আমি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী হবার সুযোগ পাইনি। বিভাগে যোগ দেবার পর মানবদাকে ঘিরে গল্প হয়ে ওঠা সেই সব আড্ডার পরিবেশ থেকেও আমি কিছুটা দূরেই ছিলাম, যদিও ফ্যাকাল্টি ক্লাবের আড্ডায় চেষ্টা করে কিছুক্ষণ হলেও প্রায়ই যোগ দিতাম। মানবদাকে সে সময় ওই আড্ডায় খুব একটা দেখিনি। তবে অবাক হয়ে মানবদার স্মৃতিশক্তি ও তাঁর সুবিস্তৃত বই পড়ার অভিজ্ঞতার শামিল যে বহুবার হইনি তা নয়। বেশ নির্ভার সে সব অভিজ্ঞতা—সহজ, কল্পনা আর রঙ্গ কৌতুকের খেলায় উজ্জ্বল। মানবদা খেলার ছলে একটা গল্পের মোড়কে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর জগতের একটা অংশ আর আমরা আনন্দে অংশগ্রহণ করতাম সেই জগতে। যেমন ব্যক্তির নাম আর পদবির আদ্যাক্ষর এক হলে তার তরতর করে উন্নতির শিখরে ওঠা কেউ যে ঠেকাতে পারবে না তা আমরা সকলেই জানতাম আর সেরকম উদাহরণ পেলেই শত কাজের মধ্যেও একে অপরকে আর মানবদাকে গিয়ে বলে আসতাম। আর মানবদাও সেরকম উদাহরণ পেলে আমাদের জানাতে ভুলতেন না। তবে এটা বোধহয় ছিল আমাদের সকলের জীবনে একটা অন্যরকম সময়। মানবদারও। সময়টা আটের দশকের মাঝামাঝি।
তুলনামূলক সাহিত্যের সঙ্গে তরজমার যে আত্মীয়তা তা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করে আর কেউ সম্ভবত দেখাননি। শুধুমাত্র ঘরের জানালা খুলে দিয়ে একটা মুক্ত এলাকা তৈরি করে তিনি সন্তুষ্ট থাকেননি। চেয়েছিলেন মননে স্বরাজ আনতে, তৃতীয় বিশ্ব বা এখনকার ভাষায় দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্বের নানা স্তরীয় সমৃদ্ধ মায়াময় বাস্তবের আর পৃথিবীর অবদমিত মানুষের সংগ্রামের কাহিনি বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। বিশ্বসাহিত্যের দরজায় এসে তিনি প্রশ্ন করলেন, কার বিশ্ব, কোন্ সাহিত্য? তাঁর অনুবাদের সূত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর নিবিড় ভালোবাসা আর আবেগ যা কোনো নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়েনি। আবেগ, ভালোবাসা না থাকলে কি অত তরজমা করা যায়? একের পর এক আফ্রিকার গল্প, লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্য, পূর্ব ইউরোপের কবিতা, পশ্চিম ইন্ডিজের কবিতা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্য, ছোটোদের জন্যে জুল ভের্ন আর বিশ্বের কিছু সেরা গল্প এবং তারপর আবার এডওয়ার্ড লিয়ার-এর ছড়া, বরিস পাস্তেরনাক-এর ডাক্তার জিভাগো, এডগার অ্যালেন পোর গল্পসংগ্রহ, ল্য ফন্তেন-এর গল্প, এডওয়ার্ড বন্ড-এর আকাট ইত্যাদি। আর অসংখ্য অনুবাদ সংকলন যেমন ছোটোদের জন্যে তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য সংকলন ‘হরবোলা’ ও ‘জিয়নকাঠি’, নির্দিষ্ট বিষয়ে কয়েকটি খণ্ডে আধুনিক ভারতীয় গল্পের সংকলন ও সম্পাদনা আর দুই খণ্ডে ‘ভেদ-বিভেদ’: দাঙ্গা, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সর্বভারতীয় গল্প সংকলন। এই সম্পাদিত অনুবাদসম্ভারকে আমরা ভারতীয় সাহিত্যপাঠের ভূমির বিস্তার আর নতুন সম্ভাবনার, গবেষণার দিক্নির্দেশ রূপে দেখতে পারি। সাধারণভাবেই তুলনামূলক সাহিত্যের পঠনপাঠনের মানচিত্রে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য আর ইতিহাসের সম্পর্কে যুক্ত হয়েছিল অনেক নতুন মাত্রা। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে, ছোটোদের হাত ধরে, সাধারণ পাঠকের ভালোলাগায় জারিত হয়ে বহুদিন ধরে জনগোষ্ঠীতে কাজ করে যাবে এই সব অনুবাদ। অনুপ্রাণিত করবে অনুরূপ সৃষ্টির নতুন নতুন উদাহরণের খোঁজ, ব্যক্তি মানুষ-সাহিত্য-ইতিহাস-পৃথিবীর সৃজনমূলক সম্পর্ক। মনে পড়ে আধুনিক ভারতীয় গল্প, তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে যাঁরা পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে শিল্পসাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করলেন, তাঁরা তাঁদের আন্দোলনের সপক্ষে রসদ সংগ্রহ করেছিলেন অন্যান্য দেশের শোষিত ও বঞ্চিতদের সাহিত্যপাঠে।
বলাবাহুল্য বিভাগের বহু ছাত্রছাত্রীর অনুবাদে হাতেখড়ি মানবদার সম্পাদিত অনুবাদ সংকলনে। আর পরবর্তীকালে বিভাগীয় উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সাহিত্য অনুবাদ কর্মশালায় মানবদার ভূমিকা ছিল মুশকিল আসানের। অবাক হয়ে দেখেছি নিমেষে তিনি সমস্যার সমাধান করছেন, অব্যর্থ তাঁর শব্দচয়ন, সুদক্ষ তাঁর ভাষাবিন্যাস। তাঁর বহু বছরের শ্রম আর শব্দপ্রেমের ফসল। অনুবাদপর্বের পর সেই অনুবাদে ফিরে যেতে বা বিশেষ সংশোধন করতে তাঁকে বড়ো একটা দেখিনি। মনে হয় অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষ অনুবাদকের প্রথম খসড়ার মধ্যেই ধরা থাকে তাঁর সাফল্য।
আগেও লিখেছি এ বিষয়ে কিন্তু আবার না লিখে পারলাম না। ১৯৯৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মানবদার অনুবাদ ভৈকম মুহম্মদ বশিরের শ্রেষ্ঠ গল্প আমাকে বশিরের আরও লেখা খুঁজে বের করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই অনুবাদ পড়তে পড়তে আমার প্রায়ই মনে হয় কোনো লেখার সঙ্গে অনুবাদকের গাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠলে, তাকে সব অর্থেই আপন করে নিলে সৃষ্টি হয় নতুন উজ্জ্বল গহন আর-একটা রচনা। আখ্যান খুঁজে খুঁজে ফেরা এই অনুবাদক যেন বশিরের কাছে এসে ভারতীয় আখ্যানবিশ্বের চাবিকাঠি পেয়ে গেছেন। পেয়েছেন স্বগোত্রীয় লেখককে। তাই অনায়াসে আঙ্গিকের সহজ ভঙ্গিমা, নিখাদ কৌতুক, হালকা অথচ বহুমাত্রিক বিন্যাসের কৌশল অবলম্বন করে বাঙালি পাঠককে নিয়ে গিয়েছেন এক ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন স্বাদের তাৎপর্যপূর্ণ ভারতীয় আখ্যানের জগতে। অনূদিত গল্পগুলোতে আসে নানান ধর্মের ও সম্প্রদায়ের মানুষ, অনেক সময়ে তাদের একত্র জীবনযাপন। অনেক ক্ষেত্রেই গল্প বলার মতো করে ছোটো ছোটো আখ্যান গড়ে ওঠে, টুকরো কথাবার্তা জুড়ে জুড়ে। জেলের গল্পগুলো ব্যতিরেকে অন্যান্য গল্পের ঘটনাপরম্পরা যেন তাৎক্ষণিকের বিধি মেনে এগিয়ে চলে, অর্থাৎ কোনো উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অর্থ নয়, যা ঘটছে তার সঙ্গে কোনো এক চরিত্রের সেই মুহূর্তে বোঝাপড়া করার প্রক্রিয়া, তার মানবিক বোধ, তার অবস্থান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার দারিদ্র্য ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে। তবে বোঝাপড়া শেষ পর্যন্ত কোনো ‘শূন্যে ঝুলে থাকার’ দর্শন অথবা জীবনের এলোমেলো ঘটনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। ইতিহাসে ধরে রাখা টুকরো টুকরো ঘটনাও গল্পে এসে ঢোকে কিন্তু প্লটের কোনো নিয়ম মেনে নয়। এ যেন তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব এক আখ্যানরীতি যা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়েরও অতি আপন। দৈনন্দিন স্বপ্ন বোনার আর স্বপ্ন ভাঙার গল্প। কৌমের গভীরে যে বোধ কাজ করে তার সঙ্গে পরিচয় হয় কোনো এক অন্য আধুনিকতার পরিপ্রেক্ষিতে। ঘরোয়া শব্দের আর কথ্যরীতির নিপুণ ব্যবহারে পারদর্শী মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে নতুন মাত্রা পেয়েছে এই আখ্যানরীতি আর অনুবাদক পেয়েছেন তাঁর বোধ, বিশ্বাস, রাজনীতি, ভালোলাগার একটা শিল্পিত আধার। হয়তো তাঁর অগণিত অনুবাদ সম্পর্কেই অনুরূপ কথা কমবেশি বলা যায়।
জানি না শেষ অবস্থায় কোন্ আখ্যানবিশ্বের সন্ধানে পাড়ি দিলেন তিনি।