অইযে চৌধুরী সাহেব, অইযে তার বিরাট বাংলো, অইযে সাহেবের নাতনী, প্রেম করে এক চাকরের সঙ্গে। চৌধুরী সাহেব তার নাতনীর জন্মদিনের পার্টি দেন। লোকেরা আসে, নাতনী গ্র্যান্ড পিয়ানোতে গান বাজায়। বেয়ারা থালা হাতে মদ বিলান। আর না হলে অইযে ছেলেটি, প্রেমে খেল দাগা। তার হবু শ্বশুর, জালেম দুনিয়া পাপের সংসার! ছেলেটি রাগে দুঃখে মদ গেলে , বৃষ্টিতে গান গায়। মাইয়টা তবে কি করবে? সেও শাওয়ারের নীচে একটু দুঃখী ক্লিভেজ দেখায়। আবার ধরেন সৎ পুলিস অফিসার নতুন থানায় এসেই, ভেঙে চুরে দেন সকল চোলাই কারখানা। এই সবই হয়। নায়িকার বাবা মদ খায়, কারণ এইটা তার স্ট্যাটাস। নায়কের বাবা খাইলে হয় স্ট্যাটাস নয় তো পাড় মাতাল, চুল্লুখোর। নায়ক খায় দুঃখে, প্রেমিকা ভাগসে তবে গেল মদ, এই সন্ত্রাসী জীবন আর ভাল্লাগে না তবে গেল মদ, দুই একটা গানও গাওয়া যায়। অইযে দারুণ মধ্যবিত্তের নায়ক রাজ্জাক মদ গিলে বলে মাতাল নই, বেঈমান বল বেঈমান। আর না হলে অই নিন্মবিত্তের আসল পুরুষ মান্না, এংরি ইয়াং ম্যান, মদ গেলে লাইক আ হাঙ্গরী ম্যান। বুকের জ্বলা নিভান। আর ছোট বেলায় শুনে ছিলাম, নায়ক জাফর ইকবাল নাকি পানির কাজ মদ দিয়ে চালাতেন। আমি মনে মনে ভাবতাম, ও তাহইলে সচু (শৌচ), আর গোসল বোধয় অই মদ দিয়েই করতেন। আর ভিলেনরা তো মদ এমনি এমনি খান। জাম্বো মদ খায় রেইপ করে। এটিয়েম সামসুজ্জামান, গ্রামের মোড়ল বেশ্যা বাড়ি যায়, মাল খায়, আর সুন্দরীরে চায়। রাজীব শহুরে বারে যান, টয়োটা হাঁকিয়ে নায়িকার বাড়ি যান। আর অই শ্রমিকশ্রেণী তো মাঝে মাঝেই গিলে, মোটর শ্রমিক, কি নৌযান শ্রমিক, এইসমস্ত ‘ছোটলোকের বাচ্চারা’ বাংলা গিলে।
আর না হইলে ধরেন, অই মাসুদ রানা। বাঙালীর এমন নায়ক এর আগে কখনোই ছিল না। বাষট্টিতে আবির্ভাব। সবাইকে কাছে টানে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। এর আগের সাহিত্যের সকল নায়ক, কি পুতুপুতু রে! এই বারে এল অগ্নিপুরুষ। আজ এর সঙ্গে শোয় তো কাল ওকে কোলে নিয়ে বসে, আর পাউরুটি মাখনে গরম ছুরি। এই ধরেন, দু একটা গুন্ডা বদমায়েশ, অথবা কেজিবি, সিয়াইয়ে, মোসাদের কয়েকটাকে উদুম কিলিয়ে, পাঁচ তারা হোটলের বাথটাবে বসে, অর্ধেক ব্র্যান্ডি গিলে করে সবাড়। মদ আর মস্তিতে মস্ত সেয়ানা। বাঙালীর নায়কের ধারণা একদম পাল্টে গেল। তার পর থেকে মদ দুঃখে নয় সুখেও খাওয়া যায়। দেবদাসের বিজ্ঞাপন আর কাজ করল না। আর ধরেন অই সময় মানে অই ষাট কি সত্তুরের দশকের, চুল লম্বা, দাড়িওয়ালা কবিগণ, অথবা এল্বার্ট ছাঁটে ঢাকার ঝকঝকে তরুণ, এদের মদ খাওয়ার ইতিহাস কারো অজানা থাকার কথা না। অই যে রেক্স কিংবা আরযুতে সন্ধ্যার আড্ডার পরে, কেউ যায় বাংলায়, কেউ যেত বিলেতে। অই তাদের কবিতা, গল্প, আত্মজীবনীতে এই মৃত্যুসঞ্জীবনী সুধার ইতিহাসও পাওয়া যায় যত্রতত্র। শামসুর রাহমান লেখেন—
“মদের নেশা খাঁটি সারা জাহানে,
বাকি যা থাকে তার বেবাক ঝুট।
বাঘিনী যেন সেই মেয়েমানুষ,
যার আঁধারে কাল কেটেছে রাত”।
( কবর-খোঁড়ার গান, ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’,১৯৬০)
“কিছুই খাব না আজ, যে-কোন আহার্যে ভয়ানক
অরুচি আমার।
কাল সারারাত আমি তারা স্রোত আর এক একর অন্ধকার
আকন্ঠ করেছি পান, রাত্রিকে নিয়েছি শুষে; আজ
আমাকে বিরক্ত করবার কোন মানে নেই, দ্যাখো
স্বস্তিতে কোথাও ব’সে থাকা দায়। একটি রাত্তির
স্মৃতিতে কেবলি দিচ্ছে হানা, যে-সৌন্দর্য চেতনাকে
নিমেষে ঝলসে দেয়, তাকে পান করে সংজ্ঞা প্রায়
লুপ্ত হয়েছিল,
মনে পড়ে। ........................”
( হ্যাঙওভার, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ১৯৭৭ )
আর ইলিয়াসেরর গল্প উপন্যাসের নানান যায়গাতেও মদ উপস্হিত। খোয়ারি মানে যে হ্যাঙওভার ঐ গল্পটা পড়েই জেনেছিলাম। তারপরে ওঁর ডায়েরিতে কবে যেন পড়েছিলাম ভ্যাট সিক্সটি নাইন দুপুর ব্যালাতেই শেষ হয়ে গেল, হয়ত অই সুন্দরবন ভ্রমণের সময়।
মুসলমান দেশে মদ নিষিদ্ধ পানীয় হলেও মদ খাওয়া যে একেবারে বন্ধ তা বলা যায় না ঠিকঠাক। একসময় প্রায় সকল থানাতেই একটা করে চোলাই মদের দোকান ছিল। মানে দেশি আরে মানে ঐ বাংলারই দোকান ছিল। এখন আছে কিনা জানা নাই। টিপুসুলতান রোডেরটা কয়েকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেল। দোকানটা ছিল রাস্তার একদম মাথায়। কেনা যেত সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। কিনলে দিত সরকারি চালানপত্র। তবে রাত হলেই ভিড় বাড়ত, অইখানেই ব্ল্যাকে বিক্রি হত, পাঁইট পাঁইট। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয়, লোকেদের ঢুলুঢুলু চোখ, হোমিওপ্যাথি অষুধের মতন গন্ধ ভরা রথ খোলার মোড়। আর ক্রিয়েটিভ খিস্তি-খেউড়। এই দিকে মানে রথখোলার অপর পাশে দুধের আড়ৎ। যেন দুধ বেচে মদ আর মদ বেচে দুধ খাওয়া যায়। আর ঈদ এলে তো কথাই নাই! সারা মাস রোযা রাখার পরে চানরাইতে ব্যাবসা হুলুস্থুল! এই পুরনো ঢাকায় লোকে ঈদের আগে, ঈদের দিনে বা তার পরের দিনে লোকে অযুহাতে মদ গিলে। লোকে মানে অই তরুন সম্প্রদায়। পুরান ঢাকার বারগুলোতে অবশ্য মাঝে মাঝে দাড়িয়ালা হুজুরদেরও মদ খাইতে দেখা যায়।
নর্থ-সাউথ রোডের বারটার নাম পূর্বাশা। কিন্তু লোকে যেন না বুঝে তাই বলতাম ফুপুর বাসা। অইটাকে প্রয়শই আমার জ্যান্তব বার মনে হয়। লাল রঙের মর্ডানিস্ট সোফা, কাউচও বলা যেতে পারে। আধো আলো আধো অন্ধকার। একটা টিভি এত্ত উচুতে যেন, মাতালের হাত না পড়ে তাতে। দেয়ালে আবার মোযাইক গ্রাফিত্তি। অইযে পারস্য দেশীয় প্রেমিক তার প্রিয়াকে দেয় লাল গোলাপ ফুল। অইখানে আসে সব লুঙ্গী পড়া লোক। লুঙ্গীর সাথে উপর নির্ভর করে যারা লোকের অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাস করেন, তারা তফাতেই থাকবেন। কারণ এইখানে আসে সকল, লোহা তামা, কাঁসা ব্যাবসায়ী। আগে লুঙ্গীর ভাঁজে কাড়ি কাড়ি টাকা থাকত , এখন হয়তো ক্রস চেক নাহ বেশির ভাগই এখন এটিয়েম কার্ড। এইখানে মদের উপর ২০০% ট্যাক্স। তাই জঘন্যটার দামও চড়া। অই সিনেমাটিক রিয়েলিটি আরকি। সিনেমাতেও বড়লোকে খায়, আর বাস্তবেও অই বড়লোকেই খায়। মদ গেলাটা যেন সাব কালচারের মতন। অনেকেই খায়, কিন্তু আউয়াজ করে না। সন্ধ্যা, রাতে টলতে বাড়ি ফেরা লোকের সংখ্যাও কম না। সপ্তাহান্তে একটু মেরে তারপরে বাড়ি ফেরা এই যা। অথবা পার্কে, সদর ঘাটের আনাচে কানাচে, আর বাড়ির ছাদে। অই হাভাতে বাঙালি বলে একটা কথা আছে না, তাই লোকে মাতাল হওয়ার জন্যই মদ খায়। তাঁতি বাজার, কিংবা শাঁখারি বাজারে, এখনও বাংলার জয় জয়কার। সেই ৮০ দশকের সন্ত্রাসী লাল বাবু না কি যেন, তারও বোধয় একটা বাংলার ভাটি ছিল দয়াগঞ্জের বাজারে। আর টিপু সুলতান রোডের ভাটি খানাটা ছিল রব সাহেবের। আমাদেরই প্রতিবেশি, মেলা দুর্নামও ছিল তার।
পাড়ার যে আকবর মামা (অন্য নামও হইতে পারে), বিহারি লোকটি, রাতের বেলায় ছাদে বসে হারমনিয়াম বাজিয়ে পুরানো হিন্দী গান গান, কথা বলতে গেলে, মুখ থেকে ভক ভক করে বেরিয়ে আসত গন্ধ। অথবা আরমানের বড় ভাই দিনে দুপুরে, অর মারে চুদি বলতে বলতে যোগীনগরের মোড়ে হেলে দুলে পড়ে যায়, মাথায় কিন্তু টুপিটি তক্ষনও বর্তমান। আমরাও কত রাত টহল দিয়েছি, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, লারমিন স্ট্রিট।
এখন তো পুংটা পুলাপান বোতলের সঙ্গে তোলে সেলফি। আর মুনেম ওয়াসিফ তার ‘ইনি গড উই ট্রাস্ট’ গল্পের ছবিতেও দেখা যায় ওয়াইনের বোতলের পিছনে বসে থাকা একজন নারী। তা সব লোকেই খায়, বড়লোকে ফরেন লিকার, আর ছোটদের বাংলা। কিন্তু বাঙালীতো, খেয়েই চিৎপটাং ওরাংওটাং!