এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • মাঙ্গুলি নাহাকের মৃত্যু

    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
    আলোচনা | বিবিধ | ১০ আগস্ট ২০০৬ | ১১৪৪ বার পঠিত
  • "গুজরাতে প্লেগের এবং ভূমিকম্পের সময় যেমন ওড়িয়া শ্রমিকরা দলে দলে পালিয়ে আসছিলেন, ঠিক সেই দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। গুজরাতের সুরাতে বিধ্বংসী বন্যার পর দলে দলে গঞ্জামবাসীরা ফিরে আসছেন। তাই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবকে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলেন। তবে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। ফলে যে যা ট্রেন পাচ্ছেন, সেই ট্রেনেই গাদাগাদি কোনো মতে ফিরছেন। প্রতিটি কামরায় গড়ে ৭০০ জন।
    এমনি ভাবেই ফেরার সময় ওখা-পুরী এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরার মধ্যেই গত পরশু মারা যান ১৮ বছরের মাঙ্গুলি নাহাক। সহযাত্রীরা বুঝতেই পারেন নি মাঙ্গুলি বসে বসে ভিড়ের চাপে দমবন্ধ হয়ে কখন মারা গেছেন। ব্রহ্মপুর স্টেশনেও তাঁকে অসুস্থ ভেবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা বলেন, মাঙ্গুলি ৩ ঘন্টা আগেই মারা যান।''
    - ২২শে আগস্টের আনন্দবাজার পত্রিকা

    অনেকেই হয় তো এই খবরটি পড়েন নি কারণ সেইদিন পত্রিকার পাতা ভীষণ জরুরী খবরে জমজমাট। যেমন-

    "সানাই শাহেনশা বিসমিল্লা খানের জীবনাবসান"
    "উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ বিল মঞ্জুর মন্ত্রিসভায়"
    "দুধপানের গুজব বন্ধে আসরে বুদ্ধ"
    "বেরিয়ে পড়ল বাইপাসের কঙ্কাল"

    অথবা

    "ভালই আছেন বসু"
    "হেয়ার থাকলে পাকিস্তান আর খেলবেই না"
    "হনুমানের জন্য শোকমিছিল"

    বা পড়লেও মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। এখন ভাবি ভারতীয় সরকারী বামপন্থার পিতামহ কি প্রফেটিক ছিলেন- "এ রকম হয়েই থাকে"। আমাদের এ সমস্ত ঘটনায় বিশেষ বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। জীবনে বিস্ময়বোধের অবকাশ কোথায়? যেখানে বলে প্লেন মেরে ট্রেড টাওয়ার উড়িয়ে দিল, সেইখানে গুজরাতে বন্যায় দিনমজুরদের দলে দলে পালিয়ে আসা তো জলভাত। আর ট্রেনে ভিড়? দশটা পাঁচের ব্যারাকপুরেই বলে আজকাল জায়গা পাওয়া যায় না! সেইখানে কোনো পাতি ট্রেনে আপৎকালীন অবস্থায় গাদাগাদি ভিড়ে এক দিনমজুরের পটল তোলা তো তুশ্চু মহায়! কেউ কেউ যদিও ভীষণ বিচলিত হয়ে চিঠি লেখার নৈতিক সদভ্যাস বজার রাখবেন। গণেশ দুধ খেলেও চিঠি লিখবেন, প্লুটোর খেতাব কেড়ে নিলেও চিঠি লিখবেন আর বাঘমুন্ডি কেস হলে তো কথাই নেই। নৈতিকতার পোয়াবারো! আজকাল আবার জরুরী বিষয়ে ফোনালাপ এবং স্টুডিও-আলাপের ব্যবস্থাও হয়েছে। তাই নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ভেবে দেখলাম- এই নিয়ে তিলকে তাল করার কোনো অর্থই নেই। যা হয়েছে মোটেও ভালো হয় নি, কিন্তু প্রতিক্রিয়ার প্রায়োরিটিও তো ঠিক করা চাই!

    এ তো গেল আমার মত মধ্যবিত্ত ঢ্যামনামির যথার্থতা। অন্যদিকে আছেন কেষ্টুবিষ্টুরা। মন্ত্রী, আমলা, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐদিকে গেলে আবার "প্রাসঙ্গিক আর্থ-সামাজিক সমস্যার অন্তর্নিহিত চরিত্র এবং তৎসংলগ্ন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সামাজিক ইতিহাস" - এই জাতীয় প্রশ্ন না উঠলে কল্‌কে পাওয়া যাবে না। তো লালুপ্রসাদ একে গরীবদের জন্য এ সি ট্রেনের ব্যবস্থা করছেন। আবার টিকিটের দাম না বাড়িয়েও ভারতীয় রেলওয়ের ১৩ হাজার কোটি টাকা লাভ হয়েছে। কম কথা! ওনাকে আমরা গোখাদ্য মামলার মত এ ক্ষেত্রেও বেনিফিট অফ ডাউট দিলাম। অন্যদিকে নবীন পট্টনায়ক মশাই তো আহ্লাদে ডগমগ। ছি: ছি:! মাঙ্গুলি মারা গেছে বলে নয়। লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্তল হাত ধরেছেন বলে। শুধু কি তাই! ওড়িষায় পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। আর এটাও ভুলে যাবেন না যে উনি কিন্তু লালুবাবুকে স্পেশাল ট্রেনের বন্দোবস্ত কারার অনুরোধ করেই রেখেছিলেন। গুজরাটগৌরব মোদীসাহেব সব ব্যাপারে কথা বলেন না। বিশেষত: অহিন্দু এবং অগুজরাটী হলে একেবারেই নয়। রাজনৈতিক নেতার এই রকম বাক্‌সংযম প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু এরা তো সবাই বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি রাজনৈতিক নেতা মশাই? সর্বঘটে ক্যাঁটালিকলা প্রতিবাদী বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কথা কইলেন না? তাঁদেরও প্রতিবাদের প্রায়োরিটি আছে মশাই। প্রতিবাদী আন্দোলনের ফোকাস আছে। সব কিছু নিয়ে কথা বললে কথার গুরুত্ব থাকে না। তবে একটু অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁদের কথা শুনে তাঁদের নিয়ে কথা বলব না বলেই ঠিক করলাম। বদমাইশ-জোচ্চোরদের নিয়ে পাতা ভরাতে পারি, কিন্তু ভীমরতিপ্রাপ্তদের নিয়ে নয়। অশোক মিত্র মহাশয়ের করুণ আক্ষেপ শুনলাম যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে এই সব বেসরকারী "দালালদের' হঠিয়ে সরকার নিজেই এই সব কাজকর্ম করে না কেন? যাঁরা এখনও "পরম করুণাময় সরকারই ভবের কান্ডারী" বলে খোয়াব দেখেন, বৃদ্ধাশ্রমে তাঁদের সুখের জীবন কাটুক এই প্রার্থনা করি। তবে বৃদ্ধাশ্রমটি পাবলিক সেক্টর হওয়া চাই বটে!

    এই সব পড়ে নিশ্চয় বুঝছেন যে এইরকম তুশ্চু বিষয় নিয়ে কিবোর্ড চালানোয় আপনার এবং আমার- উভয়েরই অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। তবে লিখতে গেলাম কেন? বুলবুলভাজায় বেশ একটা নিম্নবর্গের যন্ত্রণা ইত্যাদি গোছের লেখা লিখব বলে? নাকি সেই স্টাইল অনুসরণ করব বলে যেখানে অতি নগণ্য সংবাদের মধ্যে মহৎ লেখকেরা গরীব মানুষের স্বেদ-ক্লেদ-দু:খ-যন্ত্রণার ছবি খুঁজে পান? আজ যখন সাব-অল্টার্ন ব্যাপারস্যাপার বেশ জাতে উঠেছে, তখন গুছিয়ে এই টাইপের লেখা লিখতে পারলে দু চারটি হাততালি আর পিঠ চাপড়ানি সুনিশ্চিত। সত্যি বলতে কি, এই সব হাততালি পিঠ চাপড়ানি বেশ উপভোগ করি এবং এই লেখার পিছনে যে এই সব কিছু কাজ করছে না- এই রকম মিথ্যা কথাও বলব না। এবং এই খবর পড়ে আমার এক চিলতে বিবেকের দংশন হয় নি। বুকে এক ফোঁটা কান্নও জমে নি। কারুর অন্যায় অবিচারের উপর বিন্দুমাত্র রাগ হয় নি।

    তাহলে?

    বহুদিন বাদে খুব অবাক লাগল। কেন জানি না, একটা বিস্ময়বোধের জন্ম হল। হয় তো হবার ছিল না, বা অনেক আগেই হবার ছিল। আপনাদের সাথে সেই বিস্ময়বোধ ভাগ করে নেওয়ার তাগিদেই লেখা। এই বিস্ময় খুব অমূল্য তো! এসেছে যখন নষ্ট করি কেন? এই মাঙ্গুলি নাহাক ছেলেটি ভিড়ে বসে বসে দম বন্ধ হয়ে স্রেফ মরে গেল? একবার হাত পা নাড়াল না, একফোঁটা চিৎকার করল না, এক ফোঁটা গোঙানির শব্দও এল না? মরার আগে বা পরে এই শত শত লোকের একজনও লোকও জানল না যে তার গায়ের সাথে সেঁটে থাকা একটা আঠেরো বছরের ছেলে মরে যাচ্ছে বা মরে গেল? লোকে ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে এইভাবেই বুঝি মারা যায়? জীবনের খুঁটি আঁকড়ে ধরার জন্য একবারও নিজের শেষশক্তি দিয়ে হাত মুখ শরীর রক্তাক্ত করে না? যদি এই রক্তের বিনিময়ে সেই খুঁটিটা একবার ধরা যায়? নাকি স্রেফ মরে যায় যেন জীবন থেকে মৃত্যু একটা সীমলেস প্রক্রিয়া? আমি জানি না। কারণ এখন ভিড়ে যাতায়াত করতে খুব কষ্ট হয়। তাই ভিড়ে যাতায়াত করি না। আর আমার আশেপাশে কেউ এইভাবে মারা যায় নি। হঠৎ মরে গেছে হয় তো! কিন্তু শত লোকের মধ্যে একদম অজান্তে ভিড়ের চাপে টুঁ শব্দ না করে কেউ মারা যায় নি।

    এ রকমই কি হয়ে থাকে? আপনারা জানেন?

    নাকি উত্তরাধুনিক মতে পোলিটিকাল সোসাইটির লোকেরা এইভাবে মরে যেতেই পছন্দ করে? এটাই তাঁদের শ্রেণীচরিত্র? তবে সেক্ষেত্রেও তো ইহাই সত্য- "এ রকম হয়েই থাকে।"

    কি প্রফেটিক!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১০ আগস্ট ২০০৬ | ১১৪৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    জুবিন  - Rajat Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন