

।। ১।।
আমার ভ্রমণপিপাসু বাবা-মা আমাকে দশমাস বয়সে অজন্তা নিয়ে গেছিলেন। সে স্মৃতি আমার অবশ্যই নেই, কিন্তু মাতৃগর্ভের রহস্যের মতো অজন্তা আমায় আকর্ষণ করেছে চিরকাল। ২০২০-এর গোড়ার দিকে যাওয়ার সুযোগ হল অবশেষে। ছবিগুলো চেনার জন্য সঙ্গে নিয়েছিলাম নারায়ণ সান্যালের ‘অজন্তা অপরূপা’। স্কুলে পড়াকালীন এই বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অজন্তার আসল গুহাচিত্রগুলো দেখতে না পেলেও লেখকের নিজের করা স্কেচগুলো এবং জাতক কাহিনির বর্ণনা আমার কিশোর মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। অজন্তা যাওয়ার সময় বইখানা আবার পড়তে গিয়ে রেফারেন্সের দিকে একটু নজর দিলাম। শ্রী মুকুল চন্দ্র দে-র লেখা ‘মাই পিলগ্রিমেজ টু অজন্তা অ্যান্ড বাঘ’ বইটির কথা নারায়ণ সান্যাল উল্লেখ করেছেন। মুকুল দে শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকা শিখেছিলেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান যাত্রায় তিনি কবির সাথী ছিলেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২০-র মধ্যে মুকুল দুবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে অজন্তা যান এবং বেশ কিছু ছবির অনুকৃতি করেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই বইটি লেখা হয়। লন্ডনের থর্নটন বাটারওয়ার্থ লিমিটেড ১৯২৫ সালে বইটি প্রথম প্রকাশ করে। বইয়ের ভূমিকা লেখেন প্রাচ্য শিল্পের পণ্ডিত লরেন্স বিনিয়ন যিনি সারা জীবন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অক্লান্ত কর্মী ছিলেন। উত্তর আমেরিকার আমাজন ওয়েবসাইটে ১৯২৫-এর একটি ব্যবহৃত বই আমি খুঁজে পাই এবং সঙ্গে সঙ্গেই কিনে ফেলি। বইটি পড়ে অত্যন্ত ভালো লাগায় আমি ভারতে একজনকে বইটি পাঠানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বইয়ের ওয়েবসাইটে খোঁজ নিই। জানতে পারি জ্ঞান পাবলিশিং হাউস ১৯৮৬ সালে বইটি পুনঃপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিটি ওয়েবসাইটেই বইটি আউট অফ স্টক দেখায়। বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা ই-বুকে স্বচ্ছন্দ তাঁদের কাছে ই-কপির খোঁজ করি। পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত। অতএব এই বইটি অন্য কাউকে পড়ানোর উপায় আপাতত বন্ধ। বাধ্য হয়ে তাই আমি নিজেই বইটা নিয়ে দু-এক কথা লিখতে বসেছি। অবশ্যই মূল বইটি পাঠের অনুভূতি আমি তৈরি করতে পারব না। তবু এই লেখাটা পড়ে কারও যদি বইটা সম্পর্কে আগ্রহ জাগে এবং বইটা যদি আবার ছাপানোর বা ডিজিটাইজ করার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে একটা দুর্লভ পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে না এটা আশা করা যেতে পারে।
অজন্তার গুহাচিত্রগুলি দুশো খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ছশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আঁকা হয়। সব মিলিয়ে ২৯ টা গুহা আছে, এর মধ্যে কিছু অসমাপ্ত। ১৯১৭ সালে মুকুল দে বাইশ বছরের যুবক। ছবি এঁকে আড়াইশো টাকা জমেছিল। মুকুল সেই পুঁজি সম্বল করে অ্যাটাচি কেসে ছবি আঁকার সরঞ্জাম আর বগলে বিছানা নিয়ে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের বোম্বে মেলের একটা ইউরোপিয়ান থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে চেপে বসলেন। হাওড়া থেকে জলগাঁও প্রায় হাজার মাইল। রেলভাড়া এক পাউন্ডের (আন্দাজ পনেরো টাকা) একটু বেশি। মুকুল লিখছেন ইউরোপিয়ান কামরায় বসতে পাবার একমাত্র টিকিট হল ইউরোপিয়ান পোশাক। সাহেবি পোশাক পরা মুকুলকে নিয়ে তাঁর সহযাত্রীর কোনো সমস্যা হল না। সে ভদ্রলোক কলকাতার এক অ্যান্টিক ডিলার। বোম্বে চলেছেন ব্যবসার কাজে। তিনি কোন্ দেশের লোক মুকুল আন্দাজ করতে পারেননি তবে আমরা জানতে পারছি ভদ্রলোক ৫০০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটা লাল পাথরের মিশরীয় সিলমোহর মুকুলকে দু-টাকায় বিক্রি করেছিলেন। মুকুলের শখ হয়েছিল সেটা আংটি বানিয়ে পরার। কিন্তু লন্ডনের এক জহুরি সেটা ভেঙে ফেলে। যাত্রাপথে আরও একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে যা উল্লেখ করার লোভ আমি সামলাতে পারছি না। ট্রেন মহারাষ্ট্রে ঢুকলে সন্ধের দিকে এক মারাঠি ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে মুকুলদের কামরায় উঠে পড়েন। নেটিভ পোশাকের মানুষজন এসে পড়ায় কামরার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যাত্রীদের প্রবল আপত্তি। তারা স্টেশনমাস্টার আর গার্ডকে ডেকে আনল। গার্ড ভদ্রলোক ইউরোপিয়ান, স্টেশনমাস্টার ভারতীয়। মারাঠিকে বলা হল অন্য কামরায় ভালো সিট খুঁজে দেওয়া হবে, সে যেন নেমে যায়। মারাঠি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, চ্যাঁচাতে লাগল, “আমি সিট ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমাদের যা করার করে নাও। এরকম একটা কেস আগেও হয়েছে, সেটা বোম্বে হাইকোর্টে উঠেছিল। আমি একজন উকিল। আমি জেনেশুনেই যা করার করছি।” চ্যাঁচামেচিতে স্টেশনে ভিড় জমে গেল। এদিকে ট্রেনই বা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। গার্ড আর স্টেশনমাস্টার হাল ছেড়ে দিল। উৎফুল্ল জনতার হইচইয়ের মধ্যে ট্রেন স্টেশন ছাড়ল। ঘটনা ঘটার সময় মুকুল লিখছেন, “I was enjoying the fun, and watched with excitement to see who would win.”
রাত আড়াইটের সময় ট্রেন জলগাঁও পৌঁছাল। জলগাঁও থেকে ফর্দাপুর পঞ্চাশ মাইল। অজন্তা সেই সময় জঙ্গলাকীর্ণ। মুকুলকে চার মাইল দূরে ফর্দাপুরে থাকতে হবে। ১৯৬৫ সালে যখন নারায়ণ সান্যাল অজন্তা আসছেন তখন এই রাস্তায় বাস চলে। ১৯১৭-তে বলা বাহুল্য কোনো বাস নেই। বাইশ বছরের মুকুল অজন্তা দেখার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। তিনি এক মুহূর্তও নষ্ট করবেন না। রাত আড়াইটেতেই তাঁর টাঙা চাই। সে অবশ্য পাওয়া গেল না। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। টাঙাওয়ালা ভাড়া নিল ছাব্বিশ টাকা। হাওড়া থেকে জলগাঁও ট্রেন ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। টাঙা থেকে দেখা পশ্চিম ভারতের গ্রামের চমৎকার বিবরণ মুকুলের বইতে আছে। নেরি নামের এক গ্রামের কথা আছে যেখানে মাত্র কিছুদিন আগেই প্লেগ হওয়ায় গ্রামের সবাই বাড়ি ফেলে পালিয়েছে। সাজানো-গোছানো লালিত্যময় সে গ্রাম। দরজায় নকশা আঁকা। খাঁ খাঁ করছে।
ফর্দাপুর হায়দ্রাবাদের নিজামশাহির প্রথম গ্রাম। সেখানে পৌঁছাতেই প্রায় শেষ বিকেল। মুকুলের খুব ইচ্ছে সেদিনই একবার অজন্তা গুহা দেখে আসার। গাড়োয়ানকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। অগত্যা মুকুল একাই হাঁটা লাগালেন। বাঘোরা নদীর তীরে ফর্দাপুর গ্রাম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা উঠেছে অজন্তা গুহার দিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাতপাখিরা বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই জঙ্গলে জানোয়ারের দেখাও মুকুল পাবেন কিছুদিনের মধ্যেই। পথে দেখা হয়ে গেল জাপানি বন্ধু কাম্পু আরাইয়ের সঙ্গে। কিটো ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মিস্টার সায়ামুরার নেতৃত্বে জাপানি শিল্পীদের একটি দল সেসময় অজন্তা এসেছে গুহাচিত্রের অনুলিপি বানানোর জন্য। তারা কাজ সেরে ফর্দাপুরের ডাক বাংলোয় ফিরছিল। মুকুলকে যেহেতু সেদিনই অজন্তা দেখতে হবে তিনি আরাইকে নিয়ে সেই আসন্ন সন্ধ্যাতেই চললেন গুহার দিকে। নীলচে-বেগুনি পাথরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি গুহামণ্ডলীর সামনে প্রথম দাঁড়ানোর অনুভূতি মুকুল বর্ণনা করেছেন তাঁর বইতে। সে পড়লে বোঝা যায় একশো বছরে অনেক কিছু বদলে গেলেও বিশালের সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি বদলায় না খুব একটা। এটা ভেবেও আশ্বস্ত হই দুই থেকে দেড় হাজার বছর আগে যেসব শিল্পীরা পাথর কেটে এই গুহা বানিয়েছিল, অপূর্ব সব ছবি এঁকেছিল তাদের অনুভূতিও খুব একটা আলাদা ছিল না। সেইসব অদেখা পূর্বসূরিদের কতকটা ছোঁয়া যায় তখন।
কী এমন আছে অজন্তা গুহাচিত্রে যা দেখার জন্য হাজার মাইল পথ এসেও মুকুল এক সন্ধ্যার জন্য বিশ্রাম নিতে পারলেন না? মুকুলের বইয়ের ভূমিকাতে লরেন্স বিনিয়ন বলছেন—
"If one were asked to put into one word the secret of these paintings, the secret of their continuing power to impress and charm us—one might well answer life; for they affect us in the same way that the living movements of men and women, children, and animals affect us; with a deep content and unconscious sympathy."
বৌদ্ধধর্ম পরজন্মে বিশ্বাস করে। অজন্তার ছবিগুলোতে সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনকাহিনি ও তাঁর আগের জন্মগুলোর গল্প আঁকা হয়েছে। স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা বন্ধন ও মুক্তির যে উদ্যাপন; স্নেহ, প্রেম, কর্তব্য, আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাসভঙ্গ ও বিষাদের যে কালচক্র, যার আবর্তনে হিরের কুচির মতো ছলকে ওঠে জীবন—সেই আগুন আর ছাইয়ের গল্প অজন্তার দেয়ালে আঁকা আছে। এই গল্পের কুশীলব আমাদের দেশের মানুষ, পশু, পাখি। দেড় হাজার বছর আগের কোনো মানুষের মুখ দেখে হয়তো শিল্পী এই ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু এই মুখের ভাব চিরন্তন। উদাহরণ হিসেবে আমি দুটি ছবির কথা এখানে উল্লেখ করব। অজন্তার বিপুল সম্ভার থেকে দুটি বেছে নেওয়া অসম্ভব কাজ। এই দুটি ছবি অজন্তার শ্রেষ্ঠতম এমনও আমি বলছি না। ছবিদুটিতে পাত্রপাত্রীদের ভঙ্গিমায় এমন কিছু আছে যা এই ২০২০ সালেও আমাদের চারপাশে দেখতে পাওয়া যায়। সেজন্যই আমি এদের কথা উল্লেখ করছি।
প্রথম ছবিটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘অজন্তা মুরালস’ বইটি থেকে নিয়েছি। এই বইটাও আমি উত্তর আমেরিকার আমাজন ওয়েবসাইটে পুরোনো বইয়ের সম্ভার থেকে কিনেছি। ছবিটা অজন্তার দ্বিতীয় গুহায় দেখতে পাওয়া যায়। বিধুর পণ্ডিত জাতকের কাহিনি। এই দীর্ঘ কাহিনিটি আমি এখানে বর্ণনা করব না। ছবিতে পাঁচজন লোককে দেখা যাচ্ছে। বামদিক থেকে প্রথম চরিত্রটির নাম পুণ্যক। সে রাজকন্যা ইরান্দতীর পাণিপ্রার্থী। ফ্রেমের নীচে ডানদিকে যে মেয়েটি হাত জোড় করে বসে আছে সে রাজকন্যা ইরান্দতী। পুণ্যকের পাশের জন বিধুর পণ্ডিত। বুদ্ধ তাঁর কোনো এক পূর্বজন্মে বিধুর পণ্ডিত রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর সামনে হাত জোড় করে বসে আছেন নাগরাজ ও তাঁর রানি বিমলা। রানি বিমলার শর্ত ছিল পুণ্যক যদি বিধুর পণ্ডিতকে নাগরাজ্যে নিয়ে আসতে পারে তবে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুণ্যক বাদে সকলের দৃষ্টি বিধুর পণ্ডিতের দিকে। তাঁরা মন দিয়ে পণ্ডিতের উপদেশ শুনছেন। পুণ্যকের স্বপ্নালু দৃষ্টিতে ধৈর্যচ্যুতির আভাস। তাকে দেখে মনে হয় সে ভাবছে, “এই বুড়োর বকবকানি থামলে বাঁচা যায়, তারপর আশা করি এরা বিয়ের কথা পাড়বে।”
দ্বিতীয় ছবিটি সতেরো নম্বর গুহার। মুকুল দে-র বইতে একটি মাত্র রঙিন ছবি আছে। সেটি এই ছবিটি। ছবির বামদিকে দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে হলুদ পোশাক পরা আনত মস্তক অতিকায় বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধ বামহাতে তাঁর কাষায় বস্ত্র ধরে আছেন। ডানহাতে ভিক্ষাপাত্র। বুদ্ধের মাথার ওপর একটি কিন্নর ছাতা ধরে আছে। পারিজাত ফুল বৃষ্টি হচ্ছে। ডানদিকের এক-তৃতীয়াংশে বুদ্ধের অর্ধেক উচ্চতায় এক মহিলা একটি শিশুর কাঁধে হাত রেখে বুদ্ধের দিকে চেয়ে আছেন। শিশুটিও মুখ তুলে বুদ্ধকে দেখছে। এই মহিলা বুদ্ধের স্ত্রী গোপা যশোধরা। শিশুটি তাঁদের ছেলে রাহুল। আজকের দিনে এটাই অজন্তার একমাত্র ছবি যেখানে যশোধরাকে দেখা যায়।
যশোধরার আরও অন্তত একটি ছবির উল্লেখ পাওয়া যায় নারায়ণ সান্যালের বইতে। রাহুল জন্মের পর যশোধরা সন্তান প্রসবের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই রাতে রাজপুত্র গৌতম কাউকে কিছু না বলে গৃহত্যাগ করেন। অজন্তার ষোলো নম্বর গুহায় এই কাহিনি অনুসরণ করে একটা ছবি ছিল। কিন্তু খুব সম্ভব মুকুল দে যখন গেছেন তখনই এই ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। ‘অপরূপা অজন্তা’ বইতে নারায়ণ সান্যাল ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত গ্রিফিথ সাহেবের বই অনুসারে এই ছবির একটা রেখাচিত্র দিয়েছেন।
সতেরো নম্বর গুহায় আমাদের আলোচ্য ছবিটির সময়কাল এই ঘটনার পরে। সিদ্ধার্থ গৌতম যখন বুদ্ধ হয়ে কপিলাবস্তুতে ফিরলেন, রাজপুত্র ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে বেরোলেন, সেই সময়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছেন স্ত্রী আর পুত্র যাদের তিনি না বলে ছেড়ে গেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম পুরুষদের একজন। কিন্তু তিনিও অন্যায় করেছিলেন। অজন্তার ছবি শুধু দেবতার মহত্ত্ব প্রচার করেনি, তাঁর দুর্বলতার কথাও মনে রেখেছে। আমার খুবই ইচ্ছা হয় এই ছবিতে যশোধরার মুখের ভাবটা দেখতে। ২০২০-তে আমি যখন অজন্তা গেলাম তখন যে দূরত্ব থেকে দেখতে হয় তাতে মুখের ভাব বোঝা সম্ভব নয়। মুকুল দে-র বইতে ছবিটি ছোটো। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বইতে ছবিটি প্রমাণ মাপের হলেও মুখের ভাব স্পষ্ট নয়। লেডি হেরিংহ্যাম নামে এক শিল্পোৎসাহীর উদ্যোগে ১৯১৫ সালে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে অজন্তার ছবির একটা অ্যালবাম বেরোয়। তাতে ছবিটি আছে শুনেছি। হয়তো বা সেটা আমার আশা পূরণ করতে পারে। মুখের ভঙ্গি বুঝতে অসুবিধে হলেও ছবিটির কম্পোজিশন যে অনুভূতির সৃষ্টি করে সেখানে মহাকালের ক্ষমাহীন চোখ খুঁজে পাই। বুদ্ধ যতই বিশাল অতিমানবিক হোন না কেন, যশোধরা ও রাহুল ঋজু এবং অলঙ্ঘনীয়।
১৯১৭ সালে মুকুল দে নিজামশাহির থেকে অনুমতি পেলেন না অজন্তার ছবি অনুকৃতি করার জন্য। তিনি আবার ফিরে এলেন ১৯১৯-এ, এবারেও নিজে টাকা জমিয়ে। সঙ্গে এল নারায়ণ নামে চাকর। এবারেও মুকুলের ট্রেন থেকে নেমে তর সইছে না অজন্তা যাওয়ার জন্য। সেবারে তুলো চাষের মরশুম চলছিল। গাড়োয়ান পাওয়া গেল না। মুকুল নিজেই গোরুর গাড়ি চালাবেন ভাবলেন। কিন্তু সব কাজ সবার সাজে না। আনাড়ি মুকুল গাড়ি ভিড়িয়ে দিলেন বাঘোরা নদীর খাতে। তাতেও হতোদ্যম না হয়ে নারায়ণকে বাক্স বিছানা-সহ গাড়ির সঙ্গে থাকতে বলে নিজে হাঁটা লাগালেন অজন্তার দিকে। ঠাঁই হল ফর্দাপুরের ট্রাভেলার্স বাংলোয়। ভাড়া দিনে এক হালি-রুপি, ব্রিটিশ ভারতীয় টাকার হিসেবে তেরো আনা।
মুকুল রোজ সকালে আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে চার মাইল হেঁটে গুহায় যান। আধুনিক পৃথিবীর জন্য অজন্তা পুনরাবিষ্কার হয়েছিল ১৮১৭ সালে। মুকুলের প্রথম অজন্তা যাওয়ার ঠিক একশো বছর আগে। এই একশো বছরে বেশ কিছু ব্রিটিশ শিল্পী অজন্তার ছবি কপি করেছেন। কিন্তু ছবি সংরক্ষণের ব্যাপারে তাঁদের জ্ঞান ছিল সামান্য, বা বলা ভালো তাঁরা এ বিষয়ে যে শুধু জানতেন না তা নয়, যা জানতেন সেটা ভুল জানতেন। অত্যন্ত সস্তা নিম্নমানের বার্নিশ সেসময় অজন্তার ছবিগুলোর ওপর লাগানো হয়। ছবিগুলো কালো হয়ে যার এর ফলে। উপরন্তু বার্নিশ শুকোলে দেয়ালের প্লাস্টার ফেটে ছবির উপরিভাগের রং উঠে আসে। সেই ফাটলে পোকামাকড় বাসা বেঁধে ছবিকে আরও নষ্ট করে। এ ছাড়াও অজন্তার প্রথম যুগের ইউরোপিয়ান ভ্রমণার্থীরা কিছু ছবি দেয়াল থেকে উপড়ে নিয়ে চলে যান। মুকুল তাঁর বইতে বস্টনের মিউজিয়ামে ঠাঁই পাওয়া এমন একটি অজন্তার টুকরোর উল্লেখ করছেন। দেয়ালের গায়ে নাম লিখে আসার ট্র্যাডিশনও তখন থেকেই চলছে। ফলস্বরূপ প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণে যে ছবিগুলো দেড় হাজার বছর টিকেছিল সেগুলোই মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় নষ্ট হয়ে গেল। আমি ২০২০-তে যখন গেলাম তখন প্রায় কিছুই আর নেই। মুকুল লিখেছেন তিনি যখন ছবি আঁকতে যেতেন তখনও ছবিসমৃদ্ধ গুহাগুলোতে গুহামুখ থেকে উজ্জ্বল লাল এবং হলুদ রঙের আভা দেখা যেত। সেসব কিছুই আমি দেখতে পাইনি।
তবে এটা মনে রাখতে হবে বাইরের পৃথিবীর কাছে অজ্ঞাত হলেও স্থানীয় মানুষজন অজন্তার কথা জানত। বৌদ্ধ ধর্মের স্মৃতি বহুদিন মুছে গেছে। স্থানীয় মানুষের কাছে অজন্তার ছবিগুলো শাপগ্রস্ত দেবদেবীর, যারা পৃথিবীতে এসে আটকে পড়েছে। মুকুলের বই থেকে জানা যাচ্ছে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষের দিকে বাঘোরা নদীর চরে মেলা বসে। আশেপাশের গ্রাম থেকে দলে দলে হিন্দু পুণ্যার্থী আসে। বাঘোরার জলে চান করে নতুন কাপড় পরে পুজো দিতে আসে অজন্তার গুহায়। তারা জানে এগুলো হিন্দু মন্দির। পুরোহিতের মাধ্যমে পুজো হয়। ফলমূল, চাল, টাকা, মাটির প্রদীপ নিবেদন হয় বুদ্ধমূর্তির চরণে। নীচে বাঘোরার চরে অস্থায়ী খাবারের দোকান বসে। ছেলেপিলেরা খেলনা কেনে। দু-তিন ধরে মেলা চলে। তারপর সব শুনসান। স্মরণাতীত কাল থেকে এই মেলা চলে আসছে। একবার মুকুল এক বুদ্ধমূর্তির হাতের ভাঁজে একটা প্রাচীন মুদ্রা খুঁজে পেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বৌদ্ধ রাজার আমলের মুদ্রা হবে হয়তো। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে একদল অধ্যাপক অজন্তা এসেছিলেন। তাঁরা পরীক্ষা করে বললেন অত প্রাচীন না হলেও পাঁচশো বছরের পুরনো ইসলামি মুদ্রা। মেলায় আসা কোনো হিন্দু পুণ্যার্থী সেই মুদ্রা দিয়ে পুজো দিয়েছিল মনে হয়।
এ ছাড়াও লোকালয় থেকে দূরে থাকা সাধু-সন্ন্যাসীরাও অনেক সময় এইসব বৌদ্ধ গুহায় থাকতেন। তাঁদের রান্নাবান্নার ফলেও অনেক ছবি নষ্ট হয়েছে। আলোচ্য বইতে মুকুলের আজকের মধ্যপ্রদেশের বাঘ গুহায় ছবি আঁকতে যাওয়ার কথাও আছে। সেগুলোও ছবিসমৃদ্ধ বৌদ্ধ গুহা। মুকুল যে সময় গেলেন তখন এই জায়গা গোয়ালিয়র স্টেটের অন্তর্ভুক্ত। বাঘমতী নদীর তীরে বাঘ গুহামণ্ডলী। একটি গুহায় গোঁসাই বাবাজি নামে এক সাধুর বাস। গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করত গোঁসাই বাবাজি বাঘের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করেন। গোঁসাই-এর ঢাকের আওয়াজ যতদূর শোনা যাবে ততদূর পর্যন্ত বাঘ কারোর ক্ষতি করবে না। গ্রামবাসীরা বাবাজিকে খাবারদাবার দিয়ে যেত। বাঁদর, কাঠবেড়ালি, টিয়াপাখির সঙ্গে গোঁসাই সে খাবার ভাগ করে খেতেন। বাঘমতী নদীর চত্বরে কোল আর ভিলদের বাস। তারা বিষাক্ত তির দিয়ে শিকার করে। সাজতে-গুজতে, নাচতে ভালোবাসে। বইতে মুকুলের বন্ধু শিল্পী সুরেন করের বলা একটা চিত্তাকর্ষক গল্প আছে। সুরেন কর, নন্দলাল বসু প্রমুখ গোয়ালিয়র সরকারের আমন্ত্রণে বাঘের গুহার ছবি আঁকতে এসেছিলেন বছরখানেক আগে। বসন্তোৎসবের সময় গ্রামের মোড়ল ভোজ দেয়। গ্রামের সব মানুষের জন্য যত খুশি খাবার, পানীয়। বড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে নাচ হয়। মাদল বাজে। ভিলের সঙ্গে নাচে তার বর্শাও। নাচের মাঝে হঠাৎ হইহই শুরু হল—“হায় হায়, প্যাটেলের মাথা মাটিতে গড়াগড়ি খায়, হায় হায়, প্যাটেলের মাথা মাটিতে গড়াগড়ি খায়।” দেখা গেল সত্যিই মোড়লের মাথা মাটিতে গড়াচ্ছে। নাচতে নাচতে এমন জোশ এসেছে যে খেয়াল হয়েছে, দিয়েছে মাথা কেটে।
অজন্তার কথায় ফিরি। সূর্য ওঠার আগে মুকুলকে উঠতে হয়। নারায়ণ বাজার থেকে দুধ-ডিম কিনে এনে জলখাবার বানায়। মুকুলের কাজ নদী থেকে জল ভরা, রান্নার কাঠ জোগাড় করা। পশ্চিম ভারতে কলেরার প্রকোপ লেগেই থাকে। জল ফুটিয়ে ফিলটার করে বোতলে ভরে মুকুল গুহায় যান। দুপুরে কোনো ছেলেছোকরার হাতে নারায়ণ খাবার পাঠায়। প্রায় রোজই দেখা যায় খাবার অর্ধেক শেষ, মাংসের ঝোলে দু-একটা হাড় পড়ে আছে শুধু। যে এনেছে তাকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মেলে— পথে পড়ে গেছে সাব। অজন্তা গুহায় তখন কিছু চৌকিদার নিযুক্ত হয়েছে। তারা আশেপাশে গ্রাম থেকে আসে। সূর্য ডোবার ঢের আগে বাড়ি ফিরে যায়। সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ফেরার পথে বাঘের মুখোমুখি হওয়া আশ্চর্য নয়। তাই এই ব্যবস্থা। মুকুল সারাদিন একাই কাজ করেন। দেয়ালের ছবির ওপর ট্রেসিং পেপার লাগিয়ে প্রথমে ছাপ তোলেন। তারপর সেই ছাপ অনুযায়ী কাগজে আঁকা হয়। সবশেষে গুহায় যেমনটা রয়েছে ঠিক তেমন শেড খুঁজে রং লাগানো হয় ছবিতে। গুহার ছবির রং অবশ্য এত বছরের অত্যাচারে আসল রং থেকে বিচ্যুত। গুহার ভিতরে দিনের বেশিরভাগ সময়েই আলো ঢোকে না। সঙ্গে রাখতে হয় পেট্রোল ল্যাম্প। এরকম একটা দিনের কথা মুকুল লিখেছেন যা অবিস্মরণীয়। সন্ধে হয়ে এসেছে। মুকুল কাজ শেষ করে পেট্রোল ল্যাম্প নিভিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছেন। এমন সময় দিন শেষের আশ্চর্য আলো গুহায় ঢুকল। পেট্রোল ল্যাম্পের চেয়ে সেই আলো হাজার গুণ উজ্জ্বল। দেয়ালের প্রতিটা ছবি জীবন্ত হয়ে উঠল মুকুলের সামনে। তারপর যেমন অনাহূত এসেছিল, তেমনই নিজের খেয়ালে সেই আলো মরে গেল। ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল গুহা।
রোজ ফর্দাপুর থেকে যাওয়া-আসা, খাওয়ার অসুবিধে—সবদিক বিবেচনা করে মুকুল ঠিক করলেন নারায়ণকে নিয়ে গুহাতে গিয়েই থাকবেন। তখন বর্ষাকাল। সাতনম্বর গুহাকে বাসযোগ্য করে নেওয়া হল। এই গুহাটি ভাস্কর্যপ্রধান, এতে ছবি নেই। অজন্তার গুহাতে থেকে ছবি আঁকতে একজন শিল্পীর কতখানি আনন্দ হবে তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। মুকুল পঞ্চম শতাব্দীর শ্রমণদের মতো সারাদিন কাজ করেন। নারায়ণ বেচারি এই জনশূন্য গুহায় মন খারাপ করে বসে থাকে। সারা সপ্তাহ সে অপেক্ষা করে থাকে হাটে যাওয়ার দিনটির দিকে। হাটবার এলে ভালো জামাটি পরে, কাচা পাগড়িটি মাথায় দিয়ে সে লোকালয়ে যায়। তার মুখে হাসি ফোটে। নারায়ণের অবস্থা দেখেই বর্ষার শেষে মুকুল আবার ফিরে আসেন ফর্দাপুর। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামে কলেরা দেখা দেয়। নারায়ণকে নিষেধ করা হয় গ্রামের মধ্যে যেতে। সে সম্ভবত এই নিষেধ মানেনি। একদিন গুহা থেকে ফিরে মুকুল দেখেন প্রচুর খাবারদাবারের আয়োজন হয়েছে। খাওয়ার পরে নারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরের দিনই সে কলেরায় মারা যায়। রান্নাবান্না ও ঘরের কাজের একজন সহায়ক ছাড়া মুকুলের পক্ষে ছবি আঁকা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ধান্দু নামে এক বুড়ো লোক সেইসময় কাজ করতে আসে। কাজ নেওয়ার সময় সে বলেছিল বটে “আমি জঙ্গল খুব ভালো চিনি, তুমি আমার ছেলের মতো”, অচিরেই দেখা গেল সে সারাদিনই গজগজ করে। এমনকি মুকুলের টুকটাক জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়। গ্রামের ছেলেছোকরাদের মুকুলের খাবারদাবার বিলিয়ে একদল সাঙ্গোপাঙ্গও জোগাড় করে নিল। অগত্যা মুকুল তাকে বিদায় দিতে বাধ্য হলেন। এবার বুদ্ধু মিঁয়া নামে এক মুসলমান রাঁধুনি কাজে ঢুকল। এই লোকটি শেষ পর্যন্ত মুকুলের সঙ্গে ছিল। তাকে নিয়েও একটি চিত্তাকর্ষক গল্প রয়েছে বইতে যাকে আজকের বিচারে পলিটিক্যালি ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট বলা যেতেই পারে। নিজেকে রাঁধুনি বলে পরিচয় দিলেও বুদ্ধু মিঁয়ার রান্নাবান্নায় কোনো দক্ষতা ছিল না। সে এমনকি ডাল-ভাতও ঠিক করে সেদ্ধ করতে পারত না। একদিন রেগে গিয়ে মুকুল তাকে শুয়োর বলে গালাগালি দিলেন। বুদ্ধু মিঁয়া খুব দুঃখ পেয়ে বলল, “সাহেব, তুমি তোমার জুতো খুলে আমায় মারো, কিন্তু শুয়োর বোলো না।” মুকুল বললেন, “তুমি যদি আমার খাবার ঠিক করে সেদ্ধ না করো তাহলে আবার তোমায় শুয়োর বলব।” তারপর থেকে বুদ্ধু মিঁয়া ঠিকঠাক সেদ্ধ করত। কিছুদিন পরে বুদ্ধু মিঁয়াকে নিয়ে মুকুল আবার সাত নম্বর গুহায় থাকতে শুরু করলেন।
ভোরবেলা বাঘোরার জলে মুখ হাত ধুয়ে দিন শুরু হয়। আগের রাতে জল খেতে আসা বাঘ আর নেকড়ের পায়ের ছাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নদীর তীরে নরম মাটিতে। বুদ্ধু মিঁয়া জলখাবার বানিয়ে হাঁক দেয়, " খানা! খানা! ব্রেকফাস্ট তৈয়ার হ্যায়"। তারপর সারাদিন ধরে ছবি আঁকা। কোনো কোনো গুহায় হাজার বছর ধরে বাদুড় বাসা বেঁধেছে। সেই কটু গন্ধে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, পনেরো মিনিট অন্তর বাইরে এসে শ্বাস নিতে হয়। জঙ্গলে মৌমাছির চাক। বছরে একবার গ্রামের লোকেরা এসে মৌচাকে আগুন ধরিয়ে মধু নিয়ে যায়। একবার নিজামশাহি থেকে ইনস্পেকটর এল গুহা পরিদর্শন করতে। একটি মৌমাছি তার টাকে দিল হুল ফুটিয়ে। তারপর সে যতই দৌড়ায়, মৌমাছির ঝাঁক ততই তাকে ঘিরে ধরে। অবশেষে চৌকিদারেরা তাকে উদ্ধার করে গ্রামে পাঠাল। জন্তুজানোয়ারের উপদ্রবও আছে। একদিন সন্ধ্যায় গুহার বারান্দায় খেতে বসেছেন মুকুল আর বুদ্ধু মিঁয়া। হঠাৎ করে ভারী পাথরের চাঙর খসে পড়ল। ভূমিকম্প নাকি! দুজনে একটু খুঁজে দেখে প্রায় শতখানেক বাঁদর ঝগড়া করছে পাহাড়ের মাথায়। তারাই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। এতেই শেষ নয়। একদিন রাতে ঘুম ভেঙে মুকুল দেখেন গুহার মুখের কাছে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া চোখ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটুকরো জমাট অন্ধকারের মতো এক বিশাল বাঘের সিল্যুয়েট গুহার সামনে থেকে সরে গেল।
মুকুলের বইটা পড়তে পড়তে একটা বিষাদ আমায় ক্রমশ আচ্ছন্ন করে। মুকুল লিখছেন, অজন্তার গুহায় যে ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা রয়েছে সেই মুখ, সেই বাঁকা ভুরু, সেই গায়ের রং তিনি আশেপাশের গ্রামেও দেখতে পাচ্ছেন। ছাব্বিশ নম্বর গুহায় বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একটি ভাস্কর্য আছে। তেইশ ফুট প্রশস্ত। সেই ভাস্কর্যে বুদ্ধের মাথায় যে বালিশ আছে, যে জলপাত্র আছে, মুকুল বলছেন, দেড় হাজার বছর পরেও তা ভারতের সর্বত্র দেখা যায়। ২০২০-তে আমিও এই ভাস্কর্যটি দেখেছি। ভালো করে খুঁজলে আজকের ভারতেও হয়তো ওই জলপাত্র মিলবে, কিন্তু এখন আর তা রোজকার ব্যবহারের জিনিস না। এখন অজন্তার সিঁড়ি পর্যন্ত বাস চলে। জঙ্গলের বাঘ গল্পকথা হয়ে গেছে। বাঘোরা নদীর চরে এখনও মেলা বসে কিনা জানি না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারি সে মেলা আরও প্রান্তিক হয়েছে। গুহার দেয়ালের ছবিগুলোর বর্ণাঢ্যতা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বস্তুত অজন্তা সম্পর্কে কোনো পূর্বপাঠ না থাকলে সেই ছবি এক ঝলক দেখে কেউ হয়তো মনেও রাখবে না। ২০২০-র জানুয়ারি মাসে যখন আমরা অজন্তা যাই সেই সময়টা মহারাষ্ট্রের সরকারি স্কুলগুলো থেকে বাচ্চাদের এক্সকারশানে নিয়ে আসা হয় অজন্তা-ইলোরার গুহায়। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য টিকিট লাগে না। আমরা দেখি কুড়ি-তিরিশজন বাচ্চার দল শিক্ষকের সঙ্গে গুহায় ঢোকে। প্রায়ান্ধকার গুহায় দেয়ালের ছবি তারা কিছুই দেখতে পায় না। গর্ভগৃহের বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে সেলফি তুলে হইহই করে তারা বেরিয়ে যায়। বাঘোরার চরের মেলায় যারা পুজো দিতে আসত তারাও শিল্পোৎসাহী ছিল না। তবে ছবিগুলো হয়তো তাদের চোখে পড়ত। তাই তো তারা গল্প বানিয়েছিল স্বর্গভ্রষ্ট দেবতারা গুহায় এসে আটকে গেছে! দুধওয়ালি মারাঠি মেয়ে, রেললাইনের ধারে গ্রামের যাত্রাপালা এবং আরও অনেক কিছু যা আমার লেখা হয়ে উঠল না—সেইসব হাজার বছরের রোজনামচা নাগরিক ভারত থেকে স্রেফ উবে গেছে। আমি অতীতবিলাসী নই। বিশেষ করে মাত্র এক দশকের ব্যবধানেও মেয়েদের জীবনযাত্রার মানে যে চোখে পড়ার মতো উন্নতি দেখি, তাতে কখনোই অতীতে ফেরার ইচ্ছে হয় না। তবু মুকুল দে-র বই যেন বেলাশেষের সেই রাঙা আলো। ফেলে আসা সময় তার যাবতীয় বর্ণাঢ্যতা নিয়ে ক্ষণিকের জন্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। দু-হাজার বছর ধরে বয়ে আসা জীবনচর্যা, মাত্র একশো বছর আগেও যা ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল, তা থেকে বহুদূরে চলে এসে সেই জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা নয়, বিষণ্ণতা জাগে। মফস্সলি শীতের সন্ধ্যার মতো সেই চোরা বিষণ্ণতা একবার ঠাঁই গাড়লে তাকে নড়ানো কঠিন।
ভাল লাগলো আলচন। মুকুল বাবুর বইটির সফট কপি যদ্দুর মনে হচ্চে আমার কাছে আচে। হলদেটে স্ক্যান। বিনিওনের ইন্ট্র দেওয়া।
সিএস | 2405:201:8803:be5f:751a:ce7e:abaa:***:*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১০:২০96186
hu | 2607:fcc8:ec45:b800:84d9:f918:65f7:***:*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১০:২৯96187
i | 110.175.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১০:৩৩96188
,, | 150.129.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১১:২৩96191https://ia600806.us.archive.org/2/items/in.gov.ignca.9528/9528.pdf
তিতি রায় | 115.96.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১৪:৪৬96196শুচিস্মিতা, অত্যন্ত অপূর্ব তোমার লেখা। এ শুধু পাঠ অভিজ্ঞতা তো নয়, নিজের দর্শনও জুড়ে আছে এতে। অতীতবিলাসী না হলেও অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ ইতিহাসের কাছে তো বটেই, অনেক মানুষের ক্ষেত্রেও খুবই জরুরী। সেই অক্ষমতার কষ্ট এখানে পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়।
তিতি রায় | 115.96.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১৪:৪৭96197শুচিস্মিতা, অত্যন্ত অপূর্ব তোমার লেখা। এ শুধু পাঠ অভিজ্ঞতা তো নয়, নিজের দর্শনও জুড়ে আছে এতে। অতীতবিলাসী না হলেও অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ ইতিহাসের কাছে তো বটেই, অনেক মানুষের ক্ষেত্রেও খুবই জরুরী। সেই অক্ষমতার কষ্ট এখানে পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়।
দেবল দেব | 157.4.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১৯:১৩96203অবিন ঠাকুর আর মুকুল দে মশাইকে অজন্তার চিত্র বিষয়ে প্রথম উৎসাহিত করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। ভারতের শিল্প নিয়ে পরমোৎসাহী মানুষদের মধ্যে নিবেদিতা অগ্রগণ্যা। মুকুল দে-র বইটা আমি চোখে দেখিনি। তাই লেখিকার কাছে জানতে চাই, উনি কি নিবেদিতার নাম কোথাও উল্লেখ করেন নি?
দেবল দেব | 157.4.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১৯:১৩96204অবিন ঠাকুর আর মুকুল দে মশাইকে অজন্তার চিত্র বিষয়ে প্রথম উৎসাহিত করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। ভারতের শিল্প নিয়ে পরমোৎসাহী মানুষদের মধ্যে নিবেদিতা অগ্রগণ্যা। মুকুল দে-র বইটা আমি চোখে দেখিনি। তাই লেখিকার কাছে জানতে চাই, উনি কি নিবেদিতার নাম কোথাও উল্লেখ করেন নি?
b | 14.139.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ১৯:২৩96205অসাধারণ লাগলো। মুকুল দের বইটা পড়া হয়নি। এবার হতেই হবে৷
র২হ | 73.106.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ২০:৪৬96208রূপাবলী যেন কোনটা? নন্দলাল বসুর তিন না চার খন্ড বড় সাইজের পাতলা বইগুলো?
আরেকটা বই খুব পড়তাম নন্দলাল বসুর, শিল্পচর্চা। মোটাসোটা মেজোমতন বাঁধানো বই। তাতে ছাগলের কানের লোম দিয়ে তুলি তৈরী ইত্যাদি বিধান ছিল, খুব ঝামেলা। তবে নবরস এইসব খুব সুন্দর বুঝিয়েছিলেন। বইটা কই যে গেল।
hu | 2607:fcc8:ec45:b800:84d9:f918:65f7:***:*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ২৩:০২96211
অনিন্দিতা | 103.87.***.*** | ১২ আগস্ট ২০২০ ২৩:২০96212শ্রীলংকার সিগিরিয়া বা সিংহগিরি পর্বতে একই ধরনের বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী গুহাচিত্র আছে। ছবিগুলি এখনো উজ্জ্বল ও সুসংরক্ষিত। ৬০০ ফুট উঁচু এই পার্বত্য প্রাসাদে একটু কষ্ট করে ওপরে উঠতে পারলে সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 49.37.***.*** | ১৩ আগস্ট ২০২০ ১৪:১৯96219খুব ভালো লাগলো পরে । অসাধারণ ।
বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 202.142.***.*** | ১৩ আগস্ট ২০২০ ১৫:১৯96221
hu | 2607:fcc8:ec45:b800:84d9:f918:65f7:***:*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ০০:২৭96228
Piyali Bandyopadhyay | 2402:3a80:a5a:cb7d:0:69:c3e6:***:*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ০১:১৭96229শুচিস্মিতা,তুমি জয়ঢাক এর দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য র সঙ্গে যোগোযোগ করতে পারো স্ক্যান বা রিপ্রিন্টের ব্যাপারে।।
অত্যন্ত মূল্যবান ও সুখপাঠ্য লেখা।
সুদেষ্ণা মৈত্র | 42.***.*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ১০:৪৭96234খুব ভালো লাগল
সম্বিৎ | ১৪ আগস্ট ২০২০ ১১:৪৬96235লেখাটা খুবই ভাল, হুচি। তবে আমি অন্যকথা বলতে এসেছি। আজ থেকে বছর কুড়ি-বাইশ আগে বার্কেলের পড়ুয়া অনির্বান (দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যামেরিকান বাঙালি) bookfinder.com বলে একটি বই খোঁজার সাইট করেছিল। পরে অ্যামাজন বোধহয় কিনে নেয়। এই কুড়ি-বাইশ বছরে মাঝে মধ্যে সেখানে ঢুঁ মেরেছি বইয়ের সন্ধানে। পেয়েওছি। এখনও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধানে সেখানে যাই মাঝে সাঝে। মুকুল দে-র বই সেখানে সন্ধান করে এই পাওয়া গেল, দেখ যদি জোগাড় করতে পার।
অর্ঘ্য মজুমদার | 2409:4061:17:54b0:67ef:6e67:9049:***:*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ১৮:৩০96242নারায়ণ সান্যালের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লিখিত বইটি পড়েছিলাম l মুকুল দের উপলব্দি বর্ণনা খুবই চিত্তাকর্ষক l এমন বিষয়-সংস্থান নির্বাচন ও উপস্থাপন প্রশংসনীয়, উপভোগ্য l অশেষ ধন্যবাদ
সুকি | 49.207.***.*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ২০:৪৭96244লেখাটি উত্তম লাগলো