১০-ই অক্টোবর ২০১৯ ১ম কিস্তি
=========================
তা হোটেলখানি বেশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সামনে লোহার জমকালো গেট। রাতে এসে হর্ন বাজাতে এক রোগা পাতলা বাচ্চামত ছেলে এসে গেট খুলে বাঁদিকে হাত দেখালো। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঝুপসি গাছে ভরা, ভেতরের পথটিও ঠিক পাকারাস্তা নয় মাটির উপর ইঁট আর পাথরের টুকরো ফেলা। বাঁদিকে গাড়ি নিয়ে অল্প এগোতেই দেখা গেল আর এগোন যাবে না, মাটির পথ ধাপে ধাপে নেমে গেছে। ছেলেটি ইতিমধ্যে গেট বন্ধ করে আবার চলে এসেছে, মুখে কথা নেই হাতে টর্চ নিয়ে নামতে থাকে, সামনে কোথাও কোন আলো দেখতে পাই না। সারথী বলেন ম্যাডাম গাড়ি তো আর যাবে না, কিন্তু গেটের এত কাছে গাড়ি রাখবো? সঙ্গিনী এবার বিদ্রোহ করেন –‘আমি আর একফোঁটাও হাঁটতে পারবো না, সিঁড়ি ভাঙতেও পারবো না’। ছেলেটি অগত্যা আবার উঠে আসে, জিগ্যেস করে ‘অনেক মাল আছে নাকি? আমি একটা দুটো নিতে পারবো।‘ জিগ্যেস করি কতদূর? ইতস্তত করে বলে একটু নেমে যেতে হবে একটু ভিতরে। বলি অন্য রাস্তা নেই গাড়ি যাবার মত? এবার ডানদিকে হাত দেখায়, বলে ওদিকে যাও, আসছি আমি, বলেই নিকষ অন্ধকারে তরতর করে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। আমরা আবার গাড়িতে বসে ডানদিকে রওনা হই, এবার বেশ কিছুটা এগোন যায়। একশো মিটার বাদে একজায়গায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সাথে আরেকজন, দুজনের হাতেই দুটি জোরালো টর্চ। গাড়ি আর যাবে না।
দ্বিতীয়জন হাসিমুখে এগিয়ে আসেন ‘সব মাল আমরা নিয়ে যাচ্ছি’। জানাই মাল তেমন কিছু নেই, আপাতত হাঁটার শক্তি নেই। ভারী ভরসা দিয়ে বলেন আরে হাঁটা কই ঐ তো ওইটে আপনাদের কটেজ, আলো জ্বলছে। সত্যিই কুড়ি কি পঁচিশ পা হাঁটতেই পৌঁছে যাই। জয় (ওঁর নাম) বলেন আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন, রাতের খাবারের জন্য কতক্ষণ পরে আপনাদের নিতে আসবো বলুন? ১৫ মিনিট? কুড়ি মিনিট? কাঁচুমাচু হয়ে বলি খাবারটা ঘরে দেওয়া যাবে না? জয় আরো বেশী কাঁচুমাচু হয়ে বলেন না না এখানে বড় পোকামাকড় আসে – আপনারা খাবার জায়গাতেই আসুন। ঘর, একটা ঝকঝকে লেপা মাটির বারান্দা একটা মস্ত বড় ঘর আর মস্ত বাথরুম। নানা সাইজ ও শেপের সাদা পাথরের টুকরো দিয়ে বাথরুমের মেঝে বানানো, ঘরের মেঝেটা সম্ভবত মাটির উপরে কিছু একটা কোটিং দিয়ে তার উপর লাল প্ল্যাস্টিক পেইন্ট করা। জয় টর্চটা রেখে পনেরো মিনিট পরে আসবেন বলে চলে গেলেন। এবার লক্ষ করে দেখি ঘরের ছাদ টালির, বাঁশের আড়ায় টালি বসানো, ঘরের দেওয়াল অবশ্য ইঁট গাঁথা। দেওয়াল আর টালির চালের মাঝখানে সাদা নেট দেওয়া, মস্ত দুটো জানলা। বাথরুমে গরম জলও দিব্বি আছে, নাকি ‘গ্যাস গিজার’ কিছুক্ষণ কল খুলে রাখলে আস্তে আস্তে গরম জল আসতে শুরু করে।
ঘাসপাতা আগাছার মধ্যে দিয়ে সরু পায়েচলা পথ ধরে ডাইনিং হলে পৌঁছানো গেল। সেও মাটিলেপা মেঝে, খড়ে ছাওয়া চাল। জায়গায় জায়গায় সেই পুরানোদিনের টাংস্টেন বাল্ব ঝোলানো, তাতে শেড হিসেবে বেতের বোনা ঝুড়ি। ফলে বাল্বের হলদে আলো খানিকটা ঢাকা পড়ে অন্ধকারভাব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ডাইনিং হল চারপাশ খোলা, দেওয়াল বলতে কিছু নেই। লাগোয়া কিচেন ও রিসেপশান পাশাপাশি। খাবারদাবার দিব্বি ভাল। আর এমনিতেও অত ঘুরে অতরাতে গিয়ে গরম খাবার তৈরী পাওয়া মানেই স্বর্গ। খাবারের সাথে সাথেই তিনজনের জন্য তিনটি গ্লাস নিয়ে এসে বলেন এটা আমাদের এখানকার একটা বিশেষ পানীয়, নারকেলের দুধ আর কোকুমের সরবৎ, খেয়ে দেখুন। আরে এ তো সলকাঢ়ি, বেজায় ভালোবাসি এটা। আর মালওয়ান - কোঙ্কন উপকূল বরাবর সলকাঢ়ির যে স্বাদ সেটা পুণে সাতারা ইত্যাদি শহরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সঙ্গিনী ইতস্তত করেন, কী এটা? কোকুম একরকম ফল ঈষৎ টক, নারকেলের দুধের সাথে মিশিয়ে সলকাঢ়ি বানানো হয়, এছাড়া কোকুমের নানা ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহারও কোঙ্কন গোয়া উপকূল অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। ভারী সুস্বাদু পানীয় এই সলকাঢ়ি, খেলেই চনমনিয়ে চাঙ্গা লাগে।
সারথীমশাইয়ের জন্য তাঁবু বুক করেছিলাম তা জয় বলেন আপাতত আমরাই একমাত্র অতিথি, কাজেই সব কটেজই খালি। অতএব ওঁরা আর তাঁবুর ঝকমারিতে যেতে চান না, সারথীমশাইয়ের জন্যও একটা কটেজই খুলে রেখেছেন। পরেরদিন আমরা দুধসাগর ফলস যাবো, জয় বলেন সকাল এগারোটার মধ্যে বেরিয়ে যেতে, এখনো এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, রোজই বিকেলের দিকে ধুম বৃষ্টি হয়, ফলে দুপুর একটা দেড়টার পরে আর এদিক থেকে ফলসে যেতে দেয় না। উৎসাহভরে বলেন লোকে এখানে পাখীদর্শনে তো আসেই, নানারকম সাপ, বিছে, ব্যাঙ দেখতেও আসে। সাত আট রকম সাপ, তিন চার রকম ব্যাঙ আর অনেকরকম বিছে তো এই আমাদের কটেজ এলাকাতেই আছে, ওর জন্য জঙ্গলেও যেতে হবে না। আমি আড়চোখে সঙ্গিনীর দিকে তাকাই। ভয়ে ভয়ে নিজের চেয়ারের পায়াগুলো দেখছেন। :-) কটেজে ফিরে তাঁর দাবী হল লাইট নেভানো চলবে না। এদিকে একটা স্যুইচে একসাথে চারটে আলো জ্বলে চারকোণে, আমি নিকষ অন্ধকার ছাড়া ঘুমোতে পারি না। যেটা নৈশবাতি হবার কথা, সেটায় দেখি একটা জোরালো এলইডি বাল্ব লাগিয়ে রেখেছে, অতএব সেও বাদ। জানালা বন্ধই রইল, অনেক করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব বাতি নিভিয়ে শুলাম। দেয়াল আর টালির মাঝের নেট দেওয়া অংশ দিয়ে চাঁদের মৃদু আলো আসছে , রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, একটা তক্ষক ডেকে চলেছে একটানা --- এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোত্থাও। নার্ভগুলো আপনিই শিথিল হয়ে আসে।
রাতে একবার ঘুম ভাঙে, ছাদে কি যেন পড়ছে ঝিপ ঝিপ করে আওয়াজ। আবার বৃষ্টি সুরু হল নাকি? সর্বনাশ তাহলে কাল দুধসাগর যেতে পারব? তক্ষক ডাকছে দুটো, কোথা থেকে একটা ময়ুরও ডেকে চলেছে কেঁয়াআ কেঁয়াআ করে। হাতেপায়ে বড় ক্লান্তি --- আবার তলিয়ে যাই ঘুমে। ঘুম ভাঙে অজস্র পাখীর কিচিমিচিতে। জয় বলে দিয়েছিলেন সাড়ে পাঁচটা ছ’টা থেকে পাখীর কাকলী শুরু হয়ে যায়, কিন্তু দিনের আলো না ফুটলে দেখা মুশকিল। ঝিপ ঝিপ শব্দটা আরো একটু বেরেছে মনে হচ্ছে, ময়ুরটা এখনো ডাকছে থেমে থেমে, ঘড়িতে সময় পাঁচটা ছাপ্পান্ন। উঠে সাবধানে আওয়াজ না করে দরজা খুলে বারান্দায় আসি। আর অমনি ম্যাজিক! সবে আলো ফুটছে, চারিদিক ধুসর সাদা পর্দায় ঘেরা, বড় বড় নারকেলগাছ আর নাম না জানা বুনোফুলের গাছ চারপাশে --- প্রায় বারো কি চোদ্দ রকমের পাখী ডাকছে ---আর ---আর হিম পড়ছে। আশ্বিনমাসের হিম। আমাদের কুঁড়েঘরের চাল টালির উপরে নারকেল্পাতা দিয়ে ছাওয়া, চারপাশের নারকেল গাছের পাতায়, কুঁড়ের চালে হিম পড়ায় অমন ঝিপ ঝিপ শব্দ হচ্ছে। স্থাণু হয়ে যাই ---হিম পড়ার আওয়াজ, সে কোন সুদূর অতীতে শুনতাম। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগের আশ্বিনের ভোরের স্মৃতি ভেসে আসে হু হু করে --- সকাল ছ’টায় ঘুম ভাঙে শ্রীদুর্গা মিলের ভোঁ শুনে। টালির চালের উপর খড়ে ছাওয়া গোয়ালঘর, লালির বাছুর হয়েছে শেষরাতে, দৌড়ে দেখতে যাই --- উঠোনে পা দিতেই চারিদিক হিম হিম কনকনে --- ‘ঠান্ডার মইধ্যে খালি মাথাত যাইস না বাইরে, টুপিখান পইরা যা, আশ্বিনের হিম বইস্যা গেলে পুরা শীতডা ভুগাইবো।‘ সত্তরোর্ধ সেই ঋজু বৃদ্ধ কবেই মিলিয়ে গেছেন পঞ্চভুতে, আমার কপালে মাথায় এখনো রয়ে গেছে শিরাওঠা হাতে জড়িয়ে দেওয়া পশমের উষ্ণতা।
----------------------------------------------------------------------------------------
প্রথম পর্ব
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17601
দ্বিতীয় পর্ব
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17647
দারুণ!