এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • কাদম্বিনী ও অন্যরা

    Sutapa Sen লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১০ জুলাই ২০২০ | ২২০৫ বার পঠিত
  • কখনও পুষ্পবৃষ্টি, আবার কখনও তাদের আবাসনে ঢুকতে না দেওয়া। অতিমারিতে চিকিৎসকদের এমন অবস্থা নিশ্চয় অনেককেই ব্যথিত করে তুলছে। তবে এই লেখাটি লিখছি একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। বাঙ্গালোরের এক চিকিৎসক বন্ধু জানালেন বহু পরিবারে বা আবাসনে বা বাড়িওয়ালার কাছে মহিলা চিকিৎসকরা আরও অচ্ছুৎ এই অতিমারির দিনে। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অতিমারি কেন; আজও চিকিৎসা করাতে এসে অনেকেই পুরুষ ডাক্তারের খোঁজ করেন, বিশেষত শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে। আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য কোনোদিন যাবে না বোধহয়। তাঁর কথা শুনে আমার মনে পড়ে যায় বাঙালির চিকিৎসা জগতে মেয়েদের প্রবেশের কথা। কত লড়াই, কত প্রতিকূলতা পার হওয়ার সেই যন্ত্রণা আজও শেষ হয়নি। একটু পিছন ফিরে দেখি আমাদের পার হয়ে আসা পথের দিকে।

    উনিশ শতকে বাঙালি সমাজে ব্রাহ্মরা আগ্রহী হলেন মেয়েদের জন্য চিকিৎসার দরজা খুলতে। যুক্তি দেখানো হয়েছিল পর্দানশীন মেয়েদের রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনে মহিলা চিকিৎসক তৈরি করা জরুরী। সময়কালটা ঔপনিবেশিকতার যুগ। শাসক কিন্তু তার নিজের দেশে মেয়েদের জন্য চিকিৎসার দরজা খুলে দিতে বহু দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে, নানা তর্ক বিতর্কের পথ পেরিয়েছে। সেখানে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে উনিশ শতকের ষাটের দশক পার হয়ে গেছে মেয়েদের চিকিৎসাবিদ্যা পঠনের জগতে আসতে। অথচ ভারতে মেয়েদের শিক্ষার অভাবকে ভারতীয় সভ্যতার অনগ্রসরতার চিহ্ন হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষে যুক্তি সাজানো বেশ সহজ ছিল ব্রিটিশ শাসকের কাছে। শাসকের আধুনিকতা প্রমাণের দায় অনেকটা ছিল বৈকি উপনিবেশে মেয়েদের জন্য চিকিৎসা জগতের দরজা খোলার জন্যে। দেশীয় বাঙালি সমাজও নতুন দিনের আলোতে উদ্যোগী হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের দরজা মেয়েদের জন্যে খুলে দিতে। আর যে কথাটা অনেকেই ভুলে যায় তা হল নতুনের প্রতি, শিক্ষার প্রতি মেয়েদের আগ্রহ- যেটা ছাড়া সম্ভব হত না স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন।

    চিকিৎসা বা রোগীর শুশ্রূষার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বাড়ির মহিলারাই প্রাথমিক চিকিৎসার কাজটি সারতেন। বাড়াবাড়ি হলে তবেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া হতো। কলকাতায় উনিশ শতকের চিকিৎসার ইতিহাসে পাওয়া যায় যদুর মায়ের কথা যিনি তিরিশের দশকে খ্যাত ছিলেন তাঁর অধীত বিদ্যার জন্যে। সংবাদ প্রভাকরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখায় যদুর মায়ের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার জগতে প্রবেশ নিয়ে তৈরি হল নানা দ্বন্দ্ব। শরীর- বলা ভালো মেয়েদের শরীর চিকিৎসা বা শুশ্রূষার ক্ষেত্রে ছিল অবহেলার বস্তু। মেয়েদের স্বাস্থ্য- সে আবার একটা বিষয় নাকি। রক্ষণশীল সমাজের এই ছিল অভিমত। নববিভাবরী সাধারণীর মত সংবাদপত্র বলেছিল- মহিলা চিকিৎসকের অভাবে মেয়েরা মরে যায় নি।

    তবুও বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলতেই থাকে। সত্তরের দশকে শুরু হয় জোরদার প্রয়াস। আরও একটি দশক লাগে সাফল্য আসতে। উনিশ শতকের ষাটের দশকে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগের অভাব নিয়ে শুধু নয়, ব্রাহ্মসমাজের ভিতরে ও বাইরে মেয়েদের শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে চলতে থাকে বিতর্ক। কলকাতা সমাজের মান্যগন্য বাবু নীলকমল মিত্র দৌহিত্রী বিরাজমোহিনীকে মেডিক্যাল পড়াবার জন্য সরকারের কাছে আর্জি জানান। তবে তাঁর আবেদনপত্রে তিনি এও জানিয়ে দেন যে রোজ ক্লাসে আসতে পারবেনা বিরাজমোহিনী, যেদিন আসবে সেদিন পর্দার ঘেরাটোপে ক্লাস করবে আর প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে অর্থাৎ শবব্যবচ্ছেদের সময় সঙ্গে থাকবে তার স্বামী বা পিতামহ স্বয়ং। শেষ অব্দি পড়া হয়ে ওঠেনি বিরাজমোহিনীর। মেয়েদের মেডিক্যাল পড়ার ইচ্ছে নিয়ে কিছু কিছু সংবাদপত্রেও দেখা যায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। মেয়েরা কোন কথা গোপন রাখতে পারে না, তাই ডাক্তারি পড়ার অনুমতি দেওয়া উচিত নয় ইত্যাদি সব। তবুও নানা ঝঞ্ঝা পার হয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী হিসেবে যোগ দিলেন ব্রজকিশোর বসুর কন্যা ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বরী। তবে নানা বাধা এসেছিল তাঁর স্নাতক হওয়ার পথে। তবুও ১৮৮৭ র সমাবর্তনে গভর্নর জেনারেল ভূয়সী প্রশংসা তাঁর ছাত্রী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার সাক্ষ্য দেয়। শুধু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ নয় , আশির দশকের শেষ থেকে ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলেও ছাত্রী নেওয়া হতে থাকে। কিন্তু মেয়েরা পাস করে বেরোবার পর কেমনভাবে গ্রহণীয় হচ্ছে সমাজের কাছে তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় সমাজের বৃহত্তর অংশের মহিলা চিকিৎসকদের প্রতি মনোভাব। যতই গভর্নর জেনারেল প্রশংসায় ভরিয়ে দিন, পুরুষ আধিপত্যের পেশাদারী দুনিয়াটা যে মেয়েদের জায়গা ছেড়ে দেবে না সেটা বুঝেছিলেন কাদম্বরী। তাই নিয়ে এসেছিলেন এডিনবরা থেকে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি, কাগজে দিয়েছিলেন নিজের চেম্বারের বিজ্ঞাপন। চিকিৎসক হিসেবে অপমানের মুখোমুখি হওয়া তো ছিলই। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তাঁকে স্বৈরিণী আখ্যা দিতেও দুবার ভাবেনি। তিনি নিজে প্রতিবাদী ছিলেন, সঙ্গে পেয়েছিলেন ব্রাহ্ম ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ স্বামীকে। তবে সব মেয়ে এমনভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন নি। অনেকে চাকরিও ছেড়েছিলেন। ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাস করা প্রমীলা রায় মালদা ইংলিশ বাজার হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন। স্থানীয় এক জমিদার রাত্রিবেলা স্ত্রীর অসুস্থতার অজুহাতে তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে কদর্য ব্যবহার করেন। সুবিচার না পেয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। পাবনাতে মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে বহু পাল্কীওয়ালা অনেকসময় সহৃদয় ব্যবহার করতেন না। তাঁকে সম্বোধন করা হতো দাই বলে। রোগী দেখতে যাওয়ার জন্যে সবসময় জুটতো না পাল্কী। এর সঙ্গে ছিল পুরুষ সহকর্মীদের অবজ্ঞা। মেয়েরা একই সংখ্যায় রোগী দেখে, তাদের সারিয়ে তুলেও চিকিৎসক হওয়ার অনুপযুক্ত বলে উপহাসের শিকার হতো। সবচাইতে সমস্যা ছিল শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে। মেয়েরা পারেনা এই অজুহাতে সিভিল সার্জেনরা পর্দা হাসপাতালেও অপারেশন করতেন আর বার্ষিক প্রতিবেদনে মেয়েদের ভারী অপারেশনের ক্ষেত্রে অপারগতার জন্যে পর্দা মানা যাচ্ছে না বলে মহিলা চিকিৎসকদের দোষারোপ করতেন।

    ছবিটা বদলে গেছে অনেক এই একুশ শতকে। তবে সবটা বদলেছে কি? আমার বন্ধু দুঃখ করে বলেন একসঙ্গে লাঞ্চ করতে বসলে পুরুষ চিকিৎসকেরা অনেক সময় মজা করে বলেন, মুখ খারাপ করব। তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠো এখান থেকে। কিম্বা তোমাদের আর চিন্তা কি। স্বামী সারাদিন মুখের রক্ত তুলে রোগী দেখছে। তোমাদের তো শখের ডাক্তারি। বেশীরভাগ রোগী খোঁজ করে ডঃ মিঃ অমুককে। ডঃ মিসেস অমুকের অপরে এখনও ঠিক ভরসাটা আসেনা যেন। পয়লা জুলাই চিকিৎসক দিবসে পত্রপত্রিকায় চিকিৎসকদের বাণীর মধ্যে মহিলা কণ্ঠের উচ্চারণ খুঁজে পাওয়াই ভার। আজও মহিলা ডাক্তার মানেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা শিশুচিকিৎসক হিসেবে তাকে দেখাটাই যেন প্রত্যাশিত। সেখানেও কি মেয়েদের সফল হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার প্রক্রিয়াটা সহজ?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১০ জুলাই ২০২০ | ২২০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন