ভারত জোড়ো যাত্রার মাসাধিক কাল পার হয়ে গেল। ফলে এ যাত্রার এযাবৎ সাফল্যের নিরিখে অনেকেই বেশ আশাবাদী হয়ে বলতে শুরু করেছেন যে গোটা বিষয়টা যদি সত্যিই ক্লিক করে যায় অর্থাৎ ঠিকঠাক লেগে যায় তাহলে, রাহুল + যোগেন্দ্র (যাদব) ম্যাজিক দেশের রাজনীতির অভিমুখ ঘোরাতে সক্ষম হবে। শেষপর্যন্ত যদি সত্যিই তেমনটা হয়, তবে তা হবে এক নীরব সংসদীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ভিত খুব পোক্ত। কিন্তু একথাও ঠিক, আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র একটু একটু করে পচতে পচতে এখন একটা বদ্ধজলায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে সবাই এতটাই হতাশ যে, এর থেকে আর কিছু ভাল হবার আশা — প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু দেশে এখনও গণতন্ত্র টিকে আছে, তাই ভালো হবার আশাও টিকে আছে। তবে ২৪-এ মোদিকে হারাতে না পারলে গণতন্ত্র আর স্বমহিমায় থাকবে না বলেই অনেকের আশঙ্কা। সে' কারণেই প্রকৃত বিজেপি-বিরোধী সব দলের নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবেই বোঝে, যে, সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মোদিকে হারানো কতটা জরুরি।
আমরা সবাই আবার এটাও জানি, যে, মোদিকে হারাতে হলে বিরোধী ঐক্য অতীব জরুরি। কিন্তু বিরোধী ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে অতীত সংঘাতজনিত পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার দায়। কংগ্রেসের বর্তমান ছন্নছাড়া অবস্থা শুধরোতে না পারলে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলা বেশ কঠিন। তাই আশা করা হচ্ছে, এই যাত্রার সাফল্য অনেক সমস্যারই সমাধান এনে দিতে পারে। কংগ্রেস শক্তিশালী হলে এবং মোদির পরাজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলে বিরোধী ঐক্যের বিষয়টিও অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। একটা সহজ সত্য সবাইকে বুঝতে হবে, যে, মোদি হারলেই গণতন্ত্র বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। নইলে গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে সবই যাবে কবরে। ফলে দেশের স্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিলে বিরোধী অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মোদি আবার বাজিমাত করবে। কর্পোরেট শোষণ হবে লাগামহীন। আদানি-আম্বানিদের মুনাফা বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় আরও উঁচুতে স্থান হবে এদের। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও অত্যাচার আরও বাড়বে। অত্যাচারের শিকার হবে নারী এবং দলিতরা। চরম ক্ষতি হবে দেশের, যা কোনোমতেই হতে দেওয়া যাবে না।
বিজেপিকে টক্কর দিতে কংগ্রেসের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুশো আসনে মুখোমুখি লড়াই। বাকি আঞ্চলিক দলদের অনেকটাই কম। কিন্তু বিগত ১৯-এর নির্বাচনে কংগ্রেস বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয় এবং তার ফলেই বিজেপি এতবড় সাফল্য পায়। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, যে, কংগ্রেস ৫০/৫২তেই আটকে থাকবে ও আঞ্চলিক বা অন্যান্য দলেরা এতটাই ভালো ফল করবে, যে, বিজেপি ২০০র নীচেই থেমে যাবে। গণিত কিন্তু তা বলছে না। অতএব বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে হলে কংগ্রেসকে সাফল্য পেতেই হবে। তার জন্য প্রয়োজন শক্তপোক্ত সংগঠন এবং বিরোধী দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন। তবেই মিলবে মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আবেগীয় উচ্ছ্বাস। সেই জন্যই এই দীর্ঘ যাত্রা এত দীর্ঘসময় ধরে। এতে দল চাঙ্গা হবে, কর্মী-সমর্থকরা ফিরে পাবে মনোবল, বাড়বে নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাস। আর এসবের মোট ফল হবে মানুষের ভরসা ও সমর্থন লাভ। যে রাহুল গান্ধীকে 'পাপ্পু' বলে গালি দিয়েছে, অবহেলা করেছে বিজেপি নেতৃত্ব, ইদানিং তা আর বিশেষ শোনা যাচ্ছে না। এতেই প্রমাণিত হয় যে, রাহুল বিজেপি নেতৃত্বের কিঞ্চিৎ সমীহ আদায়ে সক্ষম হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তা আরো বাড়বে বৈ কমবে না। আশা করা যায়, যাত্রা-অন্তে আমরা এক প্রাপ্তমনস্ক ও দায়িত্ববান নেতারূপে রাহুল গান্ধীকে পাব।
এর নেপথ্যে আছে এই দীর্ঘ যাত্রাপথে যোগেন্দ্র যাদবের সহচর্য ও সুপরামর্শ, যিনি এই যাত্রায় সামাজিক সংগঠন সমূহের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং অসংখ্য অজানা সংগঠনের নেতৃত্বের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যাপক জনমত গঠনে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করছেন। এমন যাত্রা ভিন্ন এরকম সুযোগ মেলা সত্যিই দুস্কর। অনেকে এমনও বলছে যে, অতীত জয়প্রকাশ নারায়ণের ছায়া ক্রমশঃ মূর্ত হয়ে উঠছে যোগেন্দ্র যাদবের মধ্যে। কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের বিলাসবহুল রথযাত্রার জগঝম্প ও তার কুফল মানুষ অনেক দেখেছে। বিলাস-বর্জিত এমন দীর্ঘ সময় ও দূরত্বের পদযাত্রা এদেশের মানুষ সম্প্রতি কবে দেখেছে? এযাত্রার সদর্থক প্রভাব মানুষের মধ্যে অবশ্যই পড়বে আশা করা যায়। এযাত্রার বার্তা হচ্ছে — ঘৃণা নয়, বিভেদ নয়, চাই ঐক্য, চাই মৈত্রী, চাই শান্তি, চাই প্রগতি। এই যাত্রার ফলে দেশজুড়ে জনজাগরণের সম্ভাবনা ক্রমশই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই পেতে চলেছে এক নতুন মাত্রা।