কর্ণাটকের ভোটে কংগ্রেসের জয় তথা বিজেপির সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে প্রায় সবাই শুধু খুশিই নয়, অনেকটাই নিশ্চিন্ত এবং ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদীও। এই কাঙ্খিত জয় নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি প্রশংসার বন্যা বইলেও, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই জয়ের পিছনে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতা ও কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম, মরিয়া মনোভাব ও সদর্থক ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজনই মনে করেনি ও উদাসীন থেকেছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সংবাদদাতা মহল। অথচ দেখা গেল, যে ২১টি কেন্দ্রকে ছুঁয়ে গিয়েছিল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’, সেখানেই গতবারের তুলনায় চোখে পড়ার মতো ভালো ফল করেছে কংগ্রেস দল। এ প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, সফল ভারত জোড়ো যাত্রা-পরবর্তী কালে ৬ই ফেব্রুয়ারি দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে যোগেন্দ্র যাদব ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে সামাজিক আন্দোলন সংগঠন সমূহের নেতৃত্বে ‘ভারত জোড়ো অভিযান’ সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এবং সেখানেই গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উক্ত অভিযান চলবে ২০৩০ অবধি। অর্থাৎ ২০২৪-এ মোদী শাসন থেকে শুধু দেশকে মুক্ত করাই নয়, এক বিকল্প জনমুখী সরকার গঠন ও তার সাফল্যের জন্য সক্রিয় থেকে—সমাজের বুকে এযাবৎ কাল যে ঘৃণার রাজনীতির বীজ বপন করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার আন্দোলন চালিয়ে—সমাজকে সঠিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও জন-উন্নয়নের পথে পরিচালিত করাই উক্ত অভিযানের লক্ষ্য। এই অভিযানে বৃহৎ নাগরিক সমাজকে যুক্ত করাই হবে আগামীদিনে সমাজকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার সুনিশ্চিত প্রয়াস।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—অনেকে জানলেও, এখনও বেশিরভাগ মানুষই জানে না, যে—এই ভারত জোড়ো অভিযান ছিল যোগেন্দ্র যাদবের ‘ব্রেন চাইল্ড’। তিনি জানতেন এই অভিযান রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে করা সম্ভব হলে সমাজে ও রাজনীতিতে তার প্রভাব হবে অপরিসীম এবং নির্ণায়ক। সেই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে দীর্ঘদিন যোগেন্দ্র যাদবের টিম অসীম ধৈর্য সহকারে রাহুল, প্রিয়াঙ্কা ও তাঁদের মা সোনিয়া গান্ধীকে বুঝিয়েছেন, আশ্বস্ত করেছেন এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সুফল সম্পর্কে। কারণ, কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশ বিষয়টিকে খুব একটা সুনজরে দেখেননি এবং এক অজানা আশঙ্কায় এটিকে অনাধিকার চর্চা বলেই মনে করেছেন। এমনটা যে বাস্তবে সম্ভব—অনেকেই তা ভাবতে পারেননি। এই যাত্রার সাফল্য নিয়ে সংশয় ছিল খোদ রাহুলের ও তাঁর পরিবারেরও। কিন্তু এই পরিবারের সাথে যোগেন্দ্র যাদবের সুসম্পর্ক ও তাঁর প্রতি অটুট আস্থার কারণেই এমন ম্যাজিক শেষপর্যন্ত সফল হতে পারল।
দু-জন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতাকে দেখা গেল এই যাত্রা নিয়ে সক্রিয় হতে। একজন, প্রবীণ দিগ্বিজয় সিং ও দ্বিতীয়জন, জয়রাম রমেশ। প্রথমজনের ভূমিকা যথেষ্ট সদর্থক হলেও দ্বিতীয়জনের ভূমিকা ছিল কিঞ্চিত নেতিবাচক। রাহুলকে এক অজানা দুষ্প্রভাব থেকে রক্ষা করতে তিনি যেন এক স্বনিযুক্ত অভিভাবকের ভূমিকা পালনেই ব্যস্ত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাহুল গান্ধী গোটা যাত্রায় যে সাধারণ মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্য ও অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তা অন্য যে কোনো রাজনীতিকের জন্য ঈর্ষার কারণ হতে পারে। এমন দীর্ঘকালীন চলা ও এতখানি দীর্ঘ পথ পরিক্রমার রাজনৈতিক কর্মসূচি সফলতার সঙ্গে পালনের অভিজ্ঞতা অতীতে অর্জন করতে ক-জন পেরেছেন?
উক্ত যাত্রা বিষয়ে বড় ও প্রভাবশালী মিডিয়া যথেষ্ট উদাসীন থাকলেও, যেটুকু যা প্রচার করতে বাধ্য হয়েছে—তা শুধুই রাহুল গান্ধীকে নিয়ে। সেখানে এই একই যাত্রায় সামিল থাকা যোগেন্দ্র যাদবের নেতৃত্বাধীন সামাজিক আন্দোলনের একটি বড় অংশের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ আড়াল করা হয়েছে। অবশ্য এখন প্রায় সব বড় মিডিয়ায় কর্পোরেটের দখলদারিতে এসে গেছে। ফলে দু-চারটি হাতে গোনা ছাড়া বাকি সবই গোদি মিডিয়ায় পর্যবসিত হয়েছে এবং তাদের থেকে সদর্থক কিছু আশা করা স্রেফ মূর্খামি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ন নেতা যোগেন্দ্র যাদবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। সম্ভবত গোটা মিডিয়াই উপলব্ধি করতে পারছে, যে, রাজনীতির হাওয়া ঘুরতে আরম্ভ করেছে। কর্ণাটকে হারের পরে কিছু বিজেপি নেতা বেসুরো কথা বলা শুরু করেছেন। এমনকি সংঘের মুখপাত্রেও লেখা হচ্ছে ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা ও সাবধানবাণী। এসবই দেশের মানুষের পক্ষে সুখবর।
সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষায় বা মজবুত করার লক্ষ্যে অতীতে সামাজিক আন্দোলনের সংগঠনসমূহ অতীতে খুব একটা মাথা সম্ভবত ঘামায়নি, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির চাপে এখন নজর দিতে বাধ্য হচ্ছে। সেকারণেই আগামী ’২৪-এর নির্বাচনকে মাথায় রেখে, বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনকেও গুরুত্ব দিয়ে কৌশল ঠিক করতে এবং প্রচারে অংশ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলনের সংগঠনসমূহকে এর আগে সেভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখা না গেলেও, আগামী দিনে এর সদর্থক প্রভাব হয়তো দেশের রাজনীতির চালচিত্রে কিছুটা হলেও বদল আনতে পারে। এটা আশা করার কারণ সম্ভবত যোগেন্দ্র যাদবের মতো বিশিষ্ট বহু মানুষের চমৎকৃত বুদ্ধি ও কৌশলের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম সমাজ ও দেশটাকে সঠিক দিশায় নিয়ে যেতে সমর্থ হবে।