কাঁহা করু বৈকুণ্ঠয়ে যায়ে
যাহা নাহি নন্দ যাহা নাহি যশোদা
যাহা নাহি জল যমুনাকে নিরমল
ঔর নাহি কদম্ব কি ছায়া
- বৈষ্ণব গীতিকার পরমানন্দ দাস এর এই আকুল আর্তি আমাদের গৌড় বঙ্গের শরীরে কাঁথার মতন জড়ানো যাকে রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন ক্ষণিকার অক্ষরে অক্ষরে, যাকে আমাদের শত সহস্র কবি লেখক সাহিত্যিক শিল্পীমন হাতড়ে বেরিয়েছে দিবানিশি। এই যে বৃন্দাবনের খোঁজ তা চিরন্তন আর সেই বৃন্দাবন সশরীরে এই পৃথিবীর বুকে খুঁজে চলার কাজটি করে চলে মায়াভূত রাশি রাশি কল্পনা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রায় যে কোন ছবিতেই এই কল্পনা নামক মায়াদণ্ডটির ক্রীড়া একান্ত আবশ্যক। আর তাছাড়া আজকের এই মৃত পশুর দেহ নিয়ে মাছির ভনভন করা দুনিয়ায় আর আছেটাই বা কি! তবু শুধু প্রলাপের মতন কিছু অন্তহীন ভালোলাগাকে নিয়ে কলম ক্ষয় না করে কালপুরুষ ছবিটিকে নিয়ে কিছু বাক্য ব্যয় করবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ এই ছবির অসামান্য বিশ্বজনীন এক আবেদন যা যত সময় অগ্রসর হবে তৃতীয় বিশ্বের শরীরে ক্রমশ: সঞ্চারিত করবে জীবনবোধ এটুকু আশা হতাশ হয়েও করাই যায়।
দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে সমালোচনাধর্মী আলোচনা না করে বরং বিষয়ভিত্তিক কিছু কথা দিয়ে শুরু করা যাক। প্রধানতঃ দুটো সমান্তরাল জীবনধারা অথবা দর্শনের উপস্থিতি এ ছবির স্থাবর সম্পদ। সম্পর্কের মূল কিছু দ্বন্দ্বের চিত্র ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্যে উঠে এসেছে। বুদ্ধদেব বাবুর বিভিন্ন ছবিতেই তিনি এই ধরণের দোটানা দ্বিধা উৎকণ্ঠার যে অবস্থান আমাদের প্রাত্যহিকতায় বিদ্যমান তাকে চিহ্নিত করে যেতে যান কিন্তু তার সঙ্গে তিনি সব সময় আমাদের বোঝাতে চান সেই সব অনুভূতির নিজস্ব পৃথিবীকে। আমাদের আশেপাশে যে জগৎ টা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলছে তারও এক চেতনা আমাদের অনুভূতিকে ধারণ করে রাখে, বিয়োগের মুহূর্তে আঘাতের মুহূর্তে স্বপ্নের মুহূর্তে সেই জগতের চেতনায় আমরা আবিষ্ট হই। তারকভস্কির ছবিতে বিবেকের যে চিত্রময়তা যে শরীরী উপস্থিতি যে স্পন্দন ধ্বনিত হয় চুপিসারে সেই ধরণের একটি মানসিক আবেগ কাজ করে বুদ্ধদেব বাবুর ছবির ভেতরে, যদিও অনেকটাই আলগোছে। ছবির শুরুতেই সুমন্ত ও তার বাবার যে রসায়ন উঠে আসে পর্দায় তা কেবল গল্প হিসাবে নয় নাগরিক জীবনের একটি অনুভূতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, ঠিক যেমন অনুভূতির কথা আমরা বলছিলাম। ট্রামের দৃশ্যটির নির্বাচন এবং তারপর নাগরিক পথে বাবার তার ছেলের প্রতি আবেগ আমাদেরকে বলে দেয় যে এ দৃশ্য কেবল আমাদের ছবির নয় বরং শহরের। ধুরন্ধর শিল্পীর মতন এর ঠিক পরে পরেই সুমন্তের স্ত্রী সুপ্রিয়ার চরিত্রটির মূল ঝোঁক টিকে অনাবৃত করে দেন পরিচালক কারণ আবেগ এবং লোভের যে সমান্তরাল প্রকাশ তাঁর উপজীব্য সেই ব্যাপারে তিনি শুরু থেকেই আমাদের জানান দিতে বদ্ধপরিকর। আর এখানেই আমার চোখে এই ছবিটির অনন্যতা।
৯০এর দশক আমাদের তৃতীয় বিশ্বকে যে রূপকথার মায়াকাজল এ প্রলুব্ধ করেছিল তার সিংহভাগই যে মার্কিন আমদানি তা বোধহয় এখন আমাদের আর জানান দিয়ে যেতে হয় না। বরং আধুনিকতার ছলে বলে কৌশলে কোকোকোলা আবিষ্কারের গুপ্ত নেশায় আমাদের শরীর এখন আচ্ছন্নতাকে অতিক্রম করে একপ্রকার অভ্যস্ত। সুপ্রিয়া চরিত্রের ভেতর দিয়ে তাই কোন বিশেষ নারী চরিত্র আদপেও নয় বরং একটি আস্ত আত্ম বিচ্ছিন্ন জাতির উপস্থিতি আমরা খুঁজে পাই। বিদ্যালয়ে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কে গ্লোব এ আমেরিকার অবস্থান জিজ্ঞেস করার দৃশ্যটি দিয়ে অদ্ভুত মুনশিয়ানায় আমাদের পরশ্রীকাতর শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থাকে ধাক্কা দেন পরিচালক। আগামী বিশ বছরে বাঙালি পরিবারের যে দাম্ভিক, অতি-বাস্তববাদী সুযোগসন্ধানী উন্নতি অভিমুখী জীবন প্রায় রোজের অভ্যাসে পরিণত হতে চলেছে তা যেন দূরদর্শী এক শিল্পী দেখতে পাচ্ছেন আর আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রথম বিশ্বের লকলকে জিহ্বার কাছে সন্তান প্রেম বা বাৎসল্যের মূল্য অপস্রিয়মাণ । গ্রীন কার্ড ভিসা আর অনসাইটের মায়ায় মগ্ন উত্তর আধুনিক বাঙালি বিশ্ব নাগরিক এর যে ছবি আজকে আমাদের দেওয়ালে দেওয়ালে বাঁধানো এ তারই এক আশ্চর্য সত্যদৃষ্ট ভবিষ্যৎবাণী। যদিও এসবই এই ছবির এক পিঠ তার উল্টো দিকে সাবেকি সম্পর্কের ওঠা নামা, অভিযোগ দোষারোপের আখ্যান যেন খানিকটা ইচ্ছাকৃত। সম্পর্কহীনতার শীতলতার বিপরীতে আমাদের সংস্কৃতি গত অবস্থান। সেই পরিবেশে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা পাই রাময়নী পালাদলের গান। পরিচালকের ছবিতে সেই উত্তরার সময় থেকেই একটি জ্যান্ত অবস্থান এই গ্রাম সংস্কৃতির, যে অর্থে ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে ওরাও দের নৃত্য আমরা পাই কিংবা তাঁর দেশজ সংস্কৃতির উপাদানগুলিকে কিছুটা জাতির অস্তিত্বের ইতিহাস ও প্রশ্নের সাথে মিলিয়ে দেখার যে প্রবণতা সেই অর্থে আমার চোখে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে গ্রাম্য সংস্কৃতি ব্যবহার হয় না। বরং জীবনের সাথে সাথে এক প্রকার স্বাভাবিক উপস্থিতি হিসাবে আমরা এই দৃশ্যগুলিকে পাই। চরিত্রের অনুভূতি, মান অভিমান, বড় অর্থে আবেগ সেগুলির সাথে দেশজ উপাদান গুলিও উপস্থিত। সেই কারণেই সুমন্তের ছেলেবেলা আর তার ছোট্ট ছেলের (তখনও আমরা যা জানি) বর্তমানকে দুটি ভিন্ন সময় কালে একই রামায়নী পালার মুখে দাঁড় করানো হয়। অবশ্য কেবল গ্রামীণ সংস্কৃতিই নয়, ছবিতে মুসলিম বাঁশি ওয়ালার উপস্থিতিও অনেকাংশে এই মানবিক অনুভূতির সাথে সাথে গ্রাম শহর নির্বিশেষে সুরের, সংস্কৃতির এবং নৈসর্গিকতার অবস্থানকে ধরতে চায় বলে মনে হয়। আমাদের সকলের হৃদয় গোপনে লুকোনো কুসুমপুর এর ঠিকানা কেউ কেউ খুঁজে পায়, কেউ কেউ পায় না। কিন্তু নিছক মানচিত্রের বাইরে চোখ রাখার যে হার্দিক স্পর্ধা তাকে আয়ত্ত করতে না পারলে এই স্বর্গ অভিযান নিষ্ফলা।
ছবিতে মায়ার এই অভিজ্ঞানের পাশে পাশে নিরন্তর অবস্থান করে লোভ, ঈর্ষা, উচ্চবিত্ততার নেশা যেমনটা জীবনে ঘটতে দেখা যায় ঠিক তেমন। ভিডিও দেখে দেখে পাশ্চাত্যের কাহিনী লিখতে থাকে সুপ্রিয়া, চোখে দেখেন না কিছুই। মেকি কল্পনার পাঁকে ডুবে থাকে তার শরীর। অদ্ভুত এক হাওয়া এসে ধূলিসাৎ করে দেয় তাঁর সেই সব মেকি কল্পনা, ম্যাজিক রিয়েলিসম ব্যাপারটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিতে আসে খুব গোপনে কিন্তু তার অভিঘাত হয় চরমতম। এ ছবিও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সুমন্তের সংলাপের ভেতর দিয়ে বহমান এক মৃদু জাদু বাস্তব এই ছবির নিজস্ব সম্পদ। শুধুই সংলাপ নয় অবশ্য, অফিসে প্রমোশন না পেয়ে নোংরা রাজনীতির বিপক্ষে একটি কুকুর হয়ে দাঁড়ায় সুমন্তের প্রতিবাদের হাতিয়ার, সে প্রতিবাদ নিষ্ফলা, তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সমস্ত খুদে মানুষদের প্রতিবাদের মতোই কিন্তু তবু যেন ভীষণ কড়া, স্বতন্ত্র সেই প্রতিবাদ। ছোট্ট দুই শিশুর মধ্যে এক অজানা কল্পনার পথের উল্টো পথে আমরা দেখতে পাই আধুনিক পৃথিবীর গোদারিয় কায়দায় তুলে ধরা পোশাকি পন্যভোগী মনোবৃত্তি। টিনটিনের বদলে টয়গান, ডিব্রুগড়ের বদলে মেড ইন ইউ এস এ, রেড জাঙ্গিয়ার সেট। তবুও বউ এর নিয়ে আসা কোট প্যান্ট টাই শার্টের সাহেবি কেতা সুমন্তের গায়ে তার নিজস্ব ব্যঙ্গ হয়ে ফুটে ওঠে। অনভিজাতর ঠাট্টা হয়ে লেগে থাকে দেওয়ালে ব্যালকনিতে। টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপকের সাথে কলকাতার বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায় সুমন্তের, বাজারি মিডিয়ার সাজানো স্বপ্নের বাগান, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশ্ববার্তা মুহূর্তের ভেতর ফিকে হয়ে আসে। গলির বাঁকে ছোড়া হাতে যুবক আমাদের এক অস্থির অতীতকে মনে করায়। এক উন্মত্ত রাগী জনতার হাত থেকে এক ছিচকে পকেটমারকে বাঁচায় সুমন্ত, এক অতি সাধারণ পিতার দুই সন্তানকে দেওয়া শিক্ষা লিখিত হয় শহরের রাস্তায়, যে শিক্ষায় কল্পনা এতটুকুও ব্রাত্য নয়, ভূত দেখতে পাওয়া স্পর্শের মতন স্বাভাবিক বাস্তব।
ছবির শেষ অংশে শহরের ট্রামের সিটে বাবা ও ছেলের মিলন ঘটে, পুরনো অভিমান - রাগ - জমানো শব্দ উৎসারিত হয় অন্তর গহ্বর থেকে। মৃত্যুর ওপারে পৌঁছে আর কিসের বাঁধা! কিসের দ্বিধা!
কোলাহল তো অনেক হল এবার কথা কানে কানে
এবার হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে।।
রাবীন্দ্রিক এই আর্তি শোনা যায় ছবির গায়ে কান পাতলে। বাবার জন্য কিনে আনা শার্ট প্যান্ট বাঁশিওয়ালার হাতে তুলে দেয় সুমন্ত। যেন আবহমান কালের কোলে ঢলে পড়ে পিতা পুত্রের সম্পর্ক। গৌরবঙ্গের বৈষ্ণব সাধকদের মতন এক স্বর্গীয় মর্ত্যধাম এর মায়া খমক ধ্বনিত হয় আশেপাশে। ভবিতব্যের সুপ্রিয়া সুমন্তকে ছেড়ে চলে যায়, দর্শক আবিষ্কার করে এক লুকিয়ে থাকা কঠিন বাস্তব। কিন্তু নিছক এক রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করে রচিত হয় বাৎসল্য, ভালোবাসার ত্রিভুবন। একের পর এক মায়া বাস্তব আছড়ে পড়ে ছবির পরতে পরতে যার ব্যাখ্যা অসম্ভব। টেলিভিশন এর পর্দায় হঠাৎ গরজে ওঠেন উপস্থাপক। মেকি নিউজ চ্যানেলের আদুরে গালে সপাটে চড় কষান। গিনিস বুক এর বিশ্ব রেকর্ড কে অস্বীকার করে শিকড়ের আভিজাত্য। মেকি বড় হয়ে ওঠা আর প্রথম বিশ্বের উলঙ্গ নিতম্ব প্রদর্শনের ওপারে একক শালীনতায় দাঁড়িয়ে থাকে সুমন্তের শরীরে - মনে – অনুভবে জাগ্রত সেই বৃন্দাবন, যা কোনভাবেই একটি শহর নয়, উগ্রতার আস্ফালন ও নয়, বরং কল্পনার নিজস্ব এক স্বর্গ। পাঠক আসুন, সেই স্বর্গের রচয়িতাকে আর এক বার স্পর্শ করি।
‘দময়ন্তী দেখলেন, তাদের গাত্র স্বেদ শূন্য, চক্ষু অপলক দেহ ছায়াহীন। তাদের মাল্য অম্লান, অঙ্গ ধূলিশূন্য, ভূমি স্পর্শ না করেই তারা বসে আছেন। কেবল একজনের এই সব দেবলক্ষণ না থাকায় দময়ন্তী বুঝিলেন তিনিই নল।’ - মহাভারত(রাজশেখর বসু অনূদিত)