কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা যে-কোনো দেশ, ভাষা কিংবা কাঁটাতারের সীমানা ও কারাগারের বন্ধন থেকে মুক্ত মানুষ। প্রত্যেক মহান কবি ও সাহিত্যিকের, সে তিনি যে ভাষার বা যে দেশেরই হোন না কেন, প্রজ্ঞা ও চেতনা সর্বজনীন হয়, কারণ তাঁর কথা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় এবং হৃদয়েই গিয়ে স্থান পায়। এ কারণেই কালিদাস, বাণভট্ট, শেকস্পিয়র, মিল্টন, টেনিসন, বায়রন, সাদী, খসরু, রুমি, হাফিজ়, রবীন্দ্রনাথ, মীর, গালিব, ইকবাল, নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকরা, আন্তর্জাতিক খ্যাতির অংশীদার এবং এঁদের লেখা পৃথিবীর অজস্র ভাষায় অনূদিত হয়েছে, জনপ্রিয় হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যের অঙ্গীভূত হয়েছে।
এই লেখকের দুটি ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে — উর্দু ও ফার্সি, কিন্তু প্রায়শই অন্য ভাষার, যেমন ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, আরবি ইত্যাদির, কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা পড়ার ও তাঁদের বিষয়ে লিখবার সুযোগ হয়েছে। আমার খুব ভালো মনে আছে, এম.এ. পড়বার সময়ে বন্ধুদের বাড়ির এলাকায় নানা ভাষাভাষী মেধাবী ছাত্রদের কথা। এঁদের মধ্যে এক বাঙালি ছাত্র মহাকবি রবীন্দ্রনাথের একটি ছোটো চার ছত্রের কবিতা শুনিয়েছিল, যা আমায় খুব প্রভাবিত করে—
কর্তব্যগ্রহণ
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
উৎসাহ জাগ্রত করা এবং অসম্ভবকে সাহস, স্পর্ধা এবং ক্রমাগত প্রচেষ্টা দ্বারা সম্ভব করবার এই কবিতা আমায় খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরপর আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়া শুরু করলাম এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও অনুভব আস্বাদনের আনন্দ আমার জীবনে প্রবেশ করল। এ ছাড়াও বাংলার অনেক মহান কবি ও সাহিত্যিকের রচনার রসে ডুবতে থাকলাম। বলতে দ্বিধা নেই শঙ্খ ঘোষ তাঁদেরই একজন। উর্দু এবং বাংলাভাষী মানুষকে সাহিত্যের নিরিখে কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে প্রাচ্য ভাষাবিদ শান্তিরঞ্জন ভট্টাচার্যের অবদান উল্লেখযোগ্য।
শঙ্খ ঘোষ সর্বজনপ্রিয় একজন কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বাংলার বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, এভং অচিরেই প্রখ্যাত লেখক, বিদ্বান, সমালোচক এবং শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি অধ্যাপনা সূত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও ছিলেন বিশ্বভারতী এবং শিমলার ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভানস্ড্ স্টাডিজ-এ।
সাহিত্যে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। একজন মহৎ কবি ও সার্থক তরজমাকার হওয়া ছাড়াও তিনি ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন বলেও শুনেছি । তাঁর সাহিত্যকীর্তির যথোপযুক্ত মূল্যায়ন এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে সম্ভব নয়। সেজন্যেই আমি এখানে এই স্বনামধন্য কবির কয়েকটিমাত্র কবিতার উল্লেখ করব।
শঙ্খ ঘোষ একজন সংবেদনশীল কবি, যাঁর আঙুলে সমাজের নাড়িস্পন্দন নির্ভুল ভাবে অনুভূত হয়। তাঁর দৃষ্টি সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি এবং ট্র্যাজেডির ওপর কেন্দ্রীভূত। এবং তিনি তাদের ওপর শব্দের পোশাক সযত্নে পরিয়ে দেন। তাঁর কাব্য সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কণ্ঠস্বর এবং সহজ ও সাবলীল। একইসঙ্গে তা গভীর ও বলিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, তাঁর কবিতার মধ্যে এক অসীম তাৎপর্যও অন্তর্লীন থাকে। তিনি যে বিষয় নিয়েই লেখেন, অত্যন্ত ‘rhetoric eloquence’ নিয়ে লেখেন। শব্দের ওপর তাঁর রাজকীয় দখল। এক-একটি শব্দ যেন আংটির ওপর রত্নের মতো গাঁথা থাকে।
শঙ্খ ঘোষ প্রাচ্যের মহান কবি অলাম্মা ইকবালের মতো সহজাত কাব্যপ্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন। ছোটো ছোটো বস্তুকে অকিঞ্চিৎকর মনে করে আমরা মূল্য না দিলেও, তাঁরা তার মধ্যে প্রকৃতির রহস্য আবিষ্কার করেছেন এবং আমরা শিহরিত হয়েছি। এই তো এক মহান কবির মাহাত্ম্য। তিনি ‘শরীর’, ‘বাঘ’, ‘ব্যাঙ’, ‘বাড়ি’, ‘ভিড়’, ‘পুতুলনাচ’, ‘ধর্ম’, ‘একদিন আমরাও’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘না’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘শাদাকালো’, ‘হওয়া’, ‘নিগ্রো বন্ধুকে চিঠি’ ইত্যাদি আকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুন্দর ও অর্থবোধক কবিতা লিখেছেন। আসুন, তাঁর কিছু কবিতার পর্যালোচনা করা যাক।
‘না’ একটি চিন্তাশীল ও সুন্দর কবিতা। এখানে কবি বলছেন, দুনিয়া এবং তার সমস্ত কিছু পরিবর্তনশীল। জীবন কখনও একই অবস্থায় থাকে না। তার প্রত্যেক মুহূর্তই ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে। কবি জীবনের নির্দিষ্ট সংকটগুলির উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন, এর পর কী! মানুষের মনে অসংখ্য আশা-আকাঙ্ক্ষার দোলাচল, তারা সেসব আশা পরিপূর্ণ করার জন্য উদ্ব্যস্ত, কিন্তু দূরদর্শী প্রশ্ন করেন এর পর কী! প্রেম, মায়া-দয়া, বংশ, সম্মান, তৃপ্তি ইত্যাদি সবকিছু পাওয়ার পর তার সমস্ত সন্ধান শেষ হয়ে যায় কিনা সেই নৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা কে করবে? এর জবাব তো নঞর্থকই হবে। এই সমস্ত চেষ্টাচরিত্র অর্থহীনই প্রমাণিত হবে। প্রখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিব এই অন্তহীন বাসনার কথা কবিতায় বলেছেন এইভাবে—
হাজারোঁ খোয়াহিশেঁ অ্যায়সী কে হর খোয়াহিশ পে দম নিকলে
বহোত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফির ভি কম নিকলে—
(লক্ষ বাসনা এমন যে বাঁচব না একটিও দেয় যদি ফাঁকি
মিটেছে অনেক সাধ, তবুও সবই যেন রয়ে গেল বাকি।) (অনুবাদ : নীলাঞ্জন হাজরা)
‘বাড়ি’ কবিতাটিও ওঁর একটি বিশেষ অর্থবহ রচনা। এটিতে এক অতুলনীয় প্রজ্ঞা এবং অনুভবের প্রকাশ ঘটেছে। কবির মন পৃথিবী এবং তার দুনিয়াদারির হাঙ্গামা থেকে দূরে থাকতে চায়। এক পরম শান্তিময় আবাসের সন্ধান থাকে তার। কবি এখানে এক অপূর্ব সুন্দর রচনাশৈলীতে সেই ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলেছেন। আপনারা কি জানেন সে কেমন ঘর? সে ঘর আত্মিক এক আবাস, এ পৃথিবী থেকে অনেক দূরে কোথাও হয়তো।
‘ভিড়’ নামের কবিতাটিতে কবি অসহায়তা ও অস্বীকৃতির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে এটি এমন একটি মানবিক গুণ যা শতসহস্র লোকের ভিড়ের মধ্যেও মানুষের ব্যক্তিত্বকে বিশিষ্টতা দান করে, আলাদা করে অন্যের থেকে। তখন সে আর নিছক ভিড় বা ভিড়ের অংশ হয়ে থাকে না। দীনতা এক মহান উত্তরাধিকার, যে যত মহান, সে ততই মাটির কাছাকাছি, আর এতেই তার মাহাত্ম্য আরও বৃদ্ধি পায়।
পারস্যের সুবিখ্যাত কবি শেখ সাদী শিরাজি এইভাবেই এই গুণকে ব্যাখ্যা করেছেন, “বুদ্ধিমান মানুষ প্রীতিকেই শিরোধার্য করে, কারণ ফুলভারানত বৃক্ষশাখা সর্বদাই তার মাথাকে মাটিতে ঝুঁকিয়ে রাখে।”
‘প্রতিহিংসা’ ঘৃণার প্রতিশোধ ছাড়া আর কীই-বা। অপরাধের সর্বোত্তম প্রতিশোধ ক্ষমা ছাড়া আর কী! কেউ একজন কী অসাধারণ বলেছেন, ক্ষমা করায় যে তৃপ্তি, তা প্রতিশোধ নেওয়ায় নয়। এই চিন্তাকেই কবি শঙ্খ ঘোষ বড়োই সুন্দর আঙ্গিকে পেশ করেছেন।
কবি প্রেমকে হৃদয়ের গভীর আবেগ ও পবিত্র আকাঙ্ক্ষা দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। প্রেম যতক্ষণ হৃদয়ের আবেগবঞ্চিত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো গুরুত্ব নেই। যখনই সে আবেগপূর্ণ হয়, তখনই তার মূল্য। এই কবিতাতেও কবি প্রেমকে আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার আগুন দিয়ে দীপ্যমান করে তুলেছেন এবং এভাবেই এক মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন।
সংক্ষেপে, শঙ্খ ঘোষ বাংলা ভাষার এক মহান কবি, যাঁর কবিতা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় এবং হৃদয়ে গভীর প্রভাবও ফেলে।
তাঁর সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করি।