এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কাইজার গান্ধী 

    Nabhajit লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৩ মার্চ ২০২৪ | ৫৪৯ বার পঠিত
  • প্রথম |  দ্বিতীয়   | তৃতীয় | চতুর্থ
    পূরবী দিল্লির জি টি বি হাসপাতাল থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় চারজন শিশুর জন্য দয়ালু অভিভাবক চাই। এই সব শিশুর মা রা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। এদের বাবারা গা ঢাকা দিয়েছে। অনেক লোকজনের সারা পাওয়া গেছিলো। সন্তানহীন মা বাবার। হাসপাতালে এসে যখন শুনলো অনেক ফর্মালিটি, তার চেয়ে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেসন করিয়ে নেওয়া সহজ, ওই অনাথ বাচ্ছাগুলোকে ফেলে সকলেই চলে যায়। পৃথিবীতে বেশির ভাগ লোক ভালো, দয়ালু, অন্য লোকের দুঃখ্যে বেশির ভাগ মানুষের মন খারাপ হয়, বেশির ভাগ লোক নিজের সাধ্যমতো অন্যকে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু নিজের সাধ্যমতো। সামান্য কিছু লোক জন্মায় যারা সাধ্যের কথা ভাবে না, ঝাঁপিয়ে পরে। সে রকম এক মানুষ সুদূর দার্জিলিং জেলা থেকে আবেদন জানায় যে উনি এই ধরণের দুস্থ বাচ্ছাদের জন্য একটি আশ্রম চালান, সেখানে আরো কিছু বাচ্ছা আছে, যারা স্কুলে যায়, খেলা ধুলা করে। লোকটার নাম Zuবিন দর্জি, দু জেনারেশন ধরে কার্সিয়ং এর বাসিন্দা। কোনো এক পারসি লোক ফুলের দোকান দিয়েছিলেন এই কার্সিয়ং শহরে, এখন এই দোকান অনেক বড় হয়েছে। দুজেনেরেশন পর জুবিন সেই দোকান চালায়। সাথে সাথে চালায় দুস্থ বাচ্ছাদের জন্য এক আশ্রম। স্থানীয় লোকজন সাহায্য করে। কিছু ব্যাবসায়ী টাকা পয়সা দেয়, খুব বেশি চাহিদা নেই জুবিনের। নিজের ব্যবসা থেকেও যা টাকা পায় বেশির ভাগ খরচ করে ওর এই পরিবারের জন্য। ওর দাদু পাহাড়ের ঢালে অনেক জমি নিয়ে বাড়ি বানিয়েছিলো, এখন ওর সংসারে কোনো আত্মীয় নেই। আছে শুধু জানা দশেক বাচ্ছা আর খান চারেক মহিলা যারা এই বাচ্ছাগুলোর দেখভাল করে। জুবিন এই বাড়িতেই একটা ঘরে থাকে, বাচ্ছাদের জন্য বেশ কয়েকটা ঘর,সুন্দর সাজানো। এক হেঁসেলে সকলের জন্য রান্না হয়। এক কথায় গেরুয়া না পরে কেউ যদি সাধু হয়, তো সে জুবিন। খুব সকালে উঠে জুবিন বাচ্ছাদের নিয়ে কিছু কসরত করায়। শারীরিক আর মানুষিক ট্রেনিং, নিজেও খুব ফিট। ছ ফুটার মতো হাইট, পেটানো চেহারা, কাঁচা পাকা চুল। সকল দশটায় সব বাচ্ছাদের স্কুলে পাঠিয়ে জুবিন নিজের দোকান খোলে। দার্জিলিং জেলার অনেক ফুল চাষি ফুল দিয়ে যায় আর জনা চারেক মেয়ে ফুলের বিভিন্ন তোরা বানায়। অর্ডার আসে অনেক দূর দূরান্ত থেকে। একটা ছেলে ফুলের ডেলিভারি দেয়। এই জেলায় অনেক খ্রিস্টান চার্চ আছে, কবর খানা আছে, সেখান থেকে অর্ডার আসে। তাছাড়াও আজকাল জন্মদিন, ভ্যালেনটাইন আরো অনেক অনুষ্ঠানে ফুল অর্ডার করে অনেক লোক। দোকানের বিশেষত্ব হলো বাহারি নাম না জানা ফুল আর সাজানোর কৌশল। মানুষের মন বোঝার একটা ভূমিকা আছে, কে কাকে ফুল দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, ফুলের সাথে কি বার্তা পাঠাতে চায় এই সবই প্রতি মানুষের জন্য আলাদা।

    জুবিন এর কাছে কোনো শিশুর কোনো জাত নেই ধর্ম নেই। যে চারটে বাচ্ছাকে জুবিন দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলো তাদের মধ্যে একটা বাচ্ছা জুবিনকে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে কোথায় যেন একটু বেশি মায়া পরে গেছে। কি নাম দেবে বাচ্ছাটার ? জুবিনের সব বাচ্ছা দের এক পদবী 'গান্ধী'। জুবিন এর ঠাকুরদার নাম ছিল কাইজার, এই বাচ্ছাটার নাম দেওয়া হয় কাইজার। ছোট বেলা থেকেই সে অন্যদের থেকে আলাদা। পড়াশোনায় ভালো, তাছাড়া জুবিনকে সাহায্য করে কিছু বলার আগেই। অন্য বাচ্ছাদের নিয়ে নিজেদের ঘর পরিষ্কার করা, উঠোন ঝাড় দেওয়া, কাপড় কাচা এসব আগে কাজের লোকজন করতো কিন্তু এখন কাইজার এর নেতৃত্বে সব বাচ্ছারা মিলে করে।

    কিছু বাচ্ছাদের ছোট বেলা থেকেই বোঝা যায় বড় হয়ে কে হবে আজ্ঞাবাহক আর কে হবে আজ্ঞাকারক। অনেক বাচ্ছা আছে যাদের সবসময় বলতে হয় কি করতে হবে, তারপর তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু কিছু বাচ্ছা আছে যারা নিজের দায়িত্বে কাজ শুরু করে দেয় ভুল করে বকুনি খায় কিন্তু আবার নিজের থেকে কাজ শুরু করে, এসব বাচ্ছারাই বড় হয়ে বড় কিছু করতে পারে। কাইজার দ্বিতীয় শ্রেণীর। জুবিন অনেক বাচ্ছাকে বড় করেছে, অনেকেই নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। বাচ্ছাদের বড় হওয়া দেখে দেখে জুবিন শিখেছে অনেক কিছু।

    অন্যান্য বাচ্ছাদের সাথে কাইজার যায় কার্শিয়াঙের ভিক্টোরিয়া স্কুলে। এই শহরে দুটো ভালো স্কুল ডাউহিল গার্লস স্কুল আর ভিক্টোরিয়া বয়েস স্কুল। দার্জিলিং জেলায় এর থেকে ভালো স্কুল নেই বললেই চলে। বড়লোকদের জন্য কিছু স্কুল আছে কিন্তু সেখানে বড়লোক তৈরী হয়, মানুষ কম। স্কুলে গরমের ছুটি বা খ্রীষ্টমাস এর ছুটির সময় যখন সব বাচ্ছারা খেলা ধুলো করে, কাইজার তখন জুবিনের দোকানের অর্ডার সাপ্লাই করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুলের তোড়া পৌঁছে দেয়। জুবিন একদিন একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আর অর্কিডের গোছার সাথে একটা কার্ড লিখে কাইজারকে দিয়ে বলে সোনাদায় ডেলিভারি আছে। কার্ডটা খোলা তাই কাইজার পড়ে ফেলে। লেখা ছিল 'তুমি আমাদের হিরো, তোমার দেশ তোমাকে ভুলে গেলেও তুমিই আমাদের হিরো' তোমার বন্ধুরা। কাইজার এর কৌতহল বাড়তে থাকে, 'কে এই হিরো' ? সোনাদা অবধি বাসে বসে বসে একটাই কথা বার বার মনে আসছিলো, কেন দেশ এই হিরোকে ভুলে গেলো ? যার হাতে এই ফুলের গোছা পৌঁছে দিলো, তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। ঘরে ডেকে নিলেন কাইজারকে। অনেক দূর থেকে এসেছো হে ছোকরা একটু জল খেয়ে যাও। ভদ্রলোকের স্ত্রী দুটো মোমো ও দিলেন। কাইজার এর হাতে দশ টাকা বকশিস। কাইজার এবার কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো
    - চাচু, এই ফুল কার জন্য ?

    চাচু কিছু বলার আগে চাচী এসে যোগ দিলেন। এই ফুল আমাদের ছেলের জন্য ওর বন্ধুরা পাঠিয়েছে, প্রতি বছর পাঠায়। আজ ওর জন্মদিন। ও আমাদের হিরো। দেশের গুপ্তচর ছিল আমাদের ছেলে দেবাং। চিনে একটা অপারেশন করতে গিয়ে ধরা পড়ে তারপর ওর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ভারত সরকার অস্বীকার করে যে দেবাং ওদের গুপ্তচর ছিল। দেবাং এর শহীদ হওয়ার খবর আমরা পাই ওর এক বন্ধু মারফত কিন্তু দেশ ওকে শহিদের মর্যাদা দেয় নি। কিছু আসে যায় না। দেবাং জানতো যে ওদের কাজের কোনো প্রকাশ্য প্রশংসা হবে না। ধরাপড়লেও কেউ বাঁচাতে আসবে না। আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই সে জন্য কিন্তু আমাদের কাছে তো দেবাং শহীদ তাই ওর জন্মদিনে ওকে আমরা স্মরণ করি। ওর প্রিয় খাবার ছিল মোমো। কাইজার বকশিশ ফিরিয়ে দিতে চায় দাবাং এর বাবাকে। এই ছোট গল্প কাইজার এর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো।

    * * * * *

    কলকাতায় কলেজ শেষ করে কাইজার সুযোগ পায় হিমাচল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রী করার সাথে স্কলারশিপ।

    এখন এগারো মাসের জন্য কাইজারের ঠিকানা 'সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল পুলিশ একাডেমী', হায়দ্রাবাদ। গত দু বছর ধরে UPSC পরীক্ষা দিচ্ছিলো সে, প্রথম বার মেন্ পরীক্ষা পাস করলেও ইন্টারভিউতে আটকে যায় এবার পেয়েছে আইপিএস। আইপিএস হতেই চেয়েছিলো কাইজার। প্রথমে ভাবতো আর্মি জয়েন করবে কিন্তু পরে আইপিএস হয়ে দেশের সেবা করার প্রতি কাইজারের আকর্ষণ হয়। ট্রেনিং চলা কালীন একদিন ডাটা ইন্টারসেপশনের ক্লাসে একটা অদ্ভত কাজ করে ফেলে কাইজার। একটা ইংরেজি অক্ষরে কিছু লেখা ছিল কেউ ডিকোড করতে পারছিলো না, কাইজার ধরে ফেলে, ওটা বাংলায় কোনো কোড। ওদের ক্লাসে একজন বাঙালি ছেলে অবাক হয়ে যায়, জিজ্ঞাসা করে তুমি বাংলা জানলে কি করে? সেই থেকে ওদের আলাপ। হোস্টেল ও এক ওয়ার্ডে থাকতো দুজন। কাইজার দার্জিলিঙে মানুষ হয়েছে। বাংলা তো জানবেই, এ ছাড়াও কাইজার হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি আর হিমাচলী বলতে পারতো স্বছন্দে। সে জন্য ওর বন্ধু ছিল অনেক। কিন্তু ওই বাঙালি দীনেশ বাগচীর সাথে ওর দোস্তি একটু বেশি। দুজনেই খুব ভালো ছাত্র আর ট্রেনিং এর সময় ওদের পারফরমেন্স সকলের থেকে ভালো চলছিল। এই ট্রেনিং এর সময় দীনেশ ওকে ওর প্রেমিকার কথা বলে, এক সাথে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তো দুজন। দীনেশ আর কাইজার এর মধ্যে পার্থক্য ছিল, দীনেশের ঘর বাড়ি, বন্ধু আত্মীয়, প্রেমিকা আর তার সাথে বিয়ে করে থাকার প্ল্যান এই সব নিয়ে কথা হতো। কাইজার কখনো বলে নি ও অনাথ। কিন্তু ও যেদিন বললো যে ওর বাবার নাম জুবিন দর্জি, সেদিন দীনেশ জিজ্ঞাসা করে তাহলে তোমার পদবি গান্ধী কেন? তখন কাইজারকে বলতে হয় ওর জীবনের গল্প। জুবিন এর অপার স্নেহ, আশ্রমের অন্য ছেলেদের ভালোবাসা কাইজারকে কখনোই মনে করতে দেয় নি যে ও অনাথ। কাইজার এর জীবনের লক্ষ্য কি জিজ্ঞাসা করলে কখনোই ও নিজের ঘর বাঁধার কথা বলেনি।

    * * * * *

    কোনো মেয়েকে ও কখনো ভালোবেসেছে কি না ও নিজেও জানে না। ভারতের সাথে বিভিন্ন দেশের চুক্তি অনুযায়ী অনেক বিদেশী ছাত্র আসতো হিমাচল ইউনিভার্সিটিতে, যেমন হামিদ কারজাই। এক তুর্কি মেয়ে ছিল কাইজার দের ক্লাসে নাম বের্না পাশা। বের্না ক্লাসে আসতো দুটো খুব টাইট বিনুনি করে, অনেক চুল ছিল মাথায়, কালো চুল। চোখ দুটো ছিল ধূসর রঙের আর গায়ের রং ছিল সূর্যাস্তের পর আকাশটা যেমন গোলাপি হয়ে যায় সে রকম। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতো।

    একদিন বিকেলে সিমলা বাজারের রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো বের্নার সাথে। কাইজার চোখ ফেরাতে পারেনা। কালো মেঘের মতো চুল, আজ বিনুনি বাঁধেনি, ছল ছল দুটো ধূসর চোখ যেন বৃষ্টির অপেক্ষায়। কাইজারকে দেখে হাত নাড়লো বের্না।
    - কোথায় যাচ্ছো? বের্না জিজ্ঞাসা করে
    - এই একটু ঘুরতে এসেছি, কোনো কাজ নেই। কফি খাবে? কাইজার আমন্ত্রণ জানায়
    বের্না ভারতীয় নয়, ভারতীয় মেয়েদের মতো স্পর্শকাতরতাও ওর নেই। এক কথায় রাজি হয়ে গেলো।

    কফি পান করতে করতে নিজেদের কথা শুরু। বের্নার বাড়ি ইস্তানবুল এর এশিয়ান দিকে একটা জায়গা আছে তার নাম সুলতানবেলি, সেখানে। ঘন বসতি, একজনের বাড়ির ছাদ থেকে অন্য লোকের ছাদে চলে যাওয়া যায়। একদিকে বসফরাস, অন্যদিকে 'BLUE' মস্ক, মুসলমানদের আর এক তীর্থ। লোকজন শান্তিপ্রিয়। বের্নার বাবা একজন ডাক্তার। ওই শহরে নামডাক আছে, মা একটা স্কুলে পড়ান। ভারত নিয়ে ওদের পরিবারে অনেক কৌতূহল আর সম্মান, তাই মেয়েকে পাঠিয়েছে ভারতে।

    কাইজার সাধারণত নিজের জীবনের গল্প কাউকে করে না, কিন্তু আজ কেন যেন বের্নাকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছা হোলো। সেদিন থেকে বের্নার সাথে কাইজার এর বন্ধুত্ব। এর আগে শুধু ক্লাসে দেখা আর কয়েক টুকরো কথা হতো। বের্না থাকতো কলেজ হোস্টেলে আর কাইজার বাজারের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করতো সপ্তাহে তিন দিন, তার বদলে সামান্য কিছু টাকা আর রেস্টুরেন্টের ওপর থাকতে দিয়েছিলো, একটা ঘর, একটুকরো রান্না করার জায়গা আর একটা বাথরুম। গরমের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হয়ে যেত। বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী নিজেদের বাড়ি বা অন্য কোথাও চলে যেত। বের্না যেতে পারেনি, একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলো, সেটা শেষ হয় নি, তা ছাড়া ভারত থেকে ইস্তানবুল যাওয়াও খরচ সাপেক্ষ। এদিকে কাইজারের তেমন কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। জুবিন মারা গেছে দু বছর আগে। এখন দার্জিলিঙের গোর্খা কাউন্সিল ওই হোস্টেল দেখা শোনা করে। দার্জিলিঙে এখন আর কোনো বন্ধু নেই, সকলেই প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। হেমাঙ্গ আর্মিতে চাকরি পেয়েছে, আভাস আর কামত দুজন একসাথে আছে বেঙ্গালুরু। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দুজনেই। কাইজার, হেমাঙ্গ, আভাস আর কামত এই চারজনের একটা দল ছিল। ওই আশ্রমে ওরাই ছিল সব চেয়ে ভালো। জুবিনের চোখের মনি। এখনো যোগাযোগ রাখে ওরা। বছরে কোথাও একসাথে হয়ে সময় কাটায়।

    আবার একদিন বাজারে দেখা হয়ে গেলো বের্নার সাথে। কথা হচ্ছিলো বের্নার প্রজেক্ট নিয়ে। কাইজার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বের্না খুব খুশি। ঘন ঘন দেখা হয়ে লাগলো। একটা কফি শপে বসে ওদের প্রজেক্টের কাজ চলতো। যে কাজ করতে বের্নার অনেক সময় লাগার কথা ছিল, কাইজার এর সাহায্যে সেই কাজ খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো বের্না। কাইজার জিজ্ঞাসা করলো এখানে সিমলা ছাড়া আর কোথাও গেছো? বের্না দিল্লী দেখেছে কিন্তু আর কোথাও যেতে পারেনি। পড়াশোনার চাপ অনেক। কাইজার ভাবছিলো কি করে একটা মেয়েকে বলবে ওর সাথে কোথাও যেতে। বের্না নিজেই বলে উঠলো
    - তোমার কি খুব কাজের চাপ ?
    - কেন বলতো ? - কাইজার
    - না, আমি ভাবছিলাম ভারতে এসে কিছু না দেখে চলে যাবো ?
    - কোথায় যেতে চাও? কাইজার জিজ্ঞাসা করে
    - তুমি যাবে? উৎসাহ দেখায় বের্না
    - কলকাতা যাবে? কাইজার জিজ্ঞাসা করে

    দুদিন পর দুজন উঠে বসে সিমলা থেকে কালকার বাসে। কালকা মেল ট্রেন ধরে যাবে কলকাতা। বের্নার হাতে বেশ কিছু হাত খরচার টাকা ছিল। কাইজারও কিছু পয়সা জমিয়েছিল রেস্টুরেন্টে কাজ করে। এছাড়া কাইজার এর স্কলারশিপের টাকাও জমছিল। দুজন মিলে ফার্স্টক্লাসের টিকিট কাটলো। এমনই কপাল যে ওরা পেয়ে গেলো একটা ছোট্ট কুপ দুজনের, ওপরে আর নিচে দুটো বাংক বেড। কূপের দরজা বন্ধ করলে শুধু ওরা দুজন। কাইজার এর একটু অসস্থি হচ্ছিলো কিন্তু বের্নাকে দেখে একবার মনে হয়নি ওর কোনো সংকোচ আছে। ওরা দুজন নিচের ব্যাঙ্কে বসে গল্প করছিলো। ফ ট্রেন থেকেই খাবার দেওয়া হয়। বের্না খুব আশ্চয হয়েছিল ভারতের এই পরিষেবা দেখে। ওদের দেশে এতো দূরপাল্লার ট্রেন প্রায় নেই বললেই চলে, তার পর এমন এলাহী খাওয়া দাওয়া, ও ভাবতেও পারেনা। দুপুরের খাওয়া শেষ করে বের্না একটু ক্লান্ত। কাইজার বললো ওপরে গিয়ে শুতে কিন্তু বের্না নিচেই বসে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কাইজার একটা বই পড়ছিলো। হঠাৎ বের্না লুটিয়ে পড়লো কাইজার এর কাঁধে। কাইজার কিছু না বলে দেখতে চাইছিলো বের্না নিজেই উঠে পরে কিনা, কিন্তু বের্না জাগে নি। মনে হচ্ছে বের্না খুব শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, একটা ভরসা করার মতো কাঁধে মাথা রেখে। কাইজার ও কিছু বলে নি, নিজের কাঁধের কার্নিশে যেন আগলে ধরে রেখেছে বের্নার মাথা। ঘন্টা দুয়েক এর নির্ভেজাল ঘুম এর পর বের্না চোখ খুলেছে। খুলেই বুঝেছে যে ও কাইজারের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিলো এতক্ষন, কিন্তু লজ্জা পাওয়া তো দূর, ও চোখ খুলেও কাইজার কাঁধ থেকে মাথা ওঠায়নি, যেন ও এই বলিষ্ঠ কাঁধে মাথা রেখে নিজের আলসেমি কাটাচ্ছে। কাইজার ও কিছু বলছে না। বই এর পাতায় নজর থাকলেও কাইজার এর মাথায় কিছু ঢুকছে না। বের্নার কোঁকড়া চুলের কিছু গুঁড়ো কাইজার এর ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, একটা হালকা ভ্যানিলার গন্ধ ভেসে আসছে বের্নার মাথা থেকে। কাইজার এখন বেশ সচেতন। ভালো লাগছে কিন্তু এই ভালো লাগা বের্নাকে জানতে দেওয়া ঠিক হবে না। কি ভাববে মেয়ে টা? কাইজার এর একটা হাত বই ধরে আছে আর একটা হাত নিজের কোলে। বের্না কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে দিয়ে নিজের শরীরটা সিটের আরো পেছনে নিয়ে গিয়ে এবার কাইজারের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে আর কাইজার এর হাতটা নিজের হাত দিয়ে টেনে নিজের গলায় রেখেছে। বের্নার বুকের উত্থানের কিছুটা কাইজার টের পেয়েছে নিজের থাই এ আর কিছুটা পাচ্ছে নিজের হাতে, যে হাত বের্নার গলার কাছে রাখা। সংকোচ হচ্ছে, হাত আড়ষ্ট হয়ে আসছে কিন্তু বের্নার স্বাভাবিকতা যেন আরো বেড়ে উঠেছে। যেন কাইজারের কাছে ওর কোনো সংকোচ নেই, যেন কাইজার ওর নিজের মানুষ। বের্না এতক্ষন কাত হয়ে শুয়েছিল কাইজার এর কোলে মাথা রেখে, এবার সোজা হয়ে শুয়েছে। কাইজারের চোখে চোখ পড়েছে। কাইজার ভান করছে বই পড়ার। বই দিয়ে নিজের চোখ দুটো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই বের্না একটানে বইটা সরিয়ে ফেলেছে, কাইজার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। একজোড়া তৃষ্নার্ত চোখ। কাইজারের গলা শুখিয়ে গেছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। বইটা পাশে রেখে অন্য হাতটা বের্নার কপালে রেখেছে, যেন হাত রাখার আর জায়গা নেই। বের্নার কি জ্বর এসেছে ? গা বেশ গরম। কাইজার অন্য হাত এখন বের্নার গলা আর বুকের মাঝে কোথাও আড়ষ্ট হয়ে থমকে গেছে। বের্না হঠাৎ কাইজারের জামার কলার ধরে টান মেরে কাইজারকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। কাইজার আপত্তি করছে না আর। নিজের ঠোঁট দুটো এখন বের্নার ঠোঁটে ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে দুজনের আড়ষ্টতা শিথিল হয়ে আসছে। কাইজার যে হাত এতক্ষণ বের্নার গলা আর বুকের মাঝে ছিল সেই হাত এখন প্রাণ পেয়ে আরো নিচে নামতে শুরু করেছে, বের্নার কোনো আপত্তি নেই। কাইজার এখনো কিছুটা সচেতন। বের্না এবার কাইজারের হাতটা নিয়ে নিজের বুকের মাঝখানে নিয়ে গেছে। এর পর আর বাঁধন ভাঙতে বেশি সময় লাগে নি। কাইজারের মুখ বের্নার ঠোঁট থেকে নেমে গলা পথ ধরে বুকের উপত্যকার দিকে এগোচ্ছে। বের্না নিজের জামা সরিয়ে ফেলেছে এতক্ষনে, কাইজারের হাত বের্নার ব্রায়ের হুক খুলতে ব্যাস্ত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    প্রথম |  দ্বিতীয়   | তৃতীয় | চতুর্থ
  • ধারাবাহিক | ২৩ মার্চ ২০২৪ | ৫৪৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ভূতনাথ - Nabhajit
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন