রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সামরিক শাসন ও একনায়কতন্ত্রের অভিজ্ঞতার পরে গণতন্ত্রকেই মানুষ এ পর্যন্ত সবচেয়ে জনস্বার্থবাহী রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থাই একেবারে নিখুঁত হতে পারে না। এ হেন গণতন্ত্রের মধ্যেও যথেষ্ট গলদ রয়েছে। কিছু ত্রুটি নিহিত তার ধারণা ও সেই ভিত্তিতে তৈরি কাঠামোর মধ্যেই। যার মূলে রয়েছে নির্বাচন। অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট যে বা যারা পাবে, তারাই রাষ্ট্র শাসন করার অধিকার পাবে। সংখ্যার একটা বিরাট গুরুত্ব রয়েছে এখানে। কিন্তু এর গলদ ধরা পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশের নির্বাচনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেয়েও ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকায়নি। আবার বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের কম পেয়েও নরেন্দ্র মোদীর সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে যায়। ফলে, যে সংখ্যাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বহুমত বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে তুলে ধরার দাবিতে গণতন্ত্রের এত দাপট, তার মধ্যেই একটা স্ববিরোধীতা লুকিয়ে আছে। আবার, চিন্তার আরও একটা কারণ রয়েছে—গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার একাধিক নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে রয়েছে। গত শতাব্দীতে জার্মানিতে হিটলার, অধুনা রাশিয়ায় পুতিন ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পরের ইতিহাস সবার জানা। তাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের ঘোষিত উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এই মুখবন্ধটি করতে হল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ‘গণতন্ত্রের রহস্য’ বইটির আলোচনা করতে গিয়ে। গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গায়ত্রী এর তিনটি রহস্য বা অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, গণতন্ত্র শুধুই ভোটের অঙ্ক হতে পারে না। তাঁর কথায়, গণতন্ত্রের মধ্যে তিনটি রহস্য রয়েছে। প্রথমটি “যারা নানা ভাবে নানা ধরনের, একেবারেই আমার বা আমাদের সদৃশ নয়, এমনকি চোর, ডাকাত, পাজি, বজ্জাত, বৈষ্ণব, গর্দভ, সকলকে সমান বলে মানতে হবে। শুধু তারা আমাদের সমান ভাবলে চলবে না; আমরা তাদের সমান এটা ভাবতে পারতে হবে জীবনে, মানতে হবে।’’ দ্বিতীয়টি, গণতন্ত্রে নির্বাচন শুধুই সুপরিচালিত হওয়া যথেষ্ট নয়। “সুপরিচালিত নির্বাচন হল গণতন্ত্রের গণিত। গণতন্ত্র অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ, যে-কোনো মতবাদকে, লোকহিতকারী বা উলটো, সাম্যবাদী বা উলটো, সংখ্যাগুরু ভোট পেলে আসনে স্থান দেবে। যে-কোনো মতবাদকে গণতন্ত্রের গণিত আসন দিতে বাধ্য।’’ তৃতীয় রহস্য, “গণতন্ত্রের নিয়মাবলির ভিতর যথাযথ কর্মসূচি পালনের জন্য দরকার পূর্বে স্থাপিত গণতান্ত্রিক সমাজের। … অর্থাৎ গণতন্ত্রের পাটিগণিতকে কর্মক্ষম করতে হলে, দরকার প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সমাজের।’’
বর্তমান প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে এই তিন রহস্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। তাই এখানে সংক্ষেপে দু-চার কথা বলা যেতে পারে। গণতন্ত্রের গণিতকে বোঝার সুবিধার জন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক। ২০০৬-০৯ সালের সিঙ্গুর আল্দোলনের কথা বলছি। তখন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে ক্ষমতাসীন। (তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিখ্যাত উক্তি “আমরা ২৩৫, আর ওরা ৩৫”-র কথা অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে।) সমস্যা হল, রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতলেও বামফ্রন্ট কিন্তু সিঙ্গুর বিধানসভা আসন জেতেনি। সেটা বিরোধীদের দখলে ছিল। আবার সিঙ্গুরের দুটি পঞ্চায়েত সমিতিও ছিল বিরোধীদের দখলে। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের গণিতে গোটা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সিঙ্গুরে তারা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ। তাই সংঘাত দানা বাঁধলে দেখা গেল যে সিঙ্গুরের সংখ্যাগরিষ্ঠরা অন্য সুরে কথা বলছে। এই যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যেই সংখ্যলঘিষ্ঠতার উপাদান থেকে যাওয়া, গণতন্ত্রের গণিতের এটাও একটা রহস্য বা ধাঁধা।
গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গায়ত্রী বিবাদের প্রসঙ্গ এনেছেন। নিছক সংবিধান সংশোধন নয়, গণতন্ত্রের যাবতীয় প্রক্রিয়ার অবিরাম সংশোধনে গুরুত্ব আরোপ করে তিনি মিশেলফুকোর গুরু কঁগিয়েমের কথা মনে করিয়েছেন। কঁগিয়েমের মতে, এই ব্যাপারটি polemical অর্থাৎ বিবাদী। গায়ত্রীর বক্তব্য, বিবাদ করতে হয়। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “অধিকার এবং সমান অধিকারের মধ্যে বিবাদ এবং গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বিবাদী রহস্য একমাত্র প্রতি প্রজন্মের শিক্ষার দ্বারা কিছুটা আটকে রাখা যায়, কিছুটা।’’ ফিরে আসা যাক সিঙ্গুর প্রসঙ্গে। সিঙ্গুরের বিবাদ, বা গণতান্ত্রিক সমাজের যাবতীয় বিবাদকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের মধ্যকার বিবাদ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এখন এই বিবাদের মীমাংসা হবে কীভাবে? ২০০৮ সালে একটি আলোচনা সভায় অমর্ত্য সেনকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে যে, বিবাদের নিরসনে পারস্পরিক আলোচনার ওপর জোর দিতে হবে। কিন্তু যে কথাটা তিনি বলেননি তা হল আলোচনায় যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার মত সংখ্যালঘিষ্ঠের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইবে, তখন তা ঠেকিয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছানো যাবে কী করে? অন্য ভাবে দেখলে, যদি সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুর মত মেনে নিতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তকেই লঙ্ঘন করবে কিনা সে প্রশ্নটাও সামনে চলে আসতে পারে কিনা। সেটা যদি হয়, তাহলে তো গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র থাকবে না, তার জায়গায় যে-কোনো ক্ষমতাশীল চক্রই শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে পারবে। মনে রাখতে হবে রাশিয়ায় বিপ্লবের পরে বলশেভিকরা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেই Dictatorship of Proletariat বা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল।
এবার আসা যাক এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য গায়ত্রীর একটি নিদানের প্রসঙ্গে—শিক্ষার কথায়। গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বিবাদী চরিত্রের রহস্য থেকে মুক্তির পথ হিসেবে তিনি শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন। বীরভূম-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে কয়েকটি পাঠশালা চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিশ্বাস, প্রতি প্রজন্মের শিক্ষার মধ্য দিয়েই একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে। আগেই উল্লেখ করেছি, গণতন্ত্রের তৃতীয় রহস্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজ হল প্রকৃত গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। এবং তাঁর কাছে এই শিক্ষাই গণতন্ত্রকে তার অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ ও রহস্য থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ হতে পারে, তবে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু শিক্ষা বলতে গায়ত্রী প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সুবাদে প্রাপ্ত শিক্ষার কথা মোটেই বলছেন না। তিনি এই প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালী বদলানোর কথা বলছেন। তাঁর মতে, মুখস্থ নির্ভর যে শিক্ষাব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে, তার বাইরে গিয়ে প্রথম কর্তব্য হল সংখ্যাগুরু ভোটারদের সর্বত্র মাথা খাটানো শেখাতে হবে। তাঁর কথায়, “…সরকারকে তো আমরা বসাই, এই বদ্ধমূল ধারণা, শুধু সরকারের আমাদের প্রতি কর্তব্য আছে তাই-ই নয়, সরকারের কাছে খালি ভিক্ষে করতে হয় না। আমাদেরও উচিত, সরকারকে ভিক্ষা করার কর্তব্য শেখানো...’’ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কড়া সমালোচক গায়ত্রী স্পষ্ট বলেন, “আমাদের উচ্চশিক্ষা দেখলে কান্না পায়। সামাজিক লাইনের নীচে শিক্ষকরা মাথা খাটায় না, উত্তর শেখায়…’’
শিক্ষার আমূল সংস্কারের আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে তাঁর পরামর্শ, শিক্ষা দফতর এমন ভাবে বই বার করবে যাতে সর্বনিম্ন গোষ্ঠীর ছাত্র এবং শিক্ষক বুঝতে পারবে এগুলি মাথা খাটানোর যন্ত্র। শিক্ষার এই নতুন দিশার রূপায়ণের সম্ভাব্যতার জন্য তিনি তাকাচ্ছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভবিষ্যতের সংখ্যাগুরু নির্বাচক গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক শিক্ষার দিকে। তাঁর আশা, গণতন্ত্রের যে অন্যতম উপাদান (তাঁর কথায় ‘রহস্য’) বিসদৃশকে সমান মানা, সেটাই এই আপাত অসম্ভবকে বাস্তবায়িত করতে পারে। কিন্তু সমস্যা এখানেই। যে গণতন্ত্রের গণিতের উপর নির্ভর করে গোটা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে, যে ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে নেওয়ার পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে একটি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা ধরে নিয়ে সেই ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ চালিয়ে যায়, সেখানে তারা শিক্ষার এই গণতান্ত্রিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে দেবে কেন? ঘরের কাছেই উদাহরণ কম নেই। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হাতেকলমে করে দেখিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন শাসক শ্রেণি তা গ্রহণ করেনি। তারা ব্রিটিশ প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থাই চালু রেখেছে। গায়ত্রীও তো বলছেন, বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিকদের মনন তৈরি হচ্ছে, তাতে চিন্তা করার, প্রশ্ন করার ক্ষমতা অর্জন করা যায় না। এ কথা “বলার দরকার আছে, তোমাদের যেমন গড়া হবে না, সেটাই দরকার কত্তাদের। কেন-না, মন না থাকলে তোমাদের ওই ফুটবল কম্পিটিশন আর ১০০ দিনের কাজ দিয়ে খুশি রাখা যাবে, ম্যানুয়াল লেবার দিয়ে, গতর খাটিয়ে। তোমাদের যদি মাথা খাটে একবার, তাহলে তো তোমাদের গোনা যাবে না আর এইভাবে।’’
গণতন্ত্রের সমস্যাটির সম্যক চেহারা স্পষ্ট হয় গায়ত্রীর ‘গণতন্ত্রের রহস্য’ বইয়ে। সেইসঙ্গে মাথা খাটিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, প্রশ্ন করতে শেখায়। গায়ত্রীও তো সেটাই চেয়েছিলেন।