এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • রুমুদের ফণীজ্যেঠু

    লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৫ এপ্রিল ২০২০ | ২৩৫৩ বার পঠিত
  • ফণীজ্যেঠুকে রুমুদের পাড়া, তার পাশের পাড়া, তারও পাশের পাড়ার সব্বাই, প্রায় বয়স নির্বিশেষে ‘জ্যেঠু’বলেই ডাকত। ফণীজ্যেঠুরা তিন ভাই, চুনী, ফণী আর অনি। তিনজনই রেলে চাকরি করতেন। সেই ষাট সত্তর দশকে রেলের চাকরির বেতন খুব বেশী ছিল না, তবে অফিসারদের সুযোগ সুবিধে ছিল বেশ কিছু। উপরির সুযোগ ছিল, যদিও সকলেই সে সুযোগ নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। জ্যেঠুদের দোতলা বাড়িটা তিনভাই মিলেই করেছিলেন, পেছনে বেশ বড় একটা বাগানও ছিল। তা ১৯৫২-৫৩ সালে ওই ছোট্ট মফস্বলে জমির দাম ছিল যৎসামান্য,ফলে তিনভাই মিলে মোটামুটি ছড়ানো একটা বাড়ি খাড়া করতে তেমন অসুবিধে হয় নি। ‘লালবাড়ি’ বলতে দুই তিন পাড়ার মধ্যে সবাই একডাকে চিনত সেই বাড়ি, শুধু তার উজ্জ্বল ইঁটলাল রঙের জন্যই নয়, তার মানুষগুলোর জন্যও বটে। রুমুদের ছোট্ট মফস্বলের মানুষজনের জীবনের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকতেন এই বাড়ির মানুষগুলো, বিশেষ করে ফণীজ্যেঠু।
    .
    রুমুদের ছোটবেলাটা ছিল ভারী ঝলমলে, গমগমে। সারাবছর জুড়ে কিছু না কিছু লেগেই থাকত। ২৬শে জানুয়ারি, ১৫ই অগাস্ট পাড়ার সবচেয়ে বড় মাঠে পতাকা তোলা হত, ইস্কুলের গরমের ছুটি পড়ার পর সব বাচ্চাদের নিয়ে রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত সন্ধ্যা হত, কালীপুজোর পর সারারাত্রিব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান আর সরস্বতী পুজোর পরেও একটা ছোট বিচিত্রানুষ্ঠান হত। এই সবকটা অনুষ্ঠান আবার লালবাড়ির ছাদেও হত। পাড়ার অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের শেখানোর দায়িত্ব থাকতেন সব দাদা দিদি কাকু মামা মাসিরা। পাড়ার অনুষ্ঠানের সময় ফণীজ্যেঠু এসে বসতেন একদম সামনের সারিতে। প্রতিটি বাচ্চার উপস্থাপনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোরগলায় একটু টেনে টেনে বলে উঠতেন ‘সা-আ-ধু-উ সা-আ-ধু-উ’। তারপর বাচ্চাটিকে কাছে ডেকে খানিক্ষণ কথা বলতেন। লিখছি বটে ‘বাচ্চা’ আসলে এটা উনি ১৬-১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের সাথেও করতেন, মানে যতদিন তারা এগিয়ে এসে শুনত আর কি। মূলত শুরুর দিকের উৎসাহমুলক দুই তিনটি বাক্যের পরেই আরো ভাল কী করে করতে পারবে, কোন কোন দিকে নজর রাখা উচিত এইসব। পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চারা অনেকেই ঠিক বুঝতে পারত না, বারো, তেরো বা তার বেশী বয়সীরা অধৈর্য্য হয়ে যেত, মাঝের কিশোর কিশোরীরা মন দিয়ে শুনত কেবল। পরবর্তী কদিন বিকেলে খেলার মাঠগুলোতে চলত তার অনুকরণ করে তুমূল হাসাহাসি। জ্যেঠুর ভাইপো ভাইঝিরাও তাতে অংশ নিত, কখনও বা বাড়ির ছাদের অনুষ্ঠানের কিছু মজার গল্প বলে দিয়ে হাসির হররা ও বন্ধুদের দলে নিজেদের গুরুত্ব দুইই বাড়িয়ে নিত। জ্যেঠুর দুই মেয়ে সুচী আর কণি এইসব গল্পের সময় একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে রাখত মুখে, কথাটথা খুব একটা বলত না। সুচী অবশ্য খেলতে আসতও খুব কম, ভারী শান্ত মেয়ে সে, পড়াশোনা সেলাইফোঁড়াই নিয়েই থাকতে ভালবাসে সে, আর নয়ত গান। ভারী ভাল নজরুলগীতি গায়। নিজের প্রিয় দুই গায়িকার নামে দুই মেয়ের নাম রেখেছেন জ্যেঠু সুচিত্রা ও কণিকা, দুজনেই চমৎকার গান করে, তবে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে চায় না দুজনের একজনও।
    .
    ২৬শে জানুয়ারী, ১৫ই অগাস্ট পতাকা তোলার পর সবচেয়ে প্রথম বক্তব্য রাখতেন পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক তরণীজ্যেঠু আর তারপরেই ফণীজ্যেঠু। এই দুটো অনুষ্ঠান ছিল জ্যেঠুর একেবারে নিজস্ব। সমস্ত পরিকল্পনা প্রায় একাহাতে করতেন, কাউকে কিচ্ছুটি করতে দিতেন না। আর বক্তৃতাটি প্রতি বছর একেবারে আনকোরা নতুন দিতেন। কৈশোর যৌবনের যে আট দশ বছর রুমু শুনেছে কোনোদিন বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি হতে দেখে নি। ওদের স্কুলের বড়দি বা সেক্রেটারি মাস’শাইএর ক্ষেত্রে অবশ্য বক্তৃতার পৌনঃপুনিকতাই নিয়ম ছিল, বড়ক্লাসে উঠে রুমুরা ক্লাআসের মধ্যে চুপিচুপি পুরো বক্তৃতাই গড়গড় করে বলে খিলখিল করে হাসত। মজা হল এইসব বক্তৃতায় জ্যেঠুর বলা মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বা নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, সীমান্ত গান্ধী, বিধান চন্দ্র রায় ইত্যাদি সম্পর্কে ১৯৪৭ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন গল্পের অনেকগুলিই বড় হয়ে রুমুরা আর কোনও বইতে খুঁজে পায় নি। ফণীজ্যেঠুকে অবশ্য বই পড়তে দেখাও যেত না কখনো, খবরের কাগজ পড়তেন আর রেডিও শুনতেন যতক্ষণ বাড়ি থাকতেন। লালবাড়ির বৈঠকখানায় চুনিজ্যেঠুর কেনা এক বিশাল রেডিও ছিল, ছাদে তার এরিয়াল টাঙানো। রেডিওর সামনে মাটিতে মাথা নীচু করে বসে শুনতেন জ্যেঠু। সোফায় বা চেয়ারে উঠে বসছেন না কেন, এই জিজ্ঞাসার উত্তর ছিল তাঁর ‘বিজ্ঞান এক বিস্ময়, ঈশ্বরের দান তা, মাথা নত করে তাকে গ্রহণ করতে হয়”
    নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের এক গরমের দুপুরে জ্যেঠিমা হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে, ন্যুনতম চিকিৎসার সুযোগটুকুও না দিয়ে মারা যান। সুচীদির ততদিনে বিয়ে হয়ে দুই দুইবার যমজ সন্তান হয়ে চার ছেলেমেয়ের মা, কণিদি এমফিল করে। অনিজ্যেঠুকে ক্যান্সার ধ্বংস করেছে তার বছর চার আগেই। ছোটভাইয়ের শেষযাত্রায় ফণীজ্যেঠু যান নি, হাজার ডাকাডাকিতেও তাঁকে নাকি রেডিওর সামনে থেকে ওঠানো যায় নি, খুব লো ভলিউমে খবর হচ্ছিল তখন। ‘সধবা’ ‘পুণ্যবতী’ জ্যেঠিমার ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁকেই যেতে হয়, জ্যেঠিমা যে কি ভীষণ পুণ্যবতী, কেমন ডগডগে সিঁদুর নিয়ে জ্যেঠুর নাকের ডগা দিয়ে, কাউকে একটুও কষ্ট না দিয়ে মারা গেলেন একথা আত্মীয়স্বজন তো বটেই উৎসাহী প্রতিবেশীরাও জনে জনে জানিয়ে যেতে থাকেন। রুমুকে পরে লোপা, চুনীজ্যেঠুর মেয়ে বলেছিল, জ্যেঠু নাকি জনে জনে হাতজোড় করে বলেন ‘আপনারা চুপ করেন চুপ করেন, অতসীর কথা আপনারা জানেন না।’ তো এই অনুরোধ তাঁদের উৎসাহ বাড়িয়েই দেয়। কণিদির কাছে মাসখানেকের মধ্যে কোনও এক পরোপকারী আত্মীয় নাকি বলেছিলেন আর দেরী না করে বাবার এবার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে। প্রসঙ্গত, জ্যেঠুর বয়স তখন ৬২।
    .
    নব্বইয়ের দশক ছিল এক ঝোড়ো দশক, দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশের সবকিছু, মানুষজনের পেশা, বাসস্থানের ধরণ, ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবারগুলি। লোপা, রুমুরা তখন জীবিকার সন্ধানে উদ্ভ্রান্তপ্রায়। বেশ কিছু নতুন নতুন জীবিকার সৃষ্টিও হয়েছে, যেমন জেরক্সের দোকান, বিউটিপার্লার, ছোটখাট কম্পিউটার টিচিং সেন্টার, ডেটা প্রসেসিং সেন্টার ইত্যাদিতে অনেক ছেলেমেয়ে খুঁজে নিচ্ছে কাজ। জীবিকার প্রয়োজনেই চুনিজ্যেঠুর নাতি বাবুলকে পড়াত রুমু, লোপাই ওর দাদাকে বলে যোগাড় করে দিয়েছিল। ওর কাছে রুমু ফণীজ্যেঠুর গল্প শুনত। জ্যেঠু ক্রমশঃ আরো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন, বাবুলের ভাষায় ‘দ্যাখো পিসি বাবা বলে মেজদাদুর মাথায় আগে দু মিটার ছিট ছিল এখন ১০ মিটার হয়ে গেছে’। জ্যেঠু নাকি কালীপুজোর সময় পুজোকমিটিকে বলেন কম্বলদানের ব্যবস্থা করতে আর সেই কম্বল দেওয়া হবে পাড়ায় বাসন বিক্রি করতে আসা বাসনওয়ালিদের। কম্বলদানে যদিও বা নিমরাজী অন্যরা, বাসনওয়ালিদের দিতে কেউ রাজী নয়, কারণ তাদের সাজপোশাক দেখে তাদের মোটেই অভাবী বলে মনে হয় না। সর্বোপরি কম্বলের বাজেটের সংস্থান কোত্থেকে হবে তারও কোনও সদুত্তর জ্যেঠুর কাছে নেই। মণিমেলার আসরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জ্যেঠু, ওদের সাথে ব্রতচারী করতে থাকেন পাশে দাঁড়িয়ে, সবাই হাসে। শুনে একটু খারাপ লাগে রুমুর। আবার ভুলেও যায়।একটা যেমন তেমন চাকরি পেয়ে টিউশনি ছেড়ে দেয়, ক্রমে ব্যস্ততা এত বাড়ে যে বেরোয় ভোর সোয়া সাতটায় আর ঢোকে প্রায় মাঝরাতে, ছুটিছাটায় আর পাড়ার কোনও খবর রাখার শক্তি বা ইচ্ছা কিছুই থাকে না।
    এইভাবেই একদিন অনিশ্চিত চাকরি ছেড়ে একটু নিশ্চিত কিছু পায় রুমু, কিছু স্থিত হয় ওদের সংসারটা, শুন্য দশকের গোড়ায় চলে যায় দিল্লী, ক্রমে ইউরোপ, বছরে এক কি দুই বার বড়জোর আসা হয়। তারও মধ্যে একদিন কলকাতা যাবার পথে বাবুলের সাথে লোকাল ট্রেনে দেখা হয়ে যায় রুমুর, এটা সেটা গল্পের মাঝে শোনে ফণীজ্যেঠু বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলি বিলি করেন। এই করে নিজের সঞ্চয় প্রায় শেষ হতে বসেছে, আর হ্যান্ডবিলের বিষয়বস্তুর জন্য বাবুলরা বা অন্য আত্মীয়রাও কেউ আর সম্পর্ক স্বীকার করতে চায় না ওঁর সাথে। শুনে রুমু এত অবাক হয়, সেই ফণীজ্যেঠু? শুধু নিজের আত্মীয়ই নয় পাড়াপ্রতিবেশী, গোটা মফস্বলের সকলকে জড়িয়ে বাঁচতে চাইতেন যিনি তাঁর সাথে পরিচয় স্বীকার করতে চায় না কেউ? কেন? কী থাকে সেইসব হ্যান্ডবিলে? বাবুল প্রথমে বলতে চায় না, পরে খানিক অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে, থাকে নাকি রাস্তায় থুতু ফেলা, গাছ কেটে ফেলা, ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে সেখানে নোংরা ফেলা, (একটু ইতস্তত করে) গান্ধিজীর গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমানকে কেটে ফেলার অন্যায়, এইসব নিয়ে বাংলায় ওঁর নিজের লেখা। প্রত্যেক হ্যান্ডবিল উনি হাজার কপি করে ছাপান, নীচে থাকে ওনার সেই বিখ্যাত সইটা, ণ-ইয় দীর্ঘ ঈকার একেবারে পাখির ল্যাজের মত টেনে দিয়ে পুরো গোপাল শব্দটা লিখে ফণীগোপাল সই করতেন জ্যেঠু। বিলি করা শেষ হয়ে গেলে আবার ছাপান। রুমু আন্দাজ করে বাকীগুলো যেমন তেমন এই শেষ বিষয়টাই সম্ভবতঃ ওঁকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
    সেইবারই ফিরে আসবার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা রুমু বেরোয় টুকটাক কিছু জিনিষপত্র কিনে আনতে, থাকে যেমন প্রতিবারই; সন্ধ্যা স্টোর্স ছাড়া সেফটিপিন বা রাবার ব্যান্ডের প্যাকেট আর কোথাও তেমন ভাল তো পাওয়া যায় না – তা হঠাৎই এক অন্ধকার গলি থেকে অসম্ভব রোগা এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে একেবারে রুমুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন রাস্তা আগলে। ওই রাস্তায় তেমন লোক চলাচল নেই, রুমু একেবারে হকচকিয়ে যায়, তবে নেহাৎ বৃদ্ধ আর অসম্ভব শীর্ণ তাই ঠিক ভয় পায় নি, উনি জিগ্যেস করেন ‘কেমন আছ মা?’ ভঙ্গী অতি পরিচিতের, যদিও রুমু চিনতেই পারছে না। তা এই জায়গায় বড় হয়েছে সেই আট বছর বয়স থেকে, ইনি নিশ্চয় ওকে চেনেন, চিনতে পারছে না বলে ভারী লজ্জিত হয়ে জানায় ‘ভাল আছি’, বৃদ্ধ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেন ঠিক বলছে কিনা, ফাঁকি দিচ্ছে না তো, রোগবালাই লুকোচ্ছি না তো, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার খায় তো? রুমু চিনেও চিনতে পারছে না – জেরার ভঙ্গীতে খানিক ঘাবড়ে জানায় হ্যাঁ সব ঠিকঠাক। হঠাৎই রুমুকে চমকে দিয়ে তিনি জিগ্যেস করেন “আমি কেমন আছি?” কিছু বোঝার আগেই রুমুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “অ্যাঁ কী বললেন?” তিনি আবার জিগ্যেস করলেন “আমি কেমন আছি? আমি কি ভাল আছি? আমি কি ভাল থাকব? আমি কি ভালই থাকব? আমরা সবাই ভাল থাকব? ভালই থাকব হ্যাঁ মা?” তীক্ষ্ণ সরু কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট উচ্চারণে পরপর প্রশ্ন করে চলেন বৃদ্ধ। ভ্যাবাচ্যাকা রুমু কী বলবে ভাবতে ভাবতেই উনি ঘুরে আবার ওই গলিটায় ঢুকে যান।
    উনি কি আদৌ চিনতে পেরে কুশল জিগ্যেস করলেন, নাকি --- অবাক হয়ে এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে ঘটনাটা বলতেই বোন বলে “আরে চিনতে পারলি না, ওটা তো ফণীজ্যেঠু”। রুমু বোঝে গলার আওয়াজ কেন চেনা চেনা লাগছিল! কিন্তু এ কি চেহারা! রোগা চিরকালই, কিন্তু এ তো কঙ্কালসার আর – আর কথাবার্তা! বোন বলে হ্যাঁ এরকমই হাল হয়েছে। সুচীদি থাকে হায়দ্রাবাদে, কণিদি উত্তরবঙ্গে কলেজে পড়ায়, সেখানেই কোয়ার্টারে থাকে। অনেকবার চেষ্টা করেছে জ্যেঠুকে নিয়ে যাবার, কিন্তু নিয়ে গেলেও জ্যেঠু আবার দু’একদিনের মধ্যে চলে আসে। হ্যান্ডবিল বিলি করা তো আছেই। এখন ধারকর্জ করে ছাপায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নোংরা পড়ে থাকতে দেখলে কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে। আবার লোকের বাড়ির বাইরে কাপড় বা কম্বল বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে তারে মেলা থাকলে চুরিও করে। নিজে যে ব্যবহার করে না, সে তো দেখাই যায়, কে জানে কাদের দিয়ে আসে, নাকি বিক্রিই করে --- ভাইপো ভাইঝিরা সবাইকে বলে রেখেছে ওদের সাথে আর কোনও সম্পর্ক নেই, কেউ যেন ওঁর কোন কাজের জন্য ওদের না বলে। রুমু খেয়াল করে বোন আর ওঁর সম্পর্কে সম্মানসুচক সম্বোধন বা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করছে না, হয়ত জ্যেঠু থেকে একটা ‘রাস্তার পাগল’ হয়ে যেতে দেখেছে বলেই --- রুমুর বুকে কেমন একটা ধাক্কা লাগে, জোরালো ধাক্কা।
    .
    আরো প্রায় বছর দেড়েক বাদে বাড়ি এসে জ্যেঠুর খবর জিগ্যেস করায় রুমু শোনে মাসকয়েক আগে মারা গেছেন ফণীজ্যেঠু। চ্যাটার্জীপাড়ার ডাস্টবিনের পাশে পড়েছিলেন উপুড় হয়ে, সে এক তুমূল বর্ষার দুপুর, কতক্ষণ পড়েছিলেন কেউই ঠিক করে বলতে পারে নি, ওপাড়ার ঠিকে কাজের লোক চঞ্চলার কথা অনু্যায়ী বেলা বারোটায় সে যখন কাজ সেরে এখান দিয়ে গেছে, কাউকেই দেখে নি, আর জয়গুরু স্টোর্সের কমল ওঁকে পড়ে থাকতে দেখে বিকেল চারটে নাগাদ। তো ধরে তুলতে গিয়ে সন্দেহ হওয়ায় কমল ডাক্তার ডাকে, এসে দেখেই তিনিও হাসপাতালে রেফার করেন, হাসপাতাল জানায় ব্রট ডেড, সেরিব্রাল অ্যাটাক। এরপর অবশ্য ভাইপো ভাইঝিরা আসে শেষকৃত্যাদির কাজে সাহায্য টাহায্য করে, এবারে বাড়িটা বিক্রি করতে হবে তো। অতটা জায়গাজমি নিয়ে শুধুশুধু পড়ে আছে, এতদিন আটকে ছিল একটা সইয়ের জন্য!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৫ এপ্রিল ২০২০ | ২৩৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ০৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:০৭92044
  • ঠিক, ফণীজেঠুর এরকম পরিণতি-ই ত হওয়ার কথা।
  • স্বাতী রায় | 162.158.***.*** | ০৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১০92045
  • লেখাটা পড়ার মনে মনে একবার এখনকার চারপাশটা খুঁজছিলাম। ফনীজ্যেঠুর মত কাউকে পেলাম না। বিবর্তন?
  • সুকি | 162.158.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৫৬92068
  • এমন হয়, এমন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক কি নয়! কেমন বিষণ্ণ লাগে
  • r2h | 162.158.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২০ ১৮:০৩92073
  • :(

  • | ২৫ এপ্রিল ২০২০ ১৩:০০92668
  • স্বাতো, সুকি, একলহমা, হুতো, 

    ধন্যবাদ। 

    স্বাতী,  ফণীজ্যেঠুদের শেলফ লাইফ শেষ এরকমই শুনেছিলস্ম।  তবে আহমদনগরের কাছে গোগোলগাঁওতে এরকম,একজনের দেখা পেয়েছি।  

  • ধীমান মন্ডল | ২৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:৪৭92675
  • মনে থাকবে লেখাটা । একটা সময়কে ছুঁয়ে সত‍্যের কুলে ওঠা কত সাবলীল ভাবে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন