এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • তিব্বতে তথাগত (পর্ব - ৮)

    সৈকত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৫ মে ২০২০ | ২০৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • । সাক্ষরতা অভিযান - ১।

    “আরে! কী আরম্ভ করেছ তোমরা!” শুভ আবার একটু লজ্জা পেয়ে বলে উঠল।
    “কেন? আমি তো গল্প বলছিলাম।” জয়দা বলে।
    “মঞ্জুশ্রী কোথা থেকে এলো?”
    “আরে! তিব্বতি ঐতিহাসিকরা তাই সুংকে মঞ্জুশ্রীর অবতার বলেছে। আমি থোড়ি বলেছি!”
    “ধুর! আচ্ছা, অনেক তিব্বত হয়েছে। এবার আমার একটা কথা আছে।” শুভ আবদারের সুরে বলল।
    “ইরশাদ।” জয়দা বোধহয় শুভর কথায় তিব্বতি ছেড়ে ঊর্দু ধরল।
    “ইয়ে মানে ওই মেয়েটা…”
    “কোন মেয়েটা? প্রপার নাউনে কথা বল।” আমিই বা ছাড়ি কেন?
    শুভ একটা কড়া দৃষ্টি হেনে বলল, “কোন মেয়েটা আবার কী! মঞ্জুশ্রী! ও একটা এন জি ও-র সাথে আছে!”
    এত অবধি শুনেই আমি বলে দিলাম, “চাঁদা ফাঁদা হবেনা। নিজে গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে বন্ধুদের ঘাড় ভাঙা! ফোট!”
    “এত ছোটলোক কেন তুই? আগেই খালি টাকার চিন্তা! বলতে দে আমায়… ” শুভ রেগে গেছে।
    “আহ! বড় গোল করিস তোরা! বল, শুভ…” জয়দা রেফারির ভূমিকা ভালই পালন করে।
    শুভ সাপোর্ট পেয়ে আবার বলতে থাকে, “হ্যাঁ। এই লকডাউনের মধ্যে ওই এন জি ও-র বাচ্চাগুলোর পড়াশোনা আটকে আছে। যারা বাইরে থেকে এসে পড়াত, কেউ আসতে পারছে না। মঞ্জুশ্রী বলছিল যে আমরা যদি হেল্প করতে পারি!”
    “আমরা কী হেল্প করব?” আমি অবাক।
    “কেন? এই যে ইতিহাস নিয়ে পাতিহাঁসের মত প্যাঁক প্যাঁক করতে থাকিস। সেই জ্ঞানগুলো ওই বাচ্চাগুলোকে একটু দিয়ে আসতে পারবি না?”
    “পড়াতে হবে? তামিল তো! ইল্লে ইল্লে বলতে পারব শুধু।”
    “ওরা তোর থেকে ভাল ইংরিজি বলে। মঞ্জুশ্রী প্রতি উইকেন্ডে পড়াতে যেত।” শুভ মনে হচ্ছে গার্ল-ফ্রেন্ড জুটিয়ে একেবারে শচীন তেন্ডুলকর হয়ে গেছে। সব বল মাঠের বাইরে।
    “কোথায় জায়গাটা?” জয়দা টু দ্য পয়েন্ট।
    “এটাই একটু সমস্যা।” শুভকে চিন্তিত শোনাল।
    “কেন? অনেক দূর?”
    “না। দূর অনেক নয়। এই ধর কিলোমিটার দুয়েক। কিন্তু ওরা থাকে যেখানে তার চারিপাশে এতগুলো কন্টেইনমেন্ট জোন যে কেউ যেতে সাহস পাচ্ছে না। মঞ্জুশ্রী যেতে চাইছে। কিন্তু পুলিশি ঝামেলায় পড়লে মুশকিল।”
    “হুম। ওদের জায়গাটা যদি কন্টেইনমেন্ট জোন না হয়, তাহলে যেতেই পারে। নইলে যাওয়া ঠিক হবেনা।”
    “কিন্তু যাবে কী করে?”
    “সেটা ভাবতে হবে। ভাল কাজের জন্য কি আর উপায়ের অভাব হয় রে? আচ্ছা, তোর ওই মঞ্জুশ্রীকে ডাক না একদিন - আলাপ পরিচয় করি। আড্ডা হোক। সাথে এই প্ল্যানটাও হোক।” জয়দার কথা শুনে শুভর চোখ একেবারে চকচক করে উঠল।
    “ডাকব?"
    “নিশ্চয়ই। তুই কী বলিস?” জয়দা আমার সম্মতি চায়।
    “হ্যাঁ হ্যাঁ। আজকেই আসতে বল। ডিনার করে যাক।”

    মঞ্জুশ্রী বেশ মিশুকে। আমাদের এই ‘অল বয়েজ’ বাড়িতে এসেও একেবারে স্বাভাবিকভাবে হাসি গল্পে ভরিয়ে দিল। কথায় কথায় জানা গেল যে ও নাকি ‘দক্ষিণী’র ছাত্রী। জয়দা তাই শুনে বলল, “দক্ষিণীতে আর মন বসল না? একেবারে দক্ষিণে চলে আসতে হল?”
    মঞ্জুশ্রী সাথে সাথে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। নইলে ‘দক্ষিণী’র জন্য দক্ষিণা আসবে কোথা থেকে? আর আইটির জন্য তো শুধু এই ‘দখিন দুয়ার’ই খোলা।”
    আমরা সবাই হেসে উঠে আবদার করা হল একটা গানের। এমনিতেও আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী কেটেছে জয়দার হেঁড়ে গলার আবৃত্তি শুনে। বলা মাত্র মঞ্জুশ্রী এক কথাতেই গান ধরল - “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে…”
    শুভ অসাংস্কৃতিক অপোগণ্ড! গানের মাঝেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, "রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে একটু রবীন্দ্রখাদ্যের দিকে গেলে হয় না? রবি ঠাকুর ইজ ওয়েটিং উইথ চিলি চিকেন। বড্ড খিদে পেয়েছে।”
    মঞ্জুশ্রীর সাথে রবি ঠাকুরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। আর রবি ঠাকুর যে আজ আমাদের অর্ডার মাফিক ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন করেছে - সেটাও জানিয়ে দিয়েছিল শুভই - দায়িত্ব নিয়ে। সুতরাং শুভর আদেশ মত আমরা রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে রবি ঠাকুরের খাদ্যের দিকেই পা বাড়ালাম।
    “এই যে তোরা মারের সাগর পাড়ি দিয়ে বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিস এটা খুব ভাল ব্যাপার। আমরা সাথে আছি। খেয়ে উঠে গুছিয়ে বসে বাকি প্ল্যানটা করতে হবে। কিন্তু তার আগে একটা গল্প শোনাই। খেতে খেতে। শুনবি?” জয়দা বলল।
    জয়দার গল্পে কে আর কবে ‘না’ বলেছি! মঞ্জুশ্রীও এই এক সন্ধ্যের আড্ডাতেই জয়দার সিধু-জ্যাঠামির আঁচ পেয়ে গেছে। তাই সেও রাজি।
    “সকালে তোদের স্রোংচান গামপোর গল্প বলেছিলাম। মনে আছে কিছু?” জয়দা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল।
    “হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন?” আমি বললাম।
    “বেশ। তবে মঞ্জুশ্রীকে কন্টেক্সট দেওয়ার জন্য একটু ব্রিফ করে দে দেখি।” বলে জয়দা আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে দিল। আমার যদিও ওইসব খটোমটো জিনিসপত্র কিছুই মনেছিল না, তবু মোটামুটি টাইমলাইনটা খেয়াল ছিল। মঞ্জুশ্রীর দিকে ফিরে বললাম, “বেশ। আমাদের এখানে একটা টিবেটান স্টাডিজের ক্লাস হয়। গুরু জয় আমাদের জ্ঞান বিতরণ করেন। তা এতদিন ধরে যা বলেছে - তার সারমর্ম এরকম - খ্রিষ্টের জন্মের শখানেক বছর আগে ভারতবর্ষের এক রাজা শত্রুর ভয়ে সম্ভবতঃ তিব্বতে চলে যান। তাকে দেখে তিব্বতের প্রাচীন ধর্ম বোন ধর্মের পুরোহিতরা ঈশ্বর প্রেরিত দূত ভেবে বসে। এবং তাকে নিজেদের উপজাতির রাজা নির্বাচিত করে। নাম হয়ে ‘ঞাট্রি চানপো’। এটার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু সে যাই হোক, তিব্বতে তখন অনেকগুলি উপজাতির বাস। তাদের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বসবাসকারী উপজাতি ছিল ইয়ার্লুংরা। ঞাট্রি চানপো হলেন তাদেরই রাজা। এই রাজবংশের পরবর্তী রাজা হন সম্রাট স্রোংচান গামপো। তার সময়ই তিব্বত এক বিশাল সাম্রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। আর তার দুই বিদেশি বৌদ্ধ রাণীর দৌলতে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে। কী ঠিক বললাম, জয়দা?”
    “আর ‘মঞ্জুশ্রী' মোটেই মেয়েদের নাম নয় - ওটা ছেলেদের নাম। তাই সুং বোধিসত্ত্ব - কীসব।” শুভ এমনিতে খাওয়ার সময় কথা বলে না - কিন্তু ফুট কাটার সুযোগ পেলে ছাড়ে না।
    জয়দা মন দিয়ে চিলি চিকেন খাচ্ছিল। রবি ঠাকুর চিলি চিকেন যেটা বানায় জয়দার ভাষায় সেটা নাকি ‘ডিভাইন'। জয়দা চোখ বুজে হয়ত নন্দন কাননেই বিচরণ করছিল। আমার কথায় মর্ত্যে ফিরে এলো। শুভর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “হাই লেভেলে মোটামুটি বলেছিস। কিন্তু যেটা বলিসনি - সেটা হল ‘শিক্ষা'। তিব্বতিরা সবাই নিরক্ষর ছিল।”
    “সবাই?" মঞ্জুশ্রী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
    “ইয়েস। তুই সেখানে থাকলে অবিশ্যি এন জি ও চালাতেই পারতিস। কিন্তু সমস্যা হল অন্য। তিব্বতিদের পড়ার জন্য বা লেখার জন্য অক্ষর ছিল না।”
    “সে কি! তাহলে ওরা কাজ চালাত কী করে? মানে রাজ্য চালানোর জন্য টাকা পয়সার হিসাব তো করতে হবে!”
    “হ্যাঁ। কথ্য ভাষা ছিল। লিপি ছিল না। ওরা দড়িতে গিঁট পরিয়ে বা কাঠের প্লেকের গায়ে দাগ কেটে কেটে সমস্ত হিসাব রাখত। লিখতে পারত না। আর সেই জন্যই ও যে ঞাট্রি চানপোর গল্প বলল, সেসব অনেক পরে লেখা ইতিহাস। তার মধ্যে সত্য ঘটনা কতটা ছিল সেটাই সন্দেহজনক।”
    “আচ্ছা, জয়দা, সকালে যে বললে স্রোংচান গামপো চীনরাজ তাই সুংকে চিঠি পাঠালেন। সে চিঠি লিখলেন কী করে?” আমার মাথায় হঠাৎ প্রশ্নর উদয় হল।
    “গুড কোশ্চেন। হ্যাঁ। স্রোংচান যে তাই সুংকে চিঠি পাঠান এটা ট্যাং রাজাদের ইতিহাস নিয়ে দশম শতাব্দীতে লিউ জুএর সম্পাদিত সুবিশাল বই ‘ওল্ড বুক অফ ট্যাং’-এ লেখা আছে। কিন্তু কথা হল যে স্রোংচান যদি তিব্বতি ভাষায় লিখতেন, তাহলে কি তাই সুং সেটা উদ্ধার করতে পারতেন?”
    “তাহলে? চাইনিজে লেখা ছিল?”
    “সম্ভবতঃ। হয়ত দোভাষীর সাহায্য নিয়ে লেখা। তবে এটা একটা জিনিস প্রমাণ করে। কী বলত?” জয়দা খালি প্রশ্ন করে!
    “কী?"
    “তিব্বতে লিপি না থাকলেও লেখার চল হয়ত ছিল। নইলে রাজার মনে চিঠি লেখার কথা আসবে কেন? মৌখিক বার্তা পাঠাতে পারতেন। তাই না?”
    “যাহ। তাহলে এই যে তিব্বতি ভাষায় লেখা ‘ওঁ মনি পদ্মে হুঁ’ লেখা একটা জপযন্ত্র আছে আমাদের বাড়িতে। সে লিপি কোথা থেকে এলো?” মঞ্জুশ্রী প্রশ্ন করল।
    “সেই গল্পটাই তো বলব বললাম। তোনমি সম্ভোট। নামটা খেয়াল আছে?” আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
    “নেপাল রাজা অংশুবর্মনের কাছে স্রোংচান গামপোর সম্বন্ধ নিয়ে গেছিল না?” মনে পড়ল আমার।
    “ব্রাভো! ঠিক বলেছিস। আসলে তোনমি ছিলেন স্রোংচান গামপোর বন্ধু এবং মন্ত্রী। ঐতিহাসিকদের মতে তিব্বতের খম্বল পর্বতমালার পায়ের কাছে ‘তোন' নামে এক গ্রামে জন্ম। এবার তার নাম ‘তোনমি' নাকি ওই ‘তোন' গ্রামে জন্মের জন্য তাকে ‘তোনমি' বলা হয় - সেটা একটা প্রশ্ন। আর নামের পরের অংশ - ‘সম্ভোট’ সম্ভবতঃ ভারতীয়দের দেওয়া। জ্ঞানী সৎচরিত্রের ‘ভোট' দেশীয় মানুষ হিসাবে হয়ত তিনি ভারতবর্ষের মানুষের কাছ থেকে এই উপাধি পান।”
    “মানে বলতে চাও যে তিনি ভারতে এসেছিলেন?”
    “নইলে তিব্বতে লিপি এলো কোথা থেকে?” রহস্যময়ভাবে হাসল জয়দা।
    “ইন্টারেস্টিং!” মঞ্জুশ্রী মজা পেয়ে গেছে।
    “খুব। এই কাহিনী প্রথম যেখান থেকে জানা যায় তাকে বলা হয় ‘দ্য পিলার টেস্টামেন্ট’। তিব্বতিতে বলে ‘কা খোল মা’। এই পিলার টেস্টামেন্ট লেখা হয়েছিল রাজা স্রোংচান গামপোর সময়কালে। লিখে সেটা রেখে দেওয়া হয় লাসার ‘জোখাং' মন্দিরের একটি থামের গর্তের মধ্যে বন্ধ করে।”
    “জোখাং মানে সেই ওয়েংচেনের জন্য যে মন্দির তৈরী করে দিয়েছিলেন রাজা?” আমি জিজ্ঞেস করি।
    “ঠিক। মন্দির তৈরীর সময়ই একটি থামের মধ্যে এই পিলার টেস্টামেন্ট রেখে দেওয়া হয়।”
    “সেটা বের করল কে?”
    “থাম থেকে সেটিকে বের করেন এক বাঙালী ভদ্রলোক। কে বলতে পারবি?”
    “বাঙ্গালী? তিব্বতে?”
    “হুঁ। ভুলে গেছিস? অতীশ দীপঙ্করের কথা? অতীশ তিব্বতে গিয়ে এটি উদ্ধার করেন। এখানে অনেক ঘটনার কথাই লেখা ছিল - যার মধ্যে তোনমির ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। আর একটি সূত্র হল ‘টেস্টামেন্ট অফ বা’।”
    “তুমি আগেও এই ‘টেস্টামেন্ট অফ বা’এর কথা বলেছ। এটা কী বলত?” শুভর কথা শুনে বুঝলাম যে তার থালা খালি হয়েছে।
    “'টেস্টামেন্ট অফ বা’এর গল্প শুনেই তো আমি প্রথম তিব্বতের ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এটি ওই পিলার টেস্টামেন্টের মতই। শখানেক বছর পরে লেখা। সম্রাট ত্রিসোং দেচেনের সময়। রাজসভার এক সভাসদ ‘বা সালনাং’এর লেখা একটি বিবরণী। আচার্য শান্তরক্ষিতের তিব্বতে আসার কথা এবং সাময়ে মঠ প্রতিষ্ঠার কথা লেখা ছিল এখানে।”
    আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম। আমায় থামিয়ে দিয়ে জয়দা বলল, “এখন কোন প্রশ্ন নয় - জানি এখুনি বলবি শান্তরক্ষিত হু? কিন্তু আপাতত শান্ত থাক। যথা সময়ে বলব তার গল্প। এই বা’এর লেখা বিবরণীতেও তোনমির গল্প পাওয়া যায়।”
    “গল্পটা কী?”
    “গল্পটা তোনমির ভারতযাত্রাকে নিয়ে। তার আগে সেই অলৌকিক বাক্সের গল্প মনে আছে?”
    “অলৌকিক বাক্স?” মঞ্জুশ্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
    “হ্যাঁ। স্রোংচান গামপোর ঊর্ধতন চতুর্থ পুরুষ রাজা থোরি ঞানচানের সময় অলৌকিক ভাবে একটি সোনার বাক্স আকাশ থেকে রাজার কাছে নেমে আসে। অবিশ্যি তিব্বতি পণ্ডিত নেলপা বলেছেন এসব হল বোনপোদের বানান গুল্প - মানে গুল গল্প। বোনপোরা নাকি আকাশ নিয়ে একটু ফ্যাসিনেটেড ছিল। প্রথম রাজা ঞাট্রি চানপোকেও আকাশ থেকে নেমে আসা বলে চালিয়েছে। আবার এটাও বলেছে যে ঞাট্রি চানপো এবং তার পর বেশ কয়েকজন রাজার নাকি মৃত্যু হয়নি। সময় হলেই একটা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে তারা আকাশে চলে যেতেন।”
    “স্বর্গের সিঁড়ি?”
    “একদম তাই। সুতরাং আকাশের গল্পে বিশ্বাস করে লাভ নেই। নেলপা পণ্ডিত বলেছেন যেটা সেটা খুব প্রাকটিক্যাল। তিব্বতের পজিশনটা একবার চিন্তা কর। দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে চীন, এছাড়া সিল্ক রুট বরাবর কাশগড় খোটান ইত্যাদি রাজ্য। এরা সবাই শিক্ষিত জাতি। প্রাচীন যুগ থেকে নানাবিধ বইপত্র লেখা হয়েছে। এবার এদের মধ্যে তিব্বত একেবারে একদলা অন্ধকার। শিক্ষা দীক্ষা তো দূরে থাক অক্ষর অবধি নেই। এই সব দেশ বা রাজ্যের কেউ হয়ত কখনো ওই বইসমেত বাক্স এনে রেখে গেছিলেন। এবং তিব্বতি রাজারা কেউ সেটা পড়তে না পারায় সেটা সযত্নে রক্ষিত ছিল রাজপ্রাসাদে। যতদিন না স্রোংচান গামপো মনে করলেন এসবের অর্থোদ্ধার করা দরকার। এ ছাড়াও বাইরের দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যর জন্য একটা লিখিত মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছিল। এতদিন তিব্বত বিভিন্ন উপজাতির বাসভূমি হিসাবে ছিল। স্রোংচান রাজা হয়ে যখন প্রায় সমস্ত উপজাতিকে নিজের অধীনে এনে এক সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন তখন অ্যাডমিনস্ট্রেশন প্রয়োজনীয় হল। আগের কাঠের গায়ে দাগ কেটে হিসাবের সময় ফুরল। বহির্দেশের সাথে শুরু হল কূটনৈতিক যোগাযোগ। এবং এই সমস্ত কিছু সঠিক ভাবে অর্গানাইজড ভাবে করার জন্য দরকার হয়ে পড়ল ‘লিপি’।" জয়দা একটু থেমে জল খেল। খাওয়া আমাদের সকলেরই সারা। গল্প ছেড়ে উঠতে পারছিনা - এই যা! শুভ শুধু হাত ধুয়ে এসে আম দই খাচ্ছে মন দিয়ে।
    “তাই জন্য স্রোংচান ব্যস্ত হলেন লিখিত মাধ্যমের জন্য। এবং লিপি তৈরীর জন্য রেফেরেন্স হিসাবে তিনি বেছে নিলেন ভারতকেই। কারণ ওই সময় আশেপাশের এই দেশগুলিতে মোটামুটি দুই ধরণের স্ক্রিপ্ট চলত। চীনে তো অবশ্যই প্রাচীন চাইনিজ স্ক্রিপ্ট। আর বাকি সর্বত্র ছিল ব্রাহ্মি লিপি বা তার উনিশ-বিশ।”
    “কিন্তু কাশ্মীরের ওদিকে খরোষ্টি লিপির চল ছিল না?” মঞ্জুশ্রী প্রশ্ন করে। মেয়েটা এতসব জানে কোত্থেকে!
    “ঠিকই বলেছিস। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর পর খরোষ্টি লিপির ব্যবহার কমে যায়। সে জায়গা দখল করে ব্রাহ্মি লিপি। ওই যখন থেকে গুপ্তরা নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে লেগেছে, মোটামুটি সেই সময় থেকে। অবিশ্যি গুপ্তদের সময় ব্রাহ্মি লিপির যে রূপটি ব্যবহৃত হত তাকে 'গুপ্ত লিপি’ও বলা হয়ে থাকে!”



    (ক্রমশঃ) 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৫ মে ২০২০ | ২০৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৫ মে ২০২০ ০৪:৩৪93332
  • এই পর্ব আরো জমে উঠেছে। 

    শুভর নারকেল মাথার জন্য দুটি ছোট তথ্য, জয়দার কাছে বিস্তারিত জানার ইচ্ছা। ক. পণ্ডিত অতীশ দীপংকর তিব্বতি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের বহু বই লিখেছেন, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। খ. তার আদি বাড়ি বাংলাদেশের বিক্রমপুরে দীপংকর স্মৃতি জাদুঘর আছে। তিব্বত থেকে তার দেহভস্ম এনে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে রাখা হয়েছে।

    উড়ুক                    

       

  • সৈকত ভট্টাচার্য | ১৫ মে ২০২০ ১০:০১93343
  • বিপ্লব,

    অতীশের কথা হয়ত আমাদের স্কোপের বাইরে। আমরা শান্তরক্ষিতের সময় গিয়ে থামব। তবে, এটি বই হিসাবে প্রকাশিত হলে পরিশিষ্ট হিসাবে অতীশের কিছু কথা হয়ত থাকবে। দেখা যাক... 

  • বিপ্লব রহমান | ১৫ মে ২০২০ ১৬:০০93351
  • অবশ্যই  বই হোক,  পরিশিষ্টসহ।  এগিয়ে যান, তারপর?    

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন