পৃথিবীর বয়স কত? ধরুণ গিয়ে ঐ মোটামুটি ৪.৩ বিলিয়ন ইয়ার, মানে ওই ৪৩০ কোটি বছরের মত আর কি। তো এই এত বছর বয়সে পৃথিবীর বুক থেকে ‘প্রাণ’ নাম জিনিসটার পুরোপুরি অবলুপ্তি হয়েছে বার কয়েক ধরে নেওয়া যাক। ওই যেমন ডাইনোসার রা হাপিস হয়ে গিয়েছিল। সেই অর্থে মনুষ্য প্রজাতির (হোমো স্যাপিয়েন্স) এর অবলুপ্তি পৃথিবীর বুক থেকে এখনো হয় নি। কিন্তু যদি হত?
মানুষ কি ভাবে পুরোপুরি পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যেতে পারে সেই নিয়ে অনেক পাবলিক ভাবনা চিন্তা করেছে – অনেকের তো আবার এই নিয়ে টাইম পাস ভাবনাও আছে। পারমাণবিক বোমা এবং উল্কা/গ্রহাণু পুঞ্জ-র পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়া – এই দুটি মোটামুটি সবচেয়ে কাছেকাছি কারণ পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ ভ্যানিস করে দেবার।
এর বাইরেও কি ভাববার আছে – মানুষ যে ভাবে দিনের পর দিন পৃথিবীকে টর্চার করেছে, মাটি থেকে জল – প্রচুর প্রচুর প্রজাতি চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে – যারা আর ফিরে আসবে না। তো এই ভাবে বাকিদের ভ্যানিস করাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হাত লাগিয়ে, আমরা নিজেরাই একদিন ভ্যানিস হয়ে যাব না তো?
কিন্তু যদি এমন হয় যে, উল্কাপাত বা পরমাণু বোমা নয় – অন্য কোন এক কারণে কাল থেকে আমরা মানুষরা পৃথিবীর বুক থেকে জাষ্ট ‘নেই’ হয়ে গেলাম। মানে আর বাকি যা কিছু সব থাকবে – শুধু আমরাই থাকব না! তাহলে কেমন হবে? আমাদের স্থাপত্য, শিল্পকলা সব থাকবে – আমরা বাদে! ওই সব জিনিস কত দিন থাকবে? বা আমরা পৃথিবীকে বদলে গিয়ে যেখানে নিয়ে এসেছি, সেখানে থেকে পৃথিবী-কে তার পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে কতদিন সময় লাগবে?
এই সব নানা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে “দি ওয়ার্ল্ড উইথ আউট আস” এক অপূর্ব বই লিখেছেন অ্যালেন উইজম্যান। বইটি পড়লে নানা ভাবনার খোরাক পাবেন – মানুষ আর্বিভূত হবার আগে পৃথিবী ঠিক কেমন ছিল, কাল আমরা নাই হয়ে গেলে পৃথিবী-কে কেমন ছেড়ে যাব, আমাদের শহর গুলি কেমন থাকবে, কি কি জিনিস ক্ষয়ে বা ভেঙে যাবে, কারো আরো আরো বেশীদিন থেকে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার একটা প্রশ্ন হল – আমরা যদি ‘নেই’ হয়ে যাই, তাহলে কি প্রমাণ থেকে যাবে যে আমরা পৃথিবীতে ছিলাম একদিন? ডাইনোসারের মত শুধুই ফসিল দেখে আমাদের উপস্থিতি বিচার করতে হবে? আমাদের স্থাপত্য, শিল্পকলা থেকে হয়ত বোঝা যাবে আমরা এখানে একদিন ছিলাম – আমাদের আঁকা ছবি, আজকের ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র থেকেও না হয় বোঝা যাবে আমাদের কেমন দেখতে ছিল, আমাদের মুখ দিয়ে কেমন শব্দ বেরুতো ইত্যাদি ইত্যাদি? কিন্তু সেগুলো কতদিন টিকবে? তারপর কি হবে? আমাদের থাকার প্রমাণ কি হবে?
আর যদি এর থেকেও কেস গম্ভীর হয় – মানে পৃথিবীটাই যদি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এই মহাবিশ্বে যদি কেউ থেকে থাকে আমরা বাদে, তারা কি কোনদিনই জানতে পারবে না যে আমরা এখানে ছিলাম একদিন? আর যদি থেকেই থাকি, তাহলে কেমন দেখতে ছিলাম আমরা? মহাকাশে এদিক ওদিকে আমাদের ছবি ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি নি কি আমরা?
তলিয়ে ভেবে দেখলে খবরটা শুনে খুব বেশী আশ্চর্য হবার কিছু নেই – আমাদের বিজ্ঞানী-দের মাথাতে এটাও এসেছিল। শুধু বিজ্ঞানী-দেরই বা কেন, নাসা-র কর্তাদের মাথাতেও এটা ঘুরছিল ১৯৭৭ সালে যখন তাঁরা ভয়জার ১ এবং ২ মহাকাশে পাঠানোর শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ছোট্ট করে বলে নিই, ভয়জার ১ এবং ২ যাকে বলে যুগ্ম মহাকাশ ‘প্রোব’ – ভয়েজার ১ উৎক্ষেপিত হয় ১৯৭৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আর ভয়জার ২ আগষ্ট মাসের ২০ তারিখে। কিন্তু পরে উৎক্ষেপিত হলেও ভয়জার ১ বেশী দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিল ভয়জার ২ এর থেকে ফলে মহাকাশে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ২ নম্বর-কে টপকে নেয়। এদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বৃহস্পতি, শনি এবং তার আশেপাশের সৌরমন্ডলের সীমানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তারপর যদি এদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে তাহলে সৌরমন্ডলের বাইরে ইন্টারষ্টেলার (আন্তঃনাক্ষত্রিক) স্পেস পর্যন্ত যাবে না হয়! ২০১৩ সালে নাসা ঘোষণা করে যে ২০১২ সালের ২৫শে আগস্ট ভয়জার ১ আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে প্রবেশ করেছে। এটি প্রথম মনুষ্য নির্মিত বস্তু যা সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ভাবে ভায়জার ২ আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে প্রবেশ করে ২০১৮ সালে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের হিসেব অনুযায়ী এই মুহুর্তে ভয়জার ১ পৃথিবী থেকে ২৪০০ কোটি কিলোমিটার দূরে!
যাই হোক, ফিরে আসা যাক ১৯৭৭ সালের কথায় – নাসা-র লোকজন ভাবলেন যে, আচ্ছা এই যে এতদূরে আমরা মহাকাশ যান পাঠাচ্ছি, তাদের সাথে যদি অন্য গ্রহের বা সৌরমন্ডলের বাইরের গ্রহান্তরের প্রাণীর দেখা হয়ে যায় তাহলে তারা কি করে বুঝবে যে এটা কারা পাঠিয়েছে? তারা কি ভাবে জানবে ‘মানুষ’ নামক প্রজাতির অস্তিত্ত্ব! ডাকা হল আমেরিকার কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাষ্ট্রোফিজিসিষ্ট কার্ল সাগান এবং ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক-কে। এঁদের দুজনকে বলা হল – বাপু আমরা ভয়জার পাঠাচ্ছি মহাকাশে, তোমরা এমন কিছু সাজেষ্ট কর যেগুলো মানুষ প্রজাতির প্রতিনিধি হিসেবে স্পেস প্রোবের সাথে আমরা পাঠাবো – যা দেখে মানুষ সম্পর্ক-কে ধারণা করতে পারবে যারা কোনদিন মানুষ দ্যাখে নি তারা!
অবশ্য কার্ল সাগান এবং ফ্যাঙ্ক ড্রেক এর কাছে নাসা-র এমন অনুরোধ এই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে ‘পায়োনিয়র -১০’ এবং ‘পায়োনিয়র -১১’ মহাকাশে পাঠনোর সময় প্রথম অনুরোধ এসেছিল। অনেকেই জানেন যে কার্ল সাগান-এর জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলির অলঙ্করণ করেন জন লোমবার্গ নামে এক চিত্র শিল্পী যিনি সাথে সাথে রেডিও প্রোডিউসার-ও। তাই নাসার কাছে থেকে এমন অনুরোধ পেয়ে, সাগান প্রথম দ্বারস্থ হয়েছিলেন জন লোমবার্গ-এর। এঁরা সবাই চিন্তা ভাবনা করে যা স্থির করেছিলেন সেই মত নাসা দুই পায়োনিয়র মহাকাশ যানে তেই ৬ ইঞ্চি বাই ৯ ইঞ্চি সোনার জল করা অ্যালুমিনিয়ামের ফলক বোল্টু দিয়ে টাইট করে আটকে দিয়েছিল। আর সেই ফলকে খোদাই করা ছিল এক মনুষ্য পুরুষ এবং নারী-র নগ্ন চিত্র। আর সেই ছবির পাশে আরো খোদাই করা ছিল সৌর জগতের মধ্যে পৃথিবীর অবস্থান এবং মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি-তে সূর্যের অবস্থান। চিন্তা এমন ছিল যে কেউ যদি পায়োনিয়র এর সাথে দেখা পায়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে পৃথিবী কোথায় এবং মানুষ-দের এমন দেখতে!
পায়োনিয়র ১০ তার শেষ সিগন্যাল পৃথিবীতে পাঠায় ২০০৩ সালে ৮০০ কোটি মাইল দূরত্ব থেকে – আর কুড়ি লক্ষ্য বছর পরে পায়োনিয়র রেড স্টার আল্ডেব্রান এর কাছ দিয়ে যাবে। অন্যদিকে পায়োনিয়ার ১১ শনির কাছকাছি ছিল ১৯৭৯ সালে – তার পর থেকে সে যেদিকে গ্যাছে তাতে করে আগামি চল্লিশ লক্ষ বছর সে কোন নক্ষত্রের আশেপাশে আসবে না!
কিন্তু এগুলো তো পরের কথা – ১৯৭৭ সালে কার্ল সাগান বা ফ্রাঙ্ক ডেরেক জানতেন না যে পায়োনিয়র এত দূর চলে যাবে। কিন্তু যাক বা না যাক, তাঁরা ঠিক করে নিয়েছিলেন যে ভায়জার এ তাঁরা আরো জটিল কিছু রাখবেন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে, সেই পায়োনিয়রের মত খোদাই করা পুরুষ-নারী মূর্তি ছাড়াও। তখন ডিজিটাল যুগ আরো প্রাগাঢ় হচ্ছে নাসা-তে, কিন্তু জটিল ডিজিটালের না দিকে না গিয়ে ভয়জারের জন্য তাঁরা বানালেন আমাদের গ্রামোফোনের ডিস্কের মত ১২ ইঞ্চির একটা সোনার জল করা তামার অ্যানালগ ডিস্ক। আর সেই ডিস্কে এবারে একই সাথে ধরা থাকবে শব্দ এবং ছবি। সাথে গ্রামোফোনের পিন-এর মত একটা ‘স্টাইলাস’-ও জুড়ে দিলেন। আশা এই যে যদি কোন বুদ্ধিমান গ্রহান্তরের প্রাণির হাতে এটা আসে তাহলে তারা অন্তত এটা চালিয়ে দেখার মত বুদ্ধি ধরবে!
এই গোটা ব্যাপারটা কিন্তু নাসা বেশ বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছিল। সেই ডিস্ক ডিজাইন থেকে শুরু করে যাবতীয় মহাকাশে কসমিক-রে, তাপমাত্রা ইত্যাদি থেকে ডিস্ক-টিকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যাবে সেই নিয়ে বিশাল গবেষণা হল। কেমন সিরিয়াস? ধরে নেওয়া হচ্ছে যে এই ডিস্ক-টি মানব সভ্যতার শেষ বেঁচে থাকা টুকরো! এবার এতে যতটুকু পারো মানুষের সভ্যতার ইতিহাস ভরে দাও এবং আমাদের শেষ প্রতিভূ হিসেবে এটিকে রক্ষা করো! সেই ডিস্ক-টিকে ভরে রাখা হল এক সোনা-র হল করা অ্যালুমিনিয়ামের বক্সে। এবং জটিল হিসেব মত কম করেও সেই বাক্স মহাকাশে বহাল তবিয়তে থাকবে ১০০ কোটি বছর!
এবার ব্যাপার হল তাহলে এই ডিস্ক-এ কি তথ্য ভরে রাখা হবে? মানব সভ্যতার উপস্থিতি জানান দেওয়ার মত জটিল ব্যাপার! ওদিকে জন লোমবার্গের হাতে ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ ডিস্ক-টিকে রেডি করে দেবার। লোমবার্গ এবং তাঁর সহকারী-রা প্রবল ব্যপ্তির এক সমীক্ষা চালালেন পৃথিবীর চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, কল্প-বিজ্ঞানের লেখক সমেত আরো অনেকের মাঝে। সেই সমীক্ষা চালিয়ে ঠিক করা হল – ডিস্কে ধরা থাকবে ৫৪টি ভাষার শুভেচ্ছা বার্তা এবং সাথে ডজন ডজন পৃথিবীর অন্য প্রাণীর – চড়ুই থেকে তিমি, আর থাকবে আমাদের দৈনিক শোনা শব্দ, যেমন হার্ট বীট, মেঘের গর্জন, আগুনের চড়বড় শব্দ এবং বাচ্ছাকে দেওয়া তার মায়ের চুম্বনের শব্দ!
ডিস্কে নারী পুরুষের মূর্তি ছাড়াও রেখে দেওয়া হল আরো নানা চিত্র - আমাদের ডি এন এ গঠন; সৌরমন্ডলের এবং তার ভিতর পৃথিবীর অবস্থান; প্রকৃতি, স্থাপত্য, নগর, উঁচু ইমারতের এর সব ছবি; বাচ্ছা-কে যত্ন নেওয়া নারীর ছবি; মানুষের শিকার করা; গ্লোব নিয়ে বাচ্ছাদের খেলা রত অবস্থা; এবং মানুষের খেতে বসার ছবি। এবার ঘটনা হল যদি কেউ মানুষ দেখেই না থাকে, এবং পৃথিবীও থাকে তাদের অচেনা, তাহলে এই ছবি দেখে তারা কি করে বুঝবে কি জিনিস দেখছে? সেই ভেবে লোমবার্গ কিছু শৈল্পিক ব্যাখ্যা/ইঙ্গিত রেখে দিয়েছিলেন ডিস্কে। যেমন নারী-র পেটের কাছে গর্ভস্থ সন্তান – আশা এই যে গ্রহান্তরের প্রাণী অন্তত কিছুটা বুঝে নেবে এই থেকে!
ছবি এবং শব্দ তো হল – তাহলে সঙ্গীত কি কিছুই ধরা থাকবে না? সেই মত ঠিক করা হল ২৬টি বিভিন্ন প্রকারের সঙ্গীত ধরা থাকবে – সে পিগমি উপজাতির সঙ্গীত থেকে শুরু করে আজেরবাইজানী ব্যাগপাইপ। আর ছিল বাখ এবং মোজার্ট। সবচেয়ে বেশী নমিনেশন এসেছিল কুইন অব দি নাইট-র মোজার্টের ‘দ্যা ম্যাজিক ফ্লুট’ পারফরমেন্স ধরে রাখার – যেখানে মানব স্বরের সবচেয়ে উঁচু পর্দা ‘এফ সার্প’ ধরা পড়েছে!
এই সব নিয়ে সেই ডিস্ক এই মুহুর্তে পৃথিবী থেকে ২৪০০ কোটি কিলোমিটার দূরে। আর আজ যদি আমরা টুক করে পৃথিবী থেকে উধাও হয়েও যাই – তাহলেও আজ থাকে অন্তত আরো ১০০ কোটি বছর আমাদের অস্তিত্ব ধরা থাকবে ১২ ইঞ্চির এক তামার ফলকে! আর তার মানে কমপক্ষে আরো ১০০ কোটি বছর ধরা থাকবে পৃথিবীর বুকে বাচ্ছাকে দেওয়া তার মায়ের চুম্বনের শব্দ!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।