খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বর্তমান নেপালের অন্তর্গত কপিলাবস্তুর রাজপরিবারে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ যৌবনে গৃহত্যাগ করেন। বর্তমান বিহারের উরুবিল্ব (বোধগয়া) গ্রামে তাঁর বোধিলাভ হয় এবং তারপর থেকে তিনি বুদ্ধ নামে পরিচিত হন। বারাণসীর কাছে মৃগদাব (সারনাথ) উদ্যানে তিনি প্রথম উপদেশ দেন। ক্রমে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ে এবং তাঁর প্রচারিত জীবনচর্যা বৌদ্ধ ধর্ম নামে খ্যাতি লাভ করে।
গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী যুগে সম্রাট অশোকের দাক্ষিণ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়ে, এবং স্থানভেদে বৌদ্ধধর্মের ভিন্ন মতবাদ ও শাখা তৈরি হতে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি শুরু হয় বহুঈশ্বরবাদি মহাযান (Great Vehicle) বৌদ্ধধর্ম। গুপ্তযুগের শাসকরা হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই ধর্মেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আবার পাল রাজারা মূলত মহাযান ধর্মাবলম্বী হলেও, শৈব ধর্মকেও সমান মর্যাদা দিতেন। যার ফলে বৌদ্ধধর্মের উপর শৈব ধর্মের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে এবং শুরু হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের। এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা হল বজ্রযান। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্মে এত বেশি দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটে, যে অনেকেই বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের কোন বিশেষ পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমুখকল্পে বলা হয় শৈবতন্ত্র ও বৈষ্ণবতন্ত্রের সব মন্ত্র বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কারন এই সব মন্ত্র আসলে জ্ঞানের দেবতা মঞ্জুশ্রীর রচনা। এই পারস্পরিক আদানপ্রদানে বৈদিক দেবতারা রূপান্তরিত হয় বুদ্ধ, তারা ও বোধিসত্ত্বে, যেভাবে বুদ্ধ স্থান পায় বিষ্ণুর দশাবতারে। এইভাবেই একসময় প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের দেবী সরস্বতী পরিবর্তিত হয়ে হলেন এক বুদ্ধ তারা।
প্রাচীন বৌদ্ধধর্মে উল্লেখ থাকলেও, পরে বহুদিন কোন বৌদ্ধ সাহিত্য ও শিল্পে সরস্বতীর নিদর্শন পাওয়া যায়না। পরবর্তীকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম শুরু হলে তা ভারত থেকে নেপাল ও তিব্বতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর পরে তিব্বতে মূলত মহাযান ও বজ্রযান শাখার লামারা সরস্বতীর উপাসনা আরম্ভ করেন এবং তৈরি হতে থাকে পৌরাণিক কাহিনী। আর তার সঙ্গে শুরু হয় বৌদ্ধ মঠে ও পটে সরস্বতীর চিত্রাঙ্কন। এই ধরনের বৌদ্ধ চিত্র থাঙ্কা নামে পরিচিত।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, “তাহলে বৌদ্ধধর্মে সরস্বতীর নাম কি?” বৌদ্ধধর্মে অনেক বৈদিক দেবদেবীর নাম পরিবর্তন করা হলেও, কোন কারণে সরস্বতীর নাম পরিবর্তন করা হয়নি। যদিও বৌদ্ধধর্ম ভারতের গণ্ডী ছেড়ে যখন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রসারিত হয়, তখন স্থান ভেদে দেবীর নাম পরিবর্তন হতে থাকে। তিব্বতে তাঁর নাম হয় ‘ইয়াং চেন মো’, সঙ্গীতের দেবী হিসাবে প্রাধান্য পেলে নাম হয় ‘পিওয়া কার্পো’। মঙ্গোলিয়ায় তিনি হলেন ‘কেলেয়িন উকিন তেগ্রি’। চীন দেশে নাম হল ‘মিয়াওয়িন মু’। জাপানে তাঁকে মিলিয়ে দেওয়া হল দেবী ‘বেঞ্জাইতেন’ বা ‘বেন্তেন’-এর সাথে। যদিও বৌদ্ধ সরস্বতীর সব মন্ত্রে- তা সে যে ভাষাতেই হোক- উচ্চারণ ‘সরস্বতী’ই করা হয়।
সরস্বতীর জন্মের কাহিনী পাওয়া যায় কারান্ডাবুহ্য সুত্রে। এই মহাযান গ্রন্থ লেখা শেষ হয় আনুমানিক চতুর্থ শতাব্দীর শেষে অথবা পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে। প্রসঙ্গত, আমাদের সবথেকে পরিচিত বৌদ্ধ মন্ত্র ‘ওম মনিপদ্মে হুম’ এই গ্রন্থের অন্তর্গত। এই সুত্র অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা হলেন বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর। সৃষ্টির সময় তাঁর দেহের ভিন্ন অংশ থেকে তৈরি হয় চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বায়ু ও আকাশ। তাঁর ভ্রূ থেকে সৃষ্ট হন শিব, কাঁধ থেকে ব্রহ্মা এবং হৃদয় থেকে বিষ্ণু। সবশেষে তাঁর শুভ্র দাঁত থেকে উৎপত্তি হয় শ্বেত সরস্বতী। আবার লামা ইয়েশে গ্যামস্তো বলেছেন দেবীর সৃষ্টি সমুদ্রের ঢেউ থেকে। সমুদ্র মন্থনের সময় মেরু পর্বতের দক্ষিণে ওঠে এক অপূর্ব ঢেউ। দুধ সাগরের সেই ঢেউ যেন পুণ্য ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক । সেই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে ব্রহ্মা সেই ঢেউকে দেবীর রূপ দান করেন। নাম দেন সরস্বতী – গুণের প্রবাহ।
বৌদ্ধধর্মের প্রধান দেবতারা হলেন বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব। যারা পূর্ণ বোধি ও নির্বাণ লাভ করেছেন তাঁদের বলা হয় বুদ্ধ। যথা শাক্যমুনি, অমিতাভ, পদ্মসম্ভবা ইত্যাদি। বোধিসত্ত্ব হলেন যারা বোধিচিত্ত অর্জন করেছেন- যেমন অবলোকিতেশ্বর, বজ্রপাণি, মঞ্জুশ্রী ইত্যাদি। এঁরা নির্বাণের পথ ত্যাগ করে সংসারের সমস্ত প্রাণের দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য বারেবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিব্বতি দালাই লামাও বোধিসত্বের পুনর্জন্ম বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধধর্মের দেবী বা নারী বোধিসত্ত্ব হলেন তারা। যাঁদের থেকে জন্ম হয় সব বুদ্ধের। আবার সমস্ত বোধিসত্ত্বের সাথে স্ত্রী বা সঙ্গিনী রূপে থাকেন একজন তারা। বৌদ্ধধর্মে সবমিলিয়ে মোট একুশটি তারার উল্লেখ আছে। তারমধ্যে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও জ্ঞানের তারা হলেন দেবী সরস্বতী। তিনি বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর সঙ্গিনী। বহু থাঙ্কা চিত্রে বিভিন্ন রূপে মঞ্জুশ্রী ও সরস্বতীকে একসাথে দেখা যায়।
মঞ্জুশ্রী ও সরস্বতী একসাথে পূর্ণ জ্ঞানের প্রতীক। মঞ্জুশ্রীর ডান হাতে ধরা জ্বলন্ত খড়গ, যা অজ্ঞানতা খণ্ডন করে। বামহাতে জ্ঞান মুদ্রায় ধরা জ্ঞানের প্রতীক নীল পদ্মের ডাঁটি। পদ্মটি উঠে এসেছে বাম কানের পাশে, তার উপর রাখা আছে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র –যাতে বর্ণনা করা আছে পূর্ণ প্রজ্ঞা লাভের পথ। মঞ্জুশ্রীর কোলে বিপরীত মুখে বসে সরস্বতী। ডানহাতে বীণা -শুদ্ধ স্বর ও শিল্পের প্রতীক এবং বামহাতে পুস্তক- শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক। মঞ্জুশ্রী প্রকাশ করেন যুক্তিগত বিশ্লেষণাত্মক বাস্তব বুদ্ধি আর সরস্বতী প্রকাশ করেন শৈল্পিক ও কাব্যিক চিন্তা। এই দ্বৈত চিন্তা একসাথে মিলিয়ে প্রজ্ঞা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে সরস্বতী মঞ্জুশ্রীর মিলিত রূপ উপাসনা করা হয়।
বৌদ্ধধর্মের সব শাখা মিলিয়ে দেখলে সরস্বতীর বহু রূপ খুজে পাওয়া যায়। এখানে থাঙ্কা চিত্রে দেখা যায় এমন কিছু প্রচলিত রূপের বর্ণনা দেওয়া হল।
শ্বেত সরস্বতী তারা বা ইয়াং চেন মো দেবীর শান্ত রূপ। এইরূপে তিনি শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞানের দেবী। শ্বেত সরস্বতীর আবার দুটি রূপ আছে। প্রথমটি দুই হাত, দুই চোখ, পদ্মের উপর বসা এবং হাতে রত্নখচিত গন্ধর্ব বীণা। এই রূপ তান্ত্রিক বুদ্ধ ধর্মের ‘ইদম’ বা ইষ্টদেবতা। দ্বিতীয় রূপে দেখা যায় চার হাত, তিন চোখ, রাজহাঁসের উপর বসা, হাতে বীণা, তেন্বা (অক্ষমালা) ও পুস্তক। এই রূপটি দেখা যায় প্রধানত নেপালি থাঙ্কায়।
লাল সরস্বতী বা ইয়াং চেন মারমোর দেহের রং প্রবালের মত লাল। এটি দেবীর শক্তি রূপ। এক হাতে থাকে ইচ্ছা পুরণের রত্ন, অন্য হাতে জ্ঞান দর্পণ।
নীল সরস্বতী বা শ্রীদেবী, তিব্বতি ভাষায় পালদেন হামো বা মগজর গ্যালহ। এই রূপে দেবীকে দেখা যায় উগ্র অবস্থায়। ডান হাতে থাকে বজ্রাঙ্কিত গদা, বাম হাতের মাথার খুলি। মাথায় জ্বলে জ্ঞানাগ্নি, তাঁর সামনে পাঁচটি নর খুলি,পাঁচটি রিপুর প্রতীক। জ্ঞান চক্ষু থাকে উন্মীলিত। তীক্ষ্ণ দাঁতে কাটে দুঃখ-দানব। গলায় মুণ্ডমালা, কোমরে বাঘছাল। তাঁর নাভিতে জ্ঞান সূর্য, মাথায় দয়ার চন্দ্র। দেবী তাঁর বাহন অশ্বেতরে চড়ে রক্তের নদী- জন্ম মৃত্যু চক্র- পার করছেন, সঙ্গে থাকে দুই ডাকিনী, মকরমুখি ও সিংহমুখি। এই রূপে তিনি ধর্মপাল, জ্ঞান ও ধর্মের রক্ষা করেন। দ্বিতীয় দালাই লামা গেন্দুন গ্যাতসো দেবীর এই রূপকে দালাই লামা তথা সমগ্র তিব্বতের রক্ষার জন্য স্থাপন করেন।
বজ্রবেতালি বা দোরজে রলাংমা সরস্বতীর ডাকিনী রূপ। এই রূপে সরস্বতীকে দেখা যায় মঞ্জুশ্রীর উগ্র রূপ বজ্রভৈরব বা যমন্তকের সঙ্গিনী হিসাবে। এই দেবীর ছটি মুখ, বারটি হাত, রং অনুজ্বল নীল। তাঁর প্রধান শক্তি আরোগ্য দান এবং মানুষকে মৃত্যু ও পরকালের ভয় থেকে মুক্তি দেওয়া।
বজ্র সরস্বতী বা দোরজে ইয়ান চেমা দেবীর আরেক উগ্র রূপ। এখানে তাঁর তিনটি মুখ, মাঝেরটি লাল, দুই দিকে সাদা ও নীল। বাকি দেহের রং লাল। মোট ছটি হাত, ডানদিকের হাতে খড়গ, পদ্ম ও অঙ্কুশ এবং বাম দিকের হাতে চক্র, রত্ন বীণা ও খুলি। ইনি বুদ্ধি প্রদায়িনী দেবী।
তিব্বতি গেলুগ বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক জে সোংখাপার ইদম বা ইষ্টদেবতা ছিলেন সরস্বতী। কথিত আছে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ ও ভ্রমণের সময় সরস্বতী বহুবার তাঁর সামনে আবির্ভূত হতেন, তাঁকে অনুপ্রেরণা ও উপদেশ দেওয়ার জন্য। তিনি তিব্বতি ভাষায় একটি সরস্বতী বন্দনা রচনা করেন, যা আজও সরস্বতীর উপাসনার সময় গাওয়া হয়ে থাকে।
সেই সরস্বতী বন্দনার ইংরাজি অনুবাদটি নিচে দেওয়া হল-
Captivating presence, stealing my mind,
like a lightning-adorned cloud beautifying the sky,
there amid a celestial gathering of youthful musicians.
Compassionate goddess, come here now!
Those alluring honeybee eyes in that lotus face,
that long, dark blue hair, glowing with white light,
there before me in a pose of seductive dance.
Grant me, Saraswati, your power of speech.
Those beautiful, playful antelope eyes,
I gaze insatiably upon you, seducer of my mind.
Goddess of speech with a mother’s compassion,
make our speech as one.
More beautiful than the splendor of a full autumn moon,
a voice eclipsing the sweetest melody of Brahma,
a mind as hard to fathom as the deepest ocean,
I bow before the goddess Saraswati.
বিভূতিভূষণের "মেঘমল্লার" গল্পের কথা মনে আসে যেখানে "জ্যোৎস্নাবরণী অনিন্দ্যসুন্দরী মহিমাময়ী তরুণী" দেবীকে যুবক প্রদ্যুম্ন তান্ত্রিকের বাঁধন থেকে উদ্ধার করে নিজের প্রাণের বিনিময়ে। দেবীর বর্ণনায় সেখানে বলা হচ্ছে - "তাঁর নিবিড় কৃষ্ণ কেশরাজি অয্ত্নবিন্যস্তভাবে তাঁর অপূর্ব গ্রীবাদেশের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর আয়ত নয়নের দীর্ঘ কৃষ্ণপক্ষ্ম কোন স্বর্গীয় শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা, তাঁর তুষারধবল বাহুবল্লী দিব্য পুষ্পাভরণে মণ্ডিত, তাঁর ক্ষীণ কটি নীল বসনের মধ্যে অর্ধলুক্কায়িত মণিমেখলায় দীপ্তিমান, তাঁর রক্তকমলের মত পা দুটিকে বুক পেতে নেওয়ার জন্য মাটিতে বাসন্তী পুষ্পের দল ফুটে উঠেছে ... হ্যাঁ, এই তো দেবী বাণী! এঁর বীণার মঙ্গলঝঙ্কারে দেশে দেশে শিল্পীদের সৌন্দর্যতৃষ্ণা সৃষ্টিমুখী হয়ে উঠেছে, এঁর আশীর্বাদে দিকে দিকে সত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে, এঁরই প্রাণের ভাণ্ডারে বিশ্বের সৌন্দর্যসম্ভার নিত্য অফুরন্ত রয়েছে, শাশ্বত এঁর মহিমা, অক্ষয় এঁর দান, চিরনূতন এঁর বাণী।" দেবী সরস্বতী এভাবেই দেশ-কাল নির্বিশেষে শিল্পী মানুষের প্রেরণাদাত্রী। তিনিই একমাত্র বৈদিক দেবী যিনি আজও পূজিত হন। হিন্দু ও বৌদ্ধ কল্পনা তাঁকে যুগ্মভাবে ধারণ করে আছে।
ছবি গুলো ভারী ভাল লাগল .
ভারি সুন্দর আঁকা ছবি। খুব ভাল লিখেছেন।
একটা কথা। নিংমা, গেলুগ, কাগ্যু, শাক্য ট্র্যাডিশনে , তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে এই দেবদেবীর ট্র্যাডিশন। থেরাবাদ বা মহাযান এ এঁদের উল্লেখ নেই।
লেখা আর ছবি দুইই খুব ভালো লাগলো আমার।
নীল সরস্বতী, বজ্র বেতালি আর বজ্র সরস্বতী, তিনজনেই তো শুভশক্তি। কেউ জ্ঞান বুদ্ধির রক্ষা করেন, কেউ অসুখ আর মৃত্যুভয় থেকে বাঁচান, কেউ বুদ্ধি দেন। তাহলে এঁদের তিনজনের চেহারা এমন ভয়ানক কেন করা হয়েছে?
এই উগ্র বা ভয়ঙ্কর রূপ অশুভশক্তিকে ভয় দেখিয়ে দূরে রাখার জন্য, যাতে মানুষের কল্যাণ হয়। হিন্দু মিথোলজিতেও যেমন আছে, দুর্গা তাঁর মোহময়ী রূপ ত্যাগ করে ভয়ঙ্কর কালী রূপ ধারণ করেন, অসুরদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য।
@অরিন, ঠিক বলেছেন। আমি থেরাবাদের বিপশ্যনা মেডিটেশন করেছিলাম, সেখানে তো কোন দেবদেবী মানে না।
লামাযানের উৎপত্তি বজ্রযান থেকে হলেও পরে তা একেবারে অন্যপথ নিয়েছিলো। শাক্যমুনি বুদ্ধের উপদেশ ও দর্শনের সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। মধ্যযুগে লামা তারানাথের পুথিটি পড়লে বোঝা যাবে। অলকা চট্টোপাধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদে পাওয়া যায় সেটি। লামাযানের কেন্দ্রে রয়েছে বৌদ্ধতন্ত্রের শাখাপ্রশাখা। মহাযানে প্রকল্পিত 'দেবতা' বুদ্ধের আতিশয্য থেকেই এই সংস্কৃতিটি বেড়ে উঠেছিলো। এই চিন্তার প্রধান অবলম্বন ছিলো তিব্বত অঞ্চলে প্রচলিত নানা লোকবিশ্বাস, কুসংস্কার, কিংবদন্তিকে 'বৌদ্ধ' ধর্মের 'মূলস্রোতে' সামিল করার আকুলতা। গৌতম বুদ্ধের মনন ও চিন্তার হাজার মাইলের মধ্যেও এসব ব্যাপার আসেনা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক সমীকরণে তিব্বতের দলাই লামা বৌদ্ধ বিশ্বাসের জগতে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করার পর বহু মানুষের কাছে লামাতন্ত্রই 'বৌদ্ধধর্মে 'র মূল স্রোত হিসেবে গণ্য হওয়া শুরু হয়। বিভ্রান্তিটি এখানেই।
'বৌদ্ধধর্মের প্রধান দেবতারা হলেন বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব।' এই উক্তিটি বিপজ্জনক। শাক্যমুনি প্রচারিত 'সদ্ধর্ম' যখন থেকে 'বৌদ্ধধর্ম ' নামে প্রচারিত হওয়া শুরু হয় ( বুদ্ধঘোষের আমল থেকে ) বুদ্ধের মৌল উপদেশগুলি অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করে। 'বোধিসত্ত্বে'র 'ধর্ম' আর ব্রাহ্মণ্যবাদের পুরাণধর্ম একই বস্তু। তা সদ্ধর্ম নয়। বজ্র ও লামাযান নিয়ে সাহেবরা অনেক কিছু লিখেছেন । অত্যন্ত গভীর অধ্যয়ন না করলে তার খেই হারিয়ে যায়। বাংলায় সাধারণ পাঠ করতে গেলে আমাদের প্রাচীন পণ্ডিতদের মধ্যে আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এখনও তুমুল ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁরই আত্মজ পণ্ডিত বিনয়তোষ ভট্টাচার্য Buddhist Iconography বা বজ্রযানী দেবতাতত্ত্বের বাতিঘর। এ বিষয়ে তাঁর গবেষণাই এখনও শেষ কথা। এই লেখাটির উপজীব্য বিষয়টি পণ্ডিত বিনয়তোষের দৌলতেই আমাদের নসিব হয়েছিলো।
লেখক ছন্দক জানা লামাযানের খুব ছোট্টো একটা পরিসর নিয়ে লিখেছেন। যা লিখেছেন, মনোজ্ঞ হয়েছে। বিশেষত ছবিগুলি নিঃসন্দেহে প্রশস্তি দাবি করে।
লেখা আর ছবি দুইই ভালো লাগল।
আঃ , কী ভালো লেখা ! কী ভালো ছবি !
লেখা ও ছবি দুটিই মনোমুগ্ধকর।
এরকম পেন্টিং আজকাল খুব বিশেষ দেখা যায়না। বৌদ্ধ ধর্ম ও ইতিহাস নিয়ে জানতে বিশেষ আগ্রহী।
আমার কৌতূহল আরেকটু অন্যরকমের। ভারত ছাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের আন্তর্জাতিক যাত্রাপথ। চীন, জাপান ও অন্যান্য দেশে কি ভাবে পৌঁছেছিল ?
১ নং ছবিটি কোন দেবতার?
ওটি অবলোকিতেশ্বর মনে হল (১নং) অবশ্য ভুলও হতে পারি।
আর নিংগমস আর কাগয়ু পথের আইকনস (মানে আচার্য, সিদ্ধা , রিনপোচে এদের নিয়ে একটা লেখার অনুরোধ রইল। বড্ড কনফিউজড আমি নিংমাদের অনেক আইকনস কাগয়ু পথেও আছেন দেখতে পাই । এদের তফাতটা এখনো পরিস্কার হচ্ছে না