তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির নেশা আর বিশেষ বিশেষ ছাঁচে গড়া ভাবনা মানুষের মনোজগতে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং দুনিয়ার বাস্তব থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে মনুষ্যত্বহীন করে তোলার জন্য ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-কে আমরা যতই ঘৃণা করি না কেন, একটা কথা মানতেই হবে, ভাষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা, চিন্তার বাঁক এবং পরিপ্রেক্ষিতের বিবিধতা নির্বিশেষে এই সোশ্যাল মিডিয়া দুনিয়ার মানুষের মধ্যে এমন যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করেছে যেমনটা আগে কখনও আমাদের দিল-ও-দিমাগেই আসেনি। সম্পূর্ণ অনির্ধারিত অ্যালগোরিদম্ এবং হ্যাশট্যাগের খেয়ালখুশিতেই কিন্তু আমার শঙ্খ ঘোষ প্রাপ্তি। আমার উপলব্ধি, বাংলা কবিতার দুনিয়ায় কীভাবে তিনি হিমালয়ের মতো বর্তমান।
নীলাঞ্জনের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় আমি তাকে পরিচয় করিয়েছি কাশ্মীরি কবিতার উৎস থেকে শুরু করে তার নানা ধারার সঙ্গে। আমাদের কবিতা কীভাবে বিশদে বাংলায় নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে আমরা একটা যৌথ পরিকল্পনা করছি। এমনই এক কথোপকথনের সময় ও যখন আমায় শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে লিখতে বলে, কথাটা লঘু ভাবে নিতে পারিনি। ডুব দিলাম তাঁর কবিতায়। বাংলা তো পড়তে পারি না। ছোট্ট একটা সংকলনই সম্বল— রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে প্রকাশিত, দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর ইংরেজি তরজমা।
রবার্ট ফ্রস্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘তরজমায় যা হারিয়ে যায়, তাই কবিতা।’ বটে, কিন্তু আমি বলব, তরজমার কাজটা হল এক অপরিহার্য পাপ। আমরা কোনোদিন হুবহু তরজমা করতে পারব না। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট তরজমা নিরন্তর করে যেতেই হবে, নইলে কবিদের অগণিত দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হবেন কী করে গভীরে উৎসাহী পাঠক? তবেই না শঙ্খ ঘোষের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়!
আমি কবিতা লিখি, কবিতা তরজমাও করি। আর তা করি লাল দেদ এবং হাব্বা খাতুনের দেশ থেকে। আমি বিলক্ষণ বুঝি যে-কবির কাঁধে মহান কবিদের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরম্পরা, কী বোঝা তাঁকে বহন করতে হয়, কী চাপের মধ্যে লিখতে হয় তাঁকে। লোকে তা দেখতে পান বা না পান, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন কী না করেন, অতীতের সেই মহান কবিরা যে সৃষ্টি রেখে গিয়েছেন তার সঙ্গে বর্তমান কবির সৃষ্টির নিরন্তর একটা অন্যায় তুলনা ভিতরে ভিতরে চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় লেখেন শঙ্খ ঘোষ। কাজেই তাঁর কবিতা হাতে পাওয়া মাত্র মনে হয়েছিল, দেখি তো তাঁর বাচনভঙ্গি ও বক্তব্য থেকে কতটা চুঁইয়ে পড়ছেন রবীন্দ্রনাথ! প্রথমেই এই মানদণ্ডটা আমিও ঠিক করে ফেলেছিলাম।
বইটা পড়তে পড়তে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, এ তুলনা অন্যায়, এমন আশাটাই আসলে অন্যায়। পঞ্চাশটি মাত্র কবিতার সে সংকলন যখন শেষ করলাম, শঙ্খ আমার কাছে প্রতিভাত হলেন একেবারে স্বাধীন, সম্পূর্ণ স্বকীয় এক স্বর হয়ে। সে স্বর আমার কাশ্মীরি সংবেদনশীলতাকে নাড়া দিয়ে গেল, কিন্তু আমি এও বুঝলাম এই স্বর সংবেদনশীল কেরালাইট কিংবা রুশ মনকেও নাড়া দিয়ে যাবে। এ কথা বলে আমি কী বোঝাতে চাইছি? আমি বলতে চাইছি যে, তিনি সর্বজনীন কবি। ভাষা, সংস্কৃতি, অঞ্চলের সীমানা নির্বিশেষে যিনিই তাঁর কবিতা পড়ার সুযোগ পাবেন, সে পাঠকের মনকেই তা নাড়া দিয়ে যাবে, কারণ তাঁর কবিতার আবেদন যে অপাপবিদ্ধ, মৌলিক মনুষ্যত্বের কাছে।
শঙ্খ ঘোষের কবিতা আমাদের নিয়ে একটা সফরে রওনা হয়— যে সফরে প্রত্যেক যুক্তিবাদী মন ও অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় প্রশ্ন করতে চায়, এ অস্তিত্ব আসলে কী? প্রশ্ন করতে চায়, সতত পরিবর্তনশীল ছবিগুলিকে। প্রশ্ন করতে চায়, মহাশক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কী? এবং সেই সফর শুরু করে সকল দর্শনের সেই অন্তিম খোঁজ, যার নাম মৃত্যু।
যেমন ধরা যাক তাঁর ‘ভিড়’ কবিতাটা। আমি তো দেখি তিনি তার মধ্যে বহন করে নিয়ে চলেছেন উর্দুর মহান কবি মহম্মদ ইকবাল, কিংবা কাশ্মীরের মহান কবি রেহমান রাহির পরম্পরা, যখন তিনি সেই মহাশক্তির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন সুদৃঢ় এবং নির্ভীক জিজ্ঞাসার স্বরে:
“আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?”
এমন উচ্চারণ থেকে আমরা বুঝি দেবত্ব, ঐশ্বরিক অলঙ্ঘনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে চিরাচরিত ধ্যানধারণা থেকে কতদূর এগিয়ে গিয়েছেন শঙ্খ, যদিও আধ্যাত্মিক রহস্যের মধ্যেই তাঁর পরিশীলিত বিচরণ। এ উচ্চারণে প্রতিফলিত হয় অন্বেষিত ও অন্বেষণকারীর মধ্যে এক নিবিড় যোগাযোগ, প্রতিফলিত হয় একটা পরিবেশ যেখানে বৌদ্ধিক অন্বেষণ উৎসাহিত, কুসংস্কার আর গোঁড়ামির অন্ধ কুঠরিতে দৈবের বিভাজন নয়।
আমার মনে হয়েছে শঙ্খ ঘোষের কবিতার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফিরে ফিরে আসা বিষয় হল, অস্তিত্বের ধারণা নিয়ে তাঁর নিরন্তর চিন্তা। এই কবিতাগুলি অন্তর্মুখী স্বগতোক্তিতে ভরপুর। ভরপুর মনুষ্যচেতনা এবং আত্মসচেতনতার কাটাছেঁড়ায়। এবং ভরপুর সেই খোঁজেও যা বুঝতে চায় কীভাবে এই অস্তিত্ববোধ সামাজিক বিধিনিষেধের সঙ্গে খাপ খাওয়ার অপচেষ্টায় নিজেকে ভ্রান্তভাবে প্রকাশিত করে।
ধরুন ‘ব্যাঙ’ কবিতাটা। কবি প্রথমে একটা সর্বাঙ্গসুন্দর বাড়ির ছবি আঁকতে চাইছেন, তার মাছ, পাখি, ফুল এই সবকিছু নিয়ে।
ব্যাঙ
এ বাড়িতে
যা যা থাকা উচিত, সবই আছে
মাছ আছে পাখি আছে ফুল আছে।
তাছাড়া কুকুর আছে, যেটুকু দরকার আলো আছে, সিঁড়ির তলায়
অন্ধকারও আছে,
ঘরে ঘরে নানারঙা মোজেইক
সবই আছে ঠিক। আছে
পিতলদানিতে শোভা, ফ্রেমে বাঁধা হালফিল ছবি
আছে সবই। এমনকী ওরা দুজনেও
বেশ আছে
এত বেশি আছে যে জানে না বুকের মধ্যে কাচে
আসলে লাফায় বুড়ো ব্যাঙ।
কবিতার অন্তে এসে কবি পাঠককে চমকে দিচ্ছেন ঘুরপথে এক অন্তর্মুখী সফরে, যেখানে ‘… বুকের মধ্যে কাচে / আসলে লাফায় বুড়ো ব্যাঙ’।
আবার দেখা যাক এই কবিতাটা—
শরীর
শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটছে, ডাক্তার
ঠিক জানি না
কীভাবে বলতে হয় তার নাম
আয়নার সামনে বসলে ভারী হয়ে নামে চোখ
পেশির মধ্যে ব্যথা
ভিতর থেকে ফুটে বেরোয় হলুদ রঙের আলো
কিন্তু সে তো গোধূলির আভা। রক্তে কি
গোধূলি দেখা যায়?
রক্তে কি গোধূলি দেখা যায়? যাওয়া ভালো?
শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে, ডাক্তার
জানি না তার নাম।
অবাক লাগে ভাবতে, চিরকালের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা তিনি কীভাবে পুরে দিচ্ছেন, কী এক নয়া কৌশলে, চিকিৎসকের সঙ্গে অনায়াস আটপৌরে কথোপকথনের মধ্যে—“শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটছে, ডাক্তার / ঠিক জানি না”
সেই তলে তিনি আমাদের ফের নিয়ে চলে যেতে চান ‘না’ কবিতাটিতেও।
না
এর কোনও মানে নেই। একদিনের পর দু-দিন, দু-দিনের পর তিনদিন
কিন্তু তারপর কী?
একজনের পর দু-জন, সুজনের পর দুর্জন
কিন্তু তারপর কী?
এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান।
তুমি বলেছিলে ঘর হবে, ঘর হলো
তারপর কী?
তুমি বলেছিলে স্নেহ হবে, স্নেহ হলো
তারপর?
কতদূরে নিতে পারে স্নেহ? অন্ধকারও আমাকে সন্দেহ
করেনি কখনো
বুকে বসে আছে তার এত বড়ো প্রতিস্পর্ধী কোনো!
না-এর পর না, না-এর পর না, না-এর পর না
তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?
দেখুন, ‘এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান।’ থেকে শুরু করে তিনি পাঠককে কী এক অনির্ধারিত ত্রিশঙ্কু আতঙ্কমিশ্রিত বিস্ময়ে নিয়ে গিয়ে হাজির করেন।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায় অস্তিত্বের গতিপ্রকৃতি উন্মোচনে নিয়োজিত অবশ্যই, কিন্তু তিনি এ বিষয়েও বিলক্ষণ সচেতন যে, অনেক কিছুই বাহিরে প্রতিভাত হয়ে চলে, আর সেই বাহিরে প্রতিভাত-টা যা প্রকৃত ‘আত্ম’ তার বিশুদ্ধ প্রকাশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, কাজেই আমাদের যত সামাজিক কাজ-কারবার। এই কবিতায় তিনি এ বিষয়টি মন্থন করেছেন —
মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়
ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?
মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে
বসে থাকি?
মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই
মানব শরীর একবার?
দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার
ভেসে-ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?
যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও।
কী-বা আসে যায়
লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়!
আমি সেটা অনুভব করেছি বিশেষ করে এ কবিতার এই পঙ্ক্তি দুটিতে—“মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই / মানবশরীর একবার?”
তাঁর একটা কবিতার শিরোনাম আমার কাছে দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে—
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিয়ন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
এ কবিতার শেষ স্তবক ইঙ্গিত দেয় কী মেকি, অসম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তাকে আমরা চারিপাশে প্রতিভাত করতে থাকি।
যে শঙ্খ ঘোষকে আমি তাঁর কবিতায় পাই, তিনি সমাজের চলতি ব্যবস্থা, তার রীতিনীতিগুলির বিষয়ে দারুণ সজাগ, তীক্ষ্ণ তাঁর পর্যবেক্ষণ। তাঁর কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহের উপাদান, এমনকি রয়েছে ‘সিনিসিজম’-এর চোরা স্রোতও। বিদ্রোহটা আত্মসন্তুষ্টি এবং সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে। দেখুন এই কবিতাটা—
পুতুলনাচ
এই কি তবে ঠিক হলো যে দশ আঙুলের সুতোয় তুমি
ঝুলিয়ে নেবে আমায়
আর আমাকে গাইতে হবে হুকুমমতো গান?
এই কি তবে ঠিক হলো যে বৃষ্টিভেজা রথের মেলায়
সবার সামনে বলবে ডেকে, ‘এসো
মরণকূপে ঝাঁপাও’?
আমার ছিল পায়ে পায়ে মুক্তি, আমার সহজ যাওয়া
এ গলি ওই গলি
আমার ছিল পথশ্রমের নিশানতোলা শহরতলি
উত্তরে-দক্ষিণে
আমার চলা ছিল আমার নিজস্ব, তাই কেউ কখনো
নেয়নি আমায় কিনে
এমন সময় তুমি আবিল হাত বাড়িয়ে যা পাও
স্বাধীনতায় দিচ্ছ গোপন টান—
এই কি তবে ঠিক হলো যে আমার মুখেও জাগিয়ে দেবে
আদিমতার নগ্ন প্রতিমান?
কোনো একজনকে সুতোয় বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, আর কবি শেষ পর্যন্ত তাঁকে দিয়ে দিচ্ছেন, যা আসলে কবির নিজেরই গভীরে-কাঙ্ক্ষিত, সেই স্বাধীনতা—“আমার চলা ছিল আমার নিজস্ব, তাই কেউ কখনো/নেয়নি আমায় কিনে”
ব্যক্তিগতভাবে এ সংকলনের একটা কবিতা পড়ে আমি একেবারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি—‘রাধাচূড়া’। চর্বিতচর্বণ চিরাচরিত পরম্পরার বজ্রমুঠি অমান্য করে মুক্তি ও বেড়ে চলার অন্বেষণের স্বরূপকে সুস্পষ্ট করতে তিনি যে চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন এই কবিতায়, তাই হতবাক করেছে আমায়—
রাধাচূড়া
মালী বলেছিল। সেইমতো
টবে লাগিয়েছি রাধাচূড়া।
এতটুকু টবে এতটা গাছ?
সে কি হতে পারে? মালী বলে
হতে পারে যদি ঠিক জানো
কীভাবে বানায় গাছপালা।
খুব যদি বাড় বেড়ে ওঠে
দাও ছেঁটে দাও সব মাথা
কিছুতে কোরো না সীমাছাড়া
থেকে যাবে ঠিক ঠাণ্ডা চুপ—
ঘরেরও দিব্যি শোভা হবে
লোকেও বলবে রাধাচূড়া।
সবই বলেছিল ঠিক, শুধু
মালী যা বলেনি সেটা হলো
সেই বাড় নীচে চারিয়ে যায়
শিকড়ে শিকড়ে মাথা খোঁড়ে, আর
এখানে-ওখানে মাটি ফুঁড়ে
হয়ে ওঠে এক অন্য গাছ।
এমনকী সেই মরশুমি টব
ইতস্ততের চোরা টানে
বড়ো মাথা ছেড়ে ছোটো মাথায়
কাতারে কাতারে ঝেঁপে আসায়
ফেটে যেতে পারে হঠাৎ যে
সেকথা কি মালী বলেছিল?
মালী তা বলেনি, রাধাচূড়া!
বিশেষ করে বলছি এই চিত্রকল্পটির কথা—“এমনকী সেই মরশুমি টব/ইতস্ততের চোরা টানে/বড়ো মাথা ছেড়ে ছোটোমাথায়/ কাতারে কাতারে ঝেঁপে আসায়/ফেটে যেতে পারে হঠাৎ যে/সে কথা কি মালী বলেছিল?”
এবারে পরপর যে দুটো কবিতা তুলে দেব, তা ইঙ্গিত দেয় শঙ্খ ঘোষের সামাজিক দৃষ্টিকোণ সমাজবাদী ও বহুজনহিতায় মতবাদে বিশ্বাসী।
শাদাকালো
পথের ওই খুনখুনে বুড়ো
যখন এগিয়ে এসে বলে ‘আমি চাই।
দেবেন না? না দিয়ে
কাকে ঠকাচ্ছেন মশাই?’
আর চারদিক থেকে ভদ্রলোকেরা :
‘সাবধান, সরে যান
লোকটা নির্ঘাৎ টেনে এসেছে
কয়েক পাঁইট’
তখন আমার সামনে কেঁপে দাঁড়ায়
ওয়াশিংটনের আরেক মস্ত বুড়ো
থুত্থুরে
ছেঁড়া বুকে ঢিল খেতে খেতে
তবু যে আঙুল তুলে বলেছিল ‘শোনো
আই অ্যাম ব্ল্যাক
ও ইয়েস, আই অ্যাম ব্ল্যাক
বাট্ মাই ওয়াইফ ইজ হোয়াইট!’
নিগ্রো বন্ধুকে চিঠি
রিচার্ড, তোমার নাম আমার শব্দের মধ্যে আছে
রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয়। রিচার্ড আমার শব্দ নয়।
রিচার্ড, তোমার নাম আমার স্বপ্নের মধ্যে আছে
রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয়। রিচার্ড আমার স্বপ্ন নয়।
রিচার্ড, তোমার নাম আমার দুঃখের মধ্যে আছে
রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয়। রিচার্ড আমার দুঃখ নয়।
কিন্তু এ সংকলনে এমন কবিতা এতই কম যে, তাঁকে এখুনি সমাজবাদী কবি বলে চিহ্নিত করতে পারছি না।
তবে আমার মনে হয়েছে এই সংকলনে যে বিষয়, যে ‘থিম’-টি সবথেকে বেশি উঠে এসেছে তা হল ‘চিতা’, যা মানুষের এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাত্রা কিংবা মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী। এ সংকলনে তাঁর অধিকাংশ কবিতায় তা প্রসারিত। আমার কাছে, যে-কোনো কারণেই হোক, সেটিই শঙ্খ ঘোষের কবিতার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক উপাদান বলে মনে হয়েছে। যার ফলে আমার মনে হয়েছে তিনি জুয়ান এলিয়া বা আহমদ নদীম কাসমি-র মতো মহান উর্দু কবির সমগোত্রীয়। সারাক্ষণ শঙ্খ এঁকে তুলতে চান তাঁর নিরন্তর সঙ্গী শূন্যতা, রিক্ততা, না-থাকা-র সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের ছবি, এবং সে লড়াই কীভাবে তিনি নিয়ে যেতে চান তাঁর চিতা পর্যন্ত। মনে হয় যেন চিতা তাঁর কাছে একাধারে অন্তিম পরিণতি ও নতুন নাচ, নতুন নতুন মাত্রার বিস্তার, নয়া জীবনের শুরু।
চিতা
আজ সকাল থেকে কেউ আমাকে সত্যি কথা বলেনি
কেউ না
চিতা, জ্বলে ওঠো
সকলেরই চোখ ছিল লোভে লোভে মণিময়
মুখে ফোটে খই
চিতা, জ্বলে ওঠো
যা, পালিয়ে যা
বলতে বলতে বেঁকে যায় শরীর
চিতা
একা একা এসেছি গঙ্গায়
জ্বলে ওঠো
অথবা চণ্ডাল
দেখাও যেভাবে চাও সমীচীন ছাইমাখা নাচ।
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই বিশেষ করে এই পঙ্ক্তিগুলির প্রতি—“যা, পালিয়ে যা/বলতে বলতে বেঁকে যায় শরীর/ চিতা/একা একা এসেছি গঙ্গায়/জ্বলে ওঠো…” যা পড়ে রইল তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আগামীকে আলিঙ্গন, গভীর কৌতূহল নিয়ে।
এ সংকলনে আমার আর একটি অতি প্রিয় কবিতা ‘ধর্ম’।
ধর্ম
শুয়ে আছি শ্মশানে। ওদের বলো
চিতা সাজাবার সময়ে
এত বেশি হল্লা ভালো নয়।
মাথার উপরে পায়ের নীচে হাতের পাশে ওরা
সবাই তোমার বান্দা
ওদের বলো
বলো যে এই শূন্য আমার বুকের উপর দাঁড়াক
খুলুক তার গুল্ফ-ছোঁয়া চুল
মুকুটভরা জ্বলে উঠুক তারা। ওরা পালাক
আর, নাম-না-জানা মুণ্ডমালা থেকে
ঝরে পড়ুক, ধর্ম ঝরে পড়ুক
ঠাণ্ডা মুখে, আমার ঠাণ্ডা বুকে, ঠাণ্ডা!
কবি যে ছবি আঁকছেন তাতে তিনি শ্মশানে। চিতা তৈরি হচ্ছে। আর সেই সময়েই তিনি অস্তিত্ববাদের (এক্সিস্ট্যনশিয়ালিজম)-এর অতি প্রিয় প্রতীক ‘শূন্য’ উচ্চারণ করছেন: “বলো যে এই শূন্য আমার বুকের উপর দাঁড়াক/খুলুক তার গুল্ফ-ছোঁয়া চুল/মুকুটভরা জ্বলে উঠুক তারা। …” আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন চারপাশে কী রয়েছে, কী-ই বা নিরন্তর রয়েছে তাঁর অন্তরে তার অর্থের কোনো কূলকিনারা না পাওয়ার কথা।
মনে হয় যেন, শঙ্খ জীবনের অনিত্যতা এবং মৃত্যু থেকে পালানোর অসম্ভবতার বিষয়ে সজাগ ও সচেতন। যে মৃত্যুকে তিনি নিজের বলে অবলোকন করেছেন, অবলোকন করেছেন কত অজস্র রূপে। আমরা পড়ি—
ধ্বংস করো ধ্বজা
আমি বলতে চাই, নিপাত যাও
এখনই
বলতে চাই, চুপ
তবু
বলতে পারি না। আর তাই
নিজেকে ছিঁড়ে ফেলি দিনের পর দিন।
বলতে চাই, জানি
জানি যে আমার মজ্জার মধ্য দিয়ে তোমার
ঘিরে ঘিরে পাক দেওয়া টান
বলতে চাই তোমার শেষ নেই তোমার শুরু নেই, কেবল জল, লবণ
তোমার চোখ নেই স্নায়ু নেই
শুধু কুসুম
শুধু পরাগ, আবর্তন, শুধু ঘুর্ণি
শুধু গহ্বর
বলতে চাই, নিপাত যাও—ধ্বংস হও—ভাঙো
কিন্তু বলতে পারি না, কেননা তার আগেই
তুমি নিজে
নিজের হাতে ধ্বংস করো আমার ধ্বজা, আমার আত্মা।
পেয়ে যাই এমন সব পঙ্ক্তি—“বলতে চাই, নিপাত যাও—ধ্বংস হও— ভাঙো/ কিন্তু বলতে পারি না, কেননা তার আগেই/তুমি নিজে/নিজের হাতে ধ্বংস করো আমার ধ্বজা, আমার আত্মা।” কী সহজে তাঁর ক্রিয়াকর্মের সব কিছুর নশ্বরতাকে দেহ দেন তিনি এবং আলিঙ্গন করেন। তাঁর আর একটি কবিতা ‘ত্রিতাল’। পাই সেই ফিরে ফিরে আসা অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু—
ত্রিতাল
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে
তোমারই ঐ টুকরো-করা-শরীর
দুঃসময়ে তখন তুমি জানো
হল্কা নয়, জীবন বোনে জরি।
তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা-
মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই
কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল!
পাই এমন পঙ্ক্তি—“তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া… তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই/ শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।”
অজস্র প্রগাঢ় উপমা আর ইশারা জানান দেয়, শঙ্খর কবিতায় কত অজস্র স্তর। পড়ুন—
শূন্যের ভিতরে ঢেউ
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর,
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?
এবং লক্ষ করুন—“কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম/ সকলেই চেয়েছে আশ্রয়/…/শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে/সেকথা জানো না?”
শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া এক গভীর কৌতূহলোদ্দীপক, আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আমি মূলের ভাষা বা তার নান্দনিকতা নিয়ে কিছু বলতে তো পারি না, শুধু এটুকু বলতে পারি, তরজমায় যে কবিকে পাই তিনি গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সূক্ষ্ম সংবেদনশীল, গভীর আবেগময়, নির্ভুল পর্যবেক্ষণকারী এবং পরিশীলিত ভাবনার মানুষ। তিনি কবিতা-শিল্পটিকে করায়ত্ত করেছেন ন্যূনতম শব্দ খরচ করে সর্বাধিক সম্ভব ভাবপ্রকাশের পারদর্শিতায়। তাঁর কবিতার কথোপকথনের ভঙ্গিমা এবং বিবিধ উত্তর তুলে ধরা আমাকে প্লেটো-র ‘রিপাবলিক’, এবং পারসিক কাব্যের ‘কথোপকথন’ (ডায়ালগ) গোত্রের কবিতার কথা মনে করায়। আমার কাছে তিনি বিপুল পড়াশোনা করা একজন কবি, যাঁর এক চক্ষু নিবদ্ধ বিশ্বসাহিত্যের উপর।
শেষ করি শঙ্খরই ক’টি পঙ্ক্তি দিয়ে—
“কিছু শব্দ কটা দিন উচ্ছলতা পায় মুখে মুখে
তারপরে মরে যায়, আমরা তার শব নিয়ে ঘুরি
দুহাতে তাকেই তুমি সাজাও যে রাগে-অনুরাগে—
ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার জেনেছ কি আগে?”
(ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার)
লেখক কাশ্মীরের নবীন কবিদের মধ্যে অন্যতম স্বর। কবিতা লেখা শুরু করেন উর্দু ও ইংরেজিতে, পরে আশ্রয় নেন কাশ্মীরি ভাষার। হাব্বা খাতুন, আমীন কামিল, মেহ্জুর, শাদ রমজ়ান, রেহমান রাহি প্রমুখ কাশ্মীরি কবির কবিতা তিনি তরজমা করেছেন। সম্প্রতি কাহিনি-গদ্যের জগতেও প্রবেশ করেছেন, ছোটো গল্প দিয়ে। তাঁর লেখালিখিতে নারীর স্বর সুস্পষ্ট। তিনি পেশায় টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার।
ইংরেজি থেকে বাংলায় তরজমা : নীলাঞ্জন হাজরা
শঙ্খ ঘোষের স্কেচটি এঁকেছেন হিরণ মিত্র।
শঙ্খ ঘোষের ছবি সৌজন্য সন্দীপন চক্রবর্তী ও ফেসবুকের ‘শঙ্খ ঘোষ পেজ’।
সম্পাদনা : নীলাঞ্জন হাজরা
অনবদ্য একটি পর্যালোচনা পড়লাম। বাংলাভাষী না হয়েও শুধুমাত্র ইংরাজি তর্জমা পড়ে এমন অবিচল অন্তর্নিহিত বিস্তার এর আগে পড়েছি বলে মনে হয় না। প্রগাঢ় ভাবনাশীল হলে বোধহয় এমন লেখা, লেখা যায় । শঙ্খ বাবুর জন্মদিনে যে'কটা শ্রদ্ধার্ঘ পড়েছি তার মধ্যে এইটি অন্যতম। আমরা যারা একসমুদ্র বাংলা ভাষার কবিতার গভীর দিঘি থেকে এক মগ জল আহরণের চেষ্টা করে চলেছি তাদের কাছে এ লেখা অমূল্য। ধন্যবাদ গুরুচণ্ডালি পেজকে, এমন একটি মনোগ্রাহী লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
অনন্য প্রাপ্তি!