এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • বিনি সুতোর বাঁধন! একটি নাগরিক কল্পনা

    তুহিনাংশু মুখার্জি
    আলোচনা | সিনেমা | ২৫ আগস্ট ২০২১ | ২৪১৫ বার পঠিত | রেটিং ১ (১ জন)
  • Every man looks out for himself and he has the happiest life who managed to hoodwink himself best of all
    _ দস্তয়ভস্কির নায়কের বিব্রত, বিষণ্ন, সংশয়ে দীর্ন বুকে এই সংলাপ উনিশ শতকের নতুন সাহিত্যের পৃথিবীতে আরো এক অলংকার প্রদান করেছিল বটে কিন্তু আসন্ন বিংশ শতাব্দী কিংবা আরো এক শতক পেরিয়ে নাগরিক জীবনের স্নায়ুতে, শিরায় হৃদয়ে জঠরে বয়ে বেড়ানো প্রায় এক ধ্রুব বেদনাকে যে সে অনুমান করেছিল তার জন্যই বোধহয় আধুনিক সাহিত্যে সৃষ্টি ও সত্ত্বার জন্ম। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ উপন্যাসের পর দীর্ঘ সময় কেটেছে, আধুনিক সাহিত্য, শিল্প সিনেমা নাটক নানাভাবে চেয়েছে নাগরিক মানুষের অস্তিত্বের গভীরে ডুব দিতে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতেও এই অনুসন্ধান এখনও মেটেনি কারণ তা মেটারও নয়, যে বিশ্বায়িত পুঁজির পসরা আমাদের জীবন যাত্রার অলিতে গলিতে কংক্রিটের মতোই ছড়ানো, তার মায়াবাস্তব থেকে পরিত্রাণ এর কোন পথ যেমন নেই, তেমন ই আধুনিক মানুষ সেই চক্রাকার নাগরদোলায় দুলতে দুলতেই হটাৎ যেন স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে – look here upon this picture and on this: Have you eyes?(hamlet- 3rd act)

    জানি না, এরকমই কিছু কিছু ব্যক্তিগত অনুভবের তাগিদ কে ভিত্তি করে অতনু ঘোষের নতুন ছবি তৈরি বলেই কি দস্তয়ভস্কি র উক্তি দিয়ে এই ছবির সূচনা? উত্তর যাইহোক, এ ছবি আধুনিক জীবনের মূলতঃ নাগরিক জীবনের বিবমিসার থেকে ক্ষণিক মুক্তি চায়, স্ব- অস্তিত্ত্ব আর কল্পনাকে কামনা করে, যতটুকু প্ৰতিরোধ সম্ভব এই বীর্য হীন, অনুভূতিহীন, পাথুরে সময়ের ততটুকু করে যেতে চায় অবিরত। ছবির শুরুতেই ভোগবাদী সমাজের স্বচ্ছ চিত্রপট আমরা দেখতে পাই ৫০ লক্ষ টাকার লটারি প্রতিযোগিতায়, আমরা খুঁজে পাই আমাদের চরিত্রদের, না তারা কোন অভিজাত শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত নয়, নয় কোন অলীক রূপকথার নায়ক নায়িকা কিংবা রহস্যময়ী কোন অতি-মানবী। আমরা দেখতে পাই তারা নেহাতই ছাপোষা জীবনের মালিক। ব্যক্তিগত কিছু কথাবার্তা চলে, দুটি চরিত্রের ভেতর আমরা দর্শক একটু একটু করে ঢুকি। ছবির এই অংশে ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং জয়া আহসান উভয়ের অভিনয় যথাযথ, চিত্রগ্রহণ ও মোটামুটি ভাবে সাবেকি, যেন অতি পরিচিত বিষয় আমরা দেখতে পাই অতি সহজে ভাবেই। ছবির আসন্ন ভবিষ্যতের জন্য, পরিচালকের লুকোনো তাসে ট্রাম্প করার প্রয়োজনে যে এ এক প্রস্তুতি চাল, তা দর্শক হিসাবে আমরা ধরতে পারিনা। এর কিছু মুহূর্ত পর আমরা যখন তাদের নতুন ভাবে আবিষ্কার করা শুরু করি, আমরা বুঝি যে সহজ সরল ভঙ্গির বহিঃ কাঠামোয় লেখক তথা পরিচালক আসলে হাঁটতে চান শহুরে মনস্তত্ত্বের জটিল সারণি ধরে।

    ক্রমশই এই ধারণা যেমন পরিপক্ক হতে থাকে দর্শকের মাথায়, তেমনই আপ্পু প্রভাকরের ক্যামেরা খুব সচেতনভাবেই এক রকম অস্পষ্টতা নিয়ে আসে ফ্রেমে। কিছু কিছু দৃশ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কম আলোয় রাখা হয়েছে যা ওই মুহূর্তে দর্শকের জানা অজানায় মিশে থাকা অনুভূতিকে গাঢ় করে। পাশাপাশি জয়া এহাসান এর চরিত্রের মুখকে আয়নায় প্রতিফলিত করা কিংবা রৌদ্রস্নাত বারান্দায় একটি কমলালেবু , বৃষ্টির দৃশ্য এসব কেবলই মূহুর্তকে ধরে রাখা বলে মনে হয় না যা পরিচালকের অন্যান্য ছবির প্রায় প্রধানতম সম্পদ। বরং আধুনিক জীবনের যে সমস্ত না বলা, দ্বিধা কিংবা উষ্মা যা আধুনিকতার গলার হার হিসাবে শোভা পায় সে সবের প্রকাশ বলে মনে হতে থাকে। কাহিনির গোপনতা ভঙ্গের দায়ে আসামী সাব্যস্ত না হয়েও বলা যায় যে যেভাবে এ ছবির চরিত্র রা নিজেরা নিজেদের গল্পকে, কাহিনীকে নির্মাণ করে কিংবা বিনির্মাণ করে তা মিখাইল বাখতিন কিংবা রোলা বার্ত সহ উত্তর আধুনিকতার বেশ কিছু দেওয়াল স্পর্শ করে ফেলে। ব্লাশোর লিখনের ও লেখকের মৃত্যু সংক্রান্ত যে ধারণা মূলত উপন্যাসের সংজ্ঞাকে একসময় নস্যাৎ করে যায়, সেরকমই কাহিনীচিত্রের গল্প কেন্দ্রিকতাকে সপাট চড় কশানোর এক অপার সম্ভাবনা তৈরি হয় ছবির মধ্যভাগে যদিও শেষমেষ এই ছবি চলচ্চিত্রে র প্রথাগত বিন্যাস কে সন্মান দেখায়, গোদারের পিয়ে লে ফ্যু হতে পারেনা যা বাঙালি দর্শক কে বিব্রত হবার হাত থেকে হয়ত বাঁচিয়ে দেয়, তবু সেই উঁকি মারা সম্ভাবনার জন্যও পরিচালকের ধন্যবাদ প্রাপ্য বৈকি।

    দেবজ্যোতি মিশ্রের অসামান্য সুর এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নৈপুণ্য ছবিকে যথার্থই একটি মানবিক মাত্রা দেয়। যেভাবে পরিচালকের পূর্ববর্তী ছবি ‘রোববার’ এ গানকে একটা চরিত্র দেবার চেষ্টা হয় তা কিন্তু এখানে নেই এবং অত্যন্ত সচেতনভাবেই নেই। বরং গানের লিরিক কে যেভাবে ছবির মুহূর্তের সাথে জুড়ে দেবার প্রয়াস করা হয়েছে তা অনবদ্য। আরো একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে তা হল যে ছবির বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সংগীতের মূলতঃ সুরের অনুপস্থিতি যা সাম্প্রতিক ভারতীয় ছবিতে বিশেষ পাওয়া যায়না, দৃশ্যকে দৃশ্যের মতন রেখে দিয়ে দর্শকের মস্তিষ্ককে সুযোগ করে দেবার অতি দুর্লভ প্রয়াস এ ছবিতে পাওয়া যায়।

    অভিনয় বিভাগে আলাদা করে বলার দাবি রাখে দু একটি ছোট ছোট চরিত্রের অসামান্য অভিনয়, সিনেমা যে কেবল তার নায়ক নায়িকাকে বক্ষে লালন করেই বেড়ে ওঠে না- এই বোধের সুপ্ৰকাশ আমরা এই ছবিতে পাই। মূল চরিত্র দের অভিনয়ও বেশ জমাট।

    কর্পোরেট দুনিয়ার পৈশাচিক অপরাধহীনতা, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে দেখনদারি, একাকীত্ব, অপরাধবোধ, রোজকার জীবনে সিসিফাসের মতন ওঠা আর নামা- এসব কিছুই দর্শক পাবেন এই ছবিতে যা তার জীবনেরই উপপাদ্য। পাশাপাশি আছে এক বাবার তার ছেলের ভবিষ্যতের প্রতি প্রত্যাশা- এই রোজনামচার গদ্যের প্রথা ভেঙে খানিক কাব্যিক যা এক প্রকার জোর করেই মনে করায় সদ্যপ্রয়াত পরিচালক শ্রী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে। আরও আছে দাদার জন্য বোনের বুকের ভেতর লুকিয়ে কামড়ানো গোপন কষ্ট, অপরাধবোধ। ফেলে আসা মায়ের প্রতি ছেলের সলজ্জ অনুভব। একটির পর একটি সুতো জুড়ে জুড়ে নয় বরং সুতোগুলি এক আদুরে গোপনীয়তায় লুকোনো যা আমাদেরকেই খুঁজে পেতে হবে দর্শক, এ সবই আমাদের চেনা, কোথাও না কোথাও দৈনন্দিনতার ভেতর আমরা রোজই আবিষ্কার করি এসব কিন্তু প্রতিরোধ? এই সার্বিক অবক্ষয়, এই অনন্ত অসহায় কালনাগিনীর বিষে জর্জরিত বিশ্বায়ন উত্তর পৃথিবী যেখানে মৃত্যুনিশীথের শীতলতা আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া হাড় হিম করে দিচ্ছে সেখানে প্রতিরোধের ভাষা কি আদৌ হয়? কামুর উপন্যাসের নায়ক বা ‘ন্যসিয়া’ উপন্যাসের রোকেতার মত এই ছবির নায়ক নায়িকা খুঁজে পেতে চেয়েছে সেরকমই এক পরিসর যাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য আমরা ব্যাকুল হতে পারি যদি চাই। এই ছবির একেবারে শেষ মুহূর্তে যে ভালো লাগা, যে জীবনকে গ্রহণ করবার এক উদার অনুভূতি, হালকা অভিমানবোধ তা আজকের ইঁদুরদৌড়ে এক অসামান্য প্রাপ্তি বললে বোধহয় সামান্য অত্যুক্তিও হয় না।

    আমাদের জীবনে গল্পের যে অভাব যে সার্বিক কল্পনাহীনতা আমাদেরকে গ্রাস করে আছে সকাল থেকে মধ্যরাত, সান্ধ্য ধারাবাহিক, অলৌকিক অতিবাস্তব ওয়েব সিরিজ, সপ্তাহান্তে রেস্তোরাঁ আর মারণ ভাইরাসে মিলে মিশে আমাদের যে পাঁচমেশালী ককটেল তার বাইরে এক একান্ত ব্যক্তিগত চেতনার খোঁজ পেতে এ ছবি অতনু ঘোষের খুব দামি এক উপহার।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ আগস্ট ২০২১ | ২৪১৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    উৎসব - Manali Moulik
    আরও পড়ুন
    মোসাহেব - Rajat Das
    আরও পড়ুন
    সময় - Prasun Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন