৯-ই অক্টোবর ২০১৯
====================
আবার অক্টোবরে ফিরি। আম্বোলিঘাটের দিকে যতই এগোতে চেষ্টা করি ততই দেখি গুগল ম্যাপে হোটেলের আনুমানিক দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই সারথীমশাইকে থামতে বলতে হল। খানিক ঘেঁটে বুঝলাম আমাদের খানাপুর হয়ে যেতে হবে, আম্বোলি নয়। অতএব ঘোরাও গাড়ি, গেল একঘন্টা জলে। যাকগে এখনো পৌনে সাতটা অবধি দিনের আলো থাকে। হায় তখন যদি জানতাম সামনে কী আছে। কর্ণাটকের এই অংশের রাস্তা বেশ খারাপ আর রাস্তার মাঝে মাঝে যেখানে সেখানে খাড়া শিঙওলা গরুরা দাঁড়িয়ে আছে, বড়সড় লরির হর্নেও তাদের কোন হেলদোল নেই। অতএব পাশ কাটিয়ে চলো, ফলত ছোটখাট গঞ্জের মধ্যে গতি অত্যন্ত ধীর। এইসব গোমাতার মানুষ সন্তানরা কোথায় কে জানে!
.
সেসব কাটিয়ে এনএইচ ৪৮ ও পরে এনএইচ ৭৪৮ এ উঠে শান্তি। সন্ধ্যে ছ’টা খানাপুর বাজারে পৌঁছানো গেল। খানিক ডাইনে বাঁয়ে বেঁকে এদিক সেদিক করে এসএইচ৩১ ধরতেই দেখালো সাড়ে সাতটা নাগাদ হোটেল পৌঁছানো যাবে। এদিকে দুপাশের বাড়ি দোকান গুদামঘর মিলিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। দেখতে দেখতেই মোটামুটি মাঝারি ধরণের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল রাস্তাটা। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও। দুদিকে জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে, আকাশে অন্ধকার নামার ঠিক আগের মুহূর্তের লাল কমলা গোলাপী রঙ ধীরে ধীরে গভীর গাঢ় নীল হয়ে আসছে। সঙ্গিনী বলেন ‘আর কদ্দুর রে?’ ভরসা দিই এই তো আর ঘন্টাখানেকের একটু বেশী। সারথীমশাই বলেন এই জঙ্গলটা শেষ হবে একটা ঘাট পেরিয়ে আর ঘাট থেকে নামতেই সম্ভবতঃ আমাদের হোটেল, উনি বছরখানেক আগে আরেকজনকে নিয়ে এসেছিলেন। এতক্ষণে চেনা রাস্তা পেয়ে তাঁকেও খানিক নিরুদ্বেগ দেখায়। একটা রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং আসে, গেট বন্ধ। জঙ্গলের কোলঘেঁষে গাড়ি রেখে আমরা নামি একটু হাত পা খেলাতে। আমি ম্যাপ ঘেঁটে জঙ্গলটা চেনার চেষ্টা করি --- যা বুঝলাম এটা ভীমগড় অভয়ারণ্যের একদম বাইরের দিকের অংশ এটা। আমরা এটা পেরিয়ে খানিক গিয়ে ‘ভগবান মহাবীর অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে গিয়ে, ‘তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে’ কোলেম-মোলেম রোড ধরে দুই তিন কিলোমিটার গেলেই বাঁয়ের দিকে মিলবে আমড়াতলার মোড়, থুড়ি হোটেল।
.
এখানে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে বোঝা যাচ্ছে না, ইতিমধ্যে বেশ ক’টা বাইক ও আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সারথী গেছেন গেটম্যানের সাথে কথা বলে রাস্তাটা আরেকবার বুঝে নিতে। তিনিই হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন এরা সবাই বলছে ৬০ কিলোমিটার আগে রাস্তা বন্ধ মোলেমের দিকে যাওয়া যাবে না। খানাপুর বাজারে নোটিশ টাঙিয়েছে, রাস্তায় কাজ হচ্ছে, জাম্বোটি দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। অ্যাঁ!! বলে কি এরা!? আমিই এগোলাম ব্যাপারটা বুঝতে। কিন্তু নাহ সারথী ঠিকই বুঝেছেন, সঙ্কীর্ণ গলিসম রাস্তা, মেরামতির জন্য সম্পূর্ণই বন্ধ কিছুটা অংশ, দুপাশে জঙ্গল কাজেই পাশ কাটিয়ে ঘুরে যাওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গিনী শুনেই বলেন হোটেলে ফোন করে জিগ্যেস করতে কোন বিকল্প সংক্ষিপ্ত রাস্তা আছে কিনা, হোটেল থেকে বিকেলে একজন ফোন করেছিলেন, তিনি রাস্তা বাতলাচ্ছিলেন ধারওয়াড়, হুবলি এইসব দিক থেকে, যা পুরো উল্টো। ফলে খুব ভরসা পাই না, তবু ফোন করি। ঐ নাম্বারটি স্যুইচড অফ। অগত্যা নেটে পাওয়া নম্বরগুলোতে পরপর কল করে যাই। কোনোটি বৈধ নয় তো কোনওটি নেটওয়ার্কের বাইরে। একটা নম্বরে অবশেষে কেউ একজন ধরলেন, শুনেটুনে বললেন ওহো হ্যাঁ ওইদিকের রাস্তা বন্ধ আছে, আপনারা ওদিক দিয়ে গেছেন বুঝি? আচ্ছা চোরলাঘাট চলে আসুন, সেইখান দিয়ে রাস্তা খোলা আছে। সে আবার কোথায় রে বাবা!! এদিকে নেট একদম নেই। সারথীকে ফোন ধরাই বুঝে নেবার জন্য। তিনি বিরক্ত মুখে বলেন ‘তুমি লিখে নাও আমি কী করে বুঝব?’
.
ইতিমধ্যে হেলেদুলে একটা মালগাড়ি চলে গেছে, গেট উঠছে --- দেখি অন্য গাড়িটা কোন ফাঁকে ঘুরিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। তার মানে সেটারও ঐ পথে যাবার ছিল। বাইক আরোহীরা রেললাইনের উপর দিয়ে এগোচ্ছেন দেখে হাঁইমাই করে একজনকে থামালাম। সে নেহাৎ ১৫-১৬ বছরের বাচ্চা ছেলে। চোরলাঘাট শুনে হড়বড়িয়ে একগাদা ডাইনা, বাঁয়া , কান্নিক মারা ইত্যাদি বলে যায়। ঘোর অন্ধকার হয়ে গেছে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরবে, বেচারির তাড়া বুঝি। কোনমতে চোরলাঘাটের পথ কীভাবে ধরব সেইটুকু বুঝে নিয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে আমরা রওনা দিই, ঘড়িতে তখন ছ’টা চল্লিশ। খানাপুর বাজারের কাছাকাছি আসতেই নেট আসে। ম্যাপে গন্তব্য চোরলাঘাট দিতে সময় দেখায় এক ঘন্টা তিরিশ মিনিট, ট্র্যাফিক ন্যুনতম, তবে রাস্তাটির বেশ অনেকটা অংশ হয় হলদেটে বাদামী নয়ত টকটকে লাল। অর্থাৎ ভাঙাচোরা রাস্তা অথবা কে জানে হয়ত রাস্তাই নেই, মাটির পায়েচলা পথ। আমাদের ঘুরেফিরে আবার এসএইচ৩১ ধরতে হবে। সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি সীটে এলিয়ে পড়েছেন।
.
মিনিট কুড়ি চলতেই দুপাশে শুরু হল জঙ্গল আর শুরু হল এক অনন্ত চলা। তার আর শেষও নেই, পাশে কোনও লোকালয়ের চিহ্নও নেই। প্রথমেই চলে গেল নেট, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোনের সংযোগও বিচ্ছিন্ন। এক জায়গায় লেপার্ড সাইন, উত্তেজিত হয়ে সঙ্গিনীকে বলতেই সারথীমশাই গেলেন ভয় পেয়ে। গতি বাড়িয়ে দিলেন হু হু করে। আরে করেন কি করেন কি এত সরু রাস্তায় এত জোরে চালাবেন না, তাছাড়া উল্টোদিক থেকে মাঝেসাঝে এক আধটা গাড়ি আসছে তো। একটু গতি কমল, পেছন থেকেও একটা গাড়ির আলো দেখা গেল, সারথীমশাই সাবধানে ধারে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে ঐ গাড়িটিকে থামাতে চেষ্টা করলেন। তারা কী ভাবল কে জানে গতি বাড়িয়ে প্রচন্ডজোরে বেরিয়ে গেল, মনে হল ভয়েই পালাল। তা এমন জঙ্গলের মধ্যে ঘোর অন্ধকারে কোনও গাড়ি থামাতে চাইলে আমিও থামতে মানাই করতাম সম্ভবতঃ। ঘন্টাখানেক এরকম চলার পরে একটা পুলিশ চেকপোস্ট আর গা লাগোয়া দুটো ছোট দোকান দেখা গেল। ব্যারিকেড করার পোস্টগুলো বসিয়ে রাস্তা জিগজ্যাগ করে রেখেছে। চেকপোস্টে গাড়ি থামাবার চেষ্টা করতেই ব্যারিকেডের পাশ থেকে পুলিশ বাবাজি চেঁচিয়ে গাড়ি আগে করতে বলল, সেসব করেটরে নামতে যেতেই একজন এগিয়ে এসে প্রথমে সবকটা দরজা খুলে দিতে বলল। টর্চ মেরে দেখে তবে নামতে অনুমতি --- জানা গেল এইই চোরলাঘাটের শুরু, গোয়া কর্ণাটক সীমান্ত। এরপরে চোরলাঘাট শেষ হলে গোয়ায় ঢুকে যাবো, সেখান থেকে পথের নির্দেশ দিতে পারবে লোকজন।
.
আবার চলা শুরু। আবার দুপাশে কালো জঙ্গল, হঠাৎ এক একটা গাড়ির আলো, সঙ্গে যোগ হল তীক্ষ্ণ বাঁকসহ ঘুরে ঘুরে ওঠানামা। সঙ্গিনীর হাল খারাপ, গা গুলাচ্ছে, মাথা যন্ত্রণা, স্বাভাবিক। এতক্ষণ ধরে চলা আর এই ঘাটএর বাঁক আদৌ অভ্যেস নেই তাঁর। আরো অনেকক্ষণ চললাম আমরা। এরমধ্যে রাস্তার পাশে ভাল্লুকের অ্যালার্ট দেওয়া বোর্ড এলো। সেকথা জানানোয় এবং ভাল্লুক কখনো চলন্ত গাড়িকে চার্জ করে না, করতেই পারে না একথা শুনেও গাড়ির বাকি দুজনের কেউই খুব একটা ভরসা পেলেন না। চলা চলা আর চলা, জঙ্গল জঙ্গল আরো জঙ্গল, কোথায় যেন একটা জলপ্রপাতের অঝোরে ঝরার আওয়াজ পাওয়া গেল – অন্ধকার পাহাড়ে কিচ্ছুটি দেখার উপায় নেই --- কোথায় যেন নদীর কলকল ঝরঝর, মরাটে চাঁদের আলোয় তার অজস্র সাদাফেনার ফুঁসে ওঠা দেখা গেল এক পলক --- আবার চলা ঘুরে ঘুরে এঁকেবেঁকে --- চেনা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শুধু অফলাইন সেভ করে রাখা গুগল ম্যাপ মাঝেমাঝে ডাইনে বাঁয়ে বলে চলেছে। সেও অর্থহীন প্রলাপের মতই লাগছে কারণ রাস্তাই ডানে বাঁয়ে ঘুরছে গাড়ির না ঘুরে উপায় নেই।
.
অবশেষে একটা ছোট লোকালয় পাওয়া গেল, গুটিকয় মনিহারি দোকান, পান সিগারেটের দোকান, ধাবা ইত্যাদি। একটা বড় টায়ার আর টুকিটাকি সারানোর দোকানের সামনে নেমে জিগ্যেস করে জানা গেল আপাতত আরো খানিক এগিয়ে নতুন ব্রীজের উপর দিয়ে ওয়ালপাই যাবার রাস্তা ধরে তারপর হোটেলের পথ জিগ্যেস করলে ওখানকার লোকে বলতে পারবে। ইতিমধ্যে ফোন সংযোগ নেট সবই এসেছে। দেখি আরেকবার হোটেলে ফোন করে। আগে পুলিশ চৌকির কাছে ফোন সংযোগ পাওয়ায় হোটেলে বারংবার ফোন করেও লাভ হয় নি, কেউ ধরে নি। কে জানে হয়ত এতক্ষণে তারা ঘুমিয়েই পড়েছে। নাহ এবারেও বারকয়েক করেও একই অবস্থা, কেউই ফোন তুলছে না। অগত্যা আবার চলা শুরু – রাত ন’টা প্রায় বাজে। নেট আসায় গুগলম্যাপে হোটেলের ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, এক জায়গায় গুগল বলে বাঁয়ে বেঁকতে কিন্তু দোকানের লোকজন বলে দিয়েছিলেন সোজা যেতে --- কী করা যায়? ভীমগড় অভ্যারণ্যের ভেতরের রাস্তাবন্ধের খবর গুগলের কাছে না থাকায় গুগলের উপর তেমন বিশ্বাস করতে পারছিও না। সোজাই যাওয়া যাক। এর মধ্যেই হোটেলে ফোন করে যাই, এবার কেউ একজন ধরেন। বলেন আপনাদের তো সাড়ে সাতটা নাগাদ আসার কথা ছিল, আমরা তো ভাবছি আজ আর আসবেন না। তিনিই বলেন ঐ যে রাস্তাটা বাঁয়ে বেঁকতে বলছিল ওটাই ঠিক পথ।
.
এরপর আর তেমন সমস্যা হয় নি, হোটেল থেকে নিখুঁত নির্দেশ দিয়ে দেয়, গুগলও ঠিকঠাক নিয়ে যায় বাকিটা। ওইসময়ই রাতের খাবারের কথাও বলে দিই। হোটেলের সামনে যখন পৌঁছাই রাত তখন ন’টা পঞ্চাশ। তেরো ঘন্টা কুড়ি মিনিট পরে অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল, ততক্ষণে চলা হয়েছে ৬১৭ কিলোমিটার। পরে ম্যাপে দেখেছিলাম গোয়া সীমান্তের পুলিশ চৌকি আর সাতেরি নাকি সাকেরির মাঝের ওই পথের সামান্যই দূরে একটি মাঝারিগোছের জলপ্রপাত আছে, কালসা ফলস। কালসা আর সুরলা নদীর সঙ্গমও পথের প্রায় পাশেই। দিনেরবেলা হলে নির্ঘাৎ কিছুটা ঘুরে দেখেই যেতাম। কিন্তু রাত্রের সেই মহাবিশ্বে মহাকাশে একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে অনুভুতি পাওয়া যেত না। থাক ওরা না দেখাই থাক।
বাবা রে! কি অবস্থা!
আমরা একবার গুগল-পূর্ব যুগে জি-পি-এস নিয়ে পাহাড়ি জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলাম। পর পর দুই গাড়ি। একপাশে পাহাড় আর এক পাশে অতল খাদ। পথ বাঁকছে, সব জায়গা ভাল ভাবে দেখা যাচ্ছে না। কখনো কখনো আলো ঢেকে যাচ্ছে পাতার ছাতায়। আপনার লেখা পড়তে পড়তে সেইসব মনে চলে এল।