তখন আমার ‘মার্সেল প্রুস্ত: জীবন ও সাহিত্য’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিতে গেলাম। উনি নেড়েচেড়ে বইটা দেখলেন। খুশি হলেন। তারপর জানতে চাইলেন, “তুমি ইয়াসের কেমালের নাম শুনেছ?”
—তিনি কে?
—তুরস্কের ঔপন্যাসিক।
—আমি ওরহান পামুকের লেখা পড়েছি।
—পামুক পড়ে তুমি তুরস্ককে জানতে পারবে না। যদি সত্যিই তুরস্ককে জানতে চাও, তাহলে ইয়াসের কেমালের লেখা পড়তে হবে। আধুনিক তুরস্কের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক।
আমাদের কথা বলার বিষয় ছিল, মার্সেল প্রুস্ত। উনি হঠাৎ ইয়াসের কেমালের প্রসঙ্গে চলে গেলেন কেন, সেটাই ভাবছিলাম।
উনি অনুমান করেছিলেন। নিজেই সেটা পরিষ্কার করে বললেন, “প্রুস্ত ইউরোপের লেখক। তিনি মহান ঔপন্যাসিক। কিন্তু বাকি বিশ্বেও অনেক গ্রেট লেখক ছড়িয়ে আছেন। তুমি তাঁদের কথা জানবে না?”
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আমার শিক্ষক। আমি যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগের ছাত্র, তখন উনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মাঝেমধ্যে সেখানে ক্লাস নিতে আসতেন। আর যখন আমি সেখানে গবেষণা করছি, তখন বিভিন্ন প্রয়োজনে নানাসময় ওঁর তিলজলার ফ্ল্যাটে আমাকে যেতে হয়েছিল। ফোনেও আমাদের মধ্যে কথা হত।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে আমি ভালোবাসতাম। জ্ঞানের প্রতি তাঁর আর্তি ছিল অপরিসীম। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অমায়িক, বিনয়ী, রসিক। কথা বলতে ভালোবাসতেন। আর সেটাও মজা করে করে। ওঁর ‘সেন্স অফ হিউমার’ ছিল তুলনাহীন। কখনও কোনো পাণ্ডিত্য ফলাতেন না। পণ্ডিত-সুলভ হাবভাবও তাঁর ছিল না। কিন্তু ওঁর কাছে বসে এক ঘণ্টা সময় কাটালেও সমৃদ্ধ হওয়া যেত, এবং তাও চা-কফি খেতে খেতে, গল্প করে করে। জলবাতাসের মতোই তাঁর কাছে বিশ্বসাহিত্য ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁর রক্তের মধ্যেই মিশেছিল ওসব। তার জন্য তাঁকে কখনও অতিরিক্ত কোনো চেষ্টা করতে হত না।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মূলত কবি। নিজে খুব কম কবিতা লিখেছেন। কিন্তু যতটুকু লিখেছেন, তা বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে গেছে। বৌদ্ধিক, মেধাবী, রহস্যময় কবিতা লিখতেন তিনি। পড়লে হেঁয়ালির মতো মনে হয়। আমি তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলাম।
কবিতার প্রতি এই ভালোবাসাই তাঁকে দিয়ে গোটা বিশ্বের কবিতা অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে। তিনি আফ্রিকা–আমেরিকার কালো মানুষের ‘নিগ্রো’ কবিতা অনুবাদ করেছেন। লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহী কবিতা অনুবাদ করেছেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের কবিতা অনুবাদ করেছেন। ওয়ালকট ও ব্রাফেটের ক্যারিবিয়ান কবিতা অনুবাদ করেছেন। পূর্ব ইউরোপের কবিতা অনুবাদ করেছেন। যেখানেই প্রান্তিক মানুষ অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভে গর্জে উঠেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে, মানবেন্দ্র সেই কবিতাকে বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।
বিশ শতকের বিশ্ব কবিতার যে বিচিত্র ধারা, বাঙালি প্রথম তার স্বাদ পায় মানবেন্দ্রের অনুবাদ পড়েই। তিনি নিকানোর পাররার ‘অ্যান্টি-পোয়েট্রি’-কে যেমন বাঙালিকে চিনিয়েছেন, তেমনই চিনিয়েছেন মিরোস্লাভ হোলুব বা ভাস্কো পোপার কবিতাকে। অনুবাদ যে মহৎ সাহিত্য কর্ম, সেটা মানবেন্দ্রই প্রথম বাঙালিকে দেখালেন। কিন্তু তিনি যা কিছু করেছেন, তা একটা নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের জায়গা থেকেই। সেখানে তিনি কোনো আপস করেননি।
আর সে কথাও তিনি স্পষ্ট করেই আমাকে বলেছিলেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আমি কোনোদিন হোর্হ লুই বোর্হেস বা মারিও ভার্গাস লোসার কোনো লেখার অনুবাদ করব না।”
—কেন? অবাক হয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম।
উনি বলেছিলেন, “বোর্হেস ফ্যাসিজমকে সমর্থন করেছিলেন। আর লোসা করেছিলেন তাঁর দেশের ডিকটেটরশিপকে। এঁরা নিশ্চয়ই বড়ো লেখক। কিন্তু এদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই...”
আর সত্যিই তিনি নিজের জীবন থেকে বোর্হেস ও লোসাকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারকে যেসব লেখক সমর্থন করেন, তিনি ছিলেন তাঁদের কঠোর বিরোধী।
বলতে গেলে, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে তিনিই প্রথম বাঙালিকে ব্যাপকভাবে চেনালেন। মাচাদো দ্য আসিস, সেসার ভায়েহো, আলেহো কার্পেন্তিয়ার, হুয়ান রুলফো, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস—এদের গোটা বিশ্ব চিনত, বাঙালি চিনত না। মানবেন্দ্রই প্রথম তাঁদের চেনালেন। তিনি ওসব চেনানোর আগে বাঙালির বিশ্বসাহিত্যচর্চা ছিল মোটের ওপর ইউরো–কেন্দ্রিক। ইউরোপ আর আমেরিকার বাইরেও যে কী বিপুল আর মহান সাহিত্য লেখা হয়েছে, সেটা তিনি বারবার বাঙালিকে মনে করাতে চাইতেন। তাঁর বাড়িতেই আমি প্রথম বহু দুর্লভ বই দেখি। ইকুয়েডরের দেমেত্রিয় আগুইলেরা মালতার ‘সেভেন মুন অ্যান্ড সেভেন সারপেন্টস’, উরুগুয়ের হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির ‘দি শিপইয়ার্ড’, এসব বইতো মানববাবুর কাছেই প্রথম দেখি। তিনিই এসব নামের সঙ্গে প্রথম আমাদের পরিচয় করান এবং তাঁদের গুরুত্ব আমাদের বোঝান।
কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি সবসময়ই ভারতীয় সাহিত্যের কথা মনে রেখেছেন এবং বাঙালির কাছে বিভিন্ন ভাষার ভারতীয় সাহিত্যকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন পুরোপুরি সচেতন। পাঁচ খণ্ডে ভারতীয় গল্পের অনুবাদ সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এ ছাড়া দুই খণ্ডে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভারতীয় গল্পের সংকলন তাঁর আর একটি স্মরণীয় কাজ। ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে সারাজীবন ভেবেছেন ও কাজ করেছেন মানবেন্দ্র। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালিরা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রতি যত আকর্ষণ বোধ করে, ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি ততটাই উদাসীন। তাঁদের চোখে ভারতীয় সাহিত্যও একটি প্রান্তিক সাহিত্য। তাই ভৈকম মহম্মদ বশিরের মতো দিক্পাল ভারতীয় লেখকের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়েছেন।
আর রয়েছে তাঁর অজস্র প্রবন্ধ। আলেহো কার্পেন্তিয়ার থেকে সুকুমার রায়। একদিকে কত অজানা, অচেনা কবি–লেখকের সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে শিশুদের প্রতি বোধ করেছেন গভীর মমতা, অজস্র কাজ করেছেন তাঁদের জন্য। ‘হরবোলা’ নামের পত্রিকা তাঁদের জন্যই তো সম্পাদনা করতেন। ব্রাজিলের মহৎ ঔপন্যাসিক হোর্হ আমাদুর উপন্যাস অনুবাদ করেছিলেন কিশোর–কিশোরীদের জন্য। আবার খেলা নিয়েও তাঁর ছিল দুরন্ত আগ্রহ। লিখেছিলেন, ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস।
সারাজীবন ধরে অজস্র কাজ করে গেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাজের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে বাঙালির বহু বছর লাগবে। তিনি ছিলেন এক বিরল বাঙালি। জ্ঞানের প্রতি তাঁর ছিল অনিঃশেষ তৃষ্ণা। শেষ জীবনে চোখে প্রায় দেখতেই পেতেন না। টিভি চালিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। আর সারা পৃথিবীর খবরাখবর শুনতেন। খেতে ভালোবাসতেন। শেষ পাতে পাঁপড় না হলে চলত না। আর ছিল মুচকি একটা হাসি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে নিজের বহু বই দিয়ে দিয়েছিলেন।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব বেশি ক্লাস আমি করিনি। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য নিয়ে গল্প করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আজও ইয়াসের কেমাল বা দেমেত্রিয় আগুইলেরা মালতার কোনো বই হাতে নিয়ে তাঁর মুখটাই সবার আগে ভেসে ওঠে। আমার মতো তাঁর কত ছাত্রছাত্রীকে যে তিনি বিশ্বসাহিত্যের কত অজানা রহস্যের সন্ধান দিয়েছেন, তার কোনো হিসেব নেই। একদিন ঠিকই বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিরল ভূমিকার প্রকৃত মূল্যায়ন হবে...
চমৎকার লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।