প্রতিবেশী হিসেবেই হয়তো আমি বাংলা সাহিত্যের এক পল্লবগ্রাহী আর বিমুগ্ধ পাঠক। এবং ‘আমার’ রবীন্দ্রনাথ, ‘আমার’ জীবনানন্দ, ‘আমার’ বুদ্ধদেব বসু, কিংবা ‘আমার’ বিষ্ণু দে-র মতো ‘আমার’ শঙ্খ ঘোষ হৃদয়-মনে খোদিত হয়ে রয়েছে অনেক কাল জুড়ে। যেরকম “দিবসের শেষ সূর্য/শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,/নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,/কে তুমি—/পেল না উত্তর।” অথবা “তোমার নগ্ন নির্জন হাত” আমার চেতনায় নাড়া দিয়েছিল একদিন, অথবা আজও দেয় অহরহ, শঙ্খ ঘোষেরও কুড়ি-দুই কুড়ি কবিতা এখনও নিস্তার দেয়নি আমাকে আন্দোলিত চেতনার সেই পয়লা ঝাঁকি থেকে। আমার এই সাড়া তাই এক বিমুগ্ধ প্রতিবেশীর সাড়া।
আবু সয়ীদ আইয়ুব সংকলিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’-য় পড়েছিলাম বুদ্ধদেব বসুর সেই ‘পথের শপথ’ কবিতা: “বিরতিবিহীন কাল/চল্লিশে দিল তাল—/আশা নাই আর আশা নাই।” কিন্তু চল্লিশে তাল দেবার দুই বছর আগেই শঙ্খ ঘোষ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০)। গত বছর তার দ্বাবিংশ সংস্করণে পরের যুগের কবিতার কয়েকটা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনাও সংযোজিত হয়ে এই বই আজ সমসসাময়িক ভারতীয় কবিতার সোনার খাঁচা। সুবর্ণজয়ন্তীও হয়ে গেল ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র।
অসমের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের আত্মিক সংযোগের স্বাক্ষর কামাখ্যা-বশিষ্ঠাশ্রম-নবগ্রহের স্থানগত আত্মার দ্যোতনাতেই কেবল নয়, তা পাই ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ অথবা স্তব্ধতায় ভরা এমন কবিতায় —
গান
জ্যোৎস্নায় মাখানো কাশ। ব্রহ্মপুত্র স্তব্ধতায় একা।
দূরের স্মরণরেখা জেগে ওঠে চরের উপরে।
বালিতে জলের ছোঁয়া, সেই জল ইন্দুনিভাননা
তুলে নিয়ে দেখি হাতে, অঞ্জলিতে যতটুকু ধরে।
তারই মধ্যে দেখা ভাসে যত কিছু ভূত-ভবিষ্যৎ
তারই মধ্যে বহমান এই মুহূর্তের নীরবতা—
দিগন্তে নদীতে মিলে গড়ে-তোলা নীলাভ ঝিনুক
তারই মধ্যে মুক্তো হয়ে লীন আজ আমাদের কথা।
মৃত্যুর চেয়েও বেশি ঘনতায় ভরে আছে প্রাণ
সমস্ত শরীর তার এই রাত্রে গানের সমান।
সে স্বাক্ষর পাই ভূপেন হাজারিকার গানের অনুরণনে ভরা এই কবিতাতেও —
সকলের গান
কামাখ্যা তার শিখর থেকে
ব্রহ্মপুত্র দেখায়
তিরিশ বছর থমকে আছে
বশিষ্ঠ-আশ্রমে
নবগ্রহের নীলসবুজে
ঝাঁপিয়ে ওঠে পা—
কিন্তু আমি আমিই কি না
আজ সে হিসেব হবে।
লাঞ্ছনাতে বয়স মাপে
শাদা খড়ির দাগ
সমস্ত গা-য় উলকি দিয়ে
হলকা তোলে শিখার—
সেই মুহূর্তে হঠাৎ যেন
শুনতে পেলাম সুর
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গলায়
ভূপেন হাজারিকার।
আবার সাড়া লাগল চোখের
জলের উপত্যকায়
অন্ধ হয়ে যাবার আগে
হাত বাড়াতে চাই।
কে যেন গান গেয়েছিলেন
গঙ্গা আমার মা
কী দিয়ে তাল দেবে দু-হাত
মশাল না কি ছাই।
টুকরো করে দেব আবার
একান্ন তার ভাগ
উড়িয়ে দেব গাঙ্গেয় দিন
অখণ্ড নিশ্বাসের—
সেই মুহূর্তে আবার যেন
শুনতে পেলাম সুর
ভূপেন হাজারিকার গলায়
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের।
এবং তা পেয়ে যাই বিয়াল্লিশের সেই মৃত্যু গুঁড়িয়ে ফেলে আনতে যাওয়া স্বাধীনতার মহাস্বপ্নেও। এই কবিতায় মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৭০-১৯৪২)-র সঙ্গে সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে অসমের দুই নারী ভোগেশ্বরী ফুকননি (১৮৮৫-১৯৪২) আর কনকলতা বরুয়া (১৯২৪-১৯৪২)-র বিরল আত্মত্যাগ—
এজলাশ
মাতঙ্গিনী হাজরাকে আমরা গুলি করে মেরেছি ধর্মাবতার
সত্যি যে, মেরেছি আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বরুয়াকে
ঘরের বউ ভোগেশ্বরী ফুচননি১-কে—
সত্যি যে, দৈবাৎ আমরা নারীঘাতী, অসহায়ভাবে নারীঘাতী আমরা দৈবাৎ।
কিন্তু ভাবুন, ধর্মাবতার, ভাবুন ঐ আন্দোলনওলাদের ধাষ্টামো
‘ভারত ছাড়ো’ হাঁক দিয়ে কাপুরুষেরা সামনে এগিয়ে দিয়েছিল মেয়েদের
আমাদের হাত কলঙ্কিত করে দেবার জন্য
ভাবুন কী ঘৃণ্য সেই চক্রান্ত, ধর্মাবতার।
অমৃতসরে আমাদের নিছকই এক বদ্লা নেবার দিনটায়
পাঁচিলঘেরা বাগানে যেখানে একটাই মাত্র সরু প্রবেশপথ
যৎকিঞ্চিৎ নারীশিশুকে আমরা খুন করে ফেলেছি ঠিকই
ওদের বুকের দিকে ছিটকে ছিটকে গেছে গুলি মাত্র ষোলোশো রাউন্ড
আর খামোখাই লালরঙে ভিজে গেছে মাটি।
ঠিক, কিন্তু ভাবুন ধর্মাবতার
কোন্ হীন মতলবে ওখানে ওদের টেনে এনেছিল পাঞ্জাবের বুরবকরা
আমাদের—শুধু আমাদেরই জব্দ করবার জন্য!
কিন্তু না
কোনো এজলাশে একথা বলতে পারেনি কেউ
আশ্চর্য যে
সাফাই গাইবার জন্য এইটুকু বুদ্ধিও সেদিন হয়নি হাবা ইংরেজদের।
দেশপ্রেমের গতানুগতিক কবিতা ছাড়া অন্য কোনো সিরিয়াস প্রসঙ্গে আমি এর আগে ভোগেশ্বরী ফুকননি এবং কনকলতা বরুয়ার কথা পাইনি কোথাও: শঙ্খ ঘোষের কবিতায় পৃথক এক প্রসঙ্গে মাতঙ্গিনী হাজরার সঙ্গে এই দুই অসমিয়া নারী প্রতিভাত হয়েছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধিক্কারের দুই জীবন্ত রূপক হয়ে, ইতিহাসের প্রায় এক কাফ্কা-ধর্মী রহস্যময় এজলাশের ভেতরে।
বাস্তবের অন্তরালবর্তী হাজার অনুভূতির আবিষ্কার-পুনরাবিষ্কার কিংবা পরীক্ষণ-পুনর্নিরীক্ষণই হয়তো শঙ্খ ঘোষের কবিতার সহজ সংজ্ঞা। তাঁর নীচু গলার প্রায় প্রতিটি উৎসারণে যেন ধ্বনিত হয়েছে পাস্কেল-কথিত সেই অন্তহীন মহাশূন্যের আবহমান নীরবতা। তাঁর কবিতাময় উচ্চমানের গাম্ভীর্য, সন্দেহ নেই: কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়া-র অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ প্রয়োগের দৃষ্টান্তগুলি এইরকমের— অনুভূতির সঙ্গে অনুভূতির খেলা, শব্দের সঙ্গে শব্দের এবং অনুপ্রাস আর অন্ত্যমিলের নিরবচ্ছিন্ন অন্বেষণের অভেদ তুলে আনে এক অনন্য সৃষ্টিশীলতা—
হাতেমতাই
হাতের কাছে ছিল হাতেমতাই
চুড়োয় বসিয়েছি তাকে
দু-হাত জোড় করে বলেছি ‘প্রভু
দিয়েছি খত দেখো নাকে।
এবার যদি চাও গলাও দেব
দেখি না বরাতে যা থাকে—
আমার বাঁচামরা তোমারই হাতে
স্মরণে রেখো বান্দাকে!’
ডুমুরপাতা আজও কোমরে ঝোলে
লজ্জা বাকি আছে কিছু
এটাই লজ্জার। এখনও মজ্জার
ভিতরে এত আগুপিছু!
এবার সব খুলে চরণমূলে
ঝাঁপাব ডাঁই-করা পাঁকে
এবং মিলে যাব যেমন সহজেই
চৈত্র মেশে বৈশাখে।
‘মা’ কবিতার তিন শিশুর বৃত্তাকার পরিক্রমণের সঙ্গে গুস্তাফ দরে-র একটি খোদাইশিল্প অবলম্বনে ভিনসেন্ট ভ্যান গখ অঙ্কিত ‘কারাবন্দিদের প্রদক্ষিণ’ শীর্ষক সেই মর্মন্তুদ চিত্রের তুলনা আসতে পারে হয়তো ‘ক্রীড়া’র রূপায়ণেরই প্রসঙ্গে।
কারাবন্দিদের প্রদক্ষিণ। ভিনসেন্ট ভ্যান গখ (দরে অবলম্বনে)
রূপায়ণ দুটিই অনন্য: ভ্যান গখের চিত্রিত লোকেরা এক উন্মাদাগারের অধিবাসী প্রাপ্তবয়স্ক লোক, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় তিনটি অবোধ শিশুর আনন্দোচ্ছল পরিক্রমণ। ভ্যান গখের ছবির কেন্দ্রে এক বড়ো শূন্য। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় নৃত্যমগ্ন অবোধের পরিক্রমণ-বৃত্তের ভেতরে মায়ের মৃত শরীর, “মুখের ওপর ভনভন করছে মাছি”:
মা
স্টেশনের প্লাটফর্মে, রাত দশটায়
তিন-তিনটে বাচ্চা নেচে চলেছে
তাদের শায়িত মায়ের চারপাশ ঘিরে।
এপাশে-ওপাশে যাওয়া-আসা করছে ট্রেন, যাত্রীদের ওঠানামা
কুলিদের দৌড়ঝাঁপ, কারো দিকে তাকাবার সময় নেই কারো
তার মাঝখানে
অফুরান হাসির শব্দে গোল হয়ে
বাচ্চাকটা ঘুরছে মাকে ঘিরে, এখনই উঠে তাদের খেতে দেবে মা
মায়ের মুখের ওপর ভন্ভন্ করছে মাছি
আর আলতো পায়ে কখন পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে মুদ্দোফরাস
তাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে এখন
মর্গে
আর বাচ্চা তিনটে নেচে চলেছে নেচেই চলেছে চারপাশ ঘিরে
এই রাত দশটায়।
একটি নির্দিষ্ট স্পেসের ভেতরে চলতে থাকা পদচালনাই দুই কলাকর্মের ব্যঞ্জিত ক্রীড়া। (হয়তো য়োহান হাইজিংগা কিংবা র’জার কে’লওয়া নির্দিষ্ট ক্রীড়াই): ভ্যান গখের পৃথিবী কারাগারের ভেতরের, শঙ্খ ঘোষের ‘মা’ কারাগারের বাইরের। দুই জায়গায় ভেতর-বাহিরের সংজ্ঞা যেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে উনামুনো-কথিত জীবনের ট্র্যাজিক চেতনারই পরিসরে। শঙ্খ ঘোষের মানুষ কখনও বিমূর্ত ‘মানব’ নয়, উনামুনোর পরিভাষায় রক্তমাংসের মানুষ— যে মানুষ জন্ম নেয়, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে থাকে এবং সর্বোপরি মারা যায় (“one who is born, suffers and above all he dies”). এই মানুষের স্বরই শঙ্খ ঘোষের কবিতার উপজীব্য। আর সেই স্বরের অনেকটা এত নীচু গলায় যে সবরমতী থেকে আসা স্বরের মতো ‘সন্তর্পণে’ আমার হৃদয়-মনকে হানে নিভৃতে:
রাঙামামিমার গৃহত্যাগ
ঘর, বাড়ি, আঙিনা
সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা
ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে—
ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!
শঙ্খ ঘোষের প্রিয় রূপকগুলি জল, মেঘ ও বৃষ্টি। কিটস্ তাঁর নিজের সমাধিস্থলের স্মারকে খোদিত করার জন্য বন্ধু জোসেফ সেভার্নকে একটি বাক্য দিয়েছিলেন— Here lies one whose name was writ in water। সেই বাক্যের ‘জল’, প্রবাহ ও অনিত্যতার হিরাক্লিসীয় দ্যোতনায় ঋদ্ধ হয়ে, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় নিরন্তর উপস্থিত:
৯ জানুয়ারি। সকাল
‘এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয়, তার জলে লেখা নাম।’
কবিদেব, কেবল বেদনা— আহা কেবল বেদনা বুঝি ভালোবাসে তোমার হৃদয়!
মাটির শীতল স্পর্শে অবিরাম অবিরাম কবর কামনা করো তাই? কতদিন
মুঠো মুঠো এমন প্রভাত তুমি ধরেছ কিশোর? কতদিন সূর্য থেকে মাটি থেকে
শূন্য থেকে ধরেছ আকুল মনোভারে
একখানি শিথিল প্রণয়?
অবশেষে একদিন জলে-লেখা-নাম কবি মাটির বাসরে ঘুম রচে।
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না।
বেদনার শাদা ফুলে আকাশ নিবিড় হবে, অবকাশে ভরে যাবে প্রাণ। অবশ
বিরামভরা এ পদচারণা তার পুঞ্জ হবে ভাষার আলোকে। আকুঞ্চিত দুটি হাতে
আঙুলে আঙুলে তুমি টেনে নেবে গান—
অবশেষে থরে থরে কথার কাকলি তুলে বীথিকুঞ্জ সাজাবে প্রণয়ী, উচ্চকিত
পৃথিবীর দুর্বার প্রতাপ তুচ্ছ ক’রে, কবিতার লেখে-লেখে সুন্দর-আশ্লেষ-ধন্য
মেঘকুঞ্জ কথার প্রণয়ী
রাত্রির আবেশে মগ্ন হবে—
তবু সে প্রেমের রাত্রি তার!
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না।
কিটসের মৃত্যুর দ্বিশতবর্ষের এই ক্ষণে (২৩ ফেব্রুয়ারি) শঙ্খ ঘোষের এই কবিতা স্মরণ করি নীরবে।
জলের বিভিন্ন অবস্থা অঙ্কন করেছেন কবি বিভিন্ন কবিতায়। স্মরণযোগ্য আর-এক উদাহরণ পাই এ কবিতায়—
জলই পাষাণ হয়ে আছে
তবে কি আমারও চোখে জল নেই? আমাদের চোখে?
তবে কি কেবলই এই সমুদ্রবাতাস ফিরে যায়
আমাদের বধিরতা নিয়ে?
আমাদের উদাসীন বধিরতা নিয়ে?
আমরা ততটা দেখে খুশি থাকি যতটুকু দেখে এ সময়
তার বেশি নয়।
ভালোবাসা শেখায় গণিত
সে শুধু বিশ্বাস করে অবিশ্বাস ছাড়া কিছু নেই
সকলেরই মাঝখানে বসে খুব অনায়াসে
সকলকে গ্রাস করা চলে—
এত শিলাপাথরের ঘেরে কালো হেসে
তুমি বলেছিলে চোখে জল নেই, আমাদের চোখে।
কখনো দুপুররাতে যখন পৃথিবী শবাসীনা
পাশেও ঘুমন্ত মুখে কোনো আভা যখন দেখি না
যখন শোকেরও মধ্যে মিশে থাকে এতখানি ঘৃণা
তখন সেকথা মনে পড়ে।
মনে পড়ে অলৌকিক তারারা জমেছে কোণে কোণে
বাজনা উঠেছে বেজে—কে কোথায় শোনে বা না-শোনে—
সত্য আর মিথ্যা এসে বিবাহে বসেছে একাসনে
আকাশপাতালজোড়া ঘরে।
তবে কি আমারও বুকে এতটা পাথরজমা ভার?
ঠিক। ঠিকই বলেছিলে তুমি, আজ
চোখে কোনো জল নেই, বুকের উপরে শুধু সেই
জলই পাষাণ হয়ে আছে।
কেন আমি জানিনে, শঙ্খ ঘোষের “জ্যোৎস্নায় মাখানো কাশ।/ব্রহ্মপুত্র স্তব্ধতায় একা” আমার মনে বারংবার নিয়ে আসে মহম্মদ ইকবালের সেই উচ্চারণ “My heart burns at the loneliness of God”। ব্রহ্মপুত্রের স্তব্ধতা আর নিঃসঙ্গতার এই এক বিরল রূপায়ণ বুঝি শঙ্খ ঘোষের জন্যই সম্ভব। সকলেই কবি নন। শঙ্খ ঘোষ কবি। ভাষায় নিহিত কত সম্ভাবনার দ্বার তিনি উন্মোচন করে চলেছেন নিরন্তর, সরল-জটিল, কত স্বরের সন্ধান কিংবা আবিষ্কার সাত দশকের কবিতায় করেছেন ‘নিঃশব্দে’ই। কত বিপন্ন মানুষের ডাক যে তাঁর স্বরসাধনায় পৌঁছেছে (“নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/একটু আগুন দে/আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/বাঁচার আনন্দে!”—‘যমুনাবতী’; “বাপজান হে/কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে/আমিই কিছু জানি না”—‘কলকাতা’)। ৫ ফেব্রুয়ারির জন্মদিনেই শুধু আমি সেগুলি স্মরণ করব না, কষ্টিপাথরের মতো তাঁর পঙ্ক্তিগুলি বাণীর গৌরব হয়ে রয়ে যাবে চিরদিন চিরকাল:
তুমি আমি কেউ নই, শুধু মুহূর্তের নির্বাপণ...
ধূপের মতন দীর্ঘ উড়ে যায় মেঘাচ্ছন্ন দিন
(‘ভূমধ্যসাগর’)
দীর্ঘ চরাচর,
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
(‘শূন্যের ভিতরে ঢেউ’)
বড়ো বেশি দেখা হলো ধর্মত যা দেখা অপরাধ!
(‘বড়ো বেশি দেখা হলো’)
ছড়ার বিভিন্ন ছন্দের প্রয়োগ (“মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে/যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে...”: ‘অন্যরাত’), অন্ত্যমিলের বিস্ময় (‘এদিক-ওদিক’ কবিতায় ‘তাণ্ডব’-এর সঙ্গে ‘প্রকাণ্ড’-এর মিল এত স্বাভাবিক যে পাঠক পুলকিত না হয়ে থাকতে পারে না) ইত্যাদির ফর্দ দিয়ে আমি এখন কাউকে বিরক্ত করব না। ‘পা তোলা পা ফেলা’য় কবি লিখেছিলেন: “কবিতার একটা নিজস্ব আবরণ আছে, তার ভিতরে প্রচ্ছন্ন রেখে অনেক কথা বলে নেওয়া যায়, অনেক আত্মপ্রসঙ্গ, কত বলেওছি হয়তো।” হয়তো কেন? খুব সম্ভবত ‘ভূমধ্যসাগর’-এও বলেছিলেন কবি, কিন্তু শঙ্খ ঘোষের আত্মপ্রসঙ্গ ‘আমি আগে’ বলার মতন রক্তমাংসের মানুষের আত্মপ্রসঙ্গ, ‘ব্যক্তিগত’ নয়। ‘বাবরের প্রার্থনা’র আত্মপ্রসঙ্গ সেই ভয়ংকর সত্তরের উন্মত্ত বঙ্গের আত্মপ্রসঙ্গ: জানু পেতে বসে সম্রাটের প্রার্থনায় লীন হয়ে গেছে বঙ্গেরই সেই ধূসর শূন্যের স্তব্ধতা।
আর-একটা কথা। ঐতিহ্যের বিস্তারে ব্রতী শঙ্খ ঘোষ প্রেরণা নিয়েছেন বিশ্বের বহুজন শিল্পী-লেখকের শব্দ-বাণী-চিত্র-সংগীত থেকে— দান্তে থেকে ইকবাল-কুমারণ আসান পর্যন্ত সবাই আছে তাঁর প্রেরণার উৎসে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-বেদনা শঙ্খ ঘোষের শিরায়-উপশিরায় প্রবহমান আর তাঁর কবিতায় বলাকার ঝংকার আমার মতো প্রতিবেশীর কানেও অনুরণিত হয়ে থাকে অহরহ: “শিরায় ছড়াও আর্দ্র ধারাময় সরীসৃপ দাহ/কটাহে ঘোরাও দণ্ড অক্ষিপট ঝিল্লি কনীনিকা/ছিন্ন করে নাও ছিন্ন অন্ধ করে দাও দুই চোখ...” (‘বড়ো বেশি দেখা হলো’)। ইতিহাসের উন্মুক্ত জানালা দিয়ে তাঁর চেতনায় এসেছে ইসলাম, হয়তো শক-হুনদল মোগল পাঠান সবাই। আমাদের কবিতায় গন্ধর্বরা বিরল, কিন্তু তারাও শঙ্খ ঘোষের কথোপকথনের সঙ্গী। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বলবেন গন্ধর্ব বেদেও আছে, ব্রাহ্মণেও আছে আর উপনিষদেও। জৈন ও বৌদ্ধ প্রতিমাবিদ্যায়ও গন্ধর্বদের প্রাধান্য। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের গন্ধর্বেরা ইস্লাম বা রিল্কে’র দেবদূতদেরই হয়তো অধিকতর আত্মীয়। নাকি এই গন্ধর্বেরা ‘লিট্ল গিডিং’-এর পরিভাষার সেই “পরিচিত সম্মিলিত প্রেত”? সেগুলি এখন থাক।
কবিকে জন্মদিনে সহস্র প্রণাম।
রঞ্জিতকুমার দেবগোস্বামী স্বনামধন্য সাহিত্য সমালোচক ও তাত্ত্বিক। তাঁর অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাটিও অসাধারণ। মননশীল পাঠকমনকে এই লেখা ছুঁয়ে যাবেই।
রঞ্জিত কুমার দেব গোস্বামী মহাশয়ের সৌজন্যে অনেক অজানা কথা জানলাম। আমি কৃতজ্ঞ।