কাজটা শুরু হয়েছিল তিন বছর আগে। শুরু হয়েছিল নদিয়ার গেদে বানপুর সীমান্ত দিয়ে। ওই সীমান্ত এলাকার পনেরো ষোলো সতেরো বছরের ছেলেগুলোকে যখন হঠাৎ করে ড্রপআউট হয়ে যেতে দেখা যেত। জানা গেল ওরা বাইরের রাজ্যে লেবারের কাজে চলে যায়। তারপর সুন্দরবন মালদা মুর্শিদাবাদ উত্তর দিনাজপুর দক্ষিণ দিনাজপুরের নানা প্রান্তিক এলাকায় ঘুরে ঘুরে ওইসব জায়গা থেকে অন্য রাজ্যে কাজে যাওয়া লেবারদের সাথে কথা।
এর মধ্যেই হঠাৎ দেশজুড়ে লকডাউন। আর দেশের নানা হাইওয়েতে রেল লাইনে নদীর পাড়ে মাইগ্র্যান্ট লেবারদের ছবি দেখা যেতে লাগল।
লকডাউনের পূর্বে ওদের দীর্ঘদিনের নানা কথা এবং লকডাউন-পরবর্তী সময়ে ওদের ফিরে আসার কথা নিয়ে এই উপস্থাপনা ‘পশ্চিমবঙ্গের মাইগ্র্যান্ট লেবার’।
***
নদিয়ার গেদে বানপুর সীমান্ত। বানপুরের ডান পাশ ধরে চলে গেছে তার কাঁটার বেড়া। ওটা দেশের বর্ডার। ওই তারকাঁটা ক্যাম্প চেকিং খুপড়ি সার্চ লাইট এসবের গায়ে লেগে আছে বাগানপাড়া, বড়ুইপাড়া, দাসপাড়া, হালসানাপাড়া। আর ওপিঠে জিরো পয়েন্টের কুলোপাড়া। এধার ওধারের ওই পাড়াগুলো থেকে রোজ রোজ ছেলেমেয়েরা এই এপারের স্কুলে পড়তে আসে, কেউ ওপারে নানির বাড়ি যায়, কেউ ওপারের কুলোপাড়া থেকে এদিকের বাজারে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসে।
স্বাধীনতা’র তিয়াত্তরবার সেলিব্রেশন হয়ে গেছে। পতাকা উঠেছে। ব্যান্ড বেজেছে। কুচকাওয়াজ হয়েছে। ইস্কুলে ইস্কুলে লজেন্স জিলিপি দেওয়া হয়েছে। সীমান্তের সুরক্ষা বাড়ানো হয়েছে। সুরক্ষাবাহিনী বাড়ানো হয়েছে।
অল্পবয়সী ছেলেগুলোর সিনেমার মতো হিরো সাজতে ইচ্ছে করে। সকালে মাটি কাটার কাজে নামে। ওর জিন্সের প্যান্টের তলায় পুকুরের কাদা ভরে যায়। আর ওই যে খোলাচুলের মেয়েগুলো মায়ের সাথে তিন বাড়ির বাসন মাজার কাজ ধরে। ওর কচি বয়সের নরম হাতের পাতায় কড়া পড়ে।
কাজের কোনো বদল হয় না পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষ। সবজিখেতে মজুরের কাজটা বদলায় না। দেয়াল রং, ভ্যান টানা, মাটি কাটার কাজ। লুঙ্গির বদলে জিন্স। চুলের কাটিঙের বদল। পকেটে মোবাইল ঢোকে। সস্তায় নেট। হাতের মধ্যে অসংখ্য ব্লুফিল্ম। আর কিছু পালটায়না। এলাকায় নতুন তেমন কিছু হয় না। নতুন অফিস কারখানা জুটমিল কিচ্ছু না। মাটি কাটার কাজ, বিলের মাছ বেচা, আমের সিজনে আমের কাজ এর চেয়ে সামান্য আর-একটু টাকা! সারা বছরের একটা ইনকাম। সেই আশায় রওনা হয়।
সীমান্তের আশপাশের ওই পাড়ার ইয়ং ছেলেরা এলাকা ছাড়ে। না! শহরের সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে নয়। আরব, কাতার, দুবাই, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি, নয়ডায় ঘেঁষাঘেঁষি করে দম বন্ধ করা কাজের জায়গায়। চটকলে, ধানমাঠে, দেয়াল রঙে সেন্টারিং-এ।
ওই যে সীমান্তের আশেপাশে থাকা ইয়ং ছেলেগুলো এইট নাইনে থাকতেই কেন পড়া ছেড়ে দিয়ে কোথায় যে চলে গেল ভাবার দরকার পড়েনি। ক্লাস এগারোর ছেলেটা সেই যে ইংরাজি পরীক্ষাটা দিয়ে আর বাকি পরীক্ষাগুলো দিতে এল না সে নিয়ে ভাবার দরকার পড়েনি। ওই সীমান্ত ঘেঁষা অজ পাড়াগাঁগুলোতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়নি ড্রপ আউট ছেলেমেয়েদের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়নি শ্যামল, অজয়, বাপি, রাজুদের নাম রেজিস্টার খাতায় পরের সেশনে আর উঠল না কেন!
খোঁজ নেওয়া হয়নি ওই যে ওপার থেকে গেট পেরিয়ে যে মেয়েটা স্কুলে আসত সে মাঝসেশনে হঠাৎ পড়াটা ছেড়ে দিল কেন! সব খাতাকলমে ম্যানেজ হয়ে গেছে।
আজ হঠাৎ সব বদলে গেল। এই মারণরোগের ভয়ে গোটা পৃথিবী কাঁপছে। ওই যে ছেলেদের বন্ধ কারখানা থেকে আন্ডারকন্সট্রাকশান বিল্ডিং-এর কাজ ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে ওদের নিয়ে আজ ভাবতে হচ্ছে হঠাৎ করে। ভাবনাটা কী? রোগ নিয়ে আসছে না তো! ফিরে এলেই রোগ ছড়াবে। রোগটা ওর থেকে ছড়াতে ছড়াতে বাজারেদোকানে সেখান থেকে কাচ বন্ধ আবাসনের ভেতর। মনে হচ্ছে ওরা থেকে যাক দূরের কোনো রাজ্যে হাইওয়েতে বা গাছের নীচে পাইপের ভেতর গাড়ির নীচে। ওরা থেকে যাক খোলা আকাশের নীচে। যেখানে খুশি।
সুনামি। ২০০৪ সাল। সুনামি হওয়ার মাস দুই তিন আগে ওরা সেবার কাজে গেছিল যেমন প্রতিবার যেত। সেকথা কোনো এক দুপুরে ওই সাতজেলিয়ার দু-নম্বর এমলি বাড়ি এলাকার এক পুকুরঘাটে বসে বলছিলেন শ্যামল ভুঁইয়া, বিনোদ ভুঁইয়া, উদয় মণ্ডল, মেঘনাথ মিস্ত্রি, পরিতোষ সর্দার। সুনামি যে আসলে কীরকম সেটা এরা নিজের চোখে দেখেছে ওই সব দ্বীপে থেকে। সেই আন্দামান নিকবর হেভলক রঙ্গোত মায়া বন্দর ডিগলিপুর দ্বীপের সুনামি। সে তাণ্ডবের মধ্যেও এরা অনেকে টিকে থেকেছে। কলা সিদ্ধ আর নারকেলের জল শাঁস খেয়ে বেঁচে রয়েছে দিনের পর দিন। সাঁতরে সাঁতরে আবার কোনো এক দ্বীপে গিয়ে উঠে পড়েছে।
ওদের অনেকেই বাঁচেনি। রবি মণ্ডল, সুবীর মণ্ডল, অশোক মণ্ডল, গোপাল মণ্ডল আরও অনেক এই ২ নম্বর এমলি বাড়ির ছেলেরাই ওই সুনামির সময়ে মরেছে ওই দ্বীপগুলিতে। আন্ডারকন্সট্রাকশন বিল্ডিঙের নীচে গাছের গুঁড়ির তলায় চাপা পড়ে থেকে গেছে। সমুদ্রের জলে ভেসে চলে গেছে। এখানে সেসব নিয়ে বলছি না। যেটা বলছি সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সুনামির পরের ঘটনা।
ফিরে এসে আবার জাহাজে করে ওই ধংসস্তুপের ভেতর ওরা গিয়ে পৌঁছেছিল। কারণ তখন ওইসব দ্বীপে লেবারের চাহিদা ছিল প্রবল। তছনছ করে দিয়ে গেছিল সে ঝড়। এদিক সেদিক লাশ তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা ঘর বাড়ি উপড়ে পড়া গাছের তলায়। সুন্দরবনের পাড়ায় পাড়ায় ঠিকাদারের লাইন পড়ে গেছিল এই জোগাড়ি রাজমিস্ত্রিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোম্পানিগুলোর প্রচুর লেবার দরকার। পোর্টব্লেয়ারে তখন আর ডকুমেন্ট চেক-এর কোনো ব্যাপার নেই। শক্তপোক্ত জ্যান্ত শরীর দিয়ে দ্বীপগুলিকে আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে। মাটি খুঁড়তে সময় লাগে। তাই মাটি না খুঁড়ে নারকেল গাছের ডাল পালা আরও সব মরা গাছের শুকনো ডালপালা যা পাচ্ছিল হাতের সামনে সেই দিয়ে চাপা দিয়ে দিচ্ছিল লাশের স্তুপ। পোর্ট ব্লেয়ার দ্বীপ থেকে চাল ডাল যা আসছিল তা কোনোরকমে ফুটিয়ে পেট ভরছিল ওদের। খাবার জল আর খাওয়ার মতো ছিল না তখন। মরা মানুষ মরা পশুপাখির কী কী সব মিশে গেছে জলের সাথে। এখানে সেখানে মরা পচা মৃতদেহের গন্ধ বেরোচ্ছিল ভগভগ করে। মাছি মশা আরও কত রকম পোকামাকড়ে ভরে গেছিল। এই জ্যন্ত জ্যান্ত শরীরগুলোও বিছানায় পড়ছিল পরপর। ওদের কেউ বেঁচে ফিরল, কেউ মরল। ওদের লাশও পোঁতা থাকল ওই সমুদ্রের ওপারে কোনো এক দ্বীপের মাটির তলায়।
***
উত্তর দিনাজপুর দক্ষিণ দিনাজপুরের বড়োটা কুষমুন্ডি বেরইল রাঘবপুর থেকে ছেলেরা যেত ক্রাশার মিলে। ওদের ভাষায় ‘কেশর মিলে’। জায়গাটা হরিয়ানা। সেসব সে কুড়ি পঁচিশ বছর আগের কথা। পাথর ভাঙার মিলের কাজে। দলে দলে চলে যেত ইটাহার হয়ে মালদা হয়ে বা রায়গঞ্জ হয়ে হরিয়ানা। ওই মিলে কাজ করতে গেলে গলা দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে মৃত্যুটাই ছিল স্বাভাবিক একটা মৃত্যু। ওই অন্য রাজ্যে মৃত্যু না হলে নিজের রাজ্যে ফিরে এসে দু-পাঁচ মাস কাটিয়ে মৃত্যু। শঙ্কর দেবশর্মা, রূপা দেবশর্মা, ঝাপাইলের ঝন্টু দেবশর্মা এরকম আরও আরও সব রাজবংশী ছেলেদের নাম পাওয়া যায় যারা ওই হরিয়ানায় পাথর ভাঙার মিলে কাজ করতে গিয়ে গলা দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে মরেছে। এখনও দেখা যায় তাদের বিধবা বউকে মাঠে লেবারের কাজ করতে। বাবাহারা অনাথ ছেলে মেয়েকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বা বড়ো হলে দাদান খাটতে যেতে। কোথায় গেছে কী কাজে গেছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর একটাই, ‘দাদনে গেছে’।
এরকমই দাদন খাটতে যায় মালদার শুকুরুল্যাপুরের ভাঙন এলাকার ছেলে বুড়ো সবাই মিলে। ঠিকাদার মালদারই নানা এলাকার। দিল্লি হরিয়ানা মহারাষ্ট্র কেরালা যায়। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ঝড় জল বৃষ্টি কনকনে ঠান্ডায় প্যাচপ্যাচে গরমে ওই ঠাসাঠাসি কামরার ভিড়ের ভেতর বাংকে মেঝেতে টয়লেটে যেখানে হোক কোনোরকমে শরীরটাকে গুঁজে দিয়ে অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়ে অনেকগুলো রাজ্যের বর্ডার পেরিয়ে চলে যায় অন্য রাজ্যে। সাথে কারও ছেলেমেয়ে বউ, কেউ একলা, কেউ পাড়ার লোকের সাথে। উঁচু উঁচু আন্ডারকন্সট্রাকশান বিল্ডিঙের পাশে নীচু ছাতের চারপাশ টিনে মোড়া সরু সরু যুজ্ঞিতে নয়তো ভাড়া করা ঘরে একসাথে দল বেঁধে গাদাগাদি করে থেকে যায়।
তিনশো বছর আগে বিহারের ছাপড়া আড়া মোতিহারি জেলা থেকে মাছ পাওয়ার জন্য নৌকো বাইতে বাইতে একদল মানুষ এসেছিল মালদার ওই এলাকায়। তারপর বাস শুরু। এক ভাঙনের এলাকা ছেড়ে এসে পৌঁছাল আর-এক ভাঙনের এলাকায়।
এখানেও বারবার পায়ের তলার মাটি গঙ্গার জলে তলিয়ে যেতে থাকে। ওরা শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলে আবার খুঁজতে থাকে পায়ের শক্ত মাটি। এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। নদীর মাছ আর চরের ঘাসে যখন আর পেট ভরে থাকল না ওদের নতুন প্রজন্ম আবার রওনা দিল অন্য অন্য রাজ্যে। দাদন খাটতে।
শকুরুল্যাপুরের সামতলী চৌধুরীর বড়ো ছেলে সুজয় চৌধুরী গেছিল দাদন খাটত। রাজ্যের নামটা ভুলে গেছে। ছেলের নামটা সামান্য ভুল হয়ে গেছিল। পাঁচ বছর চলে গেছে মাঝে। পাশের কার থেকে জেনে নিয়ে মনে করে বলেছিল সামতলী। ছেলে মরার কারণটা বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, জানি কি আমি? আমি কি ছিলাম ওখানে? ওই উঁচু বিল্ডিং থেকে পড়ে মরে গেল কি গুম করে দিল কি ওর লাশ পুঁতে দিল কীভাবে বলব বলেন তো দিদিমণি? আমি কি ছিলাম ওখানে? কী করে যাব বলেন দিদি সে কি এখানে? সে তো বিদেশ!
সুজয় কন্সট্রাকশান সাইটে কাজ করত। মালদার কোনো ঠিকাদার ওকে পৌঁছে দিয়েছিল মালদা স্টেশন পর্যন্ত। সেই ঠিকাদার ওর মাকে এসে বলেছিল, তোর ছেলে উইখানে আর নাই। পালিয়েছে।
সুজয়ের ছোটো ভাই এখন হরিয়ানা। কন্সট্রাকশান সাইটের ওয়ার্কার।
***
সুন্দরবনের সাতজেলিয়া রাঙাবেলিয়া লাহিরিপুর ছোটো মোল্লাখালি সাধুপুর এসব এলাকার নানা পাড়া থেকে পনেরো সতেরো থেকে শুরু করে ষাট পঁয়ষট্টি পর্যন্ত মানুষগুলি বছরের বেশির ভাগ দিন থাকে বাইরে। অন্য নানা রকম লেবারের কাজের মতো তেল তোলার লেবার হয়ে যাওয়ার কথাটা পাড়ায় পাড়ায় গেলেই শোনা যায়। বলে ওএনজিসির কাজে গেছিলাম। এই ঝড় জল ম্যানগ্রোভ জঙ্গল নোনা কাদামাটি জোয়ার ভাটা ছেড়ে ওদের কোনো দল চলে যায় শুকনো খরামাটির দেশে, কেউ বালির রাজ্যে, আবার কেউ পাহাড়ি এলাকায়। কসরত করে মাটির তলার তেল তুলতে। একই জায়গায় তেল তোলার কাজ না। পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ ডিগ্রি তাপের মধ্যে, পাহাড়ের কনকনে ঠান্ডায় এক স্পট থেকে আর-এক স্পটে যেতে হয় কাজ শেষ হলেই। চড়া রোদ কনকনে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা জঙ্গলের অন্ধকার, ভরদুপুর হোক বা মাঝরাত যেতে হবে পাইপ, মেশিন, মালপত্র গাড়িতে তুলে বা কাঁধে বয়ে নিয়ে ঠিকাদারের কথা মতো।
রতন সর্দার, সুকরাম সর্দাররা গোমর নদীর ধারের সর্দারপাড়া থেকে বিরাট একটা দল গেছিল ত্রিপুরা ওই কাজে। সাত মাসের জন্য। পাহাড়ে চড়া অভ্যাসে না থাকলেও খাড়াই পথে ঘাড়ের উপর মাল নিয়ে উঠত ওরা। দিন কাটছিল অনেকরকম কষ্টে। হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন। কোথায় কোথায় প্লেনে চড়ে বিদেশ থেকে মানুষ রোগ নিয়ে এল আর ওরা আটকা পড়ে গেল ওই উঁচু পাহাড়ে জঙ্গলের ভেতর কাজহারা হয়ে। ওরা চেয়েছিল ওই উঁচু পাহাড়ের কোলে স্পটের আশেপাশে যে গ্রাম আছে তার পাশেই থাকবে। হল না। গ্রামবাসী ওদের তাঁবু ছিঁড়ে দিয়ে গেল। জোর ঝামেলা করল। গ্রাম্য তিব্বতি ভাষায় বলল, তোরা কলকাতা থেকে এসেছিস তোরা রোগ নিয়ে এসেছিস।
সুন্দরবন আর কলকাতার মাঝে বেশ কতগুলি নদী আর ঘরবাড়ি গাছপালার পার্থক্য থাকলেও ওই দূরের রাজ্যে রোগের ভয়ে কলকাতা আর সুন্দরবনের কোনো পার্থক্য নেই। নিজের জায়গায় কলকাতার মতো ডাক্তার হাসপাতাল গাড়িঘোড়ার সুবিধা না পেলেও ওখানে গিয়ে ওরা কলকাতার মানুষ।
গ্রাম থেকে তাড়া খেয়ে, নোংরা পরিষ্কার করে, সাপ কোপ মেরে, জঙ্গল সাফ করে ওরা থাকতে শুরু করল একসাথে। সাতশো জন। তাঁবুতে তাঁবুতে গাদাগাদি করে। কাজ নেই। নীচ থকে গাড়ি করে যা চাল ডাল আসবে সেটাই ফুটিয়ে খেতে হবে। গাড়িতে যা জল আসবে সেটা দিয়েই খাওয়া নাওয়া সব কিছু। আর জল না এলে জল নেই। পাহাড়ের উপর গর্ত খুঁড়ে জল বার করে বাঁচার চেষ্টা করে গেল।
২১ দিন শেষ। লক ডাউন ২… ৩… ৪… । নতুন নতুন নামের লকডাউন ঘোষণা হতে থাকল দিল্লি থেকে। চ্যানেলে চ্যানেলে ঘন ঘন প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা যেতে লাগল। অনেক দূরে বসে পাহাড়ের উপর ওরা খবর পেতে থাকল, ওদের ঘরবাড়ি গোয়ালঘর ছাগলের ঘর বাঁধের উপর দিয়ে আম্ফান ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ওদের আটকে রাখা হল ওভাবেই। তারপর মাস তিনেক পর জুন মাসে ফেরত পাঠানো হল ফ্লাইটে। কথা ছিল যাওয়া-আসার খরচ ওই কোম্পানির। ফিরে এল হাতে মাত্র এক হাজার নিয়ে। প্লেনের ভাড়া আর খাওয়ার খরচ বাবদ সব কেটে নিয়েছে। হাতে মাত্র ওই এক হাজার টাকা। ডিসেম্বর থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত ওই পাহাড়ের উপর হাড়ভাঙা খাটুনির মজুরির মাত্র ওই হাজার টাকা সম্বল নিয়ে ফিরে এল। বাকি না কোনো হিসাব কিতাব, না আর কোনো টাকা।
ওদের যাওয়া শুরু হয়েছিল কবে তার দিনক্ষণ আজ আর কারও মনে নেই। ওরা ওভাবেই যায়। দাদার পর ভাই বাবার পর ছেলে। ওরা যায় হারায় লাশ হয়ে যায়। সব খবর কানে এসে পৌঁছায় না। মাঝে দু-হাজার কুড়িতে হেডলাইন হয় ওদের নিয়ে। তারপর আবার নতুন নতুন ইভেন্ট শুরু হয়ে যায়। হিরোর সুইসাইড, হিরোইনের গর্ভধারণ, দুর্গাপূজা, একুশের ভোট। ওরা চাপা পড়ে যায় নতুন নতুন ব্রেকিং নিউজের তলায়।
স্কুল ড্রপআউট ছেলেদের পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ। কন্যাদের শ্রীবৃদ্ধির ফলে এই সংখ্যা আরো বেড়ে চলেছে। চাই অর্থনৈতিক সুযোগ - পড়াশুনা আর কাজ দুয়েতেই। আর তা চাই ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে।
বেঙ্গালুরুতে উচ্চপদস্থ বঙ্গসন্তান যত কায়িক শ্রমিক সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে প্রায় তত।
দিল্লি শহরে মাঝবয়সী কাজের মহিলা হিসাবে বাঙালীর সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে বেশি।
বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ মেনে নিয়েও বলা যেতে পারে যে এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুলি নিজ রাজ্যে সুযোগের অভাবের গল্পই বলে।
পশ্চিমবঙ্গে তবে রয়েছে কারা? বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর কন্যারা?
পুরো ব্যবস্থা টার মধ্যে পাপ !!!আগা পাস্তালা বদল চাই !!রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ ঢুকে গেছে !!তাই এই অবস্থা টা অনুমেয় ।..এবং ততদিন এটা চলবেই ।..যতদিন না একটা সর্বাত্মক বিপ্লব হয় !!কিন্তু হায় !!কারা করবে ???সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে ??তাহলেই হয়েছে !!সরকার।. রেডিও ।.টিভি ।..খবরের কাগজ ।.বাম ।।.অতি বাম ।..রাম ।..রহিম ।..সব রাজনীতির মহাপ্রভুরা ....আমরা ।.যত শহুরে ""বুদ্ধিজীবী জীব ""।..কেউ না ।..সব কামিনী কাঞ্চনে বন্দি !! আশার আলো এইটাই ।..এই প্রতিবেদন ।..যেটা চোখ খুলে দিতে পারছে আমাদের ।..আমাদের মতো প্যারাসাইট দের !!! এরই মধ্যে জেগে উঠতে পারে কোনো শক্তি ।..দিন গুনছি !!!
মাইগ্রান্ট লেবারদের অবস্থা নিয়ে আর্থসামাজিক সমীক্ষা এবং ধর্মীয় সমীক্ষা হওয়া উচিত।যে জায়গাগুলোর নাম পেলাম সেখান থেকে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাচ্চারা কাজে যায়, কেন যায় তা আমরা সবাই জানি। শুধু উল্লেখ করি না।
বড্ড কস্ট হল।