দিওয়ালি কাকে বলে জানা ছিল না। দীপাবলি শব্দটাও ছাত্রবন্ধু তেই পড়া ছিল শুধু। পুজো বলতে বয়রা কালী।
সত্তর সালের শেষাশেষি ধরাধামে আসা, জন্মের পরপর ই চলে যাওয়া হয় উত্তরবঙ্গে। কালিয়াগঞ্জ জায়গাটা তখন ছিলো পশ্চিম দিনাজপুরে। এখন যেটা দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর। নিকটবর্তী শহর বলতে রায়গঞ্জ (নামেই মালুম, সেটাও গঞ্জ বিশেষ) আর বালুরঘাট। ছোট একটা জনপদ বাঘন নামে, কালিয়াগঞ্জ থেকে বেশ কিছু মাইল দূরে, সেখানেই বাবার অফিস। সাইকেলে যাতায়াত করতো। পরিবেশবান্ধব মানুষ ছিলো বলে সাইকেল, এরকম কিছু নয়। যাতায়াতের খরচ বাঁচানোর জন্য। নাগাড়ে বহু কিলোমিটার সাইকেল মেরে যে পয়সাটা বাঁচতো তা দিয়ে সপ্তাহান্তে দুই ছেলের জন্য আঁশ টা ফল টা।
কালিয়াগঞ্জের একটা প্রান্ত দিয়ে গিয়েছিলো বড়ো বাস রাস্তা। ওই রাস্তায় দৈত্যের মতো ছুটতো দূরপাল্লার বাস আর লরি। কলকাতার সাথে শিলিগুড়ির সংযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়ক । সেখান দিয়ে যেত রকেট বাস! এসপ্ল্যানেড থেকে ছেড়ে শিলিগুড়ি যাওয়ার দ্রুততম বাস। মাথায় নীল আলো জ্বলতো তার, গদির সিট, সে বাসের ঠাটঠমকই আলাদা। কলকাতা থেকে কালিয়াগঞ্জ আসতাম দার্জিলিং মেলে, প্রায়শই আনরিসার্ভড কামরায়, ক্বচিৎ স্লিপারে। গদিওয়ালা যানবাহনে বসি ই নি কখনো! অহংকারী রকেট দেখতে বাবার সাথে গিয়ে ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। হুশ করে বিদ্যুতের মতো বেরিয়ে যেত চোখের সামনে দিয়ে।
`বাবা একবার রকেট বাস চড়াবে?'
লোকটা বেচারা মন রাখা মিথ্যে বলতে পারতো না কোনোদিন। চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতো। তারপর তার সাইকেলের রডে বসে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। স্কুলপাড়ায় বাড়ি ছিলো, ভুশুন্ডির মাঠের শেষপ্রান্তের মাটির বাড়িটা। খড়ের চাল। পাশে তিনঘর স্কুল কোয়ার্টার।
সেই বাসরাস্তা থেকে একটু ঢুকে কালীমন্দির। নাকি ভীষণ জাগ্রত দেবী। বয়রা কালী। ভীষণদর্শনা। বয়রা মানে কালা, বধির। কালাই যদি হলেন তাহলে ভক্তদের প্রার্থনাই বা শুনতেন কি করে, আর না শুনলে পূরণ ই বা করতেন কি করে? তা'লে জাগ্রত হলেন কি করে রে বাবা! ইত্যাকার প্রশ্ন মনে ঘুরতো, কালীবাড়ির এক পুরোহিত কে জিগেস করায় তিনি বলেন মা'র তো ওটাই মাহাত্ম! ভক্তের অন্তরের চাহিদা বুঝতে পারেন, শোনার দরকার পড়ে না। ক্লেয়ারভয়েন্স, টেলিপ্যাথি এসব শব্দ শুনি নি তখনো, মাদাম ব্লাভাৎস্কির নাম ও না। শুনলে জানতে পারতাম যে একই গল্প ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন দেশ সমাজ ও কালে, ভক্তদের মস্তকধৌতির জন্য এইসব সিদ্ধাই এর প্রচার বড়ো প্রয়োজন।
তবে সেই করালবদনী মূর্তি দেখে ভয় পেতাম। মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠ। একের পর এক বলি হতো। পাঁঠাবলির পর বলির রক্ত গায়ে মাখতো দুধসাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা `বিশেষ' ভক্তরা। তারা সেভাবেই নকশাল তরুণদের রক্ত ও গায়ে মেখেছিলো। যদিও বাবা রাজনৈতিক ভাবে অন্য বামদলের কর্মী ছিলো, সেই তরুণদের অনেকে বাবার ভাইয়ের মতোই ছিলো। ফলে তাদের রক্তের ঋণ বাবাও মিটিয়েছিলো কিছু সত্তরের দশকে - সেই বিশেষ কালী ভক্তরা বাবাকে যথেষ্ট সমঝে চলতো তাই। যদিও কাটে কাটে লেগে গেলে কে কার মাথা আগে নাবাবে তা বলা অত সহজ ছিলো না। থাক সে সব রক্তাক্ত অধ্যায়। এখনকার পলিটিক্যালি কারেক্ট দুধেভাতে জনগণের সেইসব ঝোড়ো দিনের মানে বোঝার ক্ষমতা নেই। ফলে সে আলোচনায় না যাওয়াই ভালো।
পাঁঠা বলি ছাড়াও পাখি বলি হতো। মুরগী। সেইসব বিশেষ ভক্তরা মদের ঘোরে লাল চোখ, অনেক সময় হাতেই বলি দিতো। হাত দিয়ে পেঁচিয়ে মুরগির মাথা ছিঁড়ে এনে রক্তটা ঢালতো গায়ে মাথায়। তার সাথে মা মা রবে হুঙ্কার।
কালীপুজোয় জ্বালানোর বাজি ফুলঝুরি, ফাটানোর বাজি ক্যাপ - এই ছিলো Das Capital - অর্থাৎ বিনয় দাসের বাজেট। ক্বচিৎ বিনয়ের ব্যাটার কপালে দু একটা রংমশাল জুটে যেত - সেই বছর গুলোতে যে কি আনন্দ! বিনয়ের ব্যাটা তাপস আনন্দে ডিগবাজি খেত তখন।
ফুলঝুরি বলতে সাধারণ ফুলঝুরি ই। রঙিন বা ইলেকট্রিক ফুলঝুরি তখনো বাজারে আসেনি। ক্যাপ ছিল দুরকম - পাতা ক্যাপ (বা রোল/রিল ক্যাপ) যেটা এখন পাওয়া যায়, আর টিপ ক্যাপ - অর্থাৎ আলাদা আলাদা ক্যাপ একেকটা। বারুদের দানাটা কপালে পরার টিপের মতো গোল লাল দুটো কাগজের মাঝে লাগানো থাকতো, তাই ওই নাম। বন্দুকে ফাটালে একটা একটা করে টিপ ক্যাপ লাগিয়ে ফাটাতে হতো। রোল ক্যাপ এর দাম অনেক বেশি ছিলো। ক্যাপ ফাটানো হতো বিভিন্ন ভাবে। নখ দিয়ে টিপ ক্যাপের একটা কোনা ধরে নখের ওপর ক্যাপের টিপটা নিয়ে দেওয়ালে নখ ঘসে ফাটানো টা ছিল যাকে বলে ফ্রী-হ্যান্ড ফাটানো - অর্থাৎ কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট লাগতো না। ইনস্ট্রুমেন্ট বলতে ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক ছাড়াও আরেকটা জিনিস বিক্রি হতো - আমরা সেটাকে ক্যাপ-বল্টু বলতাম। নাট বল্টুই প্রকৃত প্রস্তাবে। সেখানে নাট আর বোল্টের মাথার মাঝখানে টিপ ক্যাপ রেখে মাপমতো টাইট করে (বেশি টাইট মারলে চাপে ফেটে যাবে) দেওয়ালে বা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলে ক্যাপ টা ফাটতো। ক্যাপ-বল্টুর পেছনে অনেক সময় প্ল্যাস্টিকের তৈরী, ওই তীরের পিছনে যেমন পালক থাকে, সেরকম নীল রঙের লাগানো থাকতো, বা সবুজ।
ফুলঝুরি আর ক্যাপ ফুরিয়ে গেলে প্যাঁকাটি গুলোই জ্বালাতে থাকতাম, আর ফুলঝুরির বাক্স গুলো ও, যতক্ষন না মা কান পেঁচিয়ে দুটো থাবড়া মেরে ঘরে তুলে নিয়ে যেত হিম পড়ছে বলে।
কলকাতায়, অর্থাৎ আড়িয়াদহ এসে থাকতে শুরু করি ঊনআশি সাল থেকে। সেই বিখ্যাত ১ নং হরিচরণ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি, যার গল্প কখনো শেষ হবে না। সেখানে এসে একটু ডাঁটো হওয়ার পর, এই মাধ্যমিক দেওয়ার আগে আগে যতদূর মনে পড়ে, নাকি ক্লাশ এইট হবে, বাজি বানাতে শুরু করলাম বাবার গাইডেন্সে। প্রথম প্রথম বাবাই বানাতো, আমি আর ভাই দেখতাম, পরে একসাথে তিনজনে। প্রধানতঃ বসন তুবড়ি, এক ছটাক আর আধ ছটাক খোলের। বার কয়েক রংমশাল। উড়োন তুবড়ির তীব্র বিরোধী ছিল বাবা, কখনো বানাতে দেয়নি, লোভীর মতো পাড়ার দাদাদের উড়োন তুবড়ি ছাড়া দেখতাম - ওঃ! সে এক শিল্প বটে! সিকি ছটাক বা তারচেয়েও ছোট খোলের উড়োন তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে উল্টো করে ধরা, অর্থাৎ আগুন লাগানোর ফুটোটা নিচের দিকে। সেই ফুটোয় প্রেমিকের চুম্বনের মতো আলতো করে জ্বলন্ত ধূপকাঠি ছোঁয়ালেই ছির ছির করে রুপোলি-সাদা রঙের (উড়োনে প্রধানতঃ এলুমিনিয়াম চুর দেওয়া হয়, তাই সাদা আলো) হালকা আগুন বেরোতে শুরু করবে - তখন দু আঙুলে ধরা উড়োন কে বার আড়াই সমান্তরাল ঝাঁকিয়ে, আগুনের ফোর্স হিসহিস করে বেরিয়ে এলে হাত এক পাক বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে তুবড়ি টা ছেড়ে দিতে হবে। ওই হাত ঘোরানোটার মধ্যেই আসল ওস্তাদি। অতি সামান্য এয়ারোডিনামিক্যাল ভুলচুকেই উড়োন হয় মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ঘাড় নড়বড় করতে করতে এর লুঙ্গি ওর শাড়ির তলায় ঢুকে অসভ্যতার চেষ্টা করবে, অথবা ভসভস করে আওয়াজ তুলে খুব সামান্য উচ্চতায় উঠে কয়েকটা বড়ো বড়ো কিন্তু অসম ব্যাসার্ধের ভাঙা বৃত্তে ঘুরে জ্বলে শেষ হয়ে যাবে। ওস্তাদের হাতের তুবড়ি সোজাআআ উঠে যাবে ওপরে রুপোলি - সাদা আলোর লেজ নাড়াতে নাড়াতে।
উড়োন তুবড়ি ছাড়তে স্কিল লাগে।
তবে উড়োন বেশ বিপজ্জনক ও বটে। ভীমবেগে নেবে আসা আংরা হয়ে যাওয়া খোল মাথায় পড়লে পিতার নাম তৎক্ষণাৎ পরিবর্তিত হয়ে খগেন্দ্রনাথ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, এভিডেভিট ছাড়াই। ফলে কালক্রমে উড়োন তুবড়ি কে বেআইনি করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে বেশ কিছু বছর উড়ন তুবড়ি বিক্রি হতো না, যারা ছাড়তো তারাই বানিয়ে নিতো। পরে আস্তে আস্তে তাও বন্ধ হয়ে যায়। উড়োন তুবড়ি বর্তমানে, আরো অনেক বাজিরই মতো, ম্লেচ্ছ ভাষায় , যাকে বলে এক্সটিংক্ট।
কিন্তু ছুঁচো কোয়াসি-এক্সটিংক্ট গ্ৰুপে পড়ে। ছুঁচোবাজি কে তাবৎ বাঙালি চেনে, টেনিদার ঝাউবাঙলোর রহস্য তাকে অমর করে রেখেছে। ফলে ছুঁচোর বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার মানে হয়না এখানে। ছুঁচোবাজি তে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে, সম্ভবতঃ উড়োন তুবড়ির থেকেও বেশি। এবং ছুঁচো বানানো যেত সবথেকে সস্তায়, একমাত্র মশলা ছাড়া আর কিছুরই প্রয়োজন পড়তো না সে অর্থে, সে মশলার কম্পোনেন্টের সংখ্যাও যৎসামান্য। ফলে ছুঁচো প্রকৃতই প্রলেতারিয়েতের বাজি ছিলো। তাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে অনেকদিন আগেই। কিন্তু বিপ্লবের মতো (আমরা ত্রিপুরার রাজ পরিবারকে নিয়ে আলোচনা করছি না এখানে) ছুঁচোবাজিরও মৃত্যু নেই! বাজারে হাজারটা বাজি আছে যেগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে ছুঁচো বাজি ই। ছুঁচোর মশলার প্রধান বৈশিষ্ট হলো তা কেওটিক মোশনের ট্রাজেক্টরি (অনির্দিষ্ট/বে-আন্দাজি গতিপথ) তৈরী করে। সুতরাং যে সমস্ত ফ্যান্সি বাজি আমরা দেখি যার পলতেয় আগুন দিলে এদিক ওদিক যায়, সেগুলো আসলে ছুঁচোর মশলা দিয়েই তৈরী, মশলার কম্পোনেন্টের ভাগে সামান্য রকমফের থাকে - এই মাত্র।
বিলুপ্ত অথবা লুপ্তপ্রায় প্ৰজাতির বাজির কথাই যখন উঠলো, তখন কিছু সেই ধরণের বাজির উল্লেখ করা যাক, আমার বসন তুবড়ি বা বসা তুবড়ি বানানোর গল্প তার পরে আসবে। ট্রেন বলে একধরণের বাজি ছিল। চতুস্কোণ মোটা কাগজের খাপের মধ্যে বাজির মশলা ভর্তি চোঙাকৃতি দুটো প্রকোষ্ঠ থাকতো। সলতের একদিক একটা প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে অন্য প্রকোষ্ঠে ঢুকে যেতো। সলতের অন্যমুখ বেরিয়ে থাকতো ওপরের প্রকোষ্ঠ থেকে, তাতে আগুন দিতে হতো। আরেকটি ফাঁকা প্রকোষ্ঠ সিলিন্ড্রিক্যাল, সেলাইয়ের সুতোর রিলের মতো, বারুদ ভর্তি দুটো প্রকোষ্ঠের ওপরে থাকতো। অর্থাৎ তিনটে সিলিন্ড্রিক্যাল চেম্বার, সবার ওপরের টা ফাঁপা আর নিচের দুটো মশলা ভর্তি, পরপর একটার ওপরে আরেকটা রেখে সেট করা থাকতো রেকট্যাংগুলার প্যারালেলপিপেড একটা কাগজের বাক্স তে, সাইজে যা কিং সাইজ সিগারেটের প্যাকেটের অর্ধেক। এই বাজি পোড়ানোর জন্য বিস্তৃত জায়গা চাই - মাঠে কাপড় শুকোনোর দড়ি টাঙানোর বাঁশ পোঁতা থাকতো অনেক বাড়ির সামনের খোলা জমিতে, সেই বাঁশদুটো আদর্শ এ ক্ষেত্রে। একটা সুতো ট্রেনবাজির ফাঁপা সিলিন্ডারের মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দুদিকের বাঁশে বেঁধে দিতে হবে। পলতেয় আগুন দিলে শোঁওও করে আওয়াজ করে ট্রেন দৌড়োতে শুরু করবে সুতোর ট্র্যাক বরাবর। একটা মশলার প্রকোষ্ঠ পুরোটা পুড়ে গেলে সলতে দিয়ে আগুন চলে যাবে অন্য প্রকোষ্ঠে, আবার উল্টোবাগে শোঁ করে ফিরে র আসবে সুতোর ট্র্যাক বরাবর। আমার দারুন লাগতো এটা। তবে সুতো বেঁকে গেলে বা ঢিলে হয়ে ঝুলে গেলে সলতের আগুন সুতোয় লেগে সুতো পুড়ে যাবে, এবং ট্রেন বাবাজি সুতো খুলে মাটিতে অবতরণ করে ইতঃস্তত বিচরণ শুরু করবেন। দর্শকগণ তখন লুঙ্গি বা শাড়ির ঘের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
তারপর সাইরেন। ছোট্ট চোঙ্গাকার টিনের কৌটোয় মশলা থাকতো। বাইরে যথারীতি রাংতার মোড়ক। পলতেয় আগুন দিলে বাজিটা উর্ধমুখী প্যাঁচানো পথে (আপওয়ার্ডলি ডাইরেক্টেড স্পাইরাল ট্র্যাজেক্টরি) উড়ে যেত তীব্র আওয়াজ করে। কি মশলা থাকতো খোদায় মালুম, আওয়াজ বেরোতো অবিশ্বাস্য রকমের তীক্ষ্ণ - তাই নাম সাইরেন। এটা বহুকাল হলো উঠে গেছে।
লঙ্কাপট্কা/কালিপটকার ছোট ভাই ছিলো ধানি পটকা, আড়ে দীঘে লঙ্কাপটকার অর্ধেক মাপের, বেগুনি রঙের কাগজে মোড়ানো থাকতো, ধানী লঙ্কার রঙের। তাই এই নাম। ছিল চকোলেট বোমের ছোটভাই আলুবোম, রাংতার বদলে বেগুনি রঙের ঘুড়ির কাগজে মোড়া। ভুঁইপটকা ছিল দেওয়ালে বা মেঝেয় ছুঁড়ে মারার জন্য - জোর আওয়াজ। কম্বাশন বাই প্রেশার, অর্থাৎ ভুঁইপটকা আর পেটোর মশলায় তফাৎ ছিলো না কোনো, পুলিশ তাই বেআইনি করে দেয়। এবছরে, আশ্চর্য, আবার সেগুলিকে বাজারে দেখছি, তা প্রায় তিরিশ বছর বাদে। চপেরই মতো, পেটো ইন্ডাস্ট্রিও কি কুটির শিল্প হিসাবে সরকারি তকমা পেলো তাহলে?
পরে বাজারে আসে দুলালের চকলেট বোম, কিন্তু বুড়িমার পেডিগ্রিই ছিলো আলাদা। খুব সম্ভব তিন রকম সাইজের (সুতরাং আওয়াজের) হতো। চকলেট বোম হাতে ধরে ফাটানোর একটা কায়দা আছে (খবরদার ভুলেও কেউ আমার লেখা পড়ে এ কাজ করতে যাবেন না!), পলতের ঠিক বিপরীত দিকটা তর্জনী এবং মধ্যমার নখ দিয়ে চেপে ধরে হাতটা দূরে বাড়িয়ে আগুন দিতাম। মশলার বার্স্ট সামনের অর্থাৎ পলতের দিকে হতো, রাংতা, সুতলির বাঁধন সমস্ত উড়ে ছেৎরে ফাঁক হয়ে যেত, কিন্তু বিস্ফোরণের ইম্প্যাক্ট পলতের উল্টোদিকের অংশে ততটা পড়তো না, সেই দিকটা অক্ষতই থাকতো। ফাটা চকোলেট বোমের অবশেষ যদি হাতে তুলে কখনো খুঁটিয়ে দেখেন (সেভাবে দেখেই হাতে ধরে বোমা ফাটানোর স্ট্র্যাটেজি মাথায় এসেছিলো আমার), তাহলে কি বোঝাতে চাইছি সেটা পরিষ্কার হবে আরো। একই ভাবে দোদোমাও আঙুলে ফাটানো যায় (উঁহু, একদম সে চেষ্টা করবেন না!), নলটার নিচের ফুটোয় কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে সলতেয় আগুন দিলে প্রথম আওয়াজ তার পরেই টানের চোটে আঙ্গুল থেকে ছিটকে ওপরে উঠে যাবে, তারপর দ্বিতীয়বার ফাটবে আকাশে।
চকোলেট বোম দোদোমা এঁরা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু বিলুপ্ত হয়েছেন এনাদের বড়দা বড়দি - বোতল বোম আর নারকেল বোম। নামেই মালুম তাদের দুজনকে দেখতে কেমন ছিলো। বিশাল আকার, বিকট আওয়াজ। বোতল বোম একবারে একটাই ফাটানো হতো। কিন্তু বেলুড়ের দিকে কোথাও একটা, খুব সম্ভবতঃ দোলমঞ্চে, নারকেল বোম একটার সাথে একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে বেঁধে এমনভাবে, যাতে একটা ফাটলে সেই আগুনে পরেরটার পলতে জ্বলে ওঠে, সেভাবে সাজিয়ে ফাটানো হতো। গঙ্গার এপারে বসে আমরা রাত্রে মুহুর্মুহু কামান গর্জনের আওয়াজ পেতাম।
এই কামান গর্জন নিয়ে এক কিস্যা আছে। ১ নং হরিচরণ চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে বেশ বড়ো মাঠ ছিলো। বাড়ির বাইরে একটা পাড় বাঁধানো পাতকুয়া। পাতকোর মুখ ঢাকা থাকতো কাঠের তক্তা দিয়ে, যাতে জলে নোংরা না পড়ে। এক কালীপুজোর রাত্রে, পাড়ার সবাই যখন বাজি ফাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ঢুকে গেছে, পরীক্ষামূলক ভাবে আমি পাতকোর ভেতরে চকোলেট বোম ফেলেছিলাম, ফেলেই দ্রুত তক্তা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম। সলতেটা কেটে ছোট করে নিয়েছিলাম যাতে জল ছোঁয়ার আগেই আগুন মশলায় পৌঁছোয়। কুয়োর বায়ুস্তম্ভের অনুরণন (যাঁরা উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন তাঁরা ওপেন পাইপ ক্লোজ্ড পাইপের একুস্টিক ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন) দলমাদল আর জাহানকোষা বা বোধহয় একদম দার্দানেলিস ক্যাননেরই মতো গর্জন করে উঠেছিলো বোমটা ফাটায় - সারা পাড়ার লোক বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো - ভেবেছিলো বোধহয় আবার স্পুতনিক ভেঙে পড়লো - এবং আমি তৎক্ষণাৎ পাঁচিল টপকে পিসির বাড়ি (পাশাপাশি বাড়ি ছিলো) লম্বা দি। ধরতে পারলে আমার ছফুটিয়া পিতৃদেব আমার রক্তে হোলি খেলতেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিলো না। পরের দিন বাড়ি ঢুকেছিলাম বাবা অফিস বেরিয়ে গেলে।
তুবড়ি প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। মশলা বলতে সোরা (পটাশিয়াম নাইট্রেট), গন্ধক আর কাঠকয়লা। আদর্শ কাঠকয়লা হবে, ফারসীতে যাকে বলে, নিম-তর্-নিম-খুশক, অর্থাৎ পুরো ভিজেও না (গুঁড়ো হবে না) পুরো শুকনো ও না (গুঁড়ো অর্ধেক উড়ে চলে যাবে), এরকম। সোরা প্রচন্ড হাইগ্রোস্কোপিক, সাবধানে রাখতে হতো ময়েশ্চার বাঁচিয়ে। গন্ধক নিয়ে কোন সমস্যা নেই। মালমশলা কিনতে পাওয়া যেতো আড়িয়াদহ সখের বাজারে দশকর্ম ভাণ্ডারে (দোকানটা, কি আশ্চর্য, এখনো টিকে আছে এবং ভালোই বিক্রিবাটা হয় আধুনিক মল মূত্রের প্রতিযোগিতার চাপ সামলেও), কিনে তারপর হামানদিস্তার গুঁড়ানো (আমার ঠাকুমার ছোট বোনের, মিউনিসিপ্যালিটি ইস্কুলের দুঁদে বড়দিমনি ছিলেন যিনি, তাঁর পান ছেঁচার হামানদিস্তয় কাঠকয়লা গুঁড়ো করেছিলাম একবার। তারপর কি হইয়াছিলো তাহা শ্যামলাল জানে...) এবং মিহিস্য মিহি করে ছাঁকার পালা। কাঠকয়লা গুঁড়ো করতে ভূত হয়ে যেতাম। গুঁড়ো হলে তার সাথে যাবে লোহাগুঁড়ো (হলদেটে রঙের ফুলকি হবে) আর এলুমিনিয়াম গুঁড়ো (সাদা সাদা ফুল হবে)। পয়সা থাকলে (আমাদের ছিলো না) তার সাথে যাবে স্ট্রনশিয়াম (লাল আলো) আর ব্যারাইটা (সবুজ আলো)। এবারে মেশানোর পালা, কোনটা কি ভাবে মেশানো হবে কোন রেশিও প্রপোরশনে, সেটা খুব সাবধানে ছোট্ট দাঁড়িপাল্লায় (এক পরিচিতর থেকে গয়নার দোকানের দাঁড়িপাল্লা ধার করে আনতাম) মেপে মেপে করতে হতো - ভাগ ভুল হয়ে গেলে মশলা তীব্র বিস্ফোরক হয়ে যাবে। প্রতিবার তুবড়ি বানানোর পর প্রথমটা বাবা জ্বালাতো আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়ে, যাতে ফাটলে নিজে মরে (এক ছটাকের মোটা মাটির খোল মশলা শুদ্ধ ফাটলে সেটার এক্সপ্লোসিভ ইমপ্যাক্ট পেটোর চেয়ে বেশি তো কম নয়), সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। মশলা ভাগ হয়ে গেলে এবারে ঠাসার পালা। মাটির খোল গুলো একটা গোটা দিন জলে ভিজিয়ে দেখে দেওয়া হতো, তারপরে শুকিয়ে নেওয়া হতো। সামনের ছিদ্র (যেখানে আগুন দেওয়া হয়) রঙিন কাগজ দিয়ে আটকে পেছন থেকে মশলা ঠাসা হতো - বুড়ো আঙুলে ফোস্কা পড়ে যেত চেপে চেপে মশলা ঠাসতে - ঠাসা যত বেশি টাইট হবে ততো বেশি ফোর্স আর ছড়িয়ে ঝাড় হবে আলোর। ঠাসা হয়ে গেলে খোলের পেছনের ছিদ্র এঁটেল মাটি দিয়ে বন্ধ করে আর একদফা রোদ খাইয়ে নেওয়া হতো তুবড়িগুলোকে।
তুবড়ির ভাগ কখনো কেউ কাউকে বলতো না, গুপ্তধনের ম্যাপের মতো করে সযত্নে নিজের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করতো সবাই। কারণটা হলো তুবড়ি প্রতিযোগিতা - যে ব্যাপারটা এখন উঠে গেছে - অনেকদিন ই। প্রতিবছর কালীপুজোর রাতে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মরণপণ রেষারেষি। একটা আখাম্বা লম্বা বাঁশ পোঁতা হতো মাঠে। তার গায়ে বিভিন্ন উচ্চতায় টিকিট মারা থাকতো বিভিন্ন রঙের কাগজের। বাঁশের নিচে তুবড়ি জ্বালানো হতো, তার ঝর্ণা কোন টিকিট অবধি পৌঁছলো সেটা দেখে নোট করা হতো। সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় যার তুবড়ির স্পার্কল পৌঁছতো সে হতো বিজয়ী। ছোটোখাটো দুর্ঘটনা যে একেবারেই হতো না তা নয় - আলোর ফোয়ারা অনেক দূর যাতে ওঠে তারজন্য প্রতিযোগীরা অনেক সময় প্রাণপনে গেদে গেদে মশলা ঢোকাতো খোলে - অতিরিক্ত ঠাস মশলা হলে তুবড়ি ফাটতো একটু জ্বলার পরই।
অল্পবয়েসে, বেশ একটু, যাকে বলে আতাক্যালানে, তাই ছিলাম (এখনো যে নই সে কথা খুব কিছু কনফিডেন্স নিয়ে বলতে পারি না)। একপুজোয় বাজি পোড়ানোর পর ঠিক করলাম আধপোড়া সব বাজির বারুদ বার করে বাজি বানাবো। সাতপোড়া চরকি, ছিন্নভিন্ন চকোলেট বোম, রংমশালের বালিভর্তি অংশ, সব কিছু থেকে খুঁটে খুঁটে মশলা বার করে একজায়গায় করলাম - করে একটা কাগজে মুড়লাম - তারপর দাঁত বার করে তাতে আগুন দেওয়ার জন্য যেই দেশলাই মেরেছি ডান হাতের পাঞ্জাটা মশালের মতো জ্বলে উঠলো! ওই মশলা বার করতে গিয়ে সারা হাতেই বারুদ মাখিয়ে ফেলেছিলাম। আগুনে পোড়ার, বিশেষতঃ বারুদের আগুনে পোড়ার কি তীব্র জ্বালা - যেন শত্রুরও এ অভিজ্ঞতা না হয়। হাত সারতে বহুদিন লেগেছিলো।
মেয়েকে এইসব গল্প করছি, ভুরু তুলে বললো - 'এতো ঝামেলা করে লাভের লাভ কি হতো? অকারণ সময় নষ্ট। তুবড়ি দোকান থেকে কিনে নিলেই পারতে।'
ভাবলাম দি ঠেসে এক থাবড়া! তারপর মায়া হলো। আহা বেচারা আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো অশ্বত্থামাই প্রকৃত প্রস্তাবে। পিটুলি গোলা খাচ্ছে সেটুকুই শুধু যা বুঝতে পারে না।