এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • তালিবান জুজুর কবলে ভারত

    এম কে ভদ্রকুমার : অনুবাদ - দময়ন্তী
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ জুলাই ২০০৮ | ১২৮১ বার পঠিত
  • গত ৭ই জুলাই কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে বীভৎস আক্রমণ, এক নজিরবিহীন ঘটনা। আশির দশকের সিভিল ওয়ারের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়, কিম্বা ২০০১ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের সময়ও কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস অথবা অন্যান্য কোনও দূতাবাসও কখনও এরকম হিংস্রভাবে আক্রান্ত হয় নি। এই আত্মঘাতী হানায় মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের, আহত ১৪০। মৃতদের মধ্যে আছেন ভারতের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার আর ডি মেহ্‌তা, কূটনীতিক ভেঙ্কটেশ্বর রাও এবং দুজন ভারতীয় প্যারামিলিটারী গার্ড।

    যথারীতি ভারতের চিন্তাশীল অংশের প্রবক্তারা সন্ত্রাসবাদী হানাকে একটি "মরাল এভিল' বলে বর্ণনা করেছেন। কাজটি অত্যন্ত ঘৃণ্য তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাকে নৈতিক অনৈতিকের লাইন টানার আগে আরও একটু ভাবার দরকার আছে। কিন্তু যখন ন্যারেটিভ শুরুই হয় ভারতকে এক নৈতিক জগতে নি:স্বার্থভাবে পরোপকার এবং আমাদের স্বভাবগত অন্তর্নিহিত ভালত্বর জন্য ঘৃণিত ও আক্রান্ত হতে দেখিয়ে, তখন তা যথেষ্ট বিপদের কথা। আসলে কিন্তু যে সময়ে আমরা বাস করছি, সেখানে কোন নৈতিকতা নয়, বরং নীতিহীন ক্ষমতার রাজনীতিই অধিকাংশক্ষেত্রে আমাদের "প্রতিপক্ষ চিহ্নিতকরণ' ও তার বর্ণনার পেছনে থাকে।

    এখন তাই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আমাদের আচরণ ও অবস্থানগুলি পুনরায় খতিয়ে দেখার। এখানে পরিস্কার করে বলে রাখা ভাল, এই খতিয়ে দেখার অর্থ কোনভাবেই সন্ত্রাসবাদী কার্য্যকলাপকে কোনরকম ছাড় দেওয়া বা কোনওভাবে কোন সমর্থন দেওয়া নয়। কিন্তু এই কাজটি করতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা অন্তত কোন নকল সারল্যের মোহে ডুবে থাকব না। একটি চড়াইপাখীর মৃত্যুও অত্যন্ত দু:খজনক, সেখানে আফগানিস্তানে বড্ড বেশী ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে, ঘটছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে, একজন ব্রিগেডিয়ারের মৃত্যু যথেষ্ট বড় ক্ষতি। আমাদের অবিলম্বে খতিয়ে দেখা উচিৎ যে কেন এটা ঘটছে? ভারত কি সত্যিই আফগানিস্তানের জটিল পরিস্থিতি তলিয়ে বুঝতে সক্ষম?

    এই কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায় কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের ওপর। তাঁদের উচিৎ এক্ষুণি সমস্ত পরিস্থিতি ও হাতে আসা তথ্য পর্যালোচনা করে দিল্লীকে রিপোর্ট দেওয়া। এরপরে মিনিস্ট্রি অফ্‌ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স বিচার করে দেখবেন ভারতের আফগান-নীতির মধ্যে কোথায়ও কোন ফাঁকফোকর আছে কিনা। সাম্প্রতিক অতীতের বিভিন্ন ঘটনায় কিন্তু একটা নির্দিষ্ট নকশা ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে, তা কি নিতান্তই আকস্মিক!?

    যখনই আফগানিস্তানে একজন করে ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানির খবর আসে তখনই নিয়ম করে "সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ'এর ভয়াবহতার কথা পুনরাবৃত্তি করে,আফগানিস্তানে অবস্থিত ভারতীয়অদের সুরক্ষাব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আমাদের ভুললে চলবে না, কূটনৈতিক মিশনের বাইরেও বেশ কয়েকহাজার ভারতীয় কিন্তু সেখানে বিভিন্নরকম পুনর্গঠনের কাজে নিযুক্ত,ড় ব্যা! তারপতর সথ আবার যে কে সেই। কিন্তু এইই কি যথেষ্ট? কেউ কি হিন্দুকুশ পাহাড়ে বসে কান দিচ্ছে আমাদের কথায়? কোথায়ও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। খুব ভুল হচ্ছে।

    একটা জিনিষ কিন্তু খুব পরিস্কার। তালিবানরা অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কোনওরকম দেখানোপনায় বিশ্বাস করে না। তাদের প্রতিটি আচরণের পিছনে একটি পরিস্কার রাজনৈতিক বার্তা থাকে এবং তার অভিমুখও নির্দিষ্ট। তালিবান ও তাদের কার্য্যকলাপ যাঁরা খেয়াল করেন তাঁরা সকলেই একমত হবেন যে গত একদশক ধরে তারা এই ধারাবাহিকতা দেখিয়ে এসেছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ইউ এস আগ্রাসনের ঠিক আগেও তারা চুক্তি করতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু ততদিনে জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বে ইউ এস প্রশাসন যুদ্ধের পথই চুড়ান্ত বলে সাব্যস্ত করেছে। বর্তমানে ভারতীয় দূতাবাসে আক্রমণ ও তার সময় দুইই বিস্তারিত পর্যালোচনার দাবী রাখে। শুধুমাত্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার অভাব ও হিংসার বাতাবরণকেই এই আক্রমণের কারণ বলে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। ভারত তো আর আফগানিস্তানে অবস্থিত যৌথবাহিনীর অংশ নয়। ইরান কিম্বা রাশিয়া এবং উজবেকিস্তানও সেই অর্থে তালিবান কিম্বা আল-কায়েদার কিছু কম শত্রু হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও ভারতকেই কেন আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে?

    প্রথমত: তালিবানরা এখনও পর্যন্ত ভারতকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে\ বেছে নিয়েছে শুধুমাত্র আফগান মাটিতেই। এখনও পর্যন্ত ভারতের মাটিতে তারা তাদের লম্বা হাত বাড়ায় নি। যদিও ভারতের আর্মি চীফ সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে তাঁর অনুমান কাশ্মীরি জঙ্গীদের সাথে আল-কায়েদা ও তালিবানদের সম্ভবত: যোগাযোগ আছে। কিন্তু এই যোগাযোগ আমার মতে একেবারেই অসম্ভব। আর এত উচ্চপদাধিকারী একজন ব্যক্তি এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন আনুমানিক মন্তব্যই বা করেন কি করে! যাই হোক, এর থেকে এই বার্তাটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তালিবানরা ভারতের "আফগান-নীতি' নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং এজন্যই তারা কিছু হিসাব মেটাতে চাইছে, আফগান মাটিতেই। সামগ্রিকভাবে ভারতের ওপর তাদের কোন বিদ্বেষ নেই।

    দ্বিতীয়ত: তালিবানরা তাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধেই। যদিও এখনও পরিস্কার নয় যে ব্রিগেডিয়ারই প্রধান লক্ষ্য ছিলেন কিনা, তবুও মনে হয় তিনিই মূল লক্ষ্য ছিলেন, এবং সেক্ষেত্রে আক্রমণের সময়টি খুবই তাৎপর্য্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি ভারতীয় সেনা আফগানিস্তান সরকারের সৈন্যবাহিনীর সাথে সহযোগীতা অনেক বাড়িয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত আফগানিস্তানের সৈন্যবাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে এবং সম্ভবত: আফগান সশস্ত্রবাহিনীকেমিলিটারী হার্ডওয়ারও যোগান দিচ্ছে। ভারতের তরফে কেউই এই খবরগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকারও করেন নি। বলাবাহুল্য তালিবানরা এগুলো সবই নজর করেছে। আফগান সৈন্যবাহিনীতে তালিবানদের লোক প্রচুর আছে বলেই গুজব। আর তাছাড়াও কাবুলে কোন খবরই খুব বেশীদিন গোপন থাকে না, কাজেই ভারত-আফগান সৈন্যবাহিনীর গলাগলি তারা ভাল চোখে দেখছে না এবং এটিকে তাদের দেশের অন্তর্নিহিত ব্যপারে ভারতের অহেতুক নাক গলানো বলেই মনে করছে।

    কেউ কেউ বলতে পারেন যে ভারত সরকার, আফগানিস্তানের নির্বাচিত, হামিদ কারজাই পরিচালিত সরকারের সাথেই সহায়তা করছে, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে। কিন্তু গৃহযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যপারটা এত সহজ নয়। ভারতকে বিশেষ কূটনৈতিক মিশন পাঠিয়ে মুজাহিদিনদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছিল যে নাজিবুল্লার সাথে সুসম্পর্ক নিতান্তই ইতিহাস মাত্র; এবং তা মুজাহিদিনদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার পথে কোনওরকমেই বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা। আরও মনে রাখতে হবে আশির দশকের মাঝামাঝি শ্রীলঙ্কায় ভারতের তথাকথিত "শান্তিরক্ষাবাহিনী'র কার্য্যকলাপ, অভ্যন্তরীণক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ব অলেই পরিগণিত হয়েছিল। ভারতকে অনেক মূল্য দিয়ে বুঝতে হয়েছিল গৃহযুদ্ধের মধ্যে একজন বহিরাগতর পক্ষে ন্যায় অন্যায়এর ভেদ করা খুবই কঠিন। স্বাভাবিক অবস্থার ন্যায় অন্যায়ের বোধ সেখানে সর্ব্বদা খাটে না, তাই বহিরাগত সেই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লে জটিলতাই বৃদ্ধি পায়।

    এখানে আরও একটি ব্যপার আছে। আফগান সৈন্যবাহিনীর ৭০ শতাংশ অফিসারই "তাজিক' সম্প্রদায়ভুক্ত। এদিকে তালিবানরা আবার অধিকাংশই "পাখতুন' সম্প্রদায়ভুক্ত। কাজেই ভারত যখন আফগান মিলিটারী অফিসারদের ট্রেনিং দেয় "তালিবান'দের সাথে লড়বার জন্য, তখন ভারত সম্পূর্ণ অকারণেই তাজিক বনাম পাখতুন লাড়াইয়ের মধ্যে তাজিক পক্ষভুক্ত হয়ে এসে দাঁড়ায়। হয় ভারত, আফগান রাজনীতির এই অত্যন্ত স্পর্শকাতর দিকটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, অথবা ইচ্ছে করেই এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। যাই হোক না কেন, সরকারের তরফে এ সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।

    তৃতীয়ত: সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হল, দিল্লীর ইউপিএ সরকার ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের আফগান নীতি তৈরী করেছে। ভারতের উচিৎ বুশ-প্রশাসনের তথাকথিত জঙ্গী ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। আফগানিস্তান আক্রমণের পেছনে
    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ জটিল স্বার্থও জড়িত। যেমন আফগানিস্তান ও রাশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সে¾ট্রাল এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার, ন্যাটোর প্রসার ঘটিয়ে একে গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশানে পরিণত করা, ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ইত্যাদি। ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক সেইমুর হার্শ সম্প্রতি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে বলেছেন যে ইরানে ক্ষমতার হাতবদল ঘটানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য আফগানিস্তানকে ব্যবহার করছে। ভারত তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এইসব শয়তানী নীতি এবং ডগমা'র অনুসারী নয়, কাজেই ভারতের আফগান নীতি মার্কিন ঘেঁষা হওয়ার কোন যুক্তি নেই।

    দুর্ভাগ্যবশত: ভারতের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রভাবশালী ও দায়িত্বশীল একটা অংশ মনে করছে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'এ সামনের সারিতে দাঁড়ালে পাকিস্তানের সাথে টক্কর দেওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সুরক্ষা- সহযোগীতার মধুর সম্পর্ক যখনই চিড় খায় অথবা আমেরিকা, যুদ্ধের কেন্দ্র পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত অথবা পাকিস্তানের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সরাতে চাইলে, ইসলামাবাদের অস্বস্তি ও প্রতিরোধ দেখেই এই অংশ আমেরিকার হয়ে লড়বার জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ে। আবার ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারক অংশের মধ্যে একটা প্রভাবশালী অংশ মনে করে ভারতের এখনই একটু "মাসল পাওয়ার' দেখানোর প্রকৃত সময় এবং তা ভারতের অবশ্যকর্তব্য। যথারীতি এই অংশের পৃষ্ঠপোষক মার্কিনীরা সর্বদাই তোল্লা দিয়ে যায় যে ভারত বড্ড বেশী নিরীহ গোবেচারী ভূমিকা পালন করে চলেছে।

    যাই হোক, আন্তর্জাতিকমহলে অনেকেই মনে করছেন যে আফগানিস্তান হয়ে উথেছে ভারত ও পাকিস্তানের একটি বিকল্প যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু এই বিকল্প যুদ্ধ এখনই বন্ধ হওয়া দরকার অন্তত: পাঁচটা কারণে। প্রথমত: এটি অত্যন্ত আপত্তিকর ও অনৈতিক। নিতান্ত নিরীহ, কষ্টসহিষ্ণু আফগানী জনগণের দুর্দশায় ভারত যদি নিতান্তই চোখ বুঁজেও থাকে, তাহলেও আফগান জনগণকে দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করাটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত: এই ছায়াযুদ্ধ ভারতের ঘোষিত আঞ্চলিক পররাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে, যা বলে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলে। তৃতীয়ত: পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ভারত উপেক্ষা করছে, যার ফল হতে পারে বিষময়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিশাল। চতুর্থত: এই ছায়াযুদ্ধ বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের বাতাবরণের খুব ক্ষতি করছে, যা সাম্প্রতিককালে ধীরেধীরে অনেকটাই গড়ে উঠছিল।

    পঞ্চমত: সবচেয়ে বড় কারণ হল, আফগানিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের লেজিটিমেট ইন্টারেস্টকে উপেক্ষা করা চুড়ান্ত মূর্খামি। ভারত নিশ্চয় চুপচাপ বসে বসে নির্বিকারভাবে দেখবে না যে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা ভূটানে পাকিস্তান আস্তে আস্তে প্রভাব বাড়াচ্ছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে সম্প্রতি তিনজন উচ্চপদস্থ ভারতীয় অফিসার কলম্বো গিয়েছিলেন,চীন ও পাকিস্তানের সাথে শ্রীলঙ্কার সহযোগীতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের উদ্বেগ ব্যক্ত করতে। এটাকে "মনরো ডকট্রিন' বা প্রভাবশালী বলয়, যাই বলা হোক না কেন, প্রত্যেক রাষ্ট্রের কিছু ভূরাজনৈতিক ( geopolitical ) বাধ্যবাধকতা থাকে। পাকিস্তানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে আফগানিস্তান বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাই পাকিস্তান কিছুতেই আফগানিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্কগুলির প্রতি চোখ বুঁজে থাকতে পারে না। অতএব একথা নিশ্চিত করে বলাই যায় যে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে, এমন কিছুর আভাষ দেখলেও পাকিস্তান তার প্রতিরোধ করতে চাইবে। এখানে উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, কান্দাহার, হেরাত, জালালাবাদ ও মাজার-ই-শরীফে
    ভারতের দূতাবাস রাখার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এক খুনের বদলা খুনের অনন্ত চক্রের জন্ম দিচ্ছে।

    শেষপর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান কেবলই পরস্পরের রক্ত ঝরিয়েই যাবে, যাতে কারোরই কোন লাভ হবে না।

    ভারতের এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ অর্থনৈতিক উন্নতি, যার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে শান্তি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্ষা করা খুবই জরুরী। চীনের উদাহরণ চোখের সামনেই রয়েছে।

    সবচেয়ে বিপদের কথা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের এই তথাকথিত বন্ধুত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়ত ভারতকে আফগানিস্তানে আরও একটু আগ্রাসী ভূমিকা দেখাতে প্ররোচিত করতে পারে (যদি না ইতিমধ্যেই তা হয়ে থাকে)। আগেও বুশ-প্রশাসন ভারতে (এবং চীন) এর কাছে আফগানিস্তানে সেনা প্রেরণের অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের অতিরিক্ত "ম্যানপাওয়ার' নিয়ে ভারত যদি "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' যোগ দেয়, তাহলে ওয়াশিংটনের খুশীর আর সীমা থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে পা দেওয়া ভারতের পক্ষে চুড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা হবে। ভারতের বোঝা উচিৎ যে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশী প্রয়োজন, স্রেফ পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই। ভারতের ভূমিকা হতে পারে আফগানিস্তানের দরজায় আমেরিকার পাপোষ হিসাবে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র নীতিপ্রণেতারা কেউ কেউ তা বুঝে অথবা না বুঝেই হঠাৎই খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন ভারতের ক্ষমতা দেখানো ও টাইট দেবার জন্য। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন হিন্দুকুশ অঞ্চলে ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ব্রিটেন বা সোভিয়েৎ ইউনিয়ানের কি হয়েছিল, আর আমেরিকারও তাই হচ্ছে।

    ভারত যদি তালিবানদের ভারতরাষ্ট্রে বিরোধী ও আক্রমণাত্মক কাজকর্মের জন্য প্রতিশোধ নিতে চাইত, তো তার একটা মানে বোঝা ?যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে তো ঘটনা তা নয়, ক্ষমতাবান প্রো-আমেরিকান লবি চাইছে ভারতকে আফগান যুদ্ধে শামিল করতে। তার সবচেয়ে সোজা উপায় হল "তালিবান'দের ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করা ও বারবার বলে যাওয়া।

    সমস্যার আরেকটা কারণ হল "পলিটিকাল ইসলাম' ও প্রতিবেশী দেশগুলিতে তার বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে ভারতের পরিস্কার ধারণার অভাব। আমেরিকার কার্নেগী স্কলার ফাওয়াজ-এ-গার্জেস ( Fawaj A Gerges ) সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন "জার্নি অফ দ্য জিহাদিস্ট - ইনসাইড মুসলিম মিলিট্যান্সি'। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে প্রথমত: "ইসলাম'পন্থিদের একটা বড় অংশই (৯০%) গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করেছে। তারা সন্ত্রাসেরও বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত: মেইনস্ট্রীম ইসলামিস্টরা নিজেদের সমাজের গণতান্ত্রিকরণের সাথে সাথে নিজেদের অনেক মৌলিক নীতির সাথে আপস করে কট্টরপন্থা থেকে সরে আসছে। তৃতীয়ত: মেনস্ট্রীম জিহাদিরা, কট্টর জিহাদি, যেমন আল-কায়েদার ক্ষেত্রে অনেকটাই কাউন্টারওয়েটের কাজ করে। চতুর্থত: "ইসলামিস্ট'রাও তাদের "ধর্মনিরপেক্ষ' ভাইদের মতই অজস্র দলে, উপদলে বিভক্ত। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল, গার্জেস দেখিয়েছেন যে তালিবানরা যতটা না "ইসলামে' বিশ্বাসী তারচেয়েও বেশী করে তাদের গোষ্ঠীগত অভ্যাসের উপরে আস্থাশীল। ফলে ক্ষমতায় আসার পরে পরে তাদের বাস্তব রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিচালন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। আল-কায়েদার শাখা হিসাবে তালিবানদের জুড়ে যাওয়ার পেছনে আমেরিকা, পাকিস্তান, সৌদি আরবের নিরাসক্ত মনোভাবও বেশ খানিকটা দায়ী।

    বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তার পক্ষে তালিবানরাই সবচেয়ে বিপজ্জনক -- একথা সম্পুর্ণ ভুল। তালিবান বহুবার বিভিন্নভাবে বার্তা পাঠিয়েছে যে তারা ভারতকে এমন শত্রু মনে করে না, যার জন্য ভারতঅকে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সাথে মিলিয়ে সর্বতোভাবে তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। হয়তবা ভারত একটু বেশীই ওভাররিয়্যাক্ট করছে। হয়ত, গোটা আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে কাস্মীরে অবিরাম রক্তপাত, পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক ব্যবহার, ১৯৯৯ সালে ভারতীয় প্লেন হাইজ্যাক করে কান্দাহার নিয়ে যাওয়া -- সেই অপমান ভারতকে প্ররোচিত করছে। ২০০১ এ বামিয়ানের বৌদ্ধমূর্তির ধ্বংসও ভারতীয় চেতনাকে আহত করেছে। হয়ত এইসব কারণেই ভারত অতিরিক্ত সতর্কতা দেখাচ্ছে।

    কিন্তু ২০০১ সালকে কাট-অফ ধরে নিয়ে ভারতের উচিৎ ছিল পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা। ২০০১ এর বন-কনফারেন্সে ভারতের উচিৎ ছিল পৃথিবীকে বোঝানোর চেষ্টা করা যে পরাজিত পক্ষকেও আলোচনার টেবিলে না আনলে, তাদের সাথে কথা বলে একটা সকলের গ্রহণযোগ্য সমাধানে না পৌঁছালে কখনই "শান্তি' আসতে পারে না। কিন্তু তা না করে ভারত যুদ্ধনীতিকেই আঁকড়ে ধরতে চাইল, ফল রক্তের অবিচ্ছিন্ন ধারা। কিন্তু ভারতকে বাস্তববাদী হতেই হবে। তালিবানি জুজুর ভয় না পেয়ে, আলোচনার মাধ্যমে একটা স্থায়ী সমাধানে আসার চেষ্টা করতে হবে।

    * সৌজন্য : 1. Asia Times Online 2008
    2. Countercurrent.org 11th April

    জুলাই ১৪, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৪ জুলাই ২০০৮ | ১২৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন