। তিব্বতে তথাগত - ১।
“২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসের এক মঙ্গলবারের সকাল। কিংস ক্রস স্টেশন থেকে বের হয়ে এসে বরফে মোড়া লন্ডনের রাস্তাতে পা ফেললেন এক যুবক। শীতের চাদরে মোড়া কুয়াশার প্রলেপ কেটে শহরের ঘুম হয়ত ভেঙেছে। কিন্তু কর্মচঞ্চল হতে তখনও দেরী আছে। ঘড়ির কাঁটায় সবে আটটা বাজে। মাথার টুপিটি প্রায় চোখ অবধি নামিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার হাত থেকে নিজের চোখ আর নাককে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন তিনি। পরনের ওভারকোটের কলারটি মুখের প্রায় অর্ধেক ঢেকে রেখেছে। হাত দুখানি পকেটে ঢোকানো। যুবকটির চেহারা লম্বা ছিপছিপে। উন্নত নাসা, শ্বেত ত্বক তাঁর ইউরোপীয় বংশ পরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। যদিও এই মুহুর্তে তাঁর মুখের কিছু অংশ ছাড়া বাকি আর কিছুই দৃশ্যমান নয়।
স্টেশন থেকে বের হয়ে এসেই বাঁ দিকে ঘুরে 'প্যানক্রাস রোড'' ধরেন যুবক। রাস্তাটি স্টেশনের গা ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে শখানেক মিটারের মত গিয়ে ইউস্টন রোডে মিশেছে। বাঁ হাতে একটি রেস্তোরাঁ। প্রাতরাশের জন্য খুলেছে। যুবকটি অন্যান্য দিন একটু আগে পৌঁছে গেলে এই রেস্তোরাঁটির দরজা ঠেলে ঢুকেই পড়েন। এক কাপ কফি আর একটা বাটার ক্রোস্যাঁ। এখানে এটাই তার পছন্দের খাবার। কিন্তু আজ তিনি তাঁর রোজকার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আগে হলেও রেস্তোরাঁতে ঢুকলেন না। দরজার ফাঁক দিয়ে শীতল হাওয়ার সাথে মিশ খেয়ে যাওয়া পাঁউরুটি আর কফির গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলেও যুবকটির আজ ওসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেন ইউস্টন রোডের দিকে। কাল রাতে যে ভালই তুষারপাত হয়েছে লন্ডন শহর জুড়ে, তা এখন শহরের চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বেশ। বাড়িগুলির চালগুলি এখনও তুষার মেখে অশীতিপর বৃদ্ধর মত পক্বকেশে দাঁড়িয়ে আছে।
ইউস্টন রোডের মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে যান যুবক। 'সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল' স্টেশনটির বাইরে দিয়ে রাস্তাটি পশ্চিমদিকে এগিয়ে গেছে মিডল্যান্ড রোডের দিকে। স্টেশনের বাইরে স্বভাবতই মানুষের সংখ্যা বেশ কিছুটা বেশী। আবহাওয়া যতই প্রতিকূল হোক, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারণের চাহিদা তো থেমে থাকতে পারেনা। বিশেষ করে লন্ডনের মত শহরে। মানুষ দৌড়ে চলেছে জীবন, জীবিকা সব কিছুর প্রয়োজনে। স্টেশন পার হয়ে মিডল্যান্ড রোডে পড়েন যুবক। এবার ডানদিকে ঘুরে যান। রাস্তার ওপারে ব্রিটিশ লাইব্রেরীর দেওয়াল। একটু এগিয়ে প্রায় দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে যান যুবকটি। সামনেই লাইব্রেরীর ভিতরে যাওয়ার একটি দরজা। দরজার সিকিউরিটি তাঁকে থামালে, পকেট হাতড়ে আইডেন্টিটি কার্ডটি বের করে মেলে ধরেন সামনে। কার্ডে যুবকের পরিচয় লেখা -
"স্যাম ভ্যান শাইক
দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরী"
সিকিউরিটি দরজা ছেড়ে দেয়। স্যাম ঢুকে পড়েন ভিতরে। বাইরের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার থেকে মুক্তি পেয়ে একটু যেন স্বস্তি দেখা যায় স্যামের মুখে। যদিও তার হাঁটার গতি বা নিজের কাজের ঘরে পৌঁছানোর ব্যস্ততা কোনটাই কমেছে বলে মনে হয়না। এত সকালে লাইব্রেরিতে জনমানব প্রায় নেই বললেই চলে। লাইব্রেরী খোলে সকাল সাড়ে নটায়। তারপর আস্তে আস্তে পাঠক, গবেষক আর একবার ঘুরে দেখার জন্য আসা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। লাইব্রেরীর স্টাফ বা বিভিন্ন বিভাগীয় কর্তারাও অফিসে ঢুকতে ঢুকতে সেই নটা। তার উপর এখন এই ঘোর শীতকাল। তাই সকাল এই সোয়া আটটার সময় সিকিওরিটি অফিসিয়াল ছাড়া আর কাউওকে বিশেষ নজরে পড়ছে না।
তবে আজ আরও একজন আছেন। স্যামের জন্য অপেক্ষারত।
স্যাম লম্বা করিডোর পার হয়ে নিজের কাজের ঘরের সামনে পৌঁছালেন। এই ঘরেই গত প্রায় দিন দশেক ধরে তিনি ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছেন বিভিন্ন প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথিপত্র। এই সব পুঁথি আবিষ্কার হয়েছে তাও প্রায় একশো বছরের হয়ে গেল। পশ্চিম চীনের ডানহুয়াং-এর একটি গুহা থেকে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ অরেল স্টেইন খুঁজে আনেন এই এত পুঁথি। ১৯০৭ সালে। এই সমস্ত পুঁথি ওই গুহার আঁধারে কত শতাব্দী কেন যে বন্দী হয়ে ছিল তা এখনও কেউ জানেনা। সব বিশেষজ্ঞদেরই নিজস্ব মতবাদ আছে, তত্ত্ব আছে। কিন্তু সকলই অনুমান নির্ভর। কেউ বলেন, কোনও অপদেবতাকে বন্দী করে রাখার উদ্দেশ্যেই এই ধর্মীয় পুঁথিপত্রকে বন্দী করে রাখা হয়। আবার কেউ বলেন এসব হল আসলে জঞ্জাল। নেহাৎ পবিত্র ধর্মীয় বাণী সম্বলিত বলে একেবারে আস্তাকুঁড়েতে জায়গা হয়নি। বদলে জায়গা হয়েছে এই গুহার মধ্যে। রেখে দেওয়া হয়েছে একেবারে রুদ্ধ করে। কিন্তু আসল সত্য কেউ জানেনা। এই সব পুঁথিপত্র ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ছিল। এখন এসে ঠাঁই হয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরীর 'স্টেইন কালেকশনে'। ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার থেকে তিব্বতের ইতিহাসের উপর পি এইচ ডি শেষ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে যোগ দেওয়ার পর নানা বিভাগে বিভিন্ন দায়িত্ব সামলে স্যাম ভ্যান শাইক এখন এই 'স্টেইন কালেকশন' এর দায়িত্বপ্রাপ্ত। গত প্রায় দশদিন ধরে তিনি ঘেঁটে চলেছেন এই সমস্ত পুঁথিপত্র। যদি কোনও আবৃত রহস্যদ্বার হঠাৎ করে উন্মোচিত হয়ে যায়, সেটাই হবে তার প্রাপ্তি।
স্যাম দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এবং ঢুকতেই প্রায় ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন।
"স্যাম..." চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন ঘরে উপস্থিত ভদ্রলোক।
"কাজুশি, তুমি!" স্যাম তখনও প্রাথমিক উত্তেজনাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
"চলে এলাম। সেই কোন সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!" কাজুশি একটু হেসে উত্তর দেন।
"কিন্তু তোমার তো এই মুহুর্তে মাঝ আকাশে থাকার কথা!" স্যামের অবাক হওয়া এখনো কাটেনি।
"কথা ছিল সেরকমই। কিন্তু শেষ মুহুর্তে বাতিল করতে হল। আর এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে এসে হাজির হলাম। সেসব বলছি বিশদে। আগে তুমি তোমার ওভারকোটটা খুলে রেখে একটু ঠাণ্ডা হয়ে বস দেখি!" স্যামকে তার চেয়ারটা দেখিয়ে কাজুশি নিজের চেয়ারটা আবার দখল করে নেন।
স্যাম ঘরের কোণার দিকে রাখা হ্যাঙারে নিজের ওভারকোটটা খুলে ঝুলিয়ে রেখে এসে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। সামনে বড়সড় কাঠের টেবিলের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়েই নানাবিধ বই খাতা, পুরনো পুঁথিপত্র। আপাত দৃষ্টিতে ছড়ানো ছিটনো, অগোছালো। কিন্তু প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট ক্রম সংখ্যা আছে। আর সেইগুলো স্যাম আর কাজুশি দুজনেরই মগজস্থ। তাই একটি টুকরো কাগজেরও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আভ্যন্তরীণ হিটিং সিস্টেমের জন্য ঘরের ভিতর বসে বাইরের প্রচণ্ড শৈত্য অনুভূত হচ্ছে না। বেশ আরামদায়ক তাপমাত্রা। টাইয়ের ফাঁসটা একটু আলগা করে নিয়ে নিজের হাই-ব্যাক চেয়ারে বসতে বসতে স্যাম বললেন, "বল এবার। হঠাৎ করে ফিরে এলে কেন? তারপর আমারও অনেক কথা বলার আছে।"
স্যামের 'অনেক কথা বলার আছে' শুনে কাজুশি চোখ কুঁচকে কৌতূহল নিয়ে তাকালেন। তার ফলে চশমার পিছনে কাজুশির দূরপ্রাচ্য মুখাবয়বের মাঝে চোখ দুটি প্রায় সরলরেখায় পরিণত হল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, "বেশ। তবে আমার সেরকম কোনও লম্বা ইতিহাস কিছু নয়। টোকিও যাওয়ার ফ্লাইট কাল প্রচণ্ড তুষারপাতের জন্য ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বাতিল করেছে। তবে আজকের ফ্লাইটের একটি টিকিট দিচ্ছিল। কিন্তু এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এলো। তাই ছুটে পালিয়ে এলুম। বাড়ি দুদিন পরে ফিরলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। কিন্তু বাড়ি চলে গেলে তালে গোলে এই ভাবনাটা হারিয়ে যাবে। তাই টিকিট পোস্টপোন করিয়ে পালিয়ে এলাম সিধা। কাল আমরা যে কাগজের টুকরোটা নিয়ে কাজ করছিলাম আমরা… খেয়াল আছে?"
স্যাম উত্তেজনায় টেবিল চাপড়ে বললেন, "খেয়াল থাকবেনা মানে? তুমি জান আমি কী পেয়েছি? তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর স্টেইন কালেকশনের বাকি পুঁথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে... নইলে এই ঠাণ্ডায় কে এই সাত সকালে সাধ করে ছুটে আসে বল?"
কাজুশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। স্যামের টেবিলের সামনে কাল কাজুশি যাওয়ার আগে অবধি সে কাগজের টুকরোটি নিয়ে দুজনে মশগুল হয়েছিলেন, সেই টুকরোটি একটি কাঁচের প্লেটের তলায় রাখা। এটি প্রায় উল্টানো ত্রিভুজাকৃতির একটি কাগজের টুকরো। প্রায় ভঙ্গুর। টুকরোটির উপরটা চব্বিশ সেন্টিমিটার চওড়া। আর লম্বায় প্রায় দশ সেন্টিমিটার। এই মাপজোকগুলি কালকেই সেরে ফেলা হয়েছিল। পাশের একটি প্যাডে পেনসিল দিয়ে সেটা লেখা রয়েছে। কাগজটিতে ইউ-চেন লিপিতে লেখা লেখাটিও লিখে রাখা হয়েছে প্যাডের কাগজে। নীচের লাইনটি প্রায় পড়াই যাচ্ছে না। অর্ধেকের বেশী অংশ ছেঁড়া। কাগজটির চেহারা দেখে এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। কাঁচের প্লেটটির পাশে একটি আতসকাঁচ রাখা। এই আতসকাঁচটির মাধ্যমেই কাল অনেক রাত অবধি স্যাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এর অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন। ভাষা পড়তে তাঁর অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এই ছিন্নপত্রটি কোথা থেকে এলো, কীসের অংশ আর কীসের কথা বলছে, সেটাই উদ্ধার করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মাথার মধ্যে। তাই এই সাতসকালে ছুটে এসেছেন আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গোড়া থেকে অর্থ উদ্ধার শুরু করবেন বলে।
অরেল স্টেইনের উদ্ধার করা সব পুঁথিপত্র মোটামুটি ব্রিটিশ মিউজিয়মের জিম্মায় ছিল। সেটা এখন এসেছে ব্রিটিশ লাইব্রেরীর কাছে। স্যাম আর কাজুশি মিলে দিন কয়েক হল প্রজেক্ট নিয়েছিলেন সেই সব প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে ঘুঁটে দেখার যে তাদের সঠিক ভাবে ভাগ করা আছে কি না। প্রধানতঃ তাঁদের চিন্তা ছিল চৈনিক পুঁথিগুলি নিয়ে। ওর মধ্যে অন্য কোনও ভাষার কিছু ঢুকে আছে কি না, সেটা খুঁটিয়ে দেখা করেছিলেন কিছু দিন ধরে। খুঁজতে খুঁজতে এই কাগজের টুকরোটি হাতে এলো। স্পষ্টতঃ এটি চৈনিক নয়। ইউ-চেন লিপিতে তিব্বতি ভাষাতে লেখা। প্রাচীন তিব্বতের উপর পি এইচ ডি করার সুবাদে স্যাম খুব ভালই চেনেন ভাষাটি। সাথে সাথে ডেকে নিয়েছিলেন সহকর্মী কাজুশিকে। দুজনে মিলে সারাদিন ধরে একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করছিলেন বার্তাটি। কিন্তু এই একটুকরো লেখা থেকে কোনও অর্থ বের হচ্ছিল না। বলা হয়েছে কোনও এক 'খেন-পো'র কথা। উল্লেখ করা হয়েছে 'অনন্ত' নামে এক ব্যক্তির কথা। কিন্তু 'অনন্ত' তো কোনও তিব্বতি নাম নয়। তবে কে সে? 'খেন-পো'ই বা কে? তাঁরা দুজনেই জানেন তিব্বতিতে 'খেন-পো' মানে ধর্মীয় প্রধান। কিন্তু এখানে কোন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে?
"আগে তোমার কথা বল। ফিরে এলে কী ভেবে?" স্যাম কাজুশিকে জিজ্ঞেস করলেন।
"কালকের ওই টুকরোটাতে 'অনন্ত' নামে একজনের কথা ছিল। নিশ্চয়ই মনে আছে?" কাজুশি বলেন। স্যাম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ান।
"অনন্ত নামে একজনের কথা আমরা আর একটা জায়গায় পাই। কানেক্ট করতে পার? ভারতবর্ষের কাশ্মীর থেকে এক বাপ-ছেলে বিতাড়িত হতে আশ্রয় নিয়েছিল লাসাতে। অষ্টম শতাব্দীর কথা। 'অনন্ত' ছিল ছেলের নাম... মনে পড়ছে?"
স্যাম দুহাতে নিজের মাথা চেপে বলে ওঠেন, "হে ভগবান, আমার এতক্ষণ কেন মনে পড়েনি? তুমি নিশ্চয়ই 'টেস্টামেন্ট অফ বা'এর কথা বলছ... "
কাজুশি মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলেন। স্যাম নিজের মনেই বলেন," তার মানে এই টুকরোটা টেস্টামেন্ট অফ বা-এর টুকরো?"
"তাই তো মনে হচ্ছে।" কাজুশি বলেন। "সেটা ভেরিফাই করব বলেই ফিরে এলাম।"
"দারুণ। দারুণ। এবার আমি তোমায় দেখাই আমি কী পেয়েছি।" বলে স্যাম ড্রয়ার থেকে খুব সন্তর্পনে পলিথিনে মোড়ানো একটা কাগজের টুকরো টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর কৌতুক সহকারে কাজুশির দিকে তাকালেন।
"কী এটা?" কাজুশির মুখে প্রশ্ন।
স্যাম কোনও উত্তর না দিয়ে আগের টুকরোটিকে কাঁচের প্লেটের তলা থেকে বের করে দ্বিতীয় টুকরোটির উপর বসিয়ে দিতেই শেষের অপূর্ণ লাইনটি জিগ-স পাজলের মত পূর্ণ হয়ে গেল। কাজুশি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন," এটা তো এরই আর একটা টুকরো। কোথায় পেলে?"
"ওই চাইনিজ কালেকশনের মধ্যেই। ওর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। কেউ দেখেনি অ্যাদ্দিন।" স্যামের চোখে মুখে আবিষ্কারের ঝলমলানি। "তাহলে চল, এবার পুরোটার মানে বের করা যাক।"
দুই ঐতিহাসিক আতসকাঁচ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন টেবিলের উপর। লেখার প্যাডে পেন্সিল নিয়ে চলতে লাগল আঁকিবুঁকি - কিছু ইংরেজি কিছু তিব্বতি। চলতে লাগল তর্কাতর্কি। তাক থেকে বই পেড়ে এনে প্রমাণ দাখিল করতে লাগল একে অন্যকে। সবশেষে দুই সহকর্মীই খাতার পাতায় একটি নামের চারিদিকে গোল্লা পাকিয়ে ক্ষান্ত দিয়ে কফি পার্লারের দিকে চললেন।
প্যাডের পাতায় পেন্সিলে লেখা রইল একটি নাম। যাকে 'খেন-পো' বলে উল্লেখ করেছেন এই 'টেস্টামেন্ট অফ বা' এর রচয়িতা।
আচার্য শান্তরক্ষিত।”
(চিত্রঃ Testament of Ba)
একটানা পুরো গল্পটা বলে জয়দা থামল। মাঝে অবিশ্যি কয়েক সেকেন্ড থেমে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। আর মোবাইলটা টং করে দুবার শব্দ করে ওঠায় ভুরু কুঁচকে নোটিফিকেশন অফ করে দিয়েছে। কিন্তু এমন টান টান গল্পর মাঝে আমরা কেউ কথা বলে পরিবেশটা নষ্ট করতে চাইনি।
জয়দা বলা শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে একবার ভুরু নাচাল। ভাবখানা এই যে, “কেমন ছিল?”
ভালই যে ছিল সেটার প্রমাণ আমাদের শুভ। সেও ফোড়ন না কেটে পুরোটা শুনেছে। আমি আর মঞ্জুশ্রী তো এমনিতেই গুড লিসনার্স।
এতক্ষণে শুভ মুখ খুলল, “আচ্ছা, এসব গল্প কোথায় পাও?”
“হোয়াট গল্প?” জয়দা বিছানার উপর একেবারে পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসেছে। হাতে অ্যাশ-ট্রে। সেটা বোধহয় মনে মনে শুভর দিকে তাক করতে করতে আবার বলল, “এসব তোর গল্প মনে হল?”
“গল্প না? তুমি কী করে এত কিছু জানলে? একেবারে সিনেমার মত…” শুভ নাছোড়।
“স্যাম ভ্যান শাইক নিজে বলেছে। আমায় মেইল করে।”
“মানে, এত ডিটেইলসে বলল?” শুভ আইটিতে না এসে ওকালতি করলে জীবনে উন্নতি করত।
জয়দা এবার কয়েক সেকেন্ড শুভর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “নাহ, মানে, মোদ্দা কথাটা বলেছে - বাকিটা আমার কল্পনা। কেন? খারাপ লাগল?”
“কক্ষনো না!” আমি জয়দার পক্ষ নিয়ে বললাম, “খারাপ হলে এমন পিন ড্রপ সাইলেন্স অডিয়েন্স পেতে?”
জয়দা একটু খুশি হল। একও গাল হেসে সলজ্জে বলল, “আসলে কদিন আগে এই শান্তরক্ষিতকে নিয়ে একটা লেখার খসড়া করছিলাম। তখন এটা লিখেছিলাম। তারপর অবিশ্যি আর এগোয়নি লেখাটা!”
“সে কী! এগোল না কেন?” মঞ্জুশ্রী এবার মুখ খুলল, “এটা কিন্তু অন্যায় জয়দা! এত ভাল লেখা মাঝপথে বন্ধ করাটা অন্যায়!”
আমরা আজ সকাল সকাল আড্ডায় বসে গেছি। শুভ মর্নিং ওয়াক করে ফেরার পথে মঞ্জুশ্রীকে ধরে এনেছে। বলেছে ব্রেকফাস্ট করে যেতে। আপিস আছে। কিন্তু তার আগে এক রাউন্ড আড্ডা দিয়ে নিচ্ছি। আপিসের অখাদ্য বসের ততোধিক অখাদ্য কণ্ঠস্বর শোনার আগে একটু পুণ্য করে নেওয়া আর কি!
জয়দা মঞ্জুশ্রী আর শুভর জন্য একটা পাসের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে কথা-বার্তা বলেছে। হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। সেটা শুনেই আমি বলছিলাম যে, আমার কলেজের এক প্রোফেসর একটা কথা বলতেন - তুমি যদি ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করতে যাও, দেখবে অল মিনস্ উইল হেল্প ইউ। বলে আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘মিনস্' মানে বোঝ?
এটা শুনে জয়দা ফটাফট মাথা নেড়ে বলল, “নট অলওয়েজ ট্রু!”
আমি বললাম, “কেন?"
“সবচেয়ে বড় প্রমাণ আচার্য শান্তরক্ষিত। ভদ্রলোক বৌদ্ধ জ্ঞান প্রচারের জন্য বুড়ো বয়েসে হিমালয় টপকে পায়ে হেঁটে তিব্বত গেলেন - কিন্তু ‘অল মীনস্ ওয়্যার এগেইন্সট হিম’…।”
(ক্রমশঃ)
এই লেখাটা আমার একটা পুরনো লেখার অংশ থেকে জুড়ে দেওয়া। :)
উপস্থাপনার ভিন্নতাটুকু ভাল লাগলো।
ব্যস্ততায় ধারাবাহিকের কিস্তি ফস্কে গিয়েছিল। নইলে মনে মনে এর জন্য অপেক্ষা করি।
উড়ুক