হলুদটা দেখা।’ হলুদ শাড়িই বেরোল, দু’ধারটা ধরে মেলে দাঁড়ালেন দু’জন, আর সেই গাছ উপড়ে-পড়া, ছাদ উড়ে-যাওয়া বিধ্বস্ত গ্রাম যেন নিমেষে হেসে উঠল। পীতবস্ত্রে অজস্র সোনালি চুমকি, পাড়ে আরও ঘন হয়ে শোভা বাড়াচ্ছে, আর আঁচলে যেন জোনাকির মেলা। এমন অপরূপ শাড়ির কারিগরদের মুখ ম্লান। আগে ১২০ টাকা দিত শাড়িতে চুমকি বসাতে, এখন ৮০ টাকা দেবে বলছে ব্যবসায়ীরা। একটা গোটা শাড়িতে কাজ করতে তিন দিন থেকে সাত দিন লাগে। কত ঘণ্টা, তা চুমকির ঘনত্ব দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়। এই কাজের দাম ৮০ টাকা হলে ঘণ্টায় ক’টাকা মজুরি দাঁড়ায়, ভাবলে মনে মনে মরে যেতে হয়।
কর্মনাশা লকডাউন অংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিককে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মালিক, ঠিকাদার তাদের শেষ ধাক্কাটা দিতে তৈরি। আর সরকার? শ্রমিকের রোজগার সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরির অধিকার, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রভৃতি অনাবশ্যক জঞ্জালকে বিদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এ বছর মার্চ মাসের পর থেকে যে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র আর বিভিন্ন রাজ্যের সরকার, তাতে মনে হয় রাষ্ট্র যেন শ্রমিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে। ভাতে মারছে, হাতে মারছে, হাঁটিয়ে মারছে, খাটিয়ে মারছে। আইন করে মারছে, আইনের তোয়াক্কা না করে মারছে। এমন এক একটা প্রস্তাব পাশ হচ্ছে সংসদে, এমন এক একটা সংশোধিত বিধি জারি করছে সরকারি দফতর, এমন বিজ্ঞপ্তি বার করছে মালিকদের সংগঠন, যেন শ্রমিকের চিতায় আরও একটা কাঠ, কফিনে আরও একটা পেরেক। হয়ত শর্তহীন দাসত্ব নয় অনাহারে মৃত্যু, কোভিড-আক্রান্ত ভারতে শ্রমিককে এমন মোড়ের সামনে এসে দাঁড় করালেন দেশের কর্তারা। কেউ বললেন, দিনে বারো ঘণ্টা অবধি কাজ করতে হবে, ওভারটাইমের আলাদা রেট আবার কী? সাধারণ রেটেই টাকা পাবে। কেউ বলল, বিনা নোটিসে, বিনা ক্ষতিপূরণে ছাঁটাই না-হওয়ার অধিকার আপাতত মুলতুবি। ন্যূনতম মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ছাতাও ছোট হয়ে আসছে।
দিনে বারো ঘণ্টা কাজের সীমা নির্দিষ্ট করেছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র এবং গোয়া। অতিমারির আবহে এমন না করলেই নাকি চলবে না। সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টার সীমা। মধ্যপ্রদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলল, কারখানা আইনের (ফ্যাক্ট্রিজ় অ্যাক্ট) অধীনে যা কিছু সুরক্ষা পাওয়ার কথা শ্রমিকদের, এমনকী কারখানার নিরাপত্তার পরীক্ষা-সহ, সে সবই তিন বছরের জন্য বন্ধ। নতুন আইন (যা বেশ কিছু দিন প্রস্তাব হিসেবে পেশ করা ছিল) পাশ করা হল, যাতে বলা হল যে ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ আছে কিনা, তা দেখার জন্য সরকারি পরিদর্শকের সার্টিফিকেট দরকার নেই, ‘থার্ড পার্টি’ ইনস্পেক্টর সার্টিফিকেট দিলেও চলবে। যদিও লকডাউনের মধ্যেই অন্তত দুটি ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতের কারখানা কত সুরক্ষিত। মে মাসের গোড়ায় বিশাখাপত্তনমের কাছে একটি রাসায়নিক কারখানায় গ্যাস লিক করে আটজনের মৃত্যু হয়, বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই মাসেরই শেষে অসমের তিনসুকিয়ায় বাঘজান তেলের খনিতে ভয়াবহ আগুন লাগে। দুটিই শিল্পে নিরাপত্তা বিধি যথাযথ পালন না করার জন্য ঘটেছে, সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। দিল্লির আনাজ মান্ডিতে জুতো-স্কুল ব্যাগ তৈরির কারখানায় আগুন লেগে ৪৩জন শ্রমিকের মৃত্যু (৮ ডিসেম্বর, ২০১৯), সে ঘটনারও বছর ঘোরেনি।
অতীতের দিকে যত চাওয়া যাবে, তত কারখানায় অগ্নিসুরক্ষা বিধি-সহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বিধির অভাব, আর তার জন্য দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর নিদর্শন চোখে পড়বে। তবু লকডাউনে সর্বাগ্রে কারখানার নিরাপত্তার বিধি শিথিল করাই সরকারের কাছে জরুরি মনে হল, এটা দেখার মতো। উত্তরপ্রদেশ অধ্যাদেশ জারি করে প্রায় সমস্ত উৎপাদনের কারখানায় ও সংস্থায় শ্রমিক সুরক্ষা আইন সাসপেন্ড করে দিয়েছে। কর্ণাটকও আলগা করে দিয়েছে শ্রমিক আইনের কড়াকড়ি। দেশে যখন অতিমারি চলছে, সেই সময়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সার্বিক কল্যাণের সমস্ত দায় থেকে নিঃশর্তে মুক্তি পেল নিয়োগকারীরা। অন্যায় ছাঁটাই বা বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে মজুরেরা শ্রমিক আদালতে বা ট্রাইবুনালেও যেতে পারবেন না, শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমেও সওয়াল করতে পারবেন না, এমন ভাবে আইনকে সাসপেন্ড করেছে এক একটা রাজ্য। কোন দেশ নিয়োগকারীকে সর্বপ্রকার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়ে শিল্পে জোয়ার এনেছে, দেখতে বড় ইচ্ছে করে।
এই সব আইন সংশোধনের জন্য সংগঠিত ক্ষেত্রেও মজুরি কমছে। উত্তরপ্রদেশ ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট, ১৯৪৮, বাতিল করেছে, তাই এক ঝটকায় শ্রমিক হারিয়েছে ওভারটাইমে দ্বিগুণ হারে মজুরি পাওয়ার অধিকার। গুজরাতও লকডাউনের শুরুতেই এমন নিয়ম জারি করেছিল, যদিও সাময়িক ভাবে। পশ্চিমবঙ্গে চটকল মালিকেরা মেয়ে মজুরদের নাইট ডিউটি চালু করতে চেয়েছেন। দুই শিফটে কাজ শুরু করার অনুমোদনও তাঁরা চেয়েছেন সরকারের কাছে। সেই সঙ্গে অস্থায়ী কর্মীদের প্রদেয় সুযোগ-সুবিধে বাদ দেওয়ার অনুমোদনও। যদিও শুভঙ্করের মতো, চটকলের শ্রমিকদের একটা বড় অংশই আসে ঠিকাদারের মাধ্যমে এবং তারা কখনওই ন্যূনতম মজুরি পায় না। সরকারি ভাবে ধার্য সেই ন্যূনতম মজুরিও কিন্তু বাস্তবে অন্যান্য রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির চাইতে অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গের চটকলে বহু বছরের অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন, মেশিন চালনায় দক্ষ শ্রমিক দৈনিক যে মজুরি পান, কেরলে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে দৈনিক রোজগার করেন তার চাইতে বেশি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ চটকলে স্বভাবতই, লকডাউনে চটকল বন্ধ হতে বেতন না পেয়ে (যদিও কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারেরই নির্দেশ ছিল নিয়মিত কর্মীদের বেতন দিয়ে যাওয়ার), এমনকী অনেকে বকেয়া বেতনও না পেয়ে, শূন্যহাতে ফিরে গিয়েছেন নিজের রাজ্যে। শ্রমিকের প্রতি চটকলের এমনই ব্যবহার। চট উৎপাদন এক শ্রমনিবিড় শিল্প, প্রায় চার লক্ষ শ্রমিকের নিয়োগকর্তা। শ্রমিক সুরক্ষায় তার ভূমিকা যদি এমন হয়, তা সার্বিক ভাবে শ্রমিকদের অবস্থায় ছাপ ফেলতে বাধ্য।
লকডাউনের আগেও শ্রমিকদের অধিকার বলে যা ছিল, তা নামেই। সম্প্রতি শ্রমিক সংগঠন নেতা অশোক ঘোষ একটি দৈনিকে লিখেছেন, আজ চটকলগুলিতে অন্তত পঞ্চাশ হাজার শ্রমিকের গ্র্যাচুইটি বাকি, টাকার অঙ্ক হাজার কোটি টাকার কম হবে না। বহু শ্রমিক গ্র্যাচুইটি না পেয়ে মারা গিয়েছেন, তাদের পরিবারও টাকা পায়নি। সম্পূর্ণ গ্র্যাচুইটি পেয়েছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা হাতে-গোণা। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা না দেওয়ার কারণে শ্রমিকেরা পেনশন থেকে বঞ্চিত।
এমন পরিস্থিতি তো কেবল চটকলে নয়, প্রায় প্রতিটি সংগঠিত শিল্পে। সংগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমিকের রোজগার সুরক্ষা ব্যহত হচ্ছে ঠিকাদারি ব্যবস্থার রমরমায়। সরকারি দফতর, পুরসভা, সরকারি হাসপাতাল, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ক্রমাগত বেড়েছে ঠিকা কর্মীর অনুপাত। সরকারি তথ্য থেকে গবেষক অভিজ্ঞান সরকার তাঁর একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন, সংগঠিত উৎপাদন ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিক ১৯৯০-৯১ সালে ছিল ১২ শতাংশ, যা ২০১১-১২ সালে বেড়ে হয়েছে ৩৪.৪ শতাংশ। সামগ্রিক ভাবে সংগঠিত ক্ষেত্রে (যার মধ্যে কন্সট্রাকশন, মাইনিং, পাওয়ার ও সার্ভিস সেক্টর পড়ে) ঠিকা শ্রমিক ওই দশ বছরে ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। পরবর্তী কালে এই অনুপাত আরও বেড়েছে, সন্দেহ নেই।
ঠিকা মজুরদের অধিকাংশই নথিভুক্ত নন, তাই তাঁদের আইনানুগ বেতন বা সুরক্ষা দেওয়ার কোনও দায় ঠিকাদার বা মালিকের নেই। ঠিকা মজুরের এই ‘অবৈধতা’ তাকে কতটা বিপন্ন করে, তার প্রমাণ লকডাউন। ভিনরাজ্যে মালিক-ঠিকাদার স্রেফ ফোন সুইচ অফ করে নিজেদের দায় এড়াল, বহু পরিযায়ী মজুর বকেয়া বেতন অবধি পাননি, কার্যত অর্ধাহারে, অপরের দয়ার দানে দিন কাটিয়েছেন। অথচ এর পরেও মালিক-ঠিকাদারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে সরকার শ্রমিক আইন শিথিল করছে, শ্রমিকের প্রাপ্য নিরাপত্তাকে ‘অধিকার’ থেকে ‘বিবেচনা’-র বিষয় করে তুলছে।
পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত এক কোটি, বোঝাল লকডাউন। তাঁদের রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাবও। এক দিকে ঠিকা শ্রমিকরা ধর্মবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষীর সহজ শিকার (মালদহের আফরাজুল শেখের মর্মান্তিক মৃত্যু মনে করুন), অন্য দিকে পুলিশি নির্যাতনের চটজলদি টার্গেট। উত্তরবঙ্গের এক শ্রমিক দিল্লিতে কাজ করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কোথাও খবর না পেয়ে স্ত্রীর যখন পাগলের মতো দশা, তখন একদিন ফিরলেন। জানা গেল, রাস্তায় প্রাতঃকৃত্য করতে গিয়েছিলেন (আর কোথায় যাবেন?) বলে পুলিশ ধরেছিল। ঠিকাদার ঝামেলার ভয়ে থানায় যায়নি, জামিনও হয়নি, তিন মাস জেল খেটে বাড়ি ফিরেছেন। যে কোনও আইনশৃঙ্খলা সমস্যায় পরিযায়ী শ্রমিক প্রথম ‘সন্দেহভাজন’। তাঁদের ‘অবৈধ’ প্রতিপন্ন হওয়ার আর একটি কারণ, আবাস। কোনও মহানগরে বা শহরে পরিযায়ী শ্রমিক কম ভাড়ায় স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশে, বৈধ ভাড়াটে হিসেবে থাকতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাঁরা বাধ্য হন রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়প্রাপ্ত মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন বস্তিতে অবৈধ ভাড়াটে হয়ে থাকতে। নেতারা এত প্রতারক হতে পারে, শ্রমিক সংগঠন এত অপদার্থ হতে পারে, শিল্পপতিরা এমন অপরিণামদর্শী হতে পারে, সহসা বিশ্বাস হয় না।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, এবং সংগঠিত ক্ষেত্রের ঠিকা শ্রমিক, এই দুই শ্রেণিই এখন আতান্তরে। তাঁদের বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে ক্রমাগত তাঁদের শ্রমের অবমূল্যায়ন করছে শিল্পপতিরা। যেন শ্রমিককে যত পুঁতে ফেলা যাবে, তত লকলক করে গজিয়ে উঠবে শিল্প। যেন শিল্প আর শ্রমিক, দুই বিপরীত পক্ষ। অন্তত একজন শিল্পপতি জোর গলায় বলেছেন, এ ধারণা ভুয়ো। তিনি আজিম প্রেমজি। বিভিন্ন রাজ্যে শ্রম আইন মুলতুবি করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাড়ি ফেরার পথে রেলে চাপা পড়ে যে ষোলজন শ্রমিক মারা গেল, তার কারণ এই নয় যে ভারতে অতিরিক্ত সামাজিক সুরক্ষা এবং শ্রমিক সুরক্ষা রয়েছে। তার কারণ এই যে, ভারতে এগুলো যথেষ্ট নেই। গত কয়েক দশকে শ্রমিক আইন এতই বদলেছে, যে তাকে আর শিল্প-বিকাশের পথে প্রধান বাধা বলা যায় না, বলছেন আজিম প্রেমজি। শিল্পের উন্নতির জন্য শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা চাই, স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর। একই কথা বলেছেন নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস-ও। তাঁর বক্তব্য, কর্মহীনতা যখন মাত্রাছাড়া, তখন সংগঠিত আর অসংগঠিত বিভেদ ভুলে সব শ্রমিকের জন্য সব রকম সুরক্ষা দিতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিকই অর্থনীতির প্রকৃত শক্তি, তাদের উপেক্ষা করা হবে কেন?
দিতে তো হবে, কিন্তু দেবে কে? শ্রমিকের হয়ে সওয়ার করার লোক কই? তাকে আরও কিছু কম টাকা দিয়ে আরও কিছু বেশি খাটিয়ে নেওয়ার লাভটাই চোখে পড়ে সবার। শুভঙ্কর শ্যামনগর থেকে সোদপুর সাইকেল চালিয়ে এক খদ্দেরের কাছে গিয়েছিল, কয়েকটি বইয়ের অর্ডার সাপ্লাই করতে। ভদ্রলোক জানিয়ে দিয়েছেন, টেন পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট না দিলে নেবেন না। তিনি আবার অর্থনীতির অধ্যাপক।
জরুরী আলোচনা। শ্রমিকের উন্নতি না হলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়তে পারে না এবং আখেরে তার ফল উৎপাদনের ওপর পড়তে বাধ্য। এটা উন্নয়নের অর্থনীতির গোড়ার কথা।
তবে অর্থনীতি পড়ালে বা পড়লেই দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থব্যবস্হাকে চাঙ্গা করার দায় তার ওপর পড়বে, এ আশা বা ধারণাটা আপত্তিজনক।
লেখাটি ভালো লাগলো - শেষ প্যারাগ্রাফটাই সারবস্তু। এমন সব হিপোক্রসী দেখতে দেখতে ক্লান্ত লাগে - সেই অধ্যাপকই আবার বড় করে প্রবন্ধ লিখবে!
আর এই যে ঠিকা শ্রমিকদের নিয়ে ছেলেখেলা এটা তো নতুন কিছুই নয়! কোভিড এসে অনেক কিছু আরো বেশী করে উলঙ্গ করে দিচ্ছে এই যা।
সাহিত্যের অধ্যাপক ডিসকাউন্ট চাইলে সেটা গ্রাহ্য? কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের? তাঁরা তো yellow journalism করে চায়ের কাপে তুফান তোলেন। অর্থশাস্ত্র বিশ্লেষণ করতে শেখায়, নীতি প্রনয়ণে সাহায্য করে। কিন্তু আচরণ প্রতিটি নাগরিকের, সেখানে দায়িত্ব আর ভন্ডামি কোন ভেদ মানে না।
গায়ে-গতরে খেটে বাঁচতে চাওয়া মানুষের মর্মান্তিক পরিস্থিতির ছবি চোখের সামনে যেন পরতে পরতে খুলে দিলেন লেখিকা। এভাবেই, গোটা ব্যবস্থাটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিক শোষণের উপর, সেখানে অতিমারি কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়়কে মুনাফা লুটের কাজে লাগায় মালিকরা। আর সরকার তো আছেই তাদের জন্য! ফলে করোনা অতিমারির এই নতুন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের, বিশেষ করে অসংগঠিত শ্রমিকদের আরো বেশি করে শুষে নেওয়ার, লুটে নেওয়ার ব্যবস্থা সরকার যে করবে সেটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই।
চমৎকার মেদহীন অন্তর্লীন আবেগমাখা লেখা। প্রায় ১৫০ বছর ধরে বহু শ্রমিকের, সংগঠকদের, সাধারণ মানুষের রণ রক্ত আত্মাহুতিতে যে অধিকার অর্জিত হয়েছে একটু একটু করে ৫ বছরের সরকার এবং রাষ্ট্রের ধাক্কায় তা এক লহমায় ছিন্নভিন্ন।
এরে কয় অতিরাষ্ট্র!
কর্পোরেটাইজেশনের ফলে দেশে ক্রমশঃ ছোট মিথোজীবী ব্যবসার পরিমণ্ডল ছোট হয়ে আসছে। সাধারণ খেটে খাওয়া স্ব-নির্ভর মানুষের বেঁচে থাকা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। সিপাহি বিদ্রোহের মতন পটভূমি তৈরি হয়েছে। আগুন না জ্বললে কিছু পাল্টাবে না।
স্বাতী অভিজ্ঞ সাংবাদিকের বিশ্লেষণী চোখে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছেন তার আর্থ - সামাজিক প্রেক্ষাপটে । আমি ও আমার পুত্র দুজনেই নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে পেশার সূত্রে কম বেশি যুক্ত হবার ফলে এই বিশেষ ক্ষেত্রের কিছু খবর পেয়ে থাকি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপ এবং প্রশাসনের দিক থেকে আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করার যে নৈতিক দায়িত্ব তাদের থাকে - সেটি কীভাবে কতো তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলতে পা রা যায় - সেটি নিয়েই যেন এক রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের নীতি নির্ধারকদের প্রতিযোগিতা চলছে - এমনই একটা আন্দাজ হয় নানান সূত্র থেকে।
মর্মান্তিক ছবি। আজকাল যা চলছে, সেদিকে তাকিয়ে বোঝাটা মুশকিল আদৌও এটা পুঁজিবাদী সমাজ না দাস ব্যবস্থায় থাকা সমাজ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের কথায় এ পুঁজিবাদ চলে না, চলছে পুঁজিপতিদের আশু লাভের সাথে তালমিলিয়ে। যার পরিণতিতে লাখো কোটি শুভঙ্করে দেশ ভরে গেল।
খুব প্রাসঙ্গিক আলোচনা। সাবলীল লেখনি।
@saikat mistry, দাস ব্যবস্থায় দাস খেতে পরতে পাবে কি না, সেই দায়িত্ব মালিককে নিতে হত। এই ব্যবস্থায় কাউকে খাওয়ানোর দায়িত্ব কারুর নেই।
ভারতে বরং ঠিক উলটোপথে হাঁটা হচ্ছে
বেসরকারি সংস্থায় কারিগরি বা নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত নীল কলার ইঞ্জিনিয়ার দের মজুরী কমিয়ে ভাতা কমিয়ে বার্ষিক মজুরী বৃদ্ধি বন্ধ করে, কাজের সময় বাড়িয়ে আগের ১২ ঘন্টা এখন ১৬ ঘন্টা, ছুটির দিন নেই, মধ্যাহ্ন ভোজন বা সান্ধ্য recess উঠিয়ে দিয়েছে, সরকারী আইন শিথিলতায়। বাকী সময় যখন তখন ফোনে যোগাযোগ। দেশের বৃহৎ infrastructure সংস্থা L&T Construction এও এই ছবি। শ্রমবিরোধী সরকার আর , আবেগ, অনুভূতি হীন মানুষ নামক প্রাণী অতিমারী তে কাঁটা বিস্তার করে, অর্থনীতি কে তলানী তে নিয়ে শেষ করছে ব্যাঙ্ক অর্থলগ্নিকারী সংস্থা গুলিকেও। শিক্ষিত বাস্তুকার দের থেকে দিন মজুর ভালো আছে। উপার্জন যেমন কম, কিন্তু unskilled কাজ অনেক। কিন্তু, skilled শ্রমবিক্রি, মেধা বিক্রী কারী দের অবস্থা অসহনীয়।
অথচ টিভিতে বাছাই করা নেতারা এসে ভাষণ দেন, আমরা এই করেছি, ওই করেছি, উন্নয়নের বণ্য বইয়ে দিয়েছি। কিন্তু আসল উন্নয়ন কী হয়েছে তা এই প্রতিবেদনটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
সাংঘাতিক রিপোর্ট, কিন্তু এ তো আন্তর্জাতিক লেবার কনভেনশনের সরাসরি উল্লঙ্ঘন! এই রকম আইন ২০২১এ রাজ্য সরকার পাশ করালো কি বলে?