ভারতের কৃষিসমস্যা শুধু মাত্র বিপণন নয়। যদিও বিপণনের সমস্যাকে ছোট করে দেখাও ঠিক নয়। আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখেছি যে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের উপস্থিতিতে কীভাবে ভোক্তার ব্যয়ের একটা বড় অংশ কৃষকের কাছে না গিয়ে স্রেফ বিপণনের নানা স্তরে ছড়িয়ে থাকা ফড়ে, আড়তদারদের পকেটে চলে যায়। কিন্তু এই সমস্যা শুধু ভারতের নয়। নিচের চার্টে কফির যে মূল্যের নানা স্তরে বণ্টনের গল্প বলা আছে তা ভারতের নয়। একাধিক দেশ জুড়ে হওয়া কফির ব্যবসার চিত্র। কিন্তু একথাও আমরা বলেছি যে কর্পোরেট বাণিজ্য শুরু হলেই এই ফড়েরাজ শেষ হয়ে যাবে এমন নয়, হয়ত আরেকটা স্তর যুক্ত হবে মধ্যস্বত্বভোগীর। খুব দ্রুত কর্পোরেট সমগ্র কৃষি বিপণন ধরে নেবে এমনও নয়। মাণ্ডির মাধ্যমে যেমন যৎসামান্য কৃষিপণ্য বিপণন হয়, তেমনি কর্পোরেটও আগামী কয়েক দশকে কৃষি বাজারের সামান্য অংশে প্রবেশ করতে পারবে। ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইক্যুইটি ফাউন্ডেশনের মতে ২০২১ সালে ভারতের সংগঠিত খুচরো বিক্রি ১৮% হতে পারে আর অনলাইনে বিক্রি ৭% হতে পারে। বর্তমানে অর্ধেকের কিছু বেশি রয়েছে এই সংখ্যা দুটি। তাও করোনার জন্য ২০২০ সালে সংখ্যাটা লাফ মেরে অনেকটাই বেড়েছে।
কিন্তু কিছু তথ্য দেখলে বোঝা যাবে যে বর্তমান কৃষিনীতিকে সর্বরোগহরা ঔষধ বা ভয়াবহ প্লেগ মহামারী কোনটাই ভাবা যাবে না। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে খাদ্য ও পানীয়ের পেছনে খরচের হার আয়ের ৪০.৭৪%, BRICS দেশগুলোতে তা ৩১% আর ভারতে ৪৪.৬%। ভারতের শহরাঞ্চলে ৩৪.৮% আর গ্রামাঞ্চলে ৫৪.৭%, দরিদ্রতমদের মধ্যে ৫৩.৫%, দরিদ্রদের মধ্যে ৩৪.৫%, মধ্যবিত্তের ২১.৫% আর ধনীদের মধ্যে ১১.৯%। দরিদ্রতম বলতে দিনে $২.৯৭ এর কম আয়ের ব্যক্তি, দরিদ্র বলতে $২.৯৭-$৮.৪৪ এর মধ্যে আয়ের ব্যক্তি, মধ্যবিত্ত বলতে $৮.৪৪-$২৩.০৩ এর মধ্যের ব্যক্তি ও তার পরে ধনী ধরা হয়েছে। ওই হিসেবে ভারতে সে সময় বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে ৭৪.৮৩% দরিদ্রতম, ২৩.২৫% দরিদ্র, ১.৯৭% মধ্যবিত্ত ও ০.০৪% ধনী ছিল। আর তাই ভারতে দরিদ্রতম ও দরিদ্র যথাক্রমে ৬০.৩১% ও ৩১.২৪% খাদ্য ও পানীয় কিনে থাকে, মোট ৯১%, সেখানে মধ্যবিত্ত ও ধনী কেনে ৮.১৪% আর ০.৩১% মাত্র।এই তথ্যের ব্যাখ্যা পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভাল। শুধু বলা ভাল, বর্তমান কৃষিনীতি গভীর ক্ষতের চিকিৎসায় ব্যাণ্ড এড লাগানোর মত।
ভারতের কৃষি সমস্যা বুঝতে গেলে আমাদের প্রথম বুঝতে হবে ভারতের কৃষকের সমস্যা। ওপরের টেবল থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রায় ৮৭% কৃষক আংশিক শ্রমিক। আর তাঁদের প্রায় ৩৫% মূলত মজুরির ওপরেই নির্ভর করেন ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য। উচ্চতর কৃষকেরও কৃষি বহির্ভূত শ্রম আয় থাকে, কিন্তু তা কায়িকশ্রমের আয় না, মেধাশক্তির আয়। নিম্নতম ৮৭% কৃষকের জমির পরিমাণ দুই হেক্টরেরও কম। পরিবার পিছু গড় জমির পরিমাণ ১.২ হেক্টর, আর মিডিয়ান আরও কম। অধ্যাপক রঙ্গনাথনের রিপোর্টে আমরা আরও দেখতে পাই যে সমাজের কোন বর্ণের হাতে কত জমি আছে আর তাদের পারিবারিক আয় কত। এই দুই তালিকা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না দরিদ্র কৃষকরা সমাজের কোন স্তরে পড়েন।
ভারতে শস্যের ফলন ২.৮৮ টন / হেক্টর, বিশ্বব্যাপী এই উৎপাদন ৩.৬৭, পশ্চিমা ইউরোপ হেক্টরপ্রতি ৬.৬৫ টন ফলন দেখি, এর অর্থ আমরা হেক্টর প্রতি আমাদের আউটপুট দ্বিগুণ করতে পারি, কিন্তু তাতে আনুষঙ্গিক খরচও বেড়ে যাবে। আর আগেই বলেছি, অস্থিতিস্থাপক চাহিদা হওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য অস্বাভাবিক কমে যাবে। কৃষকের মুনাফা আর নাও বাড়তে পারে।
ওপরের চার্ট থেকে আমরা কৃষকের আয় ব্যয় মুনাফার একটা চিত্র পাচ্ছি। এখান থেকে প্রথমত বোঝাই যাচ্ছে ভারতে গড় কৃষি পরিবার পিছু জমির যা অবস্থা তাতে শুধুমাত্র কৃষি থেকে পরিবারগুলোর যা আয় হবে তাতে বছরে দুটো ধান চাষ করে সংসার চালাতে তারা পারবে না। গুণীজন বলবেন ধানের সাহায্য মূল্য আর সারে সাবসিডি কৃষককে ধান চাষে অহেতুক উৎসাহিত করছে। এসব না থাকলে সে ধান চাষ থেকে অর্থনীতিতে স্বাভাবিক ভারসাম্য রেখে অন্যান্য চাষে সরে যাবে। তাতে বাজারে মূল্য বিকৃতি হবে না, উদার অর্থনীতি বেশ দক্ষ হয়ে উঠবে। এই গুণীজনের জন্য একটা চমক রয়েছে।
প্রথমতঃ রাসায়নিক সারে ভর্তুকি, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য জানাচ্ছে বিভিন্ন সারে ৩০-৭০% ভর্তুকি দেওয়া হয় সার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তার মধ্যে ইউরিয়াতেই এখন সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি থাকায় চাষীদের ইউরিয়া ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। বাজার দর ও উৎপাদন হার বিচার করে এর ফলে ৫০ পয়সা প্রতি কিলোতে দাম কম থাকছে।
দ্বিতীয়তঃ জল ও বিদ্যুতের ভর্তুকি। বিশেষজ্ঞ রাহুল টঙ্গিয়া একটা হিসেব দিয়েছেন, এক কেজি ধান উৎপাদনে ১৫০০ লিটারেরও মত জল প্রয়োজন (যদিও অনেক ক্ষেত্রে গড়টি আরও খারাপ)। যদি এই জল ভূগর্ভস্থ জলের টেবল থেকে পাম্প করা হয় তবে এটি প্রচুর শক্তি খরচ করে। জলের সঞ্চয়ক্ষেত্রের গভীরতা ২০০ মিটার ধরুন - কিছু অঞ্চলগুলি আরও গভীর। এর অর্থ খাঁটি পদার্থবিজ্ঞানের হিসেবে ১ কেজি ধানের জন্য জল উত্তোলন করতে 0.৮ কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তি খরচ হবে। তবে পাম্পসেটগুলি ১০০% দক্ষ নয় - অনেকগুলি খুব খারাপ, ৫০% দক্ষতার এবং অনেকগুলো কেবলমাত্র ৩৩% দক্ষ। এর অর্থ প্রতি কেজি ধানে প্রায় ২.৫ কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ লাগছে। কৃষকরা প্রকৃত ব্যয় না দিলে, বিদ্যুত সরবরাহের আসল ব্যয় কমপক্ষে ৬ টাকা প্রতি কেডব্লুএইচ, যার অর্থ গভীর জলের টেবিল অঞ্চলে প্রায় ১৫ টাকা কেজি ধান উৎপাদনের জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এই হিসেবের ন্যূনতম সাহায্য মূল্যের বাইরে।
এছাড়াও রয়েছে কৃষি ঋণের ভর্তুকি, বীমার ভর্তুকি। সামগ্রিক বিচারে ভারতে ধানের বাজার দরের চেয়ে সামাজিক মূল্য অনেকটাই বেশি, অন্ততঃ দুই আড়াই গুণ তো বটেই।
সামগ্রিক আলোচনাকে গুটিয়ে নিয়ে এলে একথাই বলা যায় যে দীর্ঘদিনের গভীর বৈষম্য, সামন্ততন্ত্র, ঔপনিবেশিক শোষণ, স্বাধীনতার পরও যথেষ্ট সক্রিয় অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার অভাবে আমাদের কৃষি অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। মূল্যব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে কৃষক আর কৃষিশ্রমিকের বিপক্ষে চলে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবেশে, শিল্পে আর শহরাঞ্চলে। আমাদের কৃষিতে খুব কম উৎপাদনশীল শ্রমিক রয়েছে, ছদ্মবেকারত্ব রয়েছে। কিন্তু তারা যখন একটু ভাল রোজগারের আশায় শহরাঞ্চলে এসে পড়ে তখনও কি তাদের কোন সুস্থ জীবন দিতে পারে আমাদের অর্থনীতি? শহর বা গ্রামের যে নতুন প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, এমনকী প্রযুক্তিগত শিক্ষাও যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার খুব আশাব্যঞ্জক?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। শুধু এটুকু উপলব্ধি করি অর্থনৈতিক সমস্যার ফলে আমাদের দরিদ্র, পশ্চাৎপদ, সামন্ততান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম যে ফসল তুলেছিল, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র (যেমনই হোক তা), জাতীয়তাবাদ, প্রজাপালক শাসনব্যবস্থা তা নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। কোন অন্ধকারের মধ্যে আমাদের আগামীকাল যেতে হবে তা ইতিহাসই বলবে।
লেখা দুটি থেকে চলমান আন্দোলনের দাবি মালা সম্পর্কে লেখক ঠিক কী বলতে চাইছেন বোঝা গেল না। প্রতিবাদী কৃষকেরাও কি পল্লবগ্রাহী?
বৃষ্টি র কোনো ফাঙশান নেই ?
এমনে মাটি খুড়ে খুড়েই সব তুলতে হবে ?
নাকি এটা ট্রিক/ ধাঁধাঁ কোনো?
"দ্বিতীয়তঃ জল ও বিদ্যুতের ভর্তুকি। বিশেষজ্ঞ রাহুল টঙ্গিয়া একটা হিসেব দিয়েছেন, এক কেজি ধান উৎপাদনে ১৫০০ লিটারেরও মত জল প্রয়োজন (যদিও অনেক ক্ষেত্রে গড়টি আরও খারাপ)। যদি এই জল ভূগর্ভস্থ জলের টেবল থেকে পাম্প করা হয় তবে এটি প্রচুর শক্তি খরচ করে। জলের সঞ্চয়ক্ষেত্রের গভীরতা ২০০ মিটার ধরুন - কিছু অঞ্চলগুলি আরও গভীর। এর অর্থ খাঁটি পদার্থবিজ্ঞানের হিসেবে ১ কেজি ধানের জন্য জল উত্তোলন করতে 0.৮ কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তি খরচ হবে। তবে পাম্পসেটগুলি ১০০% দক্ষ নয় ..."