এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • পশ্চিমবাংলার লেখালেখি

    সম্বিত সরকার
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ জুলাই ২০০৮ | ৮০৯ বার পঠিত
  • পশ্চিমবাংলার লেখালেখি

    বিষয়ে কয়েকটি কথা। পশ্চিমবঙ্গের এখনকার বাংলা সাহিত্য মুখ্যত আনন্দ গোষ্ঠী নামক একটিমাত্র কারখানার উৎপাদন। এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। "মুখ্যত", কারণ যে সব জনপ্রিয় কথাশিল্পীরা শব্দ সৃষ্টি করে জীবনধারণ করে আছেন তাঁদের অধিকাংশই আনন্দ গোষ্ঠীর বেতনভোগী। আনন্দগোষ্ঠীর আনুকূল্যে ইদানীংকালে বেশ কিছু ভালো লেখক-লেখিকা সীমিত সময়ের জন্য লোকচক্ষুর সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেও তাঁদেরই ইচ্ছায় বা রোষে আবার "পিছিয়ে পড়েছেন"। এই পশ্চাদ্‌গামীতা সাহিত্যমানের অধ:পতনজনিত নয়। বাংলা সাহিত্যের ক্রমহ্রস্বমান পাঠকের হাতে যেহেতু আনন্দ প্রকাশনাই মূলত: শোভা পায়, তাই অন্যান্য প্রকাশকদের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিকদের সামনের সারিতে নিয়ে আসা ও সেটিকে ধরে রাখা নিতান্তই কঠিন। অপরদিকে বিকশিত হবার আগেই বেশ কিছু লেখক - লেখিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছেন, এও সেই একেশ্বরবাদের ফসল। বঙ্গবিধাতা আনন্দ প্রকাশনার বাংলা সাহিত্যের দুর্দিনে এই পেশী আস্ফালন বাস্তবিকই নিন্দার্হ।

    সংখ্যাগুরু সাহিত্যিকদের (আনন্দ - ধর্মী বা লিটল ম্যাগাজিন - ধর্মী) শব্দ সাজানোর হাত, গুণে ও ময়ানে এত কাঁচা যে মোহনভোগের পরিবর্তে আমরা কেবলই হালুয়া প্রস্তুত হতে দেখি। অজস্র পৃষ্ঠার ওপর রুয়ে দেওয়া অক্ষরের জাল শুদ্ধমাত্র ঝুল হয়ে জমে থাকে। এই হাত পাকাবার আসরে পিটুলি গোলা জল না পেলে আমাদের অসুবিধা হয়। পশ্চিমবাংলার সাহিত্যরুচি দীন, দরিদ্র ও মূর্খ হয়ে উঠেছে।

    এই অবনমনের কারণ কি, তা নিয়ে আলোচনা আপাতত: মুলতুবি থাক। অবনমনের কয়েকটি ফল দেখা যাক।

    আত্মপ্রত্যয়ের অভাব। বিশ্বায়নের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে জীবিকার সুবিধা হয়েছে, কিছু¤ মধ্যবিত্তের ঘর সচ্ছল হয়েছে। বিদেশী দ্রব্য বাজারে সহজে পাওয়া গেলেও মহার্ঘ্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গড়ে কিঞ্চিৎ গতিবৃদ্ধি হলেও বহু ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান অবনমিত হয়েছে এবং আমাদের চিন্তার স্থবিরতায় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। মনের মধ্যে বহু প্রজন্ম জুড়ে জমে থাকা দ্বন্দ্ব, লজ্জা ও ভয় এখন বাধ্য হয়ে এই "বাজারের" মুখোমুখি হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে একবিংশ শতকের কর্মক্ষম বাঙালী তাদের পূর্বতন প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এই ধারণা কিয়দংশে সত্য। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গকে একে অপরের ভালোনাম ও ডাকনাম না ভেবে কলকাতার একটু বাইরে পা দিলেই সেই সত্য কিছু¤ অপ্রতুল হয়ে পড়ে। পৃথিবী অনেক ছোটো হয়ে হাতের মুঠোয় এলেও অর্থ, শিক্ষা, সুযোগ ও অভিজ্ঞতার অভাব থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। লিখে জীবিকা নির্বাহ করা অধিকাংশ দেশে কঠিন হলেও পশ্চিমবাংলায় সেই কাঠিন্য বোধ করি তুলনামূলকভাবে বেশি। দেশ-বিদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়ে জানার সুযোগ আমাদের আগে অনেক কম ছিল। এখন আন্তর্জাল তথা যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির দৌলতে সেই সুযোগের অভাব নেই। জানার আগ্রহ বা শেখার চেষ্টার অভাব আছে। কারণ, অনেক সময়েই সেই জানা বা শেখার পেছনে অ-সাহিত্যিক পরিশ্রম ও কষ্ট থাকে। কষ্ট করা, বা শেখার প্রচেষ্টাকে আমরা এখনও ন্যূনতম গুরুত্ত্ব দেই না, অজ্ঞানতাকে এবং আলস্যকে প্রতিভা মনে করি।

    কলকাতায় সম্বৎসরে একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য বইমেলা আয়োজিত হয়। অনেক মানুষ এলেও সেটি মেলার উপসর্গ ভিন্ন আর কিছু¤ই নয়। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের জ্ঞানতীর্থ কলকাতায় একটিও ভালো বইয়ের দোকান নেই। উৎসাহী পাঠককে আগে বইয়ের নাম জানতে হবে, প্রকাশকের নাম জানতে হবে, সেই বই কোন দোকানে পাওয়া যায় জানতে হবে, সবশেষে সেই বই কেনার মতো যথেষ্ট অর্থ থাকলে আমাদের বইয়ের দোকানগুলি অগ্রিম মূল্যের বিনিময়ে আমাদের প্‌ছন্দের বই "আনিয়ে দেবেন", এমনই রেওয়াজ। এছাড়া আমাদের বিদেশী সাহিত্য ও নিজেদের ভাষা নিয়ে উৎকট সাম্প্রদায়িকতায় ভোগা তো আছেই। এ ভিন্ন যোগ হয়েছে এক ধরণের উগ্র, নির্বুদ্ধি নকলনবিশি। নকল করার রোগ, রোগ নয়, বহু ক্ষেত্রেই মহৎ সাহিত্যের সোপান, সাধারণ সাহিত্যের সিঁড়ি। তার থেকে বেরোনো কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু কার থেকে নকল হচ্ছে সেটা যখন অজানা থাকে এবং তার উগ্রতা বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পরিব্যপ্ত হয়, তখন চিন্তার কথা বইকি। বহু বছর বাদে যুদ্ধ, মারী ও রাজনীতির কড়া চাবুকের হাত থেকে সামান্য পরিত্রাণ পেয়ে একটি প্রজন্ম অভূতপূর্ব আত্মগ্লানিতে ভুগে নকলের নকল করে সময় অতিবাহিত করলো।

    এইরকম সময়ে আঞ্চলিক ভাষা ভালোবাসা ও ব্যবহারের অভাবে, প্রয়োজনের অভাবে লোপ পেতে শুরু করে। প্রথমে প্রকাশিত লেখা লোকচক্ষু থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। ভারতবর্ষের অধিকাংশ আঞ্চলিক ভাষায় যেটি হয়েছে। এর পর হাতে লেখা ভাষা কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না, অত:পর মানুষের অক্ষরজ্ঞান কমতে থাকে, মানুষ অক্ষরের চিহ্নগুলো বিস্মৃত হয় ও সবশেষে মুখের ভাষা লোপ পায়। এই ঘটনা পরম্পরা ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলা হলো না। ভারতে অধিকাংশ শহরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে এই মুহূর্তে কথ্য ভাষা ব্যতীত আর কিছুই পড়ে নেই। (শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে এতটা গুরুত্ত্ব দেওয়ার আর্থসামাজিক কারণের কোনও অভাব দেখছি না।) আমরা যদি একটি ভাষা মলিন চীর বসনের ন্যায় ত্যাগ করে অপর একটি ভাষা পরিধান করতাম তবে কিছুদিন সুখ না থাকলেও স্বস্তি বিরাজ করতো। কিন্তু যেহেতু ভাষা অবস্মৃত এই শ্রেণী বসন পরিধান করতে ভুলে গেছে, আমাদের মনে কোনও সুখ বা স্বস্তি নেই। আমাদের অপর অবলম্বন মূলত: ইংরাজি, সেই ভাষায় আমাদের পারদর্শিতা ভালো নয়। ফলে এই বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ: ভাষাহীন হয়ে পড়ছে। ইংরাজী ভাষার এদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার প্রতি আকর্ষণ ক্ষীণ, নিজের ভাষার স্মৃতির বোঝা তার চারদিকে, কিন্তু তার প্রয়োজন অল্প। সেই লজ্জার ফলাফলে আমরা ইংরিজিকে নিয়ে নিজের মতো করে তার নতুন রূপ দিতে পারলাম না, একবিংশ শতাব্দীতে শেষ পর্যন্ত বাবু সম্প্রদায় ভগ্ন ভাষার নিগড়ে দিন গুজরান শুরু করলো। অন্ধ ব্যক্তি যেমন হস্তী অবলোকন করে কখনো তার শুণ্ড হাতে নিয়ে বলে এই হস্তী, কখনো তার পৃষ্ঠে হাত রেখে বলে এই হস্তী, ঠিক তেমনই, আমাদের পক্ষে বৃহৎ রাসভ ও আরবী তুরঙ্গমের মধ্যে তফাত করা আর সম্ভব নয়। আমাদের আপন আপন সাহিত্যের ঐতিহাসিক ভার এত বেশি যে তা আমরা বহন করতে অপারগ, তার দ্যুতি এত প্রবল, যে আমাদের ক্ষীণ দৃষ্টি তাকে চক্ষের মণির মধ্যে স্থান দিতে নারাজ। যে মুষ্টিমেয় ভারতীয় লেখক লেখিকা ইংরাজি ভাষাটিকে নিজের সন্তানের মতো বড়ো করে তুললেন, তার চক্ষুদান করলেন, তাঁদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হলো কই? আমরা তো দ্বার বন্ধ করে রইলাম, অভিমানে, দারিদ্রের লজ্জায়, ভয়ে।

    পৃথিবীতে যখন আন্তর্জাল মধ্যবিত্তের কুক্ষিগত হলো তখন এই অ-স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন করার একটি মহার্ঘ্য সুযোগ নষ্ট হলো। যোগ্য লেখক - লেখিকাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে, অন্যান্য আঞ্চলিক ও বিদেশী ভাষার সাহিত্যে আগ্রহ নিয়ে, তার অনুবাদ করে এবং নিজের নিজের লেখা অন্য ভাষায় অনূদিত হতে দিয়ে যে মেলবন্ধনের সুযোগ ছিল তা আমরা নিজেদের দোষে হারালাম। সংখ্যালঘু হলেও শিক্ষিত পাঠক, কিছু শক্তিশালী কলম এখনো এই মুহূর্তে বাংলা ভাষা-ভাষীর মধ্যে আছেন যাঁদের পক্ষে নানা দেশ, সাহিত্য ও মানুষের মধ্যে এই যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে - এই যোগাযোগ একমুখী নয়, এই আদান প্রদান হবে মাথা উঁচু করে, সমানে সমানে। আমরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সততই নানা দেশে "কনফারেন্সে' বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সাংস্কৃতিক মেলায় আমন্ত্রিত সাহিত্যিক হিসাবে যাই। কটি লোক আমাদের কাছে আসে? না আসার কারণ হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের দিকে আঙুল তোলার পদ্ধতিটি পুরানো হয়ে গেছে। আমরা নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি কি? শব্দের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে? বোধ করি, না, কারণ তা না হলে আমরা নানা দেশের বইমেলায় বাংলা সাহিত্যের দোকান দিতাম, আক্রান্ত সাহিত্যিককে আশ্রয় দিতে চূড়ান্ত মেরুদন্ডহীনতা প্রদর্শন করতাম না।

    বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি, বিষয় ও আবেগের প্রতি আমাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অশিক্ষিত উদাসীনতার ফল আন্তর্জালের ওপর ভয়ানকভাবে এসে পড়লো। আন্তর্জালকে গুরুত্ত্ব দেওয়ার কারণ এই, যে অধিকাংশ লোকের পক্ষে বাংলা ভাষার স্বাদ নেওয়ার সবথেকে সহজ ও সস্তা পথ আন্তর্জাল। সেভাবে দেখতে গেলে, একে বাংলার মুখ বললে অত্যুক্তি হবে না। যেহেতু এই রাজত্বে সকলেই রাজা, প্রকাশনার পেছনে মূলধন যৎসামান্য (বহু কর্মরত বাঙালী মোটামুটি সম্পন্ন), আন্তর্জালে লেখালেখির গড় মান এত ভয়াবহভাবে নীচে নেমে গেল যে সেই অক্ষরসজ্জা কেবলমাত্র লজ্জার উদ্রেগ করে। অধিকাংশ লেখার বিষয়, চিন্তা, আবেগ, অধিকাংশ লেখক লেখিকার অভিজ্ঞতা, মেধা, মনন, অনুভূতি এতই খারাপ, নূতন ভাবনার এতই অভাব - এই দুর্ভিক্ষে তাঁদের দাবদাহ ভিন্ন আর কিছু দেওয়া সম্ভবপর নয়। তাঁরা আমাদের ভাষার লজ্জানিরোধক শেষ নির্মোকটি মোচন করেচেন।

    অজস্র শারদীয়ার লেখা উৎপাদন করতে করতে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। কেননা এই শারদীয় তামাশা থেকে কিছু¤ প্রতিশ্রুতিবান (কম বা বেশি বয়েসী) সাহিত্যিককে চিহ্নিত করে এমন কোনও ব্যবস্থা করা হোক যাতে তাঁদের আর শারদীয়ায় লিখতে না হয়। হয়তো পাঁচ দশ ব্‌ছরের মধ্যে তাঁদেরই কেউ ভালো সাহিত্যিক হয়ে উঠবেন। যাঁদের লিখে দিন গুজরান করতে হয় না, কিন্তু কলম খারাপ নয়, তাঁদের থেকে নিরলস পরিশ্রমের প্রয়োজন আছে। সে নিয়ে পরে আলোচনা করছি। লেখার পরিবেশ সৃষ্টি হবার আশু প্রয়োজন। আর আমাদেরও শ্রমের মর্যাদা দিতে শেখা উচিত। যদিও এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক পরিকাঠামোয় শ্রমের মর্যাদা শব্দগুচ্ছটি যে খুব অর্থবহ, তা নয়।

    দেশের বাইরে, সংখ্যায় অত্যন্ত কম হলেও যাঁরা সত্যকার বাংলাভাষার চর্চা করেচেন ও করেন তাঁদের নিদেনপক্ষে এখনকার চেয়ে বেশি পরিচিতির প্রয়োজন ছিলো। তা হয়নি, আমরা গ্রাম্য রাজনীতি ও প্রস্তরযুগের গোষ্ঠীবদ্ধতার বাইরে খুব একটা বেরোতে পারি নি। আরেকটি অসুবিধার জায়গা হলো কলকাতা বইমেলার ন্যায় একটি নিম্ন শ্রেণীর মেলার বিষয়ে অনর্থক হৃদয় ঘামানো এবং ছদ্ম-কন্যাদায়বদ্ধতা। আমাদের সাহিত্য নিয়ে আমরা নানা দেশে যাবার কোনও চেষ্টাই করিনি। এতে দোষের কিছু¤ নেই, কারণ বাঙালী ও অবাঙালীরা বাংলা লেখা পড়েন না। যাঁরা বাংলা জানেন তাঁরা বাংলা ভাষার দূত নন। যাঁরা বাংলা ভাষা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান, তাঁদের অধিকাংশের কোনও ভাষাই জানা নেই। যে যা পারেন না, তিনি ঠিক তাই করেন, সমস্ত জীবন। ফলস্বরূপ, হাতে গোনা লোক ও বসার ঘর বাদ দিলে, এই ভাষা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত অসুবিধাজনক।

    যদি এ ভাষা বাঁচে, সংখ্যালঘু হয়েও টিকে থাকে, তবে আগামী দিনের বাংলা লেখালেখি কেমন হবে? কারা লিখবেন? যে আর্থসামাজিক শ্রেণীর গল্প ও অভিজ্ঞতা চর্চিত, চর্বিত হয়ে অসীম ক্লান্তির বাতাবরন তৈরি করেছে তাঁরা মনে হয় না আর লিখে পাঠককে আনন্দ দিতে পারবেন। তাঁদের জীবনে এমন কিছু¤ ঘটছে না, তাঁদের লেখায় এমন কিছু বিম্বিত হয় না যাতে মানুষ আকৃষ্ট হবে। ইদানীং "অন্য ধারার' মাধ্যমে "নতুন যুগের ভাষা' ব্যবহার করে কম বয়েসীদের বাংলা পড়াতে মূল স্রোত, ছোট পত্রিকা ও আন্তর্জালের সাহিত্যিক তথা শখের কলমচিরা চেষ্টা করছেন - কিন্তু তা থেকে যে পৌন:পৌনিকতা বেরিয়ে আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে কোথাও একটা, ত্বকের নিচেই সততার প্রচণ্ড অভাব আছে। যদি কোনও লেখা এর পরে বেরোয়, তবে তা এই আর্থসামাজিক শ্রেণীর বাইরে থেকে বেরিয়ে আসবে। কি নিয়ে সেই সাহিত্য লেখা হবে, তার রস কি হবে, তার অনুপান কি হবে তার বিচার করার সময় এখনো আসে নি। একটি ক্ষীণ ধারণা করা সম্ভব - যে সেই কথকতা হবে লজ্জা ও ভয় নিয়ে। এত সহস্র বছর যে লজ্জা আমাদের মস্তিষ্ককে আবৃত করে রেখেচে, যে ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তার বর্ণিল চরিত্রগুলির হদিশ পাওয়ার এই সময়। শারদীয়া নির্ভর সামাজিক ও সাহসী উপন্যাসগুলির হাস্যকর প্রয়াসগুলি থেকে আমরা তাহলে অন্তত: একটু রেহাই পাই।

    বাংলা ভাষা টিকে থাকলে আরো আশা করা যায় যে ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য অনেক আত্মপ্রত্যয়ী, অনেক শিক্ষিত হবে। তার জন্ম কফিহাইউসের কোষ্ঠকাঠিন্যময় আঁতুড়ঘর থেকে হবে না। সাহিত্যিক মহাশয় গ্রন্থাগার থেকে দুটি বিদেশী বই গোপনে তুলে এনে এক সপ্তাহে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবেন না। সত্যই কেউ যদি লিখতে চেয়ে থাকেন, কোনও বিষয়ে জেনে থাকেন তবে তাঁদের পক্ষে পণ্ডিতম্মন্য সাহিত্যিক, সমালোচক ও পাঠকের ক্যাটকলকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করা কঠিন কাজ নয়। এই লেখক লেখিকারা দৃঢ় হবেন ও বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করে তুলবেন।

    এই সমস্ত সাহিত্যিকদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা বাংলা ভাষার বেঁচে থাকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। যদিও বাংলাদেশে বাংলার প্রচলন ও প্রয়োজন পশ্চিমবাংলার তুলনায় বেশি, তার জন্যও এই কথাটি প্রযোজ্য। বাংলাদেশে খুব কম সময়ের মধ্যে বাংলায় অচেনা আরবী শব্দের জবরদস্তি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ক্ষতি করেচে। এছাড়া, আমি মনে করি, বাংলাদেশের লেখালেখির মধ্যে পশ্চিমবাংলার ওপর এক ধরণের অতিনির্ভরতা তাদের একটি নিগড়ে আটকে ফেলেচে। তা না হলে আত্মপ্রত্যএর অভাব থাকতো না। পশ্চিমবাংলা যা পারেনি পূর্ববাংলা তা আগেই করে ফেলতো। এই লেখাটির প্রয়োজন থাকতো না। এছাড়া আর্থসামাজিক অসুবিধা, শিক্ষার অভাব ও শিক্ষাবিমুখতা ইত্যাদি বাঙালী গুণগুলি তো আছেই।

    বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব লেখার মাধ্যমে। ব্যবহারিক ভাষা, কর্মক্ষেত্রের ভাষার ওপরে মানুষের হাত নেই। কিন্তু লেখার ওপরে আছে। দড়ি ধরে টান মেরে রাজা খানখান করার বিপ্লব নয়, এই প্রচেষ্টা অনেক বেশি সময়ের। আপনি, আমি, আসুন আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি। নিজেদের তুলনায় নিজেদের শিক্ষিত করে তুলি। যাঁরা মনে করি দু ছত্র লিখলে আমাদের ভালো লাগে, আমাদের দু ছত্র পড়ে অপরিচিত লোকেদের ভালো লাগে, বা লাগতে পরে, তাঁরা লিখে যাই। আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছোতে সচেষ্ট থাকি। নিজেদের লেখার মান নিয়ে চিন্তা করি। শব্দের ভাস্কর হবার সৌভাগ্য আর কটি মানুষের হয়! কিন্তু অসৎ লেখার হাত থেকে আমরা ভাষাটিকে মধ্যবিত্ত সমাজের তরফে অল্প ছায়া দিতে পারি। প্রশংসা বা উপহাসজনিত কারণে লেখার আনন্দ থেকে সরে যাওয়ার সময় এই মুহূর্তে নেই। তরবারির ন্যায় কলম নিয়ে যাঁরা আসবেন, যাঁদের কলম উদ্যত ফনার মতো উঠবে তাঁদের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হবে। ভাষা যায়, ভাষা আসে, আবার যায়। সে কথা সত্য। এ কথাও সত্য, যে ভাষার অবলুপ্তির আগে মানুষ একটু চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাটুকুও কি করা যেতে পারে না? কে জানে, একটু পরিষ্কার বাতাবরণের মধ্যে অচিরেই একটু সুস্থ বই আমাদের পাওনা হবে।

    জুলাই ৬, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জুলাই ২০০৮ | ৮০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন