আমরা যখন বড় হই তখন বিএনপি জামাত ক্ষমতায়। ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় তবুও দাপট ছিল বিরোধী দলের। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসল বিএনপি জামাত জোট। এইটা এখন বলে বুঝানো যাবে না যে একটা দল বা জোট জিতে কেমন বিভীষিকা চালাতে পারে দেশ জুড়ে। শত শত হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ হল, লুট হল, ধর্ষণ হল। পূর্ণিমা ধর্ষণ সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা। যার মা ধর্ষকদের বলেছিল বাবারা তোমরা একজন একজন করে আস, আমার মেয়েটা ছোট! উফ! কী কুৎসিত সময়! আমারা এই সব দেখে সহজেই আমাদের পথ ঠিক করে নিতে পারছিলাম। ওই দল, ওই জোট আমাদের না এইটা পরিষ্কার বুঝে গেছিলাম। এর আগ পর্যন্ত বুঝিনি, এইটা একটা দল ওইটা আরেকটা দল, এই তো! তীব্র ঘৃণা তৈরি করে দিতে সাহায্য করছিল সেই সময়ের জামাত বিএনপি জোটের সব কাজকর্ম।
এরপরে দেখলাম জামাতের শীর্ষ নেতাদেরকে মন্ত্রী বানানো হল। তারা আবার চিহ্নিত রাজাকার। আমার মনে আছে আমাদের শেরপুরের নিউ মার্কেট মোড়ে বিশাল জন সমাবেশ। কামরুজ্জামানের সাথে কে কে ছিল মনে নাই তবে আলী আহসান মুজাহিদ ছিল। তার সে কী আস্ফালন! সরাসরি হুংকার দিচ্ছিল মাইকে। এইটা ২০০৮ সালের নির্বচনের সময়ের ঘটনা সম্ভবত। আমাদের বিচার করবে? করেন কত সাহস আছে আপনাদের! এমন সব কথা। এগুলাও আমাদেরকে, আমাকে পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করছে। এগুলা দেখে শুনে বড় হয়েছি। এখন আমার বুক সেলফে যত বই আছে তার মধ্যে অনেকখানিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উপরে বই। মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ার একটা কারণ জাফর ইকবাল। তিনি একটা লেখায় লিখেছিলেন যে অল্প বই পড়ে যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায় কেউ তাহলে এই চারটি বই পড়তে হবে, বলে তিনি চারটি বইয়ের নাম দেন। আমি যখন বই কেনা শুরু করলাম, তখন ওই লিস্ট ধরে চারটা বই কিনে নিলাম। এই শুরু হল আমার মুক্তিযুদ্ধের উপরে বই পড়া।
বিএনপি জামাতের আমলে পুরো দেশ জুড়ে বোমা হামলা হল, সিনেমা হলে বোমা হামলা হল, রমনা বটমূলে বোমা হামলা হল, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হল! বিএনপি সরকার সব ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে গেল। দেশে কোন জঙ্গি নাই, সব মিডিয়ার সৃষ্টি এই সব বলা হল। এগুলা দেখতে দেখতে বড় হলাম আর এই সবও এই জোট, এই দলের প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে সাহায্য করল।
আমাদের প্রজন্মের অনেকের গল্পই এমন। কিন্তু সত্য হচ্ছে সময় বয়ে গেছে অনেকখানি। ২০০৮ সালে যে জন্ম নিয়েছে তার বয়স কত এখন? সে তো আগের কোন কথাই জানে না। তার জানার প্রয়োজন নাই। সে কেন আগে বিএনপি জামাত অত্যাচার করছে সেই গল্প শুনবে? সে দেখে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়, নানা নয় ছয় করছে আওয়ামীলীগ। যে ছেলে ২০১৪ সালে এসএসসি দিয়েছে সে এখন কী করে? সে দেখে সব শোষণ আওয়ামীলীগই করছে। তাদের নেতারাই লুটপাট করে খাচ্ছে। সব দোষ আওয়ামীলীগের। এই প্রজন্মের কাছে বর্তমানটাই শেষ কথা। সর্বশেষ ১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সময় কেউ কেউ আবার একটু চেতনা ফিরে পেয়েছিল। এরপরেও পার হয়ে গেছে প্রায় এক যুগ। তো যেটা হয়েছে তা হচ্ছে আমরা যেমন ওই সময় বিএনপি জামাত সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছিলাম, এখনকার এই বাচ্চা বাচ্চা পুলাপান এরা আওয়ামীলীগের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হচ্ছে, হয়েছে। হওয়ার ম্যালা কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, করবে না কেন?
মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামীলীগের কাছে এখন স্রেফ একটা হাতিয়ার, তারা মনে করে যখন প্রয়োজন পড়বে তখনই তারা এই হাতিরার ব্যবহার করবে। যদি সত্য সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাবান হত তাহলে জামাত এতদিনে নিষিদ্ধ হত, শিবির নিষিদ্ধ হত। এদেরকে লালন করাই হচ্ছে বিভিন্ন সময় এই সব জামাত শিবিরের কাজ বলার জন্য। ঢালাও ভাবে বলে যাও সব জামাত শিবিরের কাজ। দেশে যদি জামাত শিবির নিষিদ্ধ হয়, তাহলে তখন কার কথা বলবে? তাই নিষিদ্ধ করে দিব, করে দিব বলা হয় কিন্তু নিষিদ্ধ আর করা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে গর্ব করে সব সময় অথচ সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা পর্যন্ত করতে পারে নাই। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে পূর্ণ তালিকা! অসাম্প্রদায়িকতা এখন আওয়ামীলীগের একটা বুলি মাত্র! দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ইসলামিক দুনিয়া থেকে প্রবল চাপ আসছিল দেশকে ইসলামিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু প্রবল চাপ উপেক্ষা করে ধর্ম নিরপেক্ষতা ধরে রাখলেন। সেই দেশের সংবিধানের বর্তমান অবস্থা কী? অথচ জিজ্ঞাস করে দেখুন, অসাম্প্রদায়িক বলে নিজেদের জাহির করতে একটুও দ্বিধা করে না এরা!
যেটা বলছিলাম, বর্তমান এই পরিস্থিতি আরও তীব্র করে তুলল এই ঘৃণা। সরকার নতুন প্রজন্মের কাছে আর যেতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে। মহা পরাক্রমশালি আওয়ামীলীগ সরকারকে এই যন্ত্রণা নিয়েই চলতে হবে। ২০৪১ সাল পর্যন্ত যে ভিশন দেখানো হচ্ছিল তাতে এই আন্দোলন বড় ধাক্কা হয়ে লাগবে। এবার কোনমতে উত্তরে গেলেও কতদিন টিকে থাকতে পারবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
আমাদের হচ্ছে মহা বিপদ। আমরা যারা আওয়ামীলীগের কেউ না, কিন্তু নৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছি সব সময়। এই আন্দোলনে জাতির পিতা ইব্রাহিম, বঙ্গবন্ধু ঘোড়ার ডিম স্লোগান দেওয়া হয়েছে, এই আন্দোলনে আমি রাজাকার বলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, এখন দেখছি বর্তমান সংঘর্ষের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বলা হচ্ছে দেখুন, এতদিন আমাদেরকে কী মিথ্যা পড়ানো হয়েছে, ত্রিশ লক্ষ শহীদ মুখের কথা? মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে! এই সবই অসমর্থন যোগ্য কিন্তু তাই বলে ২০৭টা লাশ! ( গতকালের প্রথম আলো অনুযায়ী) এতগুলা মৃত্যু সব ম্লান করে দেয়, এগুলার কোনটাই একটা লাশের সমানও না!
বিপদ এখানেই শেষ না, বাংলাদেশ যে গ্যাঁড়াকলে পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য আবার আওয়ামীলীগের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে! কারণ এখন দেশের এই অবস্থায় অন্য যে কোন কিছুই বিপদের মাত্রা বাড়াবে বই কমাবে না। আবেগে অনেক কিছুই মনে হতে পারে কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এইটাই সত্য। আর এই সত্যটা বড় ভয়ানক সত্য। চোরাবালিতে আটকা বাংলাদেশ, কৌশলী না হলে, হুড়োহুড়ি করলে ডুবে যাওয়া ত্বরিত হবে আরও! আনিসুল হকের অন্ধকারের একশ বছর আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। বড় চিত্রটা দেখতে না পেলে বিপদ। দুনিয়া শুধুই সাদা কালো না, বাস্তব দুনিয়ায় ভালো খারাপের সংজ্ঞা বড় বিচিত্র। বাংলাদেশের জন্য এইটা আরও বড় রকমের বিচিত্র!
কী হবে না হবে আমি জানি না। আমিই কী করব তাও জানি না। আমি এইসবে অভ্যস্ত না। আমার জ্ঞান বুদ্ধি থমকে যাচ্ছে। অসহায় লাগছে নিজেকে। আমার নিজের জন্য এখনকার চাওয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চাওয়াটাই -
'তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে
শত্রু মিত্র নির্বিভেদে সকলের 'পরে।
স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো,
সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়ো।
স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো,
কোরো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।'
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।