এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কাইজার গান্ধী  

    Nabhajit লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩০৩ বার পঠিত
  • বের্নার কথা দীনেশ কে বলে আর লাভ নেই। বের্না জীবন থেকে সরে গেছে অনেক দিন। কলেজ শেষ করার পর বেশ কিছুদিন বের্না থেকে যায় ভারতে। একা একা ঘুরতে যেত বিভিন্ন শহরে। কাইজার তখন চাকরি খোঁজার জন্য মরিয়া। অনেকগুলো কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিতে হচ্ছিলো। ফোনে কথা হতো। তখন মোবাইল ফোন ছিল না তাই ঘন ঘন কথাও হতো না, মেসেজ নামের কোনো জিনিস তখনো আবিষ্কার হয় নি। কাইজার হিমাচল থেকে দিল্লি এসে থাকতে শুরু করেছে। আভাস গান্ধী আর কামত গান্ধী তখন দিল্লিতে চাকরি পেয়েছে। একসাথে ওদের ছোটবেলা কেটেছিলো জুবিনের আশ্রমে। কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, অভিমান আবার ভালোবাসা। এমন দিন গেছে যখন ওরা এ ওর জাঙ্গিয়াও পড়েছে, কিছুই আলাদা ছিল না। একটাই আলমারি ছিল ঘরে, গুছিয়ে কাপড় জামা রাখার অভ্যাস ছিল না, একসাথেই সব কিছু থাকতো, নিজের বলে কিছু নেই, কিন্তু কোনো অভাব বোধ ও ছিল না। জুবিন জানতো এই আশ্রমের ছেলেরা এই ভাবেই মানুষ হচ্ছে, ছেলেদের শেখাতে চায়নি কোনো কোনো জিনিষকে নিজের বানানো দরকার। হোক না কিছু মানুষ যাদের নিজের কোনো চাহিদা থাকবে না, হোক না কিছু মানুষ নিঃস্বার্থ। স্বার্থপরতা আমাদের গণ্ডিকে ছোট করে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। আমরা বেশির ভাগ লোক নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখি, অন্যের চোখ দিয়ে দেখতে শিখিনি, কিন্তু জুবিনের ছেলেরা অন্য ধাতুতে তৈরী হয়েছে। টাকা পয়সায় কেউ হয়তো চূড়ান্ত বড়লোক হয়নি, কিন্তু মানুষ হিসাবে অনেক বড় মাপের মানুষ তৈরী করেছে জুবিন দর্জি।

    আভাস আর কামাত কাইজারকেও ডেকে নেয় নিজেদের কাছে। গ্রীন পার্কে একটা ফ্ল্যাটে তিনজন থাকতো। কাইজার সারাদিন পড়াশোনা করতো কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য, দুটো ছাত্র পড়াতো বারো ক্লাসের। সেই পয়সায় হাত খরচ মিতে যেত। বাড়ি ভাড়ার টাকা আর খাওয়া দাওয়া আভাস আর কামত দিতো। কেউ কখনো এই নিয়ে কথাও বলেনি। হয়তো একেই বলে আসল আত্মীয়তা। মাঝে মাঝে কাইজার রান্না করতো আর বিয়ার বা রামের বোতল কিনে আনতো ছুটির দিনে একটু আড্ডা মারার জন্য।

    * * * * * *

    দীনেশ আর কাইজার দুজনেই পোস্টিং পেয়েছে দিল্লির পুলিশ হেডকোয়াটারে। দিল্লী পুলিশের স্পেশাল কমিশনার ইন্টেলিজেন্সের অফিসে দুজনেই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। ওদের কাজ ছিল দিল্লিতে যত বিদেশী লোকজন আছে তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। সারাদিন ইন্টারপোলের সাথে যোগাযোগ, সন্দেহভাজন লোকজনের রেজিস্ট্রেশন, তারপর তাদের ওপর নজরদারি। অবশ্যই গোপনে। এই কাজের জন্য সবসময় পুলিশ মোতায়েন করা যেত না, ভরসা করতে হতো কিছু সাধারণ খবরিদের ওপর। এক কথায় একটা প্যারালাল স্পাই নেটওয়ার্ক চালাতো এই ডিপার্টমেন্ট। প্রত্যেক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকতো। ডিপার্টমেন্টের কেউ জানতো না কারা এই নেটওয়ার্কে কাজ করছে। হয়তো ডিপার্টমেন্টের সকলকে বিশ্বাস করাও মুশকিল ছিল। কাইজারের নেটওয়ার্কে একজন ছিল মুনাবার।

    * * * * * * * * *

    কে এই মুনাবার ? এবার মুনাবারের গল্প বলি। দিল্লির দিলশাদ গার্ডেনের একটা এম আই জি ফ্ল্যাটে নিজের বৌ উষা আর তাদের মেয়েকে নিয়ে মুনাবারের ছোট সংসার। শাহাদরার কাছে একটা রেডিমেড গার্মেন্ট কোম্পানির টেলর ছিল মুনাবার। মুনাবার কলকাতার লোক, টেলরের কাজ শিখেছিল মেটেবুরুজে। তখন থেকেই বামপন্থী রাজনীতি করতো মুনাবার। নিজের আত্মীয় স্বজন কেউ তেমন ছিল না। কৃষ্ণনগর থেকে একটু দূরে তাহেরপুরে ওদের বাড়ি ছিল। ছোট চাষের জমিও ছিল। মুনাবারের বাবা মা অন্য শরিকদের সাথে সেই জমি চাষ করে কোনো রকমে সংসার চালাতো। একবার কলেরার মহামারীতে মা বাবা দুজনে চলে গেলো। মুনাবারের তখন ১৬ বছর বয়েস। মাধ্যমিক পাস্ করেছিল গ্রামের স্কুলে তারপর আর পড়াশোনার সুযোগ পায়নি। একজন জ্যেঠা ছিলেন, তিনি মেটেবুরুজে এক দর্জির কাছে মুনাবারকে রেখে এলেন। তার পর থেকে মুনাবার আর তাহেরপুর যেতে পারেনি। দিন রাত কাজ করতো ওই দর্জির দোকানে। জামিল মন্ডলের দোকান। জামিলদা তখনও অবিবাহিত, নিজের বাড়িতেই দোকান, ওপরে দুটো ঘর আর নিচে দোকানের পেছনে একটা ঘর আর একটা বাথরুম পায়খানা ছিল। মুনাবারকে ওখানেই থাকতে দিলো জামিলদা। জামিলদার সাথে মুনাবারের জেঠার কি সম্পর্ক মুনাবার জানতে পারেনি কখনো, জানতে চায় ও নি। দুবেলা খাওয়া পড়া জুটতো, কাজ ছিল কিন্তু মুনাবারের ভালোও লাগতো। জামিলদাই হাতে ধরে মুনাবারকে কাজ শিখিয়েছিলো। জামিলদা কখনো মসজিদ যেত না, নামাজও পড়তে দেখেনি মুনাবার। মুনাবার মাঝে সাথে মসজিদে যেত কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যাসটা কেটে যায়। সন্ধ্যেবেলা জামিলদা দোকান বন্ধ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে যেত, মুনাবারও নিজের কিছু বন্ধু জুটিয়েছিলো যারা একটা স্কুল ঘরে রোজ রাতে কিছু আলোচনা করতো, বেঁচে থাকার লড়াই, সাম্যবাদ এই নিয়ে বক্তিতা দিতো কিছু ভালো চেহারার লোকজন, দেখে মনে হতো তাঁরা শিক্ষিত ভদ্রলোক। কেউ কেউ ক্লাস চালাতেন, পড়াশোনা করতে বলতেন সব ছেলেদের। মুনাবার এমন এক ক্লাসে যেতে শুরু করলো। বাদলদা বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। অনেক বই পরে শোনাতেন, পড়তেও বলতেন। নতুন নতুন গল্প। ধীরে ধীরে গত তিন চার বছরে মুনাবার এক অন্ধকারময় অস্তিত্বের মধ্যে কোথাও যেন আলোর দেখা পাচ্ছিলো। কি ভাবে জানেনা কিন্তু, মুনাবারের ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনীতির ওপর আস্থা বাড়তে শুরু করে। জামিলদা জানতো সব কিন্তু কোনোদিন বাধা দেয় নি। কাজের সময় মুনাবার ছিল খুব একনিষ্ঠ। জামিলদা সম্প্রতি মুনাবারকে দিয়েই কাটটিং করাতো। কিছুদিন পর জামিলদা বিয়ে করে উষা নামের একটি মেয়েকে। হিন্দু মেয়ে, ঘরে পুজো আর্চাও করতো, জামিলদার কোনো মানা ছিল না। এক কথায় জামিলদা ছিল উদার মনের মানুষ। প্রায় একবছর জামিলদার প্রেমের সংসার চললো। ঊষা ছিল মুনাবারের বয়েসী কিন্তু মুনাবার ‘বৌদি’ ডাকতো ঊষাকে। মুনাবারকে দেওরের চোখেই দেখতো ঊষা। বৌদির দয়ায় ভালো মন্দ খাবার জুটতো মুনাবারের কপালে। একদিন সন্ধ্যের পর মুনাবার নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ও টের পায় কেউ আছে ওই ঘরে। দরজায় কান লাগিয়ে জামিলদার গলা শুনতে পায় আর এক মহিলার গলাও। ঘন ঘন নিঃস্বাস এর শব্দ। মুনাবারের সংস্কারে বাঁধে কান লাগিয়ে শুনতে, তাই বাইরে এসে রাস্তার ধারে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে এককাপ চায়ের অর্ডার দেয়। ভাবতে থাকে, জামিলদা আর বৌদি নিজেদের ঘর ছেড়ে ওর ঘরে কি করছে? মিনিট কুড়ি চায়ের দোকানে কাটানোর পরও নিজের ঘরে যেতে সংকোচ হচ্ছে মুনাবারের। দোকানের দরজা বন্ধ, তাই বাড়ির পাশের গলি দিয়েই নিজের ঘরে যেতে হবে, এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মুনাবার দেখতে পায় বাড়ির গলি দিয়ে চুপিসারে জরিনা বেরোচ্ছে। জরিনা ওদের পাড়ার মেয়ে, ব্লাউস বানাতে ও এই দোকানেই আসে, জামিলদার পুরোনো খরিদ্দার। বৌদি কি ওপরের ঘরে ? জরিনার ব্লাউসের মাপ সবসময় জামিলদাই নেয়। কোনো মহিলা কাস্টমার এলে জামিলদা বা মুনাবার দোকানের পেছনে একটা ট্রায়াল রুম আছে সেখানে দাঁড়িয়ে মাপ নেয়, আজ তো দোকান বন্ধ, জরিনা কোথা দিয়ে ঢুকলো ? মুনাবার ঠিক এই সময়ে ঢুকতে চাইছে না নিজের ঘরে। একটু অপেক্ষা করতে চাইছে। নিজের মাথাও ঘুরছে উষা বৌদির কথা ভেবে। কি হবে যদি জানতে পারে জামিলদা আর জরিনার কোনো গোপন সম্পর্ক আছে ? কিছুক্ষন পর উষা বৌদি কে দেখতে পায় রিক্সা করে ফিরছে, হাতে অনেক বাজারের ব্যাগ। মুনাবার এগিয়ে যায় বৌদিকে সাহায্য করতে।
    - ব্যাগগুলো দাও বৌদি আমি নিয়ে যাচ্ছি
    - বাঁচালে মুনাবার, ব্যাগগুলো খুব ভারী - উষা বলে
    - বাজারে জামিলদা কেও নিয়ে গেলে পারতে
    - সারাদিন দোকানে কাজ করে তাই ভাবলাম আমি গিয়ে মাসকাবারি বাজারটা সেরে নিই - ঊষার গলায় জামিলদার জন্য সহানুভূতি দেখে মুনাবারের অবাক লাগে। এই মানুষটা ধোঁকা দিচ্ছে নিজের বৌকে। দুজন মিলে যখন বাড়ি ঢুকলো তখন জামিলদা ওপরের ঘরে। বৌদি 'শুনছো' বলে ডাকতে নিচে মেনে আসে জামিলদা। একদম স্বাভাবিক আচরণ। মুনাবার ব্যাগগুলো ওপরে তুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। আজকাল রাতে বৌদি ওপরেই খাবার দেয় আর মুনাবার গিয়ে ওদের সাথেই এক টেবিলে খেয়ে আসে, যেন এই ঘরের ছোট ভাই। আজও খেতে গেছে, ওদের দুজনের কথায় কোনো বিবাদ নজরে পড়েনি। রাতে শুয়ে শুয়ে মুনাবারের ঘেন্না লাগছিলো নিজের বিছানায় শুতে। এর পর বেশ কিছুদিন মুনাবার বুঝতে পেরেছে যে ওর এই ঘরে আরো কেউ এসেছিলো। এভাবে বেশিদিন চললে উষা বৌদি নিশ্চই জানতে পারবে, তখন কি হবে ?
    মাসখানেক পরের ঘটনা, একদিন বৌদির কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় মুনাবার, জামিল বকা বকি করছে, নিজের ঘরে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছে মুনাবার। জামিলের কুকীর্তি ধরে ফেলেছে বৌদি, নালিশ জানাচ্ছে কিন্তু জামিলদা নিজেকে বলছে ' আমার যা ইচ্ছা হবে তাই করবো, তোমার ভালো না লাগে চলে যায় বাপের বাড়ি', বৌদি কাঁদছে। দিন কে দিন ঝগড়া বাড়তে লাগলো, জামিলদা একদিন বোধহয় বৌদিকে মারধর ও করেছে। এদিকে মুনাবার সব শুনছে, দোকানে এসে জামিলদার মন বসছে না। একদিন জামিলদা মুনাবার কে ডেকে বললো যে ও কিছুদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাবে, দোকানটা যেন মুনাবার ঠিকমতো সামলায়। মুনাবার জিজ্ঞাসা করেছিল
    - বৌদি কে নিয়ে যাচ্ছ জামিলদা ?
    - না, আমার নিজের কাজে যাচ্ছি, তুই খেয়াল রাখিস। বৌদির কিছু দরকার পড়লে বাজার থেকে নিয়ে আসিস।
    গত দু দিন মুনাবার বৌদি কে দেখে নি। জামিল ওপর থেকে মুনাবারের খাবার নিচে দিয়ে গেছে। পরদিন সকালে জামিলদা চলে গেলো ছোট একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। দিনের বেলা বৌদি খেতেও ডাকে নি, মুনাবার বাজারের দোকান থেকে ভাত দল তরকারি খেয়ে এসেছে। বিকেলে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ডেকেছে বৌদি কে, কোনো সারা শব্দ নেই। বুকটা একটু ছ্যাৎ করে উঠেছে। কি হলো বৌদির। ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছে মুনাবার। দোতালার ল্যান্ডিঙে উঠে আবার ডেকেছে - বৌদি, তুমি কোথায় ?
    কোনো সাড়া নেই, মুনাবার বেডরুমের দরজা খোলা দেখে ঢুকেছে, সেখানেও নেই। আর একটা ঘর আছে, বসার ঘর, সেখানেই এক কোনে ডাইনিং টেবিল পাতা, এই ঘরেই ওরা খাওয়া দাওয়া করে, সেখানেও নেই। নিচেই নেমে যাচ্ছিলো মুনাবার, হঠাৎ ল্যান্ডিং কোনায় বাথরুম থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পায়। একটা গোঁঙানির আওয়াজ। দু বার বৌদি বৌদি করে ডেকেও যখন সুবিধা হয়নি, তখন সব সংকোচ ভুলে বাথরুমের দরজা জোরে ধাক্কা দেয়। এক ধাক্কাতেই দরজার ছোট ছিটকিনি খুলে যায়। বাথরুমে বৌদি উপুড় হয়ে পরে আছে। সায়া পরনে কিন্তু গায়ে কিছুই নেই, পিঠে লাল দাগ। বৌদির নাকের কাছে হাত রেখে মুনাবার বুঝতে পেরেছে শ্বাস চলছে। কাউকে কি ডেকে আনবে। লোকজন এসে গেলে কি ভাবতে কি ভাববে এই নিয়েও মুনাবারের একটু সংকোচ হচ্ছে। বাথরুমে একটা বড় তোয়ালে ছিল, তাই দিয়ে বৌদি কে জড়িয়ে পাঁজাকোলা করে বেডরুমে নিয়ে শোয়াতে গিয়ে দেখতে পেলো যে বৌদির গালে আর কপালে আঘাতের চিহ্ন। কোনো ভাবে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে আর বৌদির কোনো অসম্মান না করে ভেজা সায়া পাল্টে বিছানার চাদরে বৌদিকে ঢেকে দিয়েছে মুনাবার। জল খাইয়াছে। বৌদি চোখ খুলেছে, কিন্তু এখনো ভালো করে কিছু বুঝতে পারেনি। গরম চা এনে দিয়েছে মুনাবার, সাথে বিস্কুট। ধীরে ধীরে উঠে বসেছে বৌদি। লজ্জায় এখন মুনাবারের দিকে তাকাতে পারছে না। ঘরের আবহাওয়া হালকা করার জন্য মুনাবার বলে ওঠে
    - কদিন ধরেই দেখছি তোমাদের ঝগড়া বাড়ছে। কি হচ্ছে এসব ? আজ জামিলদা সকালে চলে গেলো কলকাতার বাইরে, বললো না কোথায় যাচ্ছে।
    বৌদি কান্নায় মুখ ঢেকে ফেললো। তারপর যা বললো তার সারমর্ম এই রকম -
    বিয়ের এক বছর পরও বৌদি প্রেগনেন্ট হয়নি, স্বভাবতই শারীরিক দোষ বৌদির। জামিল বাচ্চা চায় কিন্তু বৌদি ওকে বাচ্চা দিতে পারছে না, তাই জামিলদা জরিনাকে বিয়ে করতে চায়। বৌদি এই সংসারে সতীনের সাথে থাকতে চায় না, তাই জামিলদার হাতে রোজ মার খেতে হয়। গত কয়েকদিন ধরে মারধরের মাত্রা বাড়তে থাকে, জামিলদা তালাক দিতে চায় বৌদি কে, বৌদি বাপের বাড়ি বলে কিছু নেই। মামার বাড়িতে ছিল। মা বাবা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়িতেই বারো হয়েছে উষা। পড়াশোনাও করেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। মামার একটা ছেলে। বাড়ির আদর সব তার জন্যই, উষা বারো হয়েছে মামীর বাড়ির কাজ করে আর গঞ্জনা শুনে। আর পাঁচটা বাড়ির মতো মামা নিজের কাজে ব্যাস্ত বা ব্যাস্ততার ভান করে উষা কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। মামার ছেলেটাও উষা কে নিজের দিদি ভাবতে পারেনি কখনো। মামা একদিন ঊষার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। মামার চেনা একটি ছেলে, একা থাকে, কেউ নেই ওর সংসারে, ছেলেটা মুসলিম কিন্তু গোঁড়া নয়, শুধু নামটাই মুসলিম। খিদিরপুরে দর্জির দোকান। একদিন মামার সাথে এই বাড়িতে এসে নাকি ও ঊষাকে দেখেছে, ভালো লেগেছে। ঊষার মনেও নেই। ছেলেটা কোনো যৌতুক চায়নি। তার ওপর কোনো ধর্মীয় বিয়ে ছেলেটা করতে চায় না, সাধারণ কোর্ট ম্যারেজ করে ঊষাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চায়। ঊষার ভালো লাগতে শুরু করে ছেলেটার মানসিকতা। কিন্তু ছেলেটা দর্জি শুনে মনে মনে একটা ছবি তৈরী করে নেয়, কানে পেন্সিল, হাতে মাপের ফিতে, ছাগল দাড়ি আর পান মসলা খেয়ে খেয়ে তেতুলবিচির মতো কালো কালো দাঁত।

    কিছুদিন পর মামা ছেলের ছবি দেখায় ঊষাকে। ছেলের ছবি দেখে উষার তলপেটের নিচে প্রজাপতি উড়তে থাকে। বাদামি চোখ, সুন্দর স্বাস্থ্য, একটা এক রঙের জামা পরা, হাতের পেশী দেখা যাচ্ছে, এক কথায় বলিউড না হলেও টলিউডের অনেক নায়কের চেয়ে জামিলকে দেখতে ভালো। মামা আজই ছেলেটার নাম বললো ঊষাকে। আজ মামী বাড়ি ছিল না তাই মামা অনেক দুঃখের কথা মন খুলে বলতে পারলো ঊষাকে। নিজের ইচ্ছা থাকলেও ঊষাকে আগলে রাখতে পারেনি, প্রায় জোর করেই বিয়ে দিতে হচ্ছে মামীর ইচ্ছায়। উষা মামাকে সান্তনা দেয় -
    তুমি অনেক করেছো মামা, আমি তোমার কথা বুঝতে পারি, আমার কোনো আপত্তি নেই এই বিয়েতে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ঊষার কথা শুনে মামা যেন অনেক শান্তি পেলো।

    ঊষার বিয়ের পর জামিল ওকে নিয়ে বাড়ি আসে, ভালোবাসা ছিল, শান্তি ছিল, কিন্তু শারীরিক মিলনের সময় জামিল খুব অস্থিরতা দেখাতো, কোথায় যেন তাল মিলতো না। অশান্ত মন নিয়ে দুজনেই অসস্থিতে ভুগতো। উষা একবার বলেছিলো জামিলকে কোনো ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার জন্য। জামিল রাজি হয় নি। দেখতে দেখতে একবছরের বেশি কেটে গেলো কিন্তু উষা প্রেগনেন্ট হলো না। এদিকে জরিনার সাথে জামিলের ঘন ঘন মেশা বাড়তে থাকলো। উষা বুঝতে পারছিলো কিন্তু প্রথমে অত গ্রাহ্য করেনি। কিছুদিন আগে জামিল বলে বসলো জরিনা কে বিয়ে করতে চায়, সেই থেকেই ঝগড়া শুরু। জরিনার সাথে হয়তো শারীরিক মিলনের তাল মিলে গেছে।

    উষা কাঁদে, মুনাবারের মনে কোথায় যেন ঊষার জন্য দুঃখ হয়। মুনাবারের জীবনে কখনো কোনো মহিলা আসে নি। মুনাবার এখন ২৭ /২৮ বছরের যুবক। শরীরের চাহিদা অনুভব করে কিন্তু ঊষাকে নিয়ে কোনোদিন কোনো খারাপ চিন্তা মাথায় আসে নি। আজ ঊষা মুনাবারের হাত ধরে অনুরোধ করে 'আমাকে এখন থেকে নিয়ে যাও'। আর একজনের স্ত্রী কে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা মুনাবারের নেই, সাহসও নেই। ঊষার হাত ছাড়িয়ে সেদিন বাদল দার সাথে দেখা হয়। বাদল দা মুনাবারের বন্ধু এখন। সব কথা বলতে পারে মুনাবার বাদল দাকে। বাদল দা বলেন ' যদি ঊষাকে বাঁচাতে চাস তাহলে ওকে নিয়ে চলে যা কোথাও, দুজনের দু কূলে কেউ নেই চিন্তা করার। কে কি বললো তাতে কি আসে যায় ? নিজে কাজ জানিস কাজ পেয়ে যাবি'।
    - কোথায় যাবো বাদল দা ?
    - দিল্লি চলে যা, আমার একটা চেলা আছে দিল্লি তে, তোদের সাহায্য করবে, যাবি ?
    - আপনি ভরসা দিলে চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু জামিল ফিরে এসে যদি পুলিশ লাগায়?
    - জামিল তা করবে না, ওর তো ঝামেলা মিটে গেলো, ওকে জরিনার সাথে থাকতে দে, কিছুদিন পর ওকে সব জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিস্। জামিল ঝামেলা করার লোক নয়, আমি ওকে চিনি।

    পরদিনই কিছু করতে হবে। হাতে কিছু টাকাও আছে মুনাবারের। বাদল দার চেনা ভদ্রলোকের ঠিকানা নিয়ে আর একটা চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরে মুনাবার। ঊষার সাথে দেখা করে জানায় যে কাল ভোরেই বেরোতে হবে। ঊষার মুখে আনন্দের ঝলক দেখতে পায়। উষা কোনো প্রশ্ন করে নি, কোথায় যাবো কি করবো ইত্যাদি। কিছু মানুষের জীবন এতো অস্থায়ী যে প্ল্যান করার বিলাসিতা এদের সাজে না। ছোট্ট থলিতে কিছু জামা কাপড় আর মামার দেওয়া একজোড়া সোনার চুরি ছাড়া কিছুই নেয় নি ঊষা। জামিল ও কিছু কিনে দিয়েছিলো ঊষা কে, সাধারণ কিছু গয়না, সব ছেড়ে ঊষা চললো নতুন জীবনের আশায়। কি সম্পর্ক আছে ঊষার সাথে মুনাবারের, এতো কথা ভাবার সময় নেই। রাত থাকতেই বেরিয়ে পরে দুজন, দরজায় তালা দিয়ে, চাবি জানালা দিয়ে ভেতরে ফেলে দেয়। জামিলের কাছে দরজার চাবি আছে।

    শুরু হলো দুজনের যাত্রা। হাওড়া থেকে দিল্লি, কোনো রেজারভেশন ছাড়াই টিকিট কিনলো মুনাবার। এক দালাল বেশ কিছু পয়সা নিয়ে থ্রী টিয়েরের একটা বগিতে দুটো সিট দিয়ে দিলো, বিকেলে ট্রেন। সারাদিন হাওড়া স্টেশনে কি করবে? স্টেশন থেকে একটু দূরে একটা সাধারণ রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করলো। বেশি কথা হচ্ছে না দুজনের কিন্তু মাঝে মাঝে ঊষা মুনাবারের হাত ধরছে। গায়ে গা লাগছে, ঊষার কোনো সংকোচ নেই কিন্তু মুনাবার এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি। দুপুরে স্টেশনে বসে উষা জিজ্ঞাসা করে
    - কি পরিচয় দেবে অন্য লোকেদের? আমাদের কি সম্পর্ক?
    মুনাবার এই কথা তা ভাবে নি এখনো। সত্যিই চিন্তার কথা। ওকি বলবে যে ঊষা জামিলের বৌ, তাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে, এখন দুজনে একসাথে থাকবে? মুনাবার জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ঊষার দিকে। উষা নিঃসংকোচে বলে
    - বলবে আমরা বিবাহিত স্বামী স্ত্রী। নাম ভাঁড়ানোর দরকার নেই। পরে কখনো সুযোগ বুঝে --- বলেই ঊষার মনে হলো মুনাবারকে জিজ্ঞাসা করে হয় নি ওর জীবনে কোনো মেয়ে আছে কি না। এবার অস্বস্থি শুরু হলো ঊষার। না জেনে শুনে মুনাবারকে ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেললো !
    সেদিন যখন মুনাবার ঊষাকে বাথরুম থেকে ঘরে নিয়ে এসেছিলো, কাপড় বদলে দিয়েছিলো, ঊষার মনে হয়েছিল মুনাবার হয়তো ঊষার প্রতি আকর্ষিত, কিন্তু আজ মুনাবার কে দেখে মনে হচ্ছে না। তাহলে ? ঊষা এক গভীর চিন্তায় পরে যায়। মুনাবার বুঝতে পারে ঊষার মনের কথা।
    - আমাকে একটু সময় দাও ঊষা, এই প্রথম ঊষা কে বৌদি না বলে নাম ধরে ডাকলো মুনাবার। তারপর ঊষার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে একটু চাপ দিলো কিছুটা আশ্বাস দেওয়ার জন্য। কথা না বলে বোঝাতে চাইলো ঘাবড়িয়োনা, ভরসা রাখো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩০৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ভূতনাথ - Nabhajit
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tanusree Mukherjee | 2409:4060:2d46:9bcd:c35d:7f5a:f207:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৪৮530691
  • খুব ভাল হচ্ছে বাপিদা। দ্বিতীয় ভাগটার তুমি আমাকে লিংক পাঠায় নি, আমি আবার ব্যাক করে পড়লাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন