প্রথমে বিশেষ কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করি। তাতে বিষয়টার গভীরতা ও গুরুত্ব বুঝতে সুবিধে হবে। প্রত্যেকটি ঘটনাই আমার নিজের চোখে দেখা। এবং ঘটনাগুলির প্রতিটিই ঘটে চলা এরকম আরো অসংখ্য 'কেস'-এর সামান্য হিমশৈলের চূড়া।
১. ৪০ বছরের পুরুষ। গলার চারদিকে অনেকগুলো উঁচু উঁচু ডিমের মত দেখতে জিনিস লক্ষ্য করছেন মাস তিনেক ধরে। মাঝে মাঝে ঘুসঘুসে জ্বর, দুর্বলতা। ফোলা অংশগুলোয় ব্যথা সেরকম নেই। পাড়ার কোয়াক, এ ডাক্তার সে ডাক্তার ঘুরে শেষমেশ ডায়াগনোসিস হ'ল টিউবারকুলার অ্যাবসেস। সোজা ভাষায় বললে টিবির ফোঁড়া। ভদ্রলোকের মোটেই বিশ্বাস হ'ল না তাঁর শরীরে টিবি আসতে পারে। তিনি বেশ অবস্থাসম্পন্ন, স্বচ্ছল পরিবারের। তিনি জানেন, টিবি-ফিবি ওসব গরীব লোকের রোগ। তাঁর এই চিকিৎসা পছন্দ হ'ল না। শহরের নামকরা হোমিওপ্যাথের কাছে গেলেন। তিনি প্রথমেই 'বিষাক্ত ও অপ্রয়োজনীয়' অ্যালোপ্যাথি ওষুধ বন্ধ করার নিদান দিলেন। তারপর অর্থলোলুপ মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারকে বাক্যবাণে সংহার করলেন। তারপর তাঁর হোমিও দাওয়াই শুরু হ'ল। বলে দিলেন ওগুলো আসলে টিউমার। ওষুধ চলাকালীন পেঁয়াজ বন্ধ করতে হ'ল। তারপর দীর্ঘদিন বিশ্বাস রেখে ওষুধ খেয়ে যেতে বললেন। প্রায় তিনমাস কাটার পরেও রোগ সারার নাম নেই বরং বেড়ে চললো। এদিকে একদিন পাড়ার দোকানের ছেলেটা ফিসফিস করে বলে গেল হোমিও পুরিয়ার মধ্যে একটা ট্যাবলেট গুঁড়ো করে মেশানো হয়। সেটাই তাঁকে তিনমাস ধরে খাওয়ানো হচ্ছে। ট্যাবলেটের স্ট্রিপের গায়ে লেখা- প্রেডনিসোলোন!! যাইহোক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগে তিনি সরকারি হাসপাতালে আসেন। ততদিনে টিবি ছড়িয়ে গেছে অনেকটা। যে সরকারি হাসপাতালকে চিরকাল গালাগালি দিয়ে এসেছেন সেখানেই প্রায় মাস দুয়েক ভর্তি থেকে তারপর নিয়মিত আউটডোরে চিকিৎসার পর সুস্থ হন।
২. আমাদের হোস্টেলের মেসে যে রোগা লিকলিকে ছেলেটা কাজ করতো সে একদিন বাড়ি গিয়ে চটজলদি মোটা করে দেওয়ার আয়ুর্বেদ ডাক্তারের খোঁজ পায়। চেম্বারের সামনে বড় বড় বিজ্ঞাপন- "আপনার হাড় জিরজিরে চেহারা নিয়ে চিন্তিত? ছ'মাস ওষুধ সেবন করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোন" অতঃপর ছেলেটা কিছু কালো কালো শিকড়-বাকড় আর রোজ একটা করে ট্যাবলেট নিয়মিত খেয়ে গেল। মাস চারেক বাদে তার এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) টিবি ধরা পড়লো। এই টিবি মারাত্মক রকমের প্রাণঘাতী আর সাধারন টিবির ওষুধ দিয়ে এর চিকিৎসা করা যায় না।
ট্যাবলেটটা ছিল ডেক্সামেথাজোন!!!
৩. পাঁচ বছরের বাচ্চা। কাশি আর ধূম জ্বর। হাসপাতাল প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে। গ্রামে পাশ করা ডাক্তার নেই। পাড়ার কোয়াক ভরসা। দু'দিনে জ্বর কমছে না দেখে কোয়াক বাচ্চার বাবার হাতে ধরিয়ে দিল ওমনাকর্টিলের বোতল। কোয়াক শুধু জানে, আর কিছুতে কাজ না হ'লে ওমনাকর্টিল দিলেই সব রোগ সেরে যায়। একদিন যায়,দু'দিন যায়... জ্বর কমে না। দশদিনের মাথায় প্রায় ধুঁকতে থাকা বাচ্চা হাসপাতালে এসে পড়লো। অবস্থা অভিজ্ঞ ডাক্তারের চোখ এড়ালো না। শহরে রেফার করা হ'ল। বুকের খোলে পুঁজ থিকথিক করছে। নিউমোনিয়া বাড়তে বাড়তে এই অবস্থা!! আইসিইউ-তে হপ্তা তিনেক,তারপর অপারেশন টেবিল ঘুরে টুরে প্রায় মাস দুয়েক বাদে বাড়ি ফিরেছিল ছেলেটা।
৪. এবার পাশ করা মডার্ন মেডিসিনেরই ডাক্তার। সাত বছরের মেয়েটার দাদ। প্রেস্ক্রিপশনে বাজার চলতি দাদের ওষুধ লিখে দিলেন। তার কম্পোজিশনে লেখা ছিল, নিওমাইসিন-মাইকোনাজোল-ক্লোবিটাসল। প্রথম পাঁচ-ছ'দিনে ম্যাজিক! অনেকটা কমে গেল! চুলকুনিও ভ্যানিশ! কিন্তু তারপর... দুদিন ওষুধ বন্ধ হলেই দাদ আবার ঘুরে ঘুরে আসে। চাকার মত দেখতে দাদের আকার-আকৃতিও কেমন বদলে যায়। এদিকে দীর্ঘদিন ওই মলম লাগিয়ে আশেপাশের চামড়াটা কেমন পাতলা আর লাল হয়ে এসেছে...
৫. প্রায় একইরকম ঘটনা হয়েছিল চটজলদি ফর্সা করার ক্রিম মেখে।
ওপরের ঘটনাগুলোর কোনটাই বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা মিল আছে, যাকে আমরা স্টেরয়েড বলি। স্টেরয়েড নামটা শুনেই অনেক শিক্ষিত মানুষ চমকে ওঠেন। সত্যিই কি স্টেরয়েড এরকম ক্ষতিকর জিনিস?
স্টেরয়েড মানেই ক্ষতিকর ? স্টেরয়েড কতটা ক্ষতিকর ?
প্রথমেই একটা জিনিস সাফ সাফ বলে দেওয়া যাক। স্টেরয়েড জিনিসটা মোটেই ভয়প্রদ কিছু নয়। এবং, তার পরেই যোগ করে দিই- যদি উপযুক্ত ব্যবহার হয়। বস্তুত, ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে স্টেরয়েড যে পরিমাণ জীবন বাঁচিয়েছে কিংবা রোগকষ্ট লাঘব করেছে তাতে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক, টিকা বা ওআরএস-এর সাথে এক সারিতে রাখাই যায়।
শুরুটাও বেশিদিন আগে নয়। প্রথম স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় ১৯৩০ সাল নাগাদ। তখনও তার নাম স্টেরয়েড হয়নি। প্রথমদিকে মূলত টেস্টোস্টেরন জাতীয় যৌগ ব্যবহার হ'ত। প্রথমে মুখে খাওয়া হ'ত। পরে জানা যায়, মুখে খেলে অধিকাংশটাই লিভারে ধ্বংস হয়ে যায়। তখন পেশীতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মধ্যে শক্তিবর্ধক হিসেবে স্টেরয়েড নেওয়ার চল শুরু হয়। নাৎসী ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবন্দীদের ওপর স্টেরয়েড প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। শোনা যায়, হিটলার নিজেই নাকি স্টেরয়েড নিতেন এবং তার ফলে তাঁর মধ্যে স্টেরয়েড সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৫৬ সালের ওলিম্পিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাথলেটরা নিজেদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক সক্ষমতা বর্ধক ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং খেলায় চোখ টাটিয়ে দেওয়ার মত সাফল্য পান। ১৯৫০ সালে প্রেডনিসোন আবিষ্কার এবং তার বানিজ্যিক উৎপাদন ৫ বছর বাদে। তারপর পরবর্তী ছয় দশকে স্টেরয়েড মডার্ন মেডিসিনের রাজপথ-অলি-গলি চষে বেড়িয়েছে। বর্তমানে মডার্ন মেডিসিনের প্রতিটি সাব-স্পেশালিটির সাথে স্টেরয়েডের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
প্রকারভেদ
আমাদের কিডনির ওপরে ছোট্ট দুটো অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি। তার বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড বেরোয়।
ক> কর্টিকোস্টেরয়েড
তার দুটি ভাগ। ১. মিনারেলোকর্টিকয়েড (অ্যাল্ডোস্টেরন ইত্যাদি) ২. গ্লুকোকর্টিকয়েড (প্রেডনিসোলন, বিটামেথাজোন, ডেক্সামেথাজোন, হাইড্রোকর্টিজোন ইত্যাদি )
খ> সেক্স স্টেরয়েড। ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি। সোজা কথায় বললে আমরা পুরুষ ও নারী হরমোন বলতে যা বুঝি সেগুলো।
গ> অ্যানাবলিক স্টেরয়েড
এই পোস্টে আমরা মূলত গ্লুকোকর্টিকয়েড আর অ্যানাবলিক স্টেরয়েড নিয়ে আলোচনা করবো। তবে সেসব পরবর্তী পর্বে। আপাতত চলুন আবার কয়েকটি ঘটনা দেখে নেওয়া যাক-
১. পরিতোষ বাবু প্রবল হাঁপানির কষ্টে ভোগেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। যে ওষুধ দিয়ে তাঁর চিকিৎসা হয় সেটা একটা স্টেরয়েড।
২. মনামী ঘোষ সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় প্রসব করেন। বাচ্চার ফুসফুস শক্তিশালী করতে যে ওষুধটা দেওয়া হয় সেটা স্টেরয়েড।
৩. ১৬ বছরের মেয়েটার জ্বর কিছুতেই নামে না। মাথার চুল উঠে যায়। মুখে ঘা। গালে আর নাকের ওপর কেমন প্রজাপতির মত দেখতে লাল দাগ। ডায়াগনোসিস হল- এসএলই। অন্যান্য ওষুধের সাথে স্টেরয়েডটাও শুরু হল।
৪. ৮০ বছরের ঠাকুমার গাঁটে ব্যথার চিকিৎসা হল গাঁটে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিয়ে।
৫. যে টিবির কথা বলেছিলাম যেটা কিনা সাধারণভাবে স্টেরয়েড পেলেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে সেখানেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা হয়।
৬. মার সাথে ঝগড়া করে পনেরো বছরের মেয়েটা সিলিং থেকে ঝুলে পড়ে। হাসপাতালে যখন আনা হয় প্রায় শেষ দশা। আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়েছিল বারো দিন বাদে। ওষুধ? সেই স্টেরয়েড।
৭. তিন বছরের বাচ্চার হিসু দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যায় আর বাচ্চাটা ফুলতে থাকে। এখন স্টেরয়েড চিকিৎসার পর সুস্থ।
৮. সারা গায়ে মৌমাছি হুল ফুটিয়েছিল আট বছরের ছেলেটার গায়ে। প্রবল ব্যথা, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। স্টেরয়েডে মুক্তি।
৯. আশঙ্কাজনক কোভিডের কথা তো আগেই বলেছি।
*******
এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বিশেষত, অটো-ইমিউন ডিজিজের চিকিৎসায় এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে স্টেরয়েড বিপ্লব এনেছে। আবার আপনি বলবেন সেগুলো কী?
অটো-ইমিউন ডিজিজে আপনার শরীরের অনাক্রম্যতার সিস্টেম আপনার শরীরকেই চিনতে ভুলে যায়। ভেবে নেয় বহিরাগত শত্রু। আর নিজের সাথে নিজের লড়াইতে আপনি রক্তাক্ত হন। তারপর শরীরের সালিশি সভায় বিবাদ মেটায় স্টেরয়েড। ইনফ্লামেশন মানে প্রদাহ। খুব সোজা করে বললে ওই ধরুন কাঁটা ফুটে জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠলো, ব্যথা হ'ল... এরকম একটা ব্যাপার। শরীরের মধ্যেকার প্রদাহ জিনিসটা বড্ড গোলমেলে। কখনও সেটা ভালো কখনও খারাপ। কাজেই বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না।
এসব ক্ষেত্রেও স্টেরয়েড গুলোর নাম সেই একই। প্রেডনিসোলন, ডেক্সামেথাজোন, হাইড্রোকর্টিজোন। অর্থাৎ, প্রথম পর্বে যে নামগুলো দেখে আপনি নাক কুঁচকে আর চোখ গোল্লা করে ভয়ে ভয়ে তাকিয়েছিলেন সেই নামগুলোই এবার আশীর্বাদের নাম।
কী? ঘেঁটে গেলেন তো?
তাহলে পরের পর্বে সেই নিয়ে কাটাছেঁড়া চলবে ।
সত্যিই স্টেরয়েড নিয়ে অনেক ভুল ভাবনা আছে। যেন নিষিদ্ধ ওষুধ, এইরকম চোখ গোল করে তাকেন অনেকে।
পরের কিস্তি আসুক। খুব প্রয়োজনীয় লেখা।
ভাল লাগছে
সহজবোধ্য ভায়ায় স্টেরয়েড নিয়ে লেখাটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, কোথাও হোঁচট না খেয়ে। ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ স্টেরয়েড ভীতি কাটনোর জন্য। শুনেছি যে স্টেরয়েড চিকিৎসায় অনেক রোগে ধাপে ধাপে মাত্রা বা ডোজ কমানো হয়, সেটা কী কী রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? আশাকরি পরের কিস্তিগুলোতে এ নিয়ে আলোকপাত করবেম।
ইন্টারেষ্টিং
পরের কিস্তির জন্য আধীর আগ্রহে বসে রইলাম, খুব ভাল লাগল
একজন নরমাল লোক , যার খাওয়া দাওয়া , হজম শক্তি , পায়খানা পেচ্ছাব ইত্যাদি নরমাল , বিপি কিছুটা বিরক্ত করে , তাও ওই খাওয়া দাওয়া একটু এদিক ওদিক হলেই , ঘুম ভালো ,বার্ধক্য জনিত রোগ যেমন দাঁত নড়া চুল পাকা , ঘুম টা একটু পাতলা হওয়া এসবের ঝামেলা তো থাকবেই !! স্বাভাবিক সেক্সচুয়াল লাইফ ।..তারও একটা লক্ষণ রেখা থাকবেই জীবনে !তার পরেও স্টেরইড ?????দরকার হয় কি ??একটু সংযত জীবন , বিশেষ করে ""ইউ আর হোয়াট ইউ ইট ""এই তত্ত্বে একটু বিশ্বাস রাখা !!!!সর্বোপরি ।...মন কে চিন্তাশীল রাখা , একটু অন্যের সাহায্যে আসা ।...এর পরেও কি স্টেরইড ??? দরকার হয় কি ??বিশেষ ভাবে অসুস্থ মানুষের কথা না হয় বাদ দিলাম , সেখানে নিশ্চই দরকার , আর অন্য জায়গায় ???
ভালো লেখা। অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
স্টেরয়েড জিনিসটার রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পর্কে একটু বলবেন। কিভাবে কাজ করে।