শিল্পী ছিল সুজয়ের বোন। সুজয় তখন যুবা করত। যুব কংগ্রেস। পাড়ার বিরাট মস্তান আর শিল্পীর পিছনে পরে গ্যালো আমাদের রমেন। রমেনরা তখন সর্দারপাড়ার দিকে বস্তিতে থাকে। উদ্বাস্তু বাড়ির দুর্দশা যেরকম হয়– বাবা মারা গ্যাছেন, ভাইগুলো ইস্কুলেও বোধহয় যায় না, তিনটে বোন আর রমেন নাকি প্রেমে পড়ে গেল! সুজয়ের বাবা রমেনদের বস্তিতে এসে চোটপাট করে গেলেন। সেই বস্তি আবার তখন কমিউনিস্ট পার্টির বেস, উলটে সব রুখে দাঁড়াল। এরপর সুজয় কেসটা হাতে নেয়। সেদিন আমরা ফিরছিলাম ময়দানে খেলা দেখে। লিগ ম্যাচ, ফোকটে টিকিট জোগাড় করে দিয়েছিল কেউ। মেন লাইনের ট্রেনে বেলঘড়িয়া নেমে হেঁটে ফিরতাম আমরা। দু তিনদিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। বড় রাস্তায় বোধ হয় জল জমে থাকত, তাই নিমতা বাজারের থেকে ভেতরের পথ দিয়ে ফিরছিলাম। ব্যাপারটা যে পার্টির ঝামেলায় চলে গ্যাছে সেই ধারণাটাই ছিল না আমার। ... ...
সিনেমা আর মোচ্ছব, সবই প্লাস্টিক আর্ট। টাইম-স্পেস টোটাল নড়বড়ে। কখন কী ঘটে যাবে কিচ্ছু বলা যাচ্ছেনা। সবই মাতালের কম্মো। পুজোর সিজনেই নাকি বসন্ত এসে গেছে, আর এই জমানায় ব্রিজ টপকালে তো সারা বছরই নবান্ন। ওদিকে নাকি মদ বন্ধ করার চক্রান্ত চলছে বাংলাদেশে, আর এদিকে গাঁজামদ বন্ধ হওয়ায় এমন কলরব, যে, সরকার নড়ে বসছে। দেয়ালে দেয়ালে প্রজাপতিরা ছবি আঁকছে, ভরদুপুরে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে গিটার। একে নাকি বলে মাল-টি পারপাস। ওদিকে মাল-আলা একটু তাড়াতাড়িই নোবেল প্রাইজ পেলে কী হবে, আমরা যথারীতি ঢিমে তালে। উৎসব টুৎসব মিটতে চলল, এতদিনে উৎসব স্পেশাল। অবশ্য টাইম-স্পেস দিয়ে হবে টা কী, সবই তো নড়বড়ে, কখন কী ঘটে যাবে কিচ্ছু বোঝাই যাচ্ছেনা, বলা তো দূরস্থান। ... ...
সেই যে দেড়েল মাতালের কথা দিয়ে বাঙালির মাতলামি বা মাতলামির মূলে থাকা মদ খাওয়ার কথা শুরু হয়েছিল, তাঁর পেশা ছিল রিক্সাটানা। তিন চাকার সাইকেল রিক্সাটানা। যাঁরা অমন পরিশ্রমের কাজ করেন তাঁদের নাকি না খেলে চলে না। খেলে অধিকাংশ সময়েই বেসামাল হয়ে পড়েন। তখন ব্যাথার গোড়া উগরে ঢেলে দেন সাহসে কুলোলে জ্যোতিবাবুর ঘাড়ে। আর মিনমিনে মেনিমুখোরা জ্বালা মেটাতে পেটান বউকে, মেয়েকে, ছেলেকে। এই কর্মটি যে নেহাৎ খেটে খাওয়া মানুষের শ্রেণীচরিত্র নয়, তাও স্পষ্ট হয়ে যায় যখন দেখি এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার সাহেব তাঁর রাজ্য সরকারি অফিসার স্ত্রীকে পিটিয়ে পরোটা বানাচ্ছেন শুক্র, শনি, রবিবার। তাঁরা এক নতুন পাড়ায় বাসা নেওয়ার পর বছর চারেক ধরে কর্তাটির শুক্রবার মধ্যরাত্র থেকে শুরু হওয়া পাড়া কাঁপানো খেউড় আর তাঁর প্রহারে আহত, আক্রান্ত কর্ত্রীর আর্তনাদে পাড়া কাঁপলে পরে পাড়ার লোকের মাতাল পেটানোর নেশা হয়। এক শুক্রবার তাঁরা বাড়ির দরজা ভেঙে মাতালকে বার করে নিয়ে বেধে রাখে পাড়ার সব থেকে ক্ষয়াটে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে। উন্মত্ত কিছু চড়-চাপড় আর জোর করে তেঁতুল জল দিয়ে নেশা ভাঙানোর প্রয়াস চলে। কেউ পুলিস ডাকে নি। ... ...
সহৃদয় পাঠক, যিনি আমার এই ব্যক্তিগত গদ্যটি এখন এই মুহূর্তে পড়তে বসলেন, আপনি কি নেশা ভাং করেন? আমার ধারণা অতি অবশ্যই করেন। নেশা এমনই এক টান যার পাল্লায় না পড়ে উপায় নেই। গানের নেশা, গল্পের নেশা, নাচের নেশা, সুরের নেশা, তালের নেশা, ছবির নেশা, কবিতার নেশা, সিনেমার নেশা, নাটকের নেশা আপনার কি নেই? আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, নক্ষত্র, পাহাড়, সমতল, দিগন্ত এদের পাল্লায় পড়ে আপনি কি ঘন্টার পর ঘন্টা কিচ্ছুটি না করে নিজের ভেতর ঢুকে পড়ে, বুঁদ হয়ে সময় কাটান নি? সূর্যোদয়ের মদ, সূর্যাস্তের গাঁজা আপনি কখনো স্পর্শ করেননি বললে আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। অনন্ত রাত্রির কোকেন কখনো কি শোঁকেন নি? এখন মোদ্দা কথাটা হল গিয়ে আপনার সময় নেই। আপনার মাথার ওপর বাঘের মত বস রয়েছে, আপনার বেডরুমে কুমিরের মত হাঁ করে বসে আছে সংসারের হাজার দায়িত্ব।এমনই এক ড্রাগনের সময়ে আমরা বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি, যেখানে আমাদের নেশাগুলিকে অর্থাৎ আমাদের গোটা পৃথিবীটাকেই আমাদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এমনই ফাঁদে আমরা পড়েছি যে আমাদের হাত পা তো বটেই এমন কি বুদ্ধিবৃত্তি থেকে আরম্ভ করে অনুভূতিগুলিকে পর্যন্ত শিকল টিকল জড়িয়ে বেঁধে মোটা জংধরা তালা লাগিয়ে চাবি দিয়ে সে চাবি আমরা নিজেরাই গিলে নিয়েছি, এবং ভুলে গেছি। ভাবুন মশাই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত এমনই আপনার জীবন যে আপনার নিজের ইচ্ছে মত কিস্যু করার উপায় নেই। আপনার সময় আপনি বিক্রি করে দিয়েছেন। নিজেই করেছেন, এবং এত কম মূল্যে করেছেন (আমি শুধু আর্থিক মূল্যের কথা বলছিনা) যে সর্বক্ষণ আপনার নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা লাগে। এই রকম একটা সময়ে আপনি কি করবেন? আপনি কিনবেন। কী কিনবেন? নেশা কিনবেন। আর সেই সব নেশা হবে নকল নেশা। পৃথিবীর নেশার মত, মানুষের নেশার মত তারা আপনার আত্মার উন্নতি ঘটাবে না। বরং প্রভাবিত করবে আপনার শরীরকে, আপনার মাথায়, রক্তে, স্নায়ুতন্ত্রে কিছুক্ষণের জন্য এমন রমরমা ছড়াবে যে আপনার মনে হবে আপনি মুক্ত। আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। কিছুক্ষণের জন্যেই আপনার এই যে সর্বক্ষণের দাসত্ব সেটা আপনি ভুলে থাকবেন।একসময়ে আপনার শরীর বিদ্রোহ করবে। আর আপনিও আপনার নেশা থেকে সটান আপনার যন্ত্রণার মধ্যে আছড়ে পড়বেন।আছড়ে পড়বেন সেই জন্য যন্ত্রণা আরো বাড়বে। কিন্তু আপনার মনে আছে সেই ইউফোরিক অবস্থাটা, ফলে আপনি আবার নেশা করতে বাধ্য হবেন, এবং আবার আছাড় খাবেন। এই যে ভয়ংকর লুপ সেটা চলতে থাকবে। আপনার শরীর মন উভয়েই দুর্বল হয়ে পড়বে। আপনি নিজেও সেটা বুঝতে পারবেন। তখন এসে হাজির হবে অপরাধবোধ।আর যেহেতু আপনি সবচেয়ে দুর্বল আপনার নিজের কাছে, সেই জন্য, শুধুমাত্র সেই জন্যেই, আপনি আপনার এই অপরাধবোধের ভারটা চাপাবেন তাদের ওপর যারা বয়সে, পদমর্যাদায়, অথবা শুধুমাত্র আপনার ভাবনায়, আপনার থেকে ছোটো। তাদের ওপর যাদের আপনি ছোটো মনে করেন। আপনি জোর গলায় ফতোয়া জারি করবেন, মেয়েরা মদ গাঁজা সিগারেট খাবে না। আপনি ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে আনন্দ করতে দেখলে পুলিশে খবর দেবেন। আপনি স্লোগান দেবেন “মদ গাঁজা চরস বন্ধ, তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ?” কবিদের মদ খেয়ে চিৎকার করে কবিতা আবৃত্তি করতে দেখলে, শিল্পীদের গাঁজায় ধুর হয়ে রঙ নিয়ে রাস্তা রঙ করতে দেখলে, আপনার গালিব, শক্তি, র্যাঁবো, পাবলো পিকাসো কাউকেই মনে পড়বে না, মনে হবে এদের হোক ক্যালানো। ইতিমধ্যে আপনার বয়স বেড়েছে, এবং যে ভয়ংকর লুপে আপনি পড়েছেন, তার ফলে আপনার বয়স বাদে অন্য কিছুই বিশেষ বাড়েনি। আপনার শরীর আর দেয় না, ফলে আপনি কৃত্রিম নেশাটাও ধরুন আর করতে পারেন না। ফলে আপনি আরো চেঁচাবেন বব ডিলনকে বলবেন বদ গাঁজাখোর,জন লেননকে বলবেন মাতাল, কবির সুমনকে বলবেন মাওবাদী, লিওনার্দ কোহেনকে বলবেন মাগীবাজ। নোংরামিটাও একটা নেশা। এটা আপনি বুঝবেন না, কিন্তু এই সর্বগ্রাসী নেশাটি আপনাকে টুঁটি চেপে পাকড়াও করবে। দল বেঁধে ঘেউ ঘেউ করতে যে কি মজা, তা তো আপনার পাড়ার কুকুরগুলি আপনাকে প্রত্যেক রাতে দেখিয়েই দিয়েছে। খিস্তি করার আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেশামুক্ত পৃথিবীর দিকে আরো দশ পা এগিয়ে যাবেন। এর ফলে সবথেকে বেশি সুবিধা হবে তাদের যাদের কাছে আপনি নিজেকে বিক্রি করেছেন। বুঝতে পারছেন? সুবিধা হবে ধনতন্ত্রের। এই মাও মাকুদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে, অথবা এদের সঙ্গে নেশা করে ফেলে যদি আপনি একদিন হঠাৎ বুঝতে পেরে যান কে বা কারা আপনাকে বেঁধে রেখেছে, পঙ্গু করে রেখেছে আপনার চেতনাকে, আপনার গোটা জীবনটাকেই, তবে তো তাদের সর্বনাশ। আপনি যদি একদিন আপনি সত্যি কি চান বুঝে ফেলে সমস্ত বাঁধন দুঃস্বপ্নের মত ঝেড়ে ফেলে অনুভব করেন মাথার চারিদিকে হরিণের দৌড়ে আসার মত বৃষ্টির শব্দ, যদি মেতে ওঠেন স্বাধীনতার নেশায়? যদি বলেন না। যদি বলেন আপনি আর নিজেকে, নিজের সময়কে বিক্রি করবেন না, কারোর কাছে? তাহলে স্যার, ম্যাডাম আপনাকে বলছি শুনুন। আপনারা প্রত্যেকে যদি এটা করেন, তাহলে গোটা মেশিনারিটাই বিকল হয়ে যাবে। সেই যন্তরমন্তর থেকে তখন বেরোবে অন্যরকম মন্ত্র। যেমন ধরুন- “দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান”। এবারএকটা গল্প শুনুন। কিছুদিন আগেই এক নেশার আড্ডায় এক শিল্পী আমায় এই গল্পটা বলে। বৌদ্ধ গল্প। বুদ্ধের কাছে এক শিষ্য এসেছে একটা প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্ন খুবই গম্ভীর। ... ...
আমার এক কাকু মারা গেলেন। খারাপ লাগা কালকে অটো না পাওয়ার মতো ফেলে দেওয়া মদের বোতলের মতো...ফাঁকা রাস্তায় কলেজ থেকে ফেরা তিনটি মেয়ের ধরিয়ে নেওয়া সিগারেট...তারপর বোসপুকুর ছাড়িয়ে কসবা থানার আগে একটা ওয়াইন শপে একটি মেয়ের কিনে নেওয়া হাফ লিটার...বয় ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করার রোপোয়ে...কিন্তু চারদিকের আলো হাতের মেহেন্দির মতো...পায়ের হিলের ছুঁচলো যৌনতায় শহর স্লিপ খায়...যেভাবে অভাবের গায়ে গায়ে উঠে এসেছে আরেকটা দিন...যেখানে অনেকদিনের কাজ করা প্রতিবাদ নিশান বদলে পাঁচিলে উঠে দেখছে...আমার রুচি মিলছে না...আমি এখানে আমি বাফার হয়ে গেছি...আমি বিষাদের বাগানে বেঁজির মতো বিষাক্ত সাপ...যার চোখের মধ্যবিত্ত লেন্স নেই...খুলে গেছে কবে...তবে এই ঘষা-খাওয়া কালচারে আমি নেই...রেপ্লিকা...ম্যানুয়াল লেবার হয়ে গোপনীয়তা বলছে...বাহ কি বানিয়েছে গুরু...কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আমি প্রথমের দলে নেই...আমার তো আর সবার মতো ছকে চলে না...সিস্টেমকে অলটার করতে এসে দেখি ওই তো পায়রার বাসা...ওই তো বেলে-ঘাটা,প্রিটোরিয়া স্ট্রিট...কিন্তু জীবন বি-এস-এন-এল...সারা জীবনে বাজে লোকদের সাথেই লড়ে গেলাম।ভালোমানুষ গোটা কতক...যদিও আমার ভিতর ভাল্লুক ও বেড়াল দুজনেই আছে।আমারও সব কিছু করতে ইচ্ছে করলেও সমাজ জানলা টেনে ধরে...কিন্তু আমি যে তাইওয়ানের মতো বেঁচে থাকতে চাই...আমি শেষ সর্ট-এ জেতে ম্যাচ...তবু গিটার বাজাবো ভেবেছিলাম...ভেবেছিলাম নতুন কিছু করবো...সেই আলাদা হতে গিয়ে বিপদে পড়েছি...কারণ সোসাইটি একটা ক্লাবের মতো...এইবার প্ল্যাস্টিক ছেড়ে বেড়িয়ে আসা দালাল স্ট্রিট ...এইবার সব গলি উন্নয়নের মেকি স্বপ্নিং কম্প-প্লেক্স...আমি সাউথ-সিটি কোয়েস্টমল যেতে চাইনা...বাইরের বিশ্বায়ন আমার নয়...আমার কাছে ভিতরটাই দামি...ভিতরে তবু সবাই পিছিয়ে পড়ে আছে/বাইরে আগামি... আবার ভিড়ে ক্লান্ত শহরের গুটিপোকা সুন্দরী...প্রেম-ভাঙা প্রেম-জাগা প্রেমময়...এশিয়ান গেমস...কি হচ্ছে কি হচ্ছে না জানি না...করাপশন...মিডিয়াহাইপ...পেজ থ্রি...জানি না...তাও কবিতা জেগে থাকে...মামমামময়...আমার সততা...উড়ে যাওয়া রেবেল...আমি জানাই...আমি যতই মাথা নিচু করে থাকি,সময় হলেই চে হয়ে যেতে পারি...আমি আপাতত কিছুই জানি না...নকল...ভণ্ডামি আর মধ্য-মেধার বিছুটিতে আমি নেই...আমার খারাপ লাগে।খারাপ লাগে বলেই লিখতে বসে...লেখার উদারতা আমাকে অনেক শিখিয়েছে...তাই এতো কিছুর পরেও জীবনে প্রথম আজ রাত ৭টা থেকে সারা কলকাতা ঘুরবো...কোথাও তোমাদের সাথে দেখা হয়ে যাবে...সিনেমার পর্দায় এখন হাত ডুবিয়েছে মহাকাশ...আপাতত সব সৃষ্টিরা মিশে যাক...যাক মিশে। ... ...
আঁতলামির সঙ্গে মাতলামির এই দ্বন্দ চিরকালের, এ দ্বন্দ সহজে মিটবার নয়। যুগ যুগ ধরে আঁতেলরা মাতালদের হেয় করবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গান লিখে, পদ্য লিখে, পোস্টার বানিয়ে, লেকচার দিয়ে, সব রকম ভাবে! ফলে মাতালদের চিরকালের বদনাম! তবে কয়ালের মাঠের ঘটনার পর আপাতত বেশ জোর দিয়েই বলা যায়, অবশেষে মাতালরাও জেগে উঠেছেন। মাতালদের জন্য বিশেষ স্কুল ও কলেজ খোলা হয়েছে – যেখানে সব রকমের মাতলামী সহজ ভাবে শেখানো হবে। মিন্টো পার্কের কাছে লা মাতালিয়া স্কুলে এখন ছাত্র ছাত্রীর কী ভিড়! আর লেক রোডে দারুচন্দ্র কলেজও নাকি দারুন চলছে। খেলা জমে উঠেছে – দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কে জেতে।। ... ...
ঢাকায় মদ বেশ দামী। বিশেষত বিদেশী মদের ওপর আবগারী শুল্কের হার অত্যন্ত বেশি। অবশ্য, রেজিস্টার্ড বারের বাইরে শস্তার মদও মেলে। ঢাকাতে আমি সর্বত্র দেখেছি “বাংলা মদ” নামে ঘরে তৈরি সবচেয়ে শস্তার মদ তৈরি এবং বিক্রি হতে। ঢাকার পুরনো এলাকাগুলোতে এই বাংলা মদ এখনও মেলে। এক লিটারের দাম ৩০০ টাকা। এর মূলত খরিদ্দাররা হল ঝাড়ুদার, চামার, ডোম, দেহব্যবসায়ী এবং ইঞ্জিনীয়ারিং আর মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা। আসলে এটা হল জীবনদায়ী ওষুধ বানাবার জন্য শস্তায় বিদেশ থেকে আমদানী করা মিথাইল মেশানো অ্যালকোহল। প্রত্যেক বছর এই বিষাক্ত মেথিলেটেড স্পিরিট খেয়ে প্রচুর লোকের মৃত্যু ঘটে। অবশ্য, ঢাকায় খানদানী মদ্যপায়ীর সংখ্যাও কম নেই। তাদের কেউ কেউ সামাজিক স্তরের অনেক ওপরের দিকে বাস করেন, ঢাকার খানদানী এলাকায় তাঁদের বাড়ি, দামি গাড়ি, বিদেশি পাসপোর্ট থাকে তাঁদের কাছে, অথবা খানদানী ক্লাব বা ডিলারদের সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা থাকে। বাকিরা হল মুখ্যত নতুন প্রজন্ম, যারা কর্পোরেট মিডিয়া হাউস, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এনজিও বা বিজ্ঞাপন এজেন্সির হাত ধরে বড় হয়েছে। এই বিশাল মাইনের প্রফেশনালরা খুব দ্রুত বেড়ে উঠেছে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি থেকে, সামরিক শাসনের শেষ হবার পরে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সাথে সাথে। ... ...
ড্রাগের জীবন আর মদ্যপানের জীবন একেবারেই আলাদা! মদ্যপানের একটা সামাজিক লেনদেন আছে। তবে ঢাকা আর দেশের বাদবাকি শহরগুলির মধ্যে এক বিরাট ড্রিংকিং-ডিভাইড শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকায় থেকে ভাবাই যায় না বাইরের বিভাগীয় শহরগুলির (চট্টগ্রাম স্পেশাল) কী নিদারুণ অবস্থা... জেলা বা উপজেলা তো আবছা... ধনী বা গোছানো কর্পোরেট তরুনদের কথা আলাদা... কিন্তু বাকি মদ্যবিত্তদের কত যে নিপিড়নের আর না পাওয়ার ভিতর দিয়ে যে দিন যাপন করতে হয়! তবে কয়েকটা হটস্পট আছে... একটু যোগাযোগ করলে কেরুর একনম্বর বাংলা মদ পাওয়া যেতে পারে... যা এক কথায় অপূর্ব! আমি যে কয়টার কথা জানি: প্রথমেই স্বয়ং দর্শনা (যেখানে কেরুর ফ্যাক্টরি), কুষ্টিয়া, পার্বতীপুর...বগুড়া/ময়মনসিংহ/টাঙ্গাইল। তবে এই জিনিসটাই বহুহাত ঘুরে প্রান্তিক জনপদে গিয়ে কি হয়, তার একটা নমুনা পাইছিলাম কফিল এর সঙ্গে গিয়ে... কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সদর থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে এক নির্জন গ্রামে বসে পান করতে গিয়ে! কই মিল গেটের মিষ্টি গন্ধযুক্ত দেশি সখি... আর কই পলিথিনে আনা কলের পানির সঙ্গে কয়েক ফোঁটা হোমিওপ্যাথি গন্ধ। চেনা লোকের কাছ থেকে আনা বলে এতে সে ঘুমের ঔষধ মেশায় নাই। কিন্তু কোনই মেরিট নাই। ... ...
তাঁদের এ ধরণের কথা বলার পেছনে অবশ্য যুক্তি আছে প্রচুর। দেশে মানুষের হাতে সে সময় ক্যাশ টাকা থাকত খুব কম। আশির দশকের আগ পর্যন্ত বড়ো ভাইয়ের বিদেশি দূতাবাসের চাকরির কারণে আমাদের বাড়ীতে ক্যাশ ইনফ্লো ছিল সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। ক্যাশ ইনফ্লো জীবনে এক ধরণের স্বাচ্ছন্দ্য ও সাচ্ছল্য এনে দেয়। অবশ্য, সেই সঙ্গে খরচ করার মানসিকতাটাও থাকতে হয়! সেই মানসিকতার কারণেই,হাই ডায়েবেটিস-হাই ব্লাডপ্রেশার নিয়েও কী মহা উৎসাহে আম্মা সারাদিন রান্নাঘরে বসে নানা পদের খাবার তৈরি করতেন! আমার বন্ধুরা ঠাট্টা করে প্রায়ই একটা কথা বলত, আমাদের বাড়ির পুডিং ছুঁড়ে মেরে নাকি মানুষ পর্যন্ত ঘায়েল করা যাবে! আম্মা দেখতে ছিলেন, রূপকথার রাজকন্যার মতো সুন্দর। চুলার আঁচে,তাঁর নাক-গাল-চিবুক টম্যাটোর মতো লাল হয়ে যেত তবু তাঁকে কখনো ক্লান্ত-বিরক্ত হতে দেখিনি! মুখের হাসিটি ছিল, সদা অমলিন। রাজধানীতে তখনো প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ শুরু হয়নি। কেরোসিন তেলের চুলো বা পাম্প দেওয়া স্টোভেই রান্না সারতে হত। কী যে দুর্বিষহ ছিল সেই প্রক্রিয়া! প্রায়ই রান্নার মাঝপথে কেরোসিন যেত ফুরিয়ে কিংবা চুলোর ফিতে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যেত। আর,সে রকম মুহূর্তে আমার কদর যেত বেড়ে। আমার খোঁজে দিগ্বিদিকে দূত বেরিয়ে পড়ত! তারের মধ্যে সুতো গেঁথে, সেই সুতো দ্রুততম সময়ে চুলোয় ঢোকানোতে আমি ছিলাম একজন এক্সপার্ট। স্কুলে,সুঁইতে সুতো ঢোকানোর খেলায় আমি বরাবর প্রথম হতাম! ... ...
অইযে চৌধুরী সাহেব, অইযে তার বিরাট বাংলো, অইযে সাহেবের নাতনী, প্রেম করে এক চাকরের সঙ্গে। চৌধুরী সাহেব তার নাতনীর জন্মদিনের পার্টি দেন। লোকেরা আসে, নাতনী গ্র্যান্ড পিয়ানোতে গান বাজায়। বেয়ারা থালা হাতে মদ বিলান। আর না হলে অইযে ছেলেটি, প্রেমে খেল দাগা। তার হবু শ্বশুর, জালেম দুনিয়া পাপের সংসার! ছেলেটি রাগে দুঃখে মদ গেলে , বৃষ্টিতে গান গায়। মাইয়টা তবে কি করবে? সেও শাওয়ারের নীচে একটু দুঃখী ক্লিভেজ দেখায়। আবার ধরেন সৎ পুলিস অফিসার নতুন থানায় এসেই, ভেঙে চুরে দেন সকল চোলাই কারখানা। এই সবই হয়। নায়িকার বাবা মদ খায়, কারণ এইটা তার স্ট্যাটাস। নায়কের বাবা খাইলে হয় স্ট্যাটাস নয় তো পাড় মাতাল, চুল্লুখোর। নায়ক খায় দুঃখে, প্রেমিকা ভাগসে তবে গেল মদ, এই সন্ত্রাসী জীবন আর ভাল্লাগে না তবে গেল মদ, দুই একটা গানও গাওয়া যায়। অইযে দারুণ মধ্যবিত্তের নায়ক রাজ্জাক মদ গিলে বলে মাতাল নই, বেঈমান বল বেঈমান। আর না হলে অই নিন্মবিত্তের আসল পুরুষ মান্না, এংরি ইয়াং ম্যান, মদ গেলে লাইক আ হাঙ্গরী ম্যান। বুকের জ্বলা নিভান। আর ছোট বেলায় শুনে ছিলাম, নায়ক জাফর ইকবাল নাকি পানির কাজ মদ দিয়ে চালাতেন। আমি মনে মনে ভাবতাম, ও তাহইলে সচু (শৌচ), আর গোসল বোধয় অই মদ দিয়েই করতেন। আর ভিলেনরা তো মদ এমনি এমনি খান। জাম্বো মদ খায় রেইপ করে। এটিয়েম সামসুজ্জামান, গ্রামের মোড়ল বেশ্যা বাড়ি যায়, মাল খায়, আর সুন্দরীরে চায়। রাজীব শহুরে বারে যান, টয়োটা হাঁকিয়ে নায়িকার বাড়ি যান। আর অই শ্রমিকশ্রেণী তো মাঝে মাঝেই গিলে, মোটর শ্রমিক, কি নৌযান শ্রমিক, এইসমস্ত ‘ছোটলোকের বাচ্চারা’ বাংলা গিলে। ... ...
তামাকু এবং অহিফেন সেবনের নেশা বাঙালির দীর্ঘকালের সঙ্গী ছিল। এখন বরং কিছুটা কমেছে। ভাল আফিং - তামাক পাওয়াও যায় না। কলিকাতার সিমলা পাড়ার দত্তবাড়ির ছেলে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ একদা হুঁকো তানলে জাত যায় কিনা দেখার অভিলাষে ছেলেবেলাতেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। পোস্তর ঢেড়ি ভেজানো জলপান করতে আমরা আমাদের অনেক দাদু ঠাকুমা - দিদিমাদের ও দেখেছি। এখনও সস্তায় এমন নেশা করা যায় মানালি বা আফগানিস্তানের গাঁজা ( গ্রন্স নামে ও যার সুখ্যাতি) অবশ্য বহুমুল্য এখন। একদা সাধু সন্ত বাউল থেকে শুরু করে, শিল্পীদের মধ্যে গঞ্জিকা সেবন, পঞ্চমুখী কল্কেতে টান দিয়ে আগুন তুলে দেওয়া বিখ্যাত ছিল। শহরের উল্লেখযোগ্য কবি ও ইন্টেলেকচুয়াল রূপচাঁদ পক্ষীর নামও আমরা জানি। নাম বদলের চেষ্টা করলেও গাঁজা পার্ক আজও স্বমহিমায় অবস্থান করছে। কিন্ত গেঁজেলদের সংখ্যা খুব একটা বেড়েছে বলা যায় না। ছাত্রাবস্থায় মধ্যবিত্ত বাঙালি, হয়ত অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য শুখা নেশায় বহুলাংশে অভ্যস্ত ছিল। গাঁজা- ভাঙ- চরস- চণ্ডু -মাজুম - ফুটুস- বাদামী চিনি, স্ম্যাক-ক্র্যাক প্রভৃতি নেশারও বেশ চল ছিল। মধ্যবিত্তের বিকাশ ঠিকমত হচ্ছিল না বলেই, অভিভাবকরা সন্তান সন্ততিদিগের পর্যাপ্ত রাহা খরচ জোগাতে না পারায় - কালির সিরাপ, ফিনাইল- ডেনড্রাইট জাতীয় বস্ত শুঁকে নেশা করার রেওয়াজ এখনও চালু আছে। সেদিক থেকে মদ্যপানের নেশায় খরচও বেশি হয়। বঙ্গজীবন থেকে গত চার দশকে অন্তর্হিত হয়েছে বুনিয়াদী এবং কোয়ালিটি শিক্ষা, হয়তো নেশার বস্তুর প্রসারের কারণেই। শিক্ষায় জাতীয় স্তরে বাংলার স্থান এখন পিছন থেকে তিন নম্বরে। নেশার প্রসার তার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় পানশালা বা মদের দোকানের সংখ্যা যত বেড়েছে তার সামান্য ভগ্নাংশেও বাড়েনি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাঙালি রাজনীতিবিদ বহু চেষ্টায় সমর্থ হয়েছেন "অ্যাল-কোলাহল" তৈরি করে, নেশার চক্রে ছেলে-ছোকরাদের ভিড়িয়ে দিয়ে, তাদের, বিশেষত বাঙালিদের আরও অকর্মণ্য ও অলস করে তুলতে। গাঁজা প্রসঙ্গে একটি কহাবত লাগু আছে দীর্ঘকাল। তা হল "গাঁজা পীয়ে রাজা.... বিড়ি পীয়ে চোর"। ক্যানাবিস বা গাঁজার অপকারী দিকের তুলনায় উপকারী দিকই বেশি। আমাদের শিক্ষকমশাই প্রফেসর জি সি চট্টোপাধ্যায় তার ক্যানাবিস সংক্রান্ত সেমিনারে এই গবেষণার কথা তুলে ধরেছিলেন। আর মদ্য? ... ...
বড় ঘটনাবহুল গেল... কিছু মনখারাপ, কিছু অভিমান, কিছু আনারস সময়, কিছু মিষ্টি মারামারি, কিছু ঝগড়া, কিছু ভুল, এবং অবশ্যই এক ভালোবাসা সহ দুর্ধর্ষ দুশমন নিজস্ব শ্লাঘা খানের অতর্কিত আক্রমণ, অনর্গল ঘটতে ঘটতে কাটিয়ে ফেললাম গতজন্ম। বিরক্তিতে তিতির অপেক্ষায় ছিলাম, অনেক শিহর অনেক ম্যাজিক ও আলোদের ফটোগ্রাফ কোন খবর না দিয়ে বেজিঝক চলে এলো। সঙ্গে তার দুই ভাই, বেইন্তেহা আর বেপনাহও ছিল। আমার বড্ড বাসি হলো রে, মায়া ও মায়াবী দুজনেই হলো। এক মানুষ লম্বা স্থান অধিকার করে আছি, শুধু এই কারণেই কত নতুন মানুষ হলো আমার। গর্বের জন্য মিনিমাম কোয়ালিফিকেশান অনেকটা বেড়ে গেল। আমি যে এক বিচিত্র ঘটনা, তা খুব একটা অজানা নেই আমার। তবু এ্যাতো এ্যাতো জনের অপরিচয় কেটে গেল, ভাবা যায়না... সেই ফাঁকতালেই খুঁখার উগ্রপন্থী শ্লাঘা খান ঢুকে গেছিল... চৌকন্না থাকতে হয় খুব.... তবে চৌকন্না ছিলাম বলেই বহুদূর থেকে ভেসে আসা এক জিনিয়াসিনির স্পর্শে ফিসফিস হয়ে গেলাম....কিছু পরে তাও নয়, খালি ঠোঁটনৃত্যের সাহায্যে বাজে বকা নামিয়ে রাখলাম তার পায়ে... কিন্তু কী বিতিকিচ্ছিরি এই মানবমনের সংস্কার, একজন ঠোঁটনৃত্য বা ফিসফিস করলে অন্যজনও ফিসফিসে মগ্ন হয়ে যায়। কী আপদ, এতে যে ভেঙানো হচ্ছে বোঝে না?? ... ...
মহাশয়, আমাদিগের কপালে পাকিস্তান হইয়াছিল কেন তাহা লইয়া কত কথাই না শুনা যায়। শুনা যায় মোগলদিগের সহিত কোচবিহারের মহামান্য নৃপতির যুদ্ধ হইয়াছিল। মোগলের প্রতিনিধি রংপুর ঘোড়াঘাটের নবাব সৌলৎ জং এসে আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়নকে ঝাড় সিংহেশ্বরের প্রান্তরে লড়াই করে হারিয়ে দিল এক কালে। সেই যুদ্ধে আমাদিগের মহারাজার অন্দরমহলের বিভীষণ এক জ্ঞাতি ভাই দীনেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনের লোভে মোগলদিগের সহিত গোপনে যোগাযোগ করেন। এবং আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণ পরাস্ত হন ঝাড় সিংহেশ্বরের যুদ্ধে। সেই লোভী জ্ঞাতিভাই দীনেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসায় মোগল সম্রাটের তরফে ঘোড়াঘাট-রংপুরের নবাব সৌলৎ জং। কিন্তু পরের বছরই আমাদিগের পরাজিত মহারাজা আবার যুদ্ধ করেন ভূটান রাজার সাহায্য লইয়া। এবং তাঁহার জয় হয়। জয় হয় বটে কিন্তু কিছু মৌজার প্রজা নাকি সাবেক শাসক মোগলদের প্রতি তাঁহাদের আনুগত্য বজায় রাখেন। কেন, না তাঁহারা নাকি মোগল সৈন্য ছিলেন। প্রথম যুদ্ধের পর মোগলের হাতে কোচবিহার গেলে এই সমস্ত অঞ্চলে বসবাস করিতে থাকে মোগল সৈন্যদের কিছু অংশ। মোগল প্রতিনিধি রংপুরের নবাবের নিকট তাঁহারা খাজনা দিতে থাকেন। কোচবিহারের মহারাজা তাঁহার উদারতায় এই বিষয়ে আর দৃকপাত করেন নাই। সামান্য কয়েকটি গ্রাম যদি খাজনা না দেয়, কী যায় আসে। আমাদিগের পূবর্পুরুষ মোগল সৈন্য ছিল কি না জানা নাই, কিন্তু কৃষিই ছিল তাঁহাদের মূল জীবিকা তা আমাদিগের অবগত। স্বাধীনতার পর রংপুরের নবাব যেহেতু পাকিস্তানে মত দান করেন, সেই কারণে ভারতে থাকিয়াও আমরা পাকিস্তানি হইয়া গেলাম। ইহাতে আমাদিগের দোষ কী? আমাদিগের কাহারো কাহারো নিকট রংপুরের নবাবের প্রজা হিসাবে খাজনার রসিদ রইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহা স্বাধীনতার আগের কথা। স্বাধীনতার পর আমরা আর খাজনা দিই নাই রংপুরে গিয়া। আমরা কোচবিহার রাজাকেও খাজনা দিতে পারি নাই, কেন না রাজার প্রজার তালিকা হইতে আমরা বাদ ছিলাম সত্য। ... ...
সেদিন সকাল থেকেই মনটা কু গাইছিলো। কারখানা বন্ধ থাকায় কাজে যেতে হয়নি। আগের দিন মালফাল খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরলাম। মা ফালতু বাওয়াল দিলো, যদিও ঘুমচোখে বেশিক্ষণ টের পাইনি। সকাল থেকেই মাথাটা টলছিলো। বমি। বিকেলে ওরা ডাকতে এলো, ভাসানের প্রসেশন। একটু গুমোটের মত ছিলো দিনটা, আকাশটা ঝুলে নেমে এলে যেমন হয়, মেঘলা দলা দলা চিটচিটে আকাশ। আমার জানার কথা না, জানিওনা, যে এইরকম লিকুইড বোতলে ভরে বোমা বানানো হয়। কিন্তু আমি না জানলেও ঐ লোকটা জানতো। ফিনিশ-সোভিয়েত যুদ্ধের কথা, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গান্স কম পড়ার কথা, সে সালা ঊনিশশো ঊনচল্লিশ-চল্লিশের ঘটনা। লোকটা অত জানে, তবু পুজোকালের দিকে টেলিফোন বুথে দাঁড়িয়ে টাইমপাস করছিলো। কপাল মাইরি! অথচ আমার দেখা অল্পস্বল্প পাসফাস করা লোকজন দিব্যি বউবাচ্চা নিয়ে ভাসান দেখে চাউমিন খেয়ে নালেঝোলের জীবন কাটিয়ে গেল। যাই হোক, ফিনিশ শুনে আমার হেভি হাসি পেয়েছিলো। মজার নাম, না? ফিনিশ! সেদিন আরেকটু হলেই আমিও ফিনিশ হয়ে যাচ্ছিলাম। মুখে পেট্রলটা নিয়ে সবে ছুঁড়তে যাবো, আড়চোখে দেখি বেগুনি সালোয়ার পরে একটা মেয়ে, সাধনদার শালীফালি হবে মনে হয়, হাসছে। ব্যস, পেটে চলে গেল একঢোঁক। তখনই বসের সাথে আলাপ। হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছিলো। ... ...
হিন্দুরা বলেন লঙ্কা দ্বীপে রাবণের তোরণদ্বার খোলার সময় ঐ শব্দ হয়। মুসলমানেরা বলেন ইমাম মেহেদীর আগমন জনিত কারণেই ঐ শব্দ। হিস্ট্রী অব বাকেরগঞ্জের লেখক বেভারীজ সাহেব সিদ্ধান্তে এসেছেন যে জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে ঝড়ের সময় এই শব্দ চারবার শোনা যায়। উনি স্থির করেছেন এর পেছনে বায়ুমন্ডলের কোনো বৈদ্যুতিক ঘটনার যোগ রয়েছে। তবে প্রবল তরঙ্গাভিঘাতের জন্যও এই শব্দ হতে পারে। এ বিষয়ে আরো বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন। ক্রমশঃ আরো রাত ঘনায়। মোকাম আবাদী জুড়ে চলাফেরা বাড়ে। রুপোলী আঁশ মাখা জাল নিয়ে জেগে ওঠে চরমমতাজ। হোগলা কুটীর ছাওয়া ঘর দোর উঠোন আদুল গায়ে মাখে রাত। হাজার হাজার অশরীরী ছুটে চলে জলাভূমি, নদীঘাট, বর্ষা বাদল পেরিয়ে ভাটার সাগর। তারপর এ দ্বীপ ও দ্বীপ সে দ্বীপ… ... ...
ন’টা বেজে গেছে, পাশে কিউবিক্ল থেকে মন্দিরাদি বেরিয়ে গেল। সিং আর অরূপ বেরোচ্ছে এবার। আনোয়ারা আর নতুন সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েটা কি একটা ইয়ার্কি মারতে মারতে খিলখিল করে যাচ্ছে গেটের দিকে। রায়বাবু আবার মুখ ভ্যাটকালেন, এটা অফিস না ফাজলামো মারানোর জায়গা – ইশ, ব্যাটার মুখ ভীষণ বাজে, মারানো ফারানো ভদ্রলোকের কথা? কস্তুরী বলল, স্যার, আমি যাই? রায়বাবু বললেন, যাবে? পাগলা নাকি? কাজ শেষ করেছ? তোমার এন্ট্রিগুলো কি আমার পিসি এসে করে দেবে? হাত চালাও হাত চালাও – কস্তুরী বলল, স্যার, এরপর বাস পাব না। রায়বাবু বললেন, পাবে পাবে, অনেক রাত অবধি বাস চলে। নাও, হাত চালাও ঝটপট। তোমার চাকরি থাকল কিনা তাই নিয়ে আমার বিশেষ চিন্তা নেই। তবে তোমার জন্য দেখছি এবার আমারটা যাবে। হাত চালাও বললেই তো আর চলেনা, কস্তুরী কী বোর্ডে আঙুল চালাতে চালেতে ভাবতে লাগল, দামানিয়া অ্যান্ড কোম্পানীর কাজটা ছাড়লাম কেন? মাইনে অনেক বেশি ছিল। হপ্তায় অন্ততঃ দুদিন মাছ খাওয়া যেত। কামাল বলে লোকটা পেছনে এসে দাঁড়াত প্রথম প্রথম। ক’দিন পর ঝুঁকে কাঁধে হাত দিয়ে এন্ট্রি বুঝিয়ে দিত। তারপর যেদিন কাঁধ থেকে হাত আস্তে আস্তে নীচে নামতে লাগল, কস্তুরী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের জোরে এক ধাক্কা দিয়ে একদলা থুথু মুখ থেকে থু – করে ছুঁড়ে দিয়েছিল তার মুখে। তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে এসেছিল অফিস থেকে। ইশ, পঁচিশ দিন মত কাজ হয়েছিল, মাইনেটাও পাওয়া যায়নি। সেদিন মেট্রোয় দামানিয়ার সঙ্গে দেখা। বলল, আরে লক্শমী, তুমি কাম ছোড়ে দিলে কেনো, একবার তো বোলবে কী পরেশানি? কস্তুরী বলল, আমি লক্ষ্মী নই। দামানিয়া কক্ষনো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা, তাকাবার আরো কত জায়গা আছে, বলল, হাঁ হাঁ, তুমি বন্দনা, ইয়াদ হোলো। কোথাও জয়েন না কোরলে এসো একদিন – ... ...
পালানোর আরো জায়গা আছে। রিমঝিম নিজেদের ভাড়াফ্ল্যাটের বারান্দায় পালায় । বারান্দার গ্রিলের ফুটোগুলো বড় বড়। বাইরে গাছ, টুকরো আকাশ। তারে তারে মেলা কত না রঙের কাপড়, ওবাড়ির, সেবাড়ির। গাছে গাছে কতরকমের শেডের সবুজ পাতা, এলোমেলো, লাট খায়। তেমনি সব বারান্দাগুলো থেকে নিচে ঝুলিয়ে রাখা তারে শার্ট, প্যান্ট, ম্যাক্সি, এমনকি শীতের দিনে শাল কম্বলও, রঙ্গিন। ওখানে একবার গিয়ে পড়লে পালানো সোজা। কেউ বুঝতে পারবে না। দেখবে রিমঝিম বাড়িতেই আছে, বারান্দায় কাপড় মেলছে। অনেকক্ষণ ধরে কাপড় মেলছে তো মেলছেই । কেউ কিচ্ছু বুঝবে না। দেখবে রিমঝিম টুকরো, ফ্যাকাশে আকাশটার দিকে তাকিয়ে, নিভু নিভু শীর্ণ ডালটায় কচি সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে চুল মুছছে, চুল ঝাড়ছে, ঝাড়ছে তো ঝাড়ছেই। আসলে তো তখন রিমঝিম পালাচ্ছে। বাথরুমে স্নানে ঢুকে রিমঝিম বড় করে কল খুলে দিয়ে পালায়। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে পালায়। ঝর ঝর করে গায়ের উপরে ঝরতে থাকে জল, আর রিমঝিম তখন কোথায় হারিয়েছে। বড় বড় পাহাড় আর ঝরনার সামনে , সেই এক সবুজ, নরম পৃথিবীতে পালিয়ে গেছে। ছোট্টবেলায় দেখা লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপনের মেয়েটার মত হয়ে। ... ...
মুগ্ধ করছে, ডর নাই জানে! কথাটা ভিন্নতর ভোল ডলফিনের কানে কানে একদিন দুঃস্বপ্নে বলেছি হাত-জোড় করে! জানিয়েছে, মহারথী মহা এক শোল ফুরিয়ে আসছে তারও সময়দীপন। তার জন্য কেঁদেছি, তাতে কিবা লাভ! সমস্ত লোকসান মানেই তিজারা, তাতেই লাইসেন্স মেলে গম্যতার গম ও লূতার। কীচকের সূরে খসে পরিশ্রান্ত যত-তত আধোলীন তারা র্যাদা ঘষে ঘষে ঘাম ফ্যালে বিহ্বল সিনিক ছুতার। কি দেখব এসব! বিপণিরচিতা, সংঘ-মেদ, পাষণ্ড নুনু নিম্নগ মাটির টানে, চায় কি ও ঢুকে যেতে, মরে যেতে সেথা? কর্ণবিলাস, তার কাজ হল শুনে যাওয়া রুচিরাক্ত নীপার ঘুঙুর সেত্তেনত্রিয়ন আর জ্বলবে না, তাই বুকে ব্যথা? ... ...
বাঙালি চলেছে বাগানে। রিলকের ভাষায় মাধ্বী মহোৎসবে! দূরন্ত তাদের সাজ। কফ ও কলারওয়ালা কামিজ। রূপোর বকলস আঁটা শাইনিং লেদারে যেন মুখ দেখা যায়। রেস্ত যাদের কম, তাদের পায়ে ইন্ডিয়া রাবার ও চায়না কোট। এলবার্ট ফ্যাশানের বাঁকা টেরি তে কাটা সিঁথি। উত্তুরে হাওয়া যদি দেয় তবে ক্রেপ বা এন্ডির চাদরও।সদ্য পাশ হওয়া আইনের চুলোর দোরে আগুন। মদের দোকানের সদর দরজা সন্ধ্যের পর বন্ধ, তো হয়েছেটা কী? সেই দুঃখে বঙ্গপুঙ্গবেরা কি খালি হাতে ফিরবেন নিজ গৃহে? নিজ শয্যায়? নিজ স্ত্রী সান্নিধ্যে? এমন অলুক্ষুণে কাজ হয় নাকি বাপু! না, খদ্দেররা খালি হাতে ফিরছেন না। পাঠক এ সেই সুসময়, যার বর্ণনায়, টেকচাঁদ ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘কলিকাতার যেখানে যাওয়া যায়, সেইখানেই মদ খাওয়ার ঘটা। কি দুঃখী, কি বড় মানুষ, কি যুবা, কি বৃদ্ধ সকলেই মদ পাইলে অন্ন ত্যাগ করে’। জোড়াসাঁকোর ঠেকের দরজা খোলা অনেক রাত পর্যন্ত। মেছোবাজারেরও। সর্বত্র ফরফর করে ফুটছে ইংরেজি মিশেল বাংলার খই। ফুটছে রাতচরা হুল্লোড়, বটকেরা। শৌখিন কুঠিওয়ালা সাহেবরা একটু জলযোগ সেরে বসেছেন এস্রাজটি নিয়ে। রেস্তহীন গুলিখোর গেঁজেরল মাতালরা আর করে কী। লাঠি হাতে তাদের অনেকেই কানা সেজে ঘুরছে মৌতাতের সম্বলটুকু খুঁজতে। ‘অন্ধকে কিছু দান করো গো বাপ’ – তাদের সেই করূণ কন্ঠস্বর ছাপিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দুপাশের বাড়ীর কিছু খেমটার তালিমের আওয়াজে। তা তা ধিন তা। শনিবার মহারাত এগোচ্ছে রবিবার ভোরের দিকে। সুতানুটির পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসে মিলে মিশে গিয়েছে কোহল, বেলি আর আতরের গন্ধ। ... ...
শৈশব ব্যাপারটা নিয়ে আমার বিশেষ আদিখ্যেতা নেই। গেছে- বাঁচা গেছে, আপদ গেছে। বাঙালির শৈশব(অন্তত আমি যখন শিশু ছিলুম) তো ঠিক অ্যালিস বা চার্লির শৈশব নয়। কোনও নার্নিয়ার গপ্পো নেই। শিশু অর্থাৎ বারোয়ারি দুচ্ছাই! যেই না সিলিং-এর নুরনকশায় একটা হিজিবিজবিজ দেখতে পেয়েছে, অথবা ব্যাকরণ শিং-এর সঙ্গে দু’দণ্ড আপন মনে কথা বলতে বসেছে – সবে মনে হয়েছে, দূর এইখানটায় হ য ব র ল ফেল, আমি হলে তো এইটা বলতাম – সাতপাঁচ ভেবে যেই না খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠতে যাবে,অমনি কোথ্থেকেকে এক হুমদো কাকীমা এসে, ‘ওমা! আপন মনে কী বিড়বিড় করছিস?’ বলে গাল টিপে দিয়ে চলে যাবে। তুমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছ তাতে কারও কিছু যায় আসে না, তোমার কোনও নির্জনতা নেই। সর্বক্ষণ গোটা দুনিয়া তোমার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে, তুমি উলঙ্গ, ল্যাংটো। তোমার যে কোনও নিরিবিলিকে, একলাযাপনকে দুনিয়ার সামনে বেপর্দা করে দেওয়া যায়। বাবা সিগারেট খাওয়ার সময় বলবে, ‘বড়রা খায়’; চপ-মুড়ি খেতে খেতে রোববারের সিনিমা চোখে মাসিমা বলবে, বড়রা দেখে; মধ্যকৈশোরে পা-রাখা দিদি বাড়িতে তুমি থাকলে আরামসে বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে নেবে, ফোনে বলবে; একা আছি’। তুমি নেই চাঁদ, তুমি আসলে একটা ছায়া। তুমি ভোট দাও না, দেশের সেবায় মিছিল করো না, বন্যাত্রাণ কি বিচিত্রানুষ্ঠানে চাঁদা দাও না, মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর করুণা কুড়োও না, তুমি জাস্ট নেই। ... ...