৭ সেপ্টেম্বর কামদুনির স্কুল মাঠে অপরাজিতার স্মরণে হাজির হওয়া মানুষের নব্বই শতাংশই ছিল মেয়েরা। স্থানীয়রা ছিলেন ভালোসংখ্যক, সুঁটিয়া থেকে এসেছিলেন প্রতিবাদী মঞ্চের মানুষজন, কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগণার এপয়া ও অন্যান্য গণসংগঠনের কর্মীরা এবং কয়েকজন নামকরা ব্যক্তি। অপরাজিতার জন্য, কামদুনির জন্য, নির্যাতিত সব মেয়েদের জন্য সুবিচার চেয়ে মিলিত হয়েছিলেন সকলে। কেসের পরবর্তী ডেট ১০ সেপ্টেম্বর সকলকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের নজরদারি কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার আবেদন জানান হয়। সংক্ষিপ্ত সভার পর মিছিল গিয়ে বাতি জ্বালান হয় কামদুনি মোড়ে অপরাজিতার স্মরণবেদীতে, যে বেদীতে অপরাজিতাকে "শহীদের সম্মান" ঘোষণা দিয়েছে কামদুনির মানুষ।
পার্ক স্ট্রীটের ধর্ষণকে মুখ্যমন্ত্রী ''সাজানো ঘটনা'' হিসাবে অবহিত করার পর এবং অন্যরকম বলায় গোয়েন্দা-প্রধানকেই অপসারিত করার পর এই রাজ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও যৌন উৎপীড়ন প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে, এমনকি কলেজ চলাকালীন কলেজের সংসদকক্ষে পরিকল্পিত কায়দায় দলবদ্ধ ধর্ষণ সংগঠিত করে শাসকদলের ছাত্রনেতারা। এরকম সময়ে দিল্লি থেকে শুরু হয় নির্ভয়া আন্দোলন। দেশের রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা ধর্ষনের দায় মেয়েদের ওপরই চাপায়, সমাজপতিরা ধর্ষিতাকেই মুখ লুকাতে বলে অন্ধকার গৃহকোণে আর ধর্ষক বিন্দাস ঘুরে-ফেরে সমাজে --এই ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় নির্ভয়া আন্দোলন।
জুন মাসের ৭তারিখ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে কামদুনির মেয়েটি আক্রান্ত ধর্ষিত ও নিহত হয়। কামদুনি ফুঁসে ওঠে। ধর্ষণ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এতদিন যে কেবলমাত্র শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন চলছিল কামদুনির মানুষ তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেন, শহরের গন্ডি পেরিয়ে নির্ভয়া আন্দোলন গ্রামেও ব্যাপ্ত হয়, মেয়েটি হয় অপরাজিতা।
সারা দেশে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তি পাবার হার মাত্র ২৬%। অর্থাৎ শতকরা ৭৪জন ধর্ষক কোন না কোন ভাবে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে। কামদুনির অপরাধীদের কি শাস্তি হবে? পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রবল জনমতের চাপে পড়ে ঘটনার দশদিন পর মুখ্যমন্ত্রী কামদুনি গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি আন্দোলনরত মানুষকে ভরসা দেওয়ার বদলে "মাওবাদী" তকমা দেন। সি আই ডি-র চার্জশীট থেকে সরকারের ইন্টেনশন আরো পরিষ্কার হয়, মূল অপরাধীরা যাতে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার রাস্তা পায় তার ব্যবস্থা করাই যেন পুলিশের উদ্দেশ্য, অপরাজিতার পরিবারের অভিযোগকে কোনরকম গুরুত্বই সেখানে দেওয়া হয়নি, এমনকি দলবদ্ধ ধর্ষণের চার্জ না এনে কেবলমাত্র এমন একজনের বিরুদ্ধেই ধর্ষণের চার্জ আনা হয় যে অপরাজিতার পরিবারের করা এফ আই আর-এ মূল অভিযুক্ত নয়। পুলিশ এমনভাবে চার্জ গঠন করে যাতে করে ওই একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অপ্রমাণ হলে বাকী ''ষড়যন্ত্রে মদতদাতা'' বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়। বারাসত আদালতের বিচারক এই চার্জশীট দেখে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে কেন দেওয়া হবেনা সে প্রশ্ন তোলেন। এরপরই কলকাতায় সিটি সেসন কোর্টে মামলা স্থানান্তরিত করা হয়।
কামদুনির নাছোড়বান্দা মানুষ ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নজরদারি চালিয়ে যেতে চান। তাই সব ডেটেই তাঁরা আসেন কলকাতা। কিন্তু পুলিশ তাঁদের প্রতিদিন হয়রানি করে। আসার পথে তাঁদের গাড়ি বারবার বেরাস্তায় ডাইভার্ট করে দেয়া হয়। কোর্টের কাছে তাদের গাড়ি রাখতে দেওয়া হয়না, পুলিশ টাকা চায়। ক্ষুব্ধ মানুষগুলো জানান যে সরকার যদি ভেবে থাকে যে বারাসাত থেকে কলকাতায় কেস নিয়ে এনে ও পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে কামদুনির আন্দোলনকারীদের থামিয়ে দেবে তবে তারা ভুল করছে, ভিক্ষে করে হলেও তাঁরা আসবেন। ১০সেপ্টেম্বর তাই আরো বেশী সংখ্যায় এসেছিলেন তাঁরা। এপয়া ও মৈত্রী সংগঠনের কর্মীরাও হাজির ছিলেন। জিপিও-র সামনে পুলিশ তাদের বেধরক লাঠিপেটা করে, অপরাজিতার ছোটো ভাই ও মৌসুমি কয়াল সহ বেশ কয়েকজনকে আহত রক্তাক্ত করে এবং ১১জনকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার লকআপে নিয়ে যায়, বাকীদের হেয়ার স্ট্রীট থানায়।
৭ তারিখ কামদুনির সভাশেষে শ্লোগান উঠেছিল ''সুঁটিয়া থেকে কামদুনি--যারা শাসক তারাই খুনি''। মানুষজন বলছিলেন যে শেষ পর্যন্ত লড়তে চান তাঁরা। এই যে এত মানুষ এতদিন ধরে কষ্ট সয়েও জানাতে চাইছে যে তারা চেনেন অপরাধীদের, জানেন তাদের অতীত কার্যকলাপও—এইসব চিৎকার কোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করবেনা কেন? আগোছালভাবে এই ধরণের প্রশ্নও শোনা যায়।