জয়দার বেয়াড়া ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে রসভঙ্গ করল। ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বার পাঁচেক ‘ওকে' বলে নামিয়ে রাখল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়ে গেছে।”
আমরা এরওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কার কী হয়ে গেল?”
“আঃ! কিছুই বুঝিস না তোরা! মঞ্জুশ্রীদের পাস হয়ে গেছে। আমায় মেইল করে দেবে। আমি পাঠিয়ে দেব তোদের।”
এটা সত্যিই ভাল খবর। মঞ্জুশ্রী আনন্দে জয়দাকে একেবারে ‘থ্যাঙ্কু’ ‘ট্যাংকু' বলে একশা করল। জয়দা কিছুক্ষণ ‘হেঁ হেঁ এ আর এমন কি ব্যাপার…’ মার্কা মুখ করে রইল।
“তাহলে তোদের তিব্বত অভিযান কবে হবে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“শনিবারই যা। শুভস্য শীঘ্রম।” জয়দা বলল।
শুভ আর মঞ্জুশ্রী দুজনেই সেটা মেনে নিলো। জয়দা ওর সেই আলিবর্দী খাঁর আমলের উইন্ডোজ ল্যাপটপটা ফরম্যাট করে রেখেইছে। শুধু স্কাইপ ইন্সটল করে নিলেই হল।
“যাক তাহলে একটা বড় সমস্যা মিটল যখন আজ আপিসে একটু দেরী করে লগ ইন করলে গিল্টি ফিল হবে না। গল্পর বাকিটা শুনেই যাই, কী বলিস তোরা?” মঞ্জুশ্রী আমাদেরকে নিজের দলে টানার অভিপ্রায়ে বলল। আমাদের আর কী! ল্যাপটপ খুললেই হল যখন হোক। সুতরাং ‘না' বলার কারণ থাকতেই পারে না।
“বেশ। তাহলে কোথায় থেমেছিলাম যেন?” জয়দা জিজ্ঞেস করল।
“ওই তো মাশাংকে হাপিশ করে দেওয়ার প্ল্যান চলছে!” আমি খেই ধরিয়ে দিই।
“হ্যাঁ! রাজার তখন বছর কুড়ি বয়স। মাশাং-এর অনাচার আর সহ্য হল না। রাজসভার বৌদ্ধ মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করে এক প্ল্যান ফাঁদলেন। মাশাং নিজে প্রধান বোন পুরোহিত এবং রাজার অন্যতম প্রধান মন্ত্রী। এই দুই শীর্ষ ক্ষমতাকে তার মৃত্যুবাণে পরিণত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র রচনা হল। এই পরিকল্পনা রূপায়ন করার দায়িত্ব পড়ল গোই নামে এক বৌদ্ধ মন্ত্রীর উপর। বোন ধর্মের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে প্রয়োজন পড়ে জ্যোতিষীদের। তাদের গণনার দ্বারা আগেভাগে জানতে পারা আগত বিপদ-আপদ থেকে রাজা তথা রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখা পুরোহিতের কাজ। গোই তাই সবার আগে রাজ্যের প্রধান জ্যোতিষীর কাছে হানা দিলেন। প্রচুর সোনা দিয়ে হাত করা হল তাকে। কথা হল, সে গণনা করে বলবে যে রাজার সামনে সমূহ বিপদ। সকলের সামনে যখন তাকে এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধারের রাস্তা বাতলাতে বলা হবে - সে তখন ঠিক সেটাই বলবে যেটা তাকে গোই শিখিয়ে দেবে। সোনা পেলে কে আর অন্য কথা ভাবে? হীরা পেয়ে ‘একমেবোদ্বিতীয়ম’ বিজ্ঞানীও হীরক রাজকে যন্তরমন্তর ঘরে পুরে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে নি - এ তো সামান্য জ্যোতিষী। রাজি হয়ে গেল। অতঃপর সেই শুভদিনে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসা হল রাজা ঠিস্রোং দেচেনের কাছে। কাগজের উপর বিস্তর আঁকিবুঁকি কেটে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম মেপে, গ্রহ নক্ষত্র উল্কা ধূমকেতুর গতিপথ বিচার করে ভুরু কুঁচকে মুখ গম্ভীর করে সে বললে, মহারাজ, ভয়ে বলি না নির্ভয়ে বলি? রাজা বললেন, নির্ভয়ে বল। সে বললে, মহারাজ কপালে বড় দুর্ভোগ। আপনার - আপনার রাজ্যের। রাজাও বিষম চিন্তিত হওয়ার নাটক করে বললেন, তাহলে উপায়? জ্যোতিষী আবার বিস্তর আঁক কষে বললে, উপায় একটাই। আপনার দুই কাছের এবং বিশ্বস্ত মন্ত্রীই পারে আপনাকে বাঁচাতে। রাজা স্ক্রিপ্ট মাফিক বেশ কিছুটা ভেবে বললেন, দুই সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত মন্ত্রী বলতে মহামন্ত্রী মাশাং এবং গোই। যাতে মাশাং-এর সন্দেহ না হয় তাই ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছিল গোইয়েরও নাম। ফল হল। মাশাং জ্যোতিষীর কাছে জানতে চাইল, কী করতে হবে? জ্যোতিষী নিদান দিলে, মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে থাকতে হবে সাতদিন। বাইরের কাকপক্ষীটিও যেন না জানতে পারে। যেমন জ্যোতিষীর দাওয়াই, সেই মত খোঁড়া হল দুই গর্ত দুই মন্ত্রীর জন্য। সুসময় দেখে দুই মন্ত্রী প্রবেশ করল। কিন্তু রাত বাড়তে তুলে আনা হল গোইকে। মাশাং-এর গর্তের মুখে চাপা পড়ল বিশাল এক পাথরের চাঁই। জীবন্ত কবর দেওয়া হল তাকে।”
“ইশ! কী সাঙ্ঘাতিক। এ তো ধর্মসংস্থাপনার্থায় একেবারে খুন!” মঞ্জুশ্রী বলে উঠল।
“খুন। কিন্তু ধর্মসংস্থাপনার্থায় নয়, একেবারেই একটি রাজনৈতিক হত্যা! আমার মনেহয় ধর্ম যতটা না রাজার শিরঃপীড়া ছিল - তার চেয়েও বেশী ছিল তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন এই সুবিশাল তিব্বত সাম্রাজ্যের সর্বময় সম্রাট - কিন্তু তার বদলে মাশাং-এর অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত আডমিন্সট্রেশন চলছে। সমস্ত সামন্তরাজারা ধর্মগুরু হওয়ার সুবাদে মাশাংকেই মেনে চলে। আর এই সামন্তপ্রভুরাই এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি। এদিকে ইয়ার্লুং সাংপো থেকে ওদিকে আমুদরিয়া অবধি এই বিশাল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা লাসায় বসে একা সম্রাটের পক্ষে অসম্ভব! তাই এই সমস্ত রিমোট কন্ট্রোলকে নিজের হাতে নিয়ে আসার জন্যই এই হত্যা। পাশাপাশি বোন ধর্মের মূল স্তম্ভটি সরে যাওয়ার ফলে সুগম হল বৌদ্ধধর্মের পথও।”
“আমুদরিয়া মানে সেই আফগানিস্তান অবধি ছড়িয়ে গেছিল তিব্বত?” মঞ্জুশ্রী বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে।
“তবে আর বলছি কী! চীনকে একেবারে খেদিয়ে দিয়ে মধ্য এশিয়ার কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল তিব্বত। অবিশ্যি চীন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কিছুদিন। আন লুসান নামে এক সেনানায়কের বিদ্রোহে চীনের ট্যাং সাম্রাজ্যের ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছিল। সেসব সামলাতে গিয়ে এদিকে মধ্য এশিয়া হাতছাড়া হয়ে গেছিল। তিব্বতের সেনাদল যখন আমুদরিয়ার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল তখন অন্যদিকে আরব দুনিয়ার রাজা কে জানিস?” জয়দা রহস্যজনক ভাবে তাকাল।
আমরা ভেবে না পেয়ে বললাম, “কে?”
“ক্লু দিই?”
“দাও।”
“সহস্র এক আরব্য রজনী।”
“আরব্য রজনী?” আমি তাও কিছু ভেবে পেলাম না। মঞ্জুশ্রী একটু ভেবে বলল, “তুমি কি বলতে চাও হারুন-আল-রশিদ?”
“কারেক্ট! বাগদাদের খলিফা হারুন-অল-রশিদ তখন তখ্তে।”
“হারুন-আল-রশিদ সত্যি সত্যি ছিল নাকি?” আমি আর শুভ দুজনেই যারপরনাই অবাক।
“সে কি রে! না থাকলে বাগদাদে ‘বায়ত আল-হিকমা’ তৈরী করল কে? প্রজ্ঞা-নিলয়। এক সুবিশাল গ্রন্থাগার। মাত্র বছর কুড়ি রাজত্ব করেছিলেন হারুন। আর সূচনা করে গিয়েছিলেন এক স্বর্ণযুগের - সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান - সব দিক থেকে আরব সাম্রাজ্য একেবারে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গেছিল। সেই বাগদাদ সেই দামাস্কাস আর এখনকার বাগদাদ, আজকের দামাস্কাস - যুদ্ধ বিধ্বস্ত, মানুষের কান্না বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের স্বর্ণযুগের সেসব নগরী। আমরা নাকি সভ্য হচ্ছি - আরও আরও - রোজ একটু একটু করে। মানুষ মারার কল বের করছি নতুন নতুন - আসলে মোদ্দা কথা হল সেই - চ্যাপলিন মঁসিয়ে ভর্দুতে বলে গেছেন - Wars, conflict - it's all business. One murder makes a villain; millions, a hero. Numbers sanctify, my good fellow!”
“চিরন্তন সত্য!” মঞ্জুশ্রী আনমনা হয়ে বলল।
“হুম। যাই হোক, যা বলছিলাম - তিব্বতি সেনাবাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনে সেই কিংবদন্তীসম খলিফা হারুন-আল-রশিদ অবধি তড়িঘড়ি চীনের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন ‘যদি যুদ্ধ বাধে তবে সাহায্য যেন পাই’ বলে। এসব অবিশ্যি ঠিস্রোং দেচেনের সাম্রাজ্যের একেবারে শেষের দিকের কথা। আমাদের সময়-সরণীতে ঠিস্রোং দেচেন সবে মাত্র নিকেশ করেছেন বোন পুরোহিত মাশাংকে। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের মস্ত সুযোগ তার হাতে। কিন্তু করবে কে? তিব্বতে কারোর সেই জ্ঞান নেই যে জনসাধারণের মধ্যে বুদ্ধের বাণী প্রসার করতে পারবে। তাছাড়া সম্রাটের ইচ্ছে তার সৎ মা জেনচেং-এর অপূর্ণ ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করা। তিব্বতের বুকে ভারতবর্ষ বা চীনের মত একটি বৌদ্ধ বিহার তৈরী হবে - যেখানে দেশ বিদেশের পণ্ডিতদের আনাগোনা হবে, থাকবে গ্রন্থাগার, তিব্বতিতে অনূদিত হবে অন্যান্য ভাষার গ্রন্থাবলী। কিন্তু এই সুবিশাল প্রজেক্টে নেতৃত্ব দেবে কে? সম্রাটের বৌদ্ধ মন্ত্রীদের মধ্যে সালনাং ছিলেন অন্যতম। সালনাং নিজে ভারতবর্ষে এসেছেন শিক্ষার জন্য। কিছু বছর বুদ্ধগয়া এবং নেপালে কাটিয়ে ফিরে গেছিলেন তিব্বতে। এদেশে এসে তার নতুন নাম হয়েছে ভিক্ষু জ্ঞানেন্দ্র। সুতরাং ঠিস্রোং দেচেন মনে করলেন ভারতবর্ষের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের ব্যাপারে জ্ঞানেন্দ্রর ধারণা থাকবে। রাজা আলোচনায় বসলেন তার সাথে। জ্ঞানেন্দ্র সমস্ত পরিকল্পনার কথা শুনে বললেন, এই সুবিশাল কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য একজনের নামই আমার মাথায় আসছে। ভারতবর্ষ এবং নেপালে বসবাসকালে আমি তার পরিচয় পাই। তার সাথে আমাদের এই তিব্বতে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ব্যাপারেও দীর্ঘসময় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আপনার মন্ত্রী মাশাং-এর ভয়ে আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাতে ভরসা পাইনি। আমার বিশ্বাস আপনি যদি তাকে আমন্ত্রণ জানান আমি সেই বার্তা নিজে গিয়ে তার কাছে নিবেদন করতে পারি। আমার বিশ্বাস পরম কারুণিক তথাগতর বাণী আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচারের জন্য তিনি আপনার আহ্বানকে গ্রহণ করবেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কে সেই মহান ব্যক্তি? জ্ঞানেন্দ্র উত্তর দিলেন, ভারতবর্ষের নালন্দা মহাবিহারের উপাধ্যায় মহাপণ্ডিত ভারতীয় দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাধ্যমক আলংকারকারিকা’, ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ প্রভৃতির রচয়িতা মহান দার্শনিক আচার্য শান্তরক্ষিত।”
(ক্রমশঃ)
হিংসা, হত্যা, রাজকূটের পর অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার! যে কোনো থ্রিলারকে হার মানায়।
অবশ্য প্রধান ধর্মগুলোই প্রচুর রক্তপাতে প্রতিষ্ঠিত।
আমিও আগে তাই ভাবতাম যে ভদ্রলোকের পদবী বোধহয় 'রক্ষিত'। ভদ্রলোক যে বাঙালী তাতে সন্দেহ নেই।
বিপ্লব, মজার কথা হল - তিব্বতের যে দুই সম্রাটকে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্য বিভিন্ন বোধিসত্ত্বের অবতার বলে দাবী করা হয় - সেই স্রোংচান গামপো এবং ঠিস্রোং দেচেন দুজনেই রাজত্বকালের নব্বই শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন যুদ্ধ বিগ্রহ করে - রুধির প্রস্রবণে স্নাত হয়ে।
accha Guru Rinpoche ba. Padmasambhav namok je bouddho sonyasi Pakistan eer Swat theke Tibet e giye Kagyu Buddhist sect eer procholon koren aapni take eriye gelen keno?
দেবাঞ্জন, এড়ালাম কই? পড়তে থাকুন। পরের পর্বগুলিতে আসবেন তিনি।