
সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন বা CBSE নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রম ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিল। গত ৭ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনা-পরিস্থিতিতে ক্লাস করানোর অসুবিধার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। যদিও এতে পাঠ্যক্রমের মূল ধারণাগুলো অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই দাবি পরিচালকদের। তো, কোন্ কোন্ বিষয় বাদ পড়ল? বাদ পড়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, জাত-ধর্ম-লিঙ্গ, নাগরিকত্ব, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি।
যেমন, ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়েদের পড়তে হবে না ‘গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভারতের সংবিধানের কাঠামো’। ক্লাস টেনের ছাত্রছাত্রীদের জানতে হবে না ‘গণতন্ত্র ও বৈচিত্র’, ‘জাত, ধর্ম ও লিঙ্গ’, ‘গণতন্ত্রের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো’। কিন্তু কেন? করোনার জন্য যদি পাঠ্যক্রম কমাতেই হয় তবে বেছে বেছে এগুলোকেই কেন বাদ দিতে হবে? মোদী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, লেখাপড়ার গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই এসব করা হয়েছে!
লেখাপড়ার গুরুত্বটা ঠিক কী, কোন্ কোন্ বিষয় না জানলে লেখাপড়ার গুরুত্ব বাড়ে, এসব প্রশ্ন মনের কোনায় উঁকি মারলেও, করোনার আবহে পাঠ্যক্রম কমানোর একটা আবেদন আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দাঁড়ান, করোনা আতঙ্কের কিছুদিন আগে, যখন আজকের অস্বাভাবিকত্ব ছিল না, তখন কেন ক্লাস নাইনের ইতিহাস বই থেকে ‘জাতপাতের সংঘাত’-কে বাদ দেওয়া হয়েছিল? চাপ কমানোর জন্য?
আসুন এবার একটু দেখে নিই, অতীতে বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের শাসনকালে কীভাবে স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রম বদলে গেছে।
এখনও পর্যন্ত এদেশের শিক্ষাকাঠামোয় স্কুলগুলোকে, সেগুলো সরকারি হোক কি বেসরকারি, কোনো একটি পর্ষদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় ও তাদের পাঠ্যসূচি মেনে চলতে হয়। ১৯৬১ সালে তৈরি হয়েছিল ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (NCERT), যাদের কাজ কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষাপর্ষদগুলোর জন্য পাঠ্যসূচি তৈরি করা ও পাঠ্যবই প্রকাশ করা। CBSE-সহ বিভিন্ন শিক্ষাপর্ষদ এদের পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই ব্যবহার করে।
১৯৭৭ সালে জনতা সরকারের মধ্য দিয়ে সংঘ পরিবার প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়। ক্ষমতায় এসেই ‘মেডিয়েভেল ইন্ডিয়া’ (রোমিলা থাপার) ও ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’ (বিপান চন্দ্র), NCERT-র এই দুটি ইতিহাস বইকে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। রোমিলা থাপারের বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে বইটি মুসলমান শাসকদের প্রতি নরম থেকেছে এবং হিন্দুপন্থী উৎসাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যদিও কোন্ ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা সরকারের তরফে জানানো হয়নি [Redolph, Lloyd I. et al, 1983]। এই দুটি বইয়ের সঙ্গে ‘ফ্রিডম স্ট্রাগল’ ও ‘কমিউনালিজম অ্যান্ড দ্যা রাইটিং অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’—এই দুটো ইতিহাস বইকেও আক্রমণ করা হয়। এসবের কিছুদিনের মধ্যে যখন একাদশ শ্রেণির জন্য অধ্যাপক রামশরণ শর্মার ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ বইটি প্রকাশিত হয়, তখনও একই কায়দায় সরকারের তরফে বইটিকে আপত্তি করা হয় ও বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, এইসব বইয়ের লেখকেরা সারা পৃথিবীতে সমাদৃত ও ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
দেশ জুড়ে প্রবল সমালোচনা আর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে জনতা দলের ভরাডুবির ফলে এইসব উদ্যোগের সাময়িক অবসান ঘটে। এরপর ১৯৯৯ সালে এনডিএ জোটের প্রধান দল হিসেবে বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসে। এবার আর কিছু বই বাজার থেকে তুলে নেওয়া নয়, NCERT-র পাঠক্রমই বদলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০০২ সালে দেশে নতুন পাঠ্যক্রম ঘোষিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল সংঘ পরিবারের পছন্দমতো ‘সঠিক ইতিহাস’ পড়ানো এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য শেখানো। শুধু স্কুলেই নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ‘শেখানোর’ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ নিয়ে কোর্স খোলারও ব্যবস্থা হয়। সংঘ পরিবারের কাছে ‘সঠিক ইতিহাস’-এর অর্থ পুরানকে ইতিহাসের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া, ব্রাহ্মণ্যবাদকে তুলে ধরা আর মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি বিদ্বেষ ছুড়ে দেওয়া। NCERT-র নতুন পাঠক্রমে অত্যন্ত সুকৌশলে এমন ‘প্রকৃত ইতিহাস’ ঢোকানো হয়েছে।
অবশ্য নতুন পাঠ্যক্রম ঘোষণা করেই সংঘ নেতৃত্ব ক্ষান্ত হয়নি, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আর এস শর্মা, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র প্রমুখদের রচিত স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইগুলোর কিছু কিছু অংশ, যেগুলো সংঘের অপছন্দ, কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সেগুলোকে মুছে দেয়। কোন্ কোন্ অংশ এভাবে মুছে ফেলল? একাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়ের জন্য আর এস শর্মার ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ বইটার কথাই ধরা যাক। বইটার ৭ নং পৃষ্ঠার একটি অনুচ্ছেদের শেষ কয়েকটা বাক্য সরানো হয়েছে, যেখানে প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণের কথা আনা হয়েছে। ২০-২১ নং পৃষ্ঠার একটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে, পৌরাণিক সাহিত্যের সূত্র ধরে অযোধ্যায় রামের থাকার সময় ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব নির্ণয় করা যেতেই পারে কিন্তু অযোধ্যায় ওই সময়ে মানুষ বসবাসের কোনো চিহ্ন পুরাতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে পাওয়া যায়নি। যে কৃষ্ণ মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং যার লীলাক্ষেত্রে হিসেবে মথুরাকে চিত্রিত করা হয়, সেই মথুরাতে ২০০ খ্রিস্টপূর্বের আগে মনুষ্যবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় না—এ কথাও লেখা হয়েছে অনুচ্ছেদটিতে। মহাকাব্য ধরে যুগ নির্ণয়কেও প্রশ্ন করা হয় এই অনুচ্ছেদে, যেটা সংঘের ইতিহাস-বীক্ষণের পরিপন্থী। ফলে বাদ দেওয়া হয় অনুচ্ছেদটিকে। বইয়ের ৪৫ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে তাম্রযুগে যারা বসবাস করত, তারা গোমাংস-সহ অন্যান্য পশুর মাংস খেত, কিন্তু শুকরের মাংস সেভাবে খেত না। এই অনুচ্ছেটাকেও কেটে ফেলা হয়। আবার ৯১-৯২ পৃষ্ঠায় যেখানে জৈন ও বৌদ্ধদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৩৭-৩৮ পৃষ্ঠায়, যেখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, সেখানের অংশগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ওই বইয়ের ২৪০-৪১ পৃষ্ঠায় বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা কেন বিশ্বে অনন্য ও অদ্ভুত, কীভাবে এখানকার ধর্ম এমন স্থবির ও অমানবিক বর্ণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় কতটা সুখ ভোগ করেছে এই ব্যবস্থার ফলে, এসব কথা লেখা হয়েছে এখানে। ফলে পুরোটাই ধরে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য রোমিলা থাপারের লেখা ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ থেকেও একই কায়দায় অপছন্দের বাক্যগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। এই বইয়েও যেখানে লেখা হয়েছে যে অতিথি আপ্যায়নে গোমাংস খাওয়ানোই প্রাচীন ভারতের রীতি ছিল (৪০-৪১ পৃষ্ঠা), সেই অংশটাকে বাদ দিয়েছে।
এখন মুশকিল হল, ইতিহাস তো লিখিত হয় তথ্যের ভিত্তিতে, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের ইচ্ছে-অনিচ্ছার উপর নয়। যে পুরান নিয়ে সংঘ পরিবারের এত আগ্রহ, সেখানেও তো গোমাংস ভক্ষণের কথা বলা আছে। শতপথ ব্রাহ্মণ ৩.৪.১.২, বৈশিষ্ট্য ধর্মসূত্র ৪.৮ বা বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬.৪.১৮, গোমাংস ভক্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায় [Thapar, Romila, 2001]। একইভাবে মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের ভারত নিয়ে যেখানে সংঘেরর অপছন্দের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, তাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। দিল্লি হিস্টোরিয়ানস গ্রুপের প্রকাশিত পুস্তিকায় কী কী বাদ দেওয়া হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে [Delhi Historians’ Group, 2001, পৃ. ৫৮-৬৪]।
এই সামগ্রিক পরিকল্পনা সফল করার জন্য NCERT-র বিভিন্ন কমিটি বদলে দেওয়া হয়, প্রতিথযশা ঐতিহাসিকদের পদচ্যুত করা হয়। কিন্তু নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী কারা বই লিখবেন, কারাই বা পর্যালোচনা করবেন? শেষ পর্যন্ত এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি, যদিও NCERT-র তৎকালীন অধিকর্তা জানিয়ে রাখেন, নতুন বইগুলোর বিষয়বস্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে কি না, ধর্মবিশেষজ্ঞদের দিয়ে পর্যালোচনা করা হবে! সেইসময়ের শিক্ষা তথা মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী এতে যোগ করেন, ধর্ম-সংক্রান্ত যে-কোনো বিষয় ধর্মের প্রধানদের অনুমোদন সাপেক্ষেই পাঠ্যবইয়ে ঢোকানো যাবে [Mukherjee, Mridula and Mukherjee, Aditya, 2001]! অর্থাৎ যুক্তি, তথ্য, ঐতিহাসিক সত্য, বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে আর জ্ঞানচর্চা করা যাবে না, জ্ঞানচর্চা পরিচালিত হবে ধর্মগুরুদের নির্দেশে। বিজেপি-আরএসএস শিক্ষায় হস্তক্ষেপের সারসংক্ষেপ বোধহয় এটাই।
২০০৪-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হলে শিক্ষাকে হিন্দুত্বকরণ করার প্রক্রিয়া কিছুটা ধাক্কা খায়। কিন্তু যে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি শিক্ষায় ঢুকছে, তার স্থায়ী প্রভাব থেকে যায়। যেমন ২০০৪-এর পরে অর্জুন সিং নতুন শিক্ষামন্ত্রী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আনতে অস্বীকার করেন। এরপর ২০১৪ সালে মোদী সরকার কেন্দ্রে এলে শিক্ষাকে হিন্দুত্বকরণ করার জোয়ার আসে। কীভাবে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীরা অবিজ্ঞানের চর্চা করতে শুরু করে, তা আমরা দেখেছি। এগুলো সবই হিন্দুত্ববাদীদের পূর্ব পরিকল্পনা। এই সময় দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক যোগা দিবস’ পালনের জন্য নির্দেশিকা জারি করা হয়। যোগার মাধ্যমে পুরোদস্তুর হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালানো হয়। এই সময় বিজ্ঞান গবেষণার তালিকায় বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক বিষয়, যেমন গোমূত্র গবেষণা ইত্যাদিকে জুড়ে দেওয়া হয়।
গৈরিকীকরণের অভিযান কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তার আভাস পাওয়া যাবে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোকে পর্যালোচনা করলে। গুজরাট এবিষয়ে অগ্রগণ্য। সংঘ পরিবার ও তাদের সমর্থকের কাছে গুজরাটের শিক্ষাব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্তযোগ্য মডেল। ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে সংঘ পরিবারের দর্শন অনুযায়ী সাজিয়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাঠক্রম হিন্দুত্ববাদ ওরফে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী সাজানো হয়। বিশিষ্ট আরএসএস প্রচারক দীননাথ বাটরা-কে গুজরাট স্কুল শিক্ষার জন্য সহায়ক বই লিখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শ্রী বাটরা গুজরাট রাজ্য শিক্ষাপর্ষদের জন্য ন-টি সহায়ক বই লেখেন, যেগুলোর ভূমিকা লেখেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। ২০১৪ সালের ৩০ জুন গুজরাট সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায় যে রাজ্যের ৪২০০০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছেলেমেয়ের জন্য বইগুলো পড়া বাধ্যতামূলক (The Hindu, Ahmedabad, 25/07/2014)। কী আছে এইসব বইয়ে? ইতিহাস, সংস্কৃতি, চরিত্রগঠন, গণিত ইত্যাদি বিষয়ে লেখা বইগুলো হিন্দুত্ববাদের কড়া পাঠ দেয়; ছেলেমেয়েদের অখণ্ড ভারত—যার মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, তিব্বত ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে একটি দেশ ভাবতে শেখায়। এই দীননাথ বাটরা আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিদ্যাভারতীর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন; বাজপেয়ী সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশীর মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন এবং প্রাচীন ভারতে যে গোমাংস খাওয়া হত, এই ঐতিহাসিক তথ্যকে NCERT-র সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন; দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত গবেষক এ কে রামানুজনের ‘তিনশো রামায়ণ’, যেখানে দেখানো হয় যে ভারতে প্রচলিত রামায়ণগুলো মোটেও এক নয়, তাকে পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেন। ভারতীয় শিক্ষাকে গৈরিকীকরণের অন্যতম মুখ এই দীননাথ বাটরা যে ইতিহাস বলবেন সেটা বিকৃত ও ভ্রান্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর এমন একজনকে দিয়েই লেখানো হল গুজরাট স্কুল-শিক্ষার বই!
শুধু গুজরাটই নয়, বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যেও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন, মধ্যপ্রদেশে বলা হয়েছে বিদ্যাভারতীর স্কুল-শিক্ষা সরকারি শিক্ষার বিকল্প। ‘টিচিং টু হেট’ প্রবন্ধে অধ্যাপক নন্দিনী সুন্দর দেখিয়েছেন শিক্ষাকে গৈরিকীকরণের মধ্য দিয়ে সংঘ পরিবার কীভাবে ঘৃণার পাঠ দেয়। সেই প্রবন্ধে মধ্যপ্রদেশের একটি এলাকাকে কেস স্টাডির জন্য বাছা হয়, এবং উনি দেখান, কীভাবে সরকারি স্কুল থেকে প্রধান্য পাচ্ছে সংঘ পরিচালিত বিদ্যাভারতীর স্কুল।
ফলে আজকে যে বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হল, সেটা আকস্মিক একেবারেই নয়, বরং পূর্বপরিকল্পনা মাফিকই এই বদল আনা হয়েছে। বাদ পড়া বিষয়গুলোর উপর সংঘ পরিবারের অরুচি দীর্ঘদিনের। করোনা তাদের খানিক সুবিধা করে দিল, এই যা।
অনিন্দিতা | 103.87.***.*** | ২০ জুলাই ২০২০ ১৭:২৫95370সম্প্রতি দেখা গিয়েছে তামিলনাড়ুর ষষ্ঠ শ্রেণীর পরীক্ষার একটি প্রশ্ন। দলিত কাকে বলে? তার multiple choice answers হল foreigner, untouchable, middle class, upper class. বলে দেওয়া অবান্তর এক্ষেত্রে সঠিক উত্তরটা কী। প্রশ্নটি সম্পর্কে কী বলব জানি না।
শিক্ষার গৈরিকিকরণ অনেকদূর এগিয়ে নেওয়া হল। সেকুলারিজম, ফেডেরেলিজম কাকে বলে জানার দরকার নেই। হিন্দু রাষ্ট্রের কনক্রিট ভিত বানাবে এই শিক্ষাব্যবস্থা।
এলেবেলে | 202.142.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ০১:১৪95386এই সুলিখিত তথ্যবহুল প্রবন্ধটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের পাঠক্রমে যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটে চলেছে শাসকের অঙ্গুলিহেলনে, এ তো বাস্তব সত্য। কিন্তু পড়াশোনার বিষয়টা যেহেতু রাজ্যগুলো জুড়েও ব্যাপ্ত এবং সে সব রাজ্যগুলোও শাসকরাই শাসন করে থাকেন, তাই সেই চিত্রটা তুলে না ধরলে আলোচনাটা খানিক একমাত্রিক হয়ে পড়বে বলে আমার নিজের ধারণা।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যস্থায় বাম আমলে এই পাঠক্রম ও তার অন্তর্ভুক্ত বিষয় নিয়ে এনসিইআরটি-র মতো না হলেও, খুব কম কিছুও হয়নি। পাঠ্যপুস্তকগুলোতে লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টা প্রকট তো ছিলই, সম্প্রদায়গত বিদ্বেষটাকেও খুব ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়নি। সর্বোপরি কোনও কোনও বিষয়ে ছিল সিলেবাসের পাহাড়প্রমাণ বোঝা।
২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের প্রথম ভাষা হিসবে বাংলা ছিল ২০০ নম্বরের। সেখানে গদ্য-পদ্য মিলিয়ে মোট পাঠের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯টি! একটি রচনা লিখতে হত ২০ নম্বরের, সেখানে বোর্ড মূল্যায়ন করার একটা অলিখিত নিয়ম বানিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা যাকে এইট পয়েন্টস বলে অভিহিত করত - মানে ভূমিকা ও উপসংহার ছাড়াও যেভাবে হোক আরও ৬টা পয়েন্ট লিখতেই হবে। সঙ্গে থাকতে হবে অন্তত তিনটে চটকদার উদ্ধৃতি।
১৯৯০-১৯৯৮ পর্যন্ত পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস বইতে ছিল রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা (বলিভিয়া)-র বিপ্লবের ইতিহাস। সেখানে মাও, হো, সাইমন বলিভার, দিয়েন বিয়েন ফু-র যুদ্ধ প্রাণপণে মুখস্ত করত ছোট ছোট বাচ্চারা। মানে একেবারে প্রথম থেকেই ইতিহাস সম্পর্কে স্থায়ী ভীতি তৈরি করার রাস্তা পাকা।
প্রায় ২০০০ সাল অবধি ইংরেজির বিষয়-শিক্ষকদের মোটামুটি সর্ববিদ্যা বিশারদ ধরে নেওয়া হয়েছিল কোনও এক অজানা কারণে। তাঁদের পড়াতে হত মহাকাশচারীদের ইতিহাস, ব্রেল পদ্ধতি, প্রতিসরণ, ফারেনহাইট-সেলসিয়াস স্কেলের পার্থক্য, ভিটামিন, উদ্ভিদের সংকোচন-প্রসারণ, নিরক্ষীয় অঞ্চল, কর্কটক্রান্তি-মকরক্রান্তি রেখা এবং সনেটের রকমফের ইত্যাদি নানাবিধ বস্তু এবং সমস্ত কিছুই ইংরেজি টার্মিনোলজিতে। অথচ তারা ভূগোল ক্লাসে বুধ-শুক্র-মঙ্গল; ভৌতবিজ্ঞান ক্লাসে প্রতিফলন-প্রতিসরণ; জীবনবিজ্ঞান ক্লাসে সালোকসংশ্লেষ-শ্বসন কিংবা ইতিহাস ক্লাসে বিপ্লব-বিদ্রোহের সামান্য ইংরেজি টার্মগুলোও শিখত না।
বাম আমল গেল, নতুন জমানা এল কিন্তু পাঠক্রমে কিছু কসমেটিক পরিবর্তন ছাড়া মুল বিষয়টা একই রয়ে গেল। নিছকই কৌতূহলবশে সপ্তম শ্রেণির অঙ্ক বইয়ের প্রথম ৭৮ পাতা দেখেছিলাম। সেখানে হিন্দু নাম পেয়েছিলাম ৪৯টা, মুসলমান ১৫টা এবং খ্রিস্টান সাকুল্যে একটা। না, কোনও প্রান্তিক, দলিত মানুষের পদবি দেখিনি। বরং দেখেছি, হিন্দুদের নামের পরে বাবু আর মুসলমানদের নামের পরে চাচা (আমিনুল চাচা) বা বেগম (ফরিদা বেগম)। এই যে সূক্ষ্ম বিভাজনের ভেদরেখা শিশুদের মনের গভীরে গেঁথে যাচ্ছে একেবারে জীবনের কৈশোরদশাতেই, তার থেকে পরিত্রাণ কীভাবে পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না জানি না।
আসলে শাসক চিরকালই শাসক। সে কেন্দ্রেই হোক বা রাজ্যে। আর শিক্ষাব্যবস্থা তাদের মর্জিমাফিকই চলে।
সুব্রত রায় | 45.248.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ০১:২৮95387প্রয়োজনীয় লেখা। সময়োচিত।
a | 220.253.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ০৪:০৯95388
এলেবেলে | 202.142.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ১১:১৮95393খুব স্বাভাবিক এই সন্দেহপ্রকাশ। কারণ সে ব্যাপারে সন্দেহ না থাকলে, টিপিক্যাল লেফট লিবার্যালদের বিজেপি-কে একবগ্গা আক্রমণ করে প্রগতিশীল হয়ে উঠতে খানিকটা অসুবিধা হয় আর কি! কিন্তু তাতে ইতিহাস বদলায় না। পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস বইও বদলায় না!!
b | 14.139.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ১২:২৬95396
পাতিহাঁস | 178.128.***.*** | ২৩ জুলাই ২০২০ ০৪:০২95431