আমার বাবা গুরুতর দীর্ঘস্থায়ী কিডনির অসুখে (CKD) আক্রান্ত। সোজা কথায় বললে বাবার দু'টো কিডনিই খারাপ। গত ৫ ই মে ILS হাসপাতাল থেকে ওখানে ডায়ালিসিস হওয়া সব রোগীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়। গত ৬ ই মে জানা যায় আমার বাবা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। সত্যি বলছি সব থেমে গেছিলো সেদিন। চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখিনি। যখন আমার বাবা কে স্বাস্থ্য দপ্তরের বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যায় আর বাবা আমার হাতটা ছেড়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন, আমি ভাবিনি আর কোনোদিন বাবাকে দেখতে পাবো। বাবার যে আগে থেকেই কিডনি ফেইলিওরের মতো এক দুরারোগ্য অসুখ। কী করে জয় করবে আমার সত্তর বছরের বাবা এই মহামারীকে?
উত্তরটা জানা ছিল না তখন। রোজ শুনছিলাম এক এক করে ডায়ালিসিসের রোগীরারা ভেন্টিলেশনে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে আমি আর আমার মাও গৃহবন্দী। আমাদের দু'জনকেও আলাদা থাকতে বলা হয়। একে অপরকে যে সাহস দেব তাও সম্ভব হচ্ছিলনা। এরই মধ্যে এক প্রতিবেশীর ব্যাবহারে খুব কষ্ট পাই। ভগবানে বিশ্বাস আর ছিল না আমার। সবসময় মনে হতো - আমরাই কেন?
জীবনটা একদিনে পুরো ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। হাজারটা ফোন আসত রোজ। ভাল লাগতনা এক কথা সবাইকে বলতে। থানা, মিউনিসিপালিটি, স্বাস্থ্য দপ্তর - এই ফোনগুলো ধরতেই হত। তবে সারাদিন একটাই ফোনের অপেক্ষা করতাম,বাবার! যখনই কথা হত বলত "অনেক অসুবিধা ঠিকই এখানে কিন্তু আমি ঠিক সামলে নেব"। অবাক লাগত খুব। মনে হত কত মনের জোর আমার বাবার। বাবার বুকে ডায়ালিসিসের চ্যানেল, তাই স্নানটুকুও নিজে করতে পারেনা। আমি আর মা সারদিন ভাবতাম কি করে পারছে বাবা? ওখানে তো বাবাকে ছোঁওয়াও বারণ৷ আমি আর মা রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি। কিডনি-এর সমস্যার কারনে বাবার ৮০% সবজি ও ফল খাওয়া বারণ। এমন অনেক দিন গেছে হাসপাতালে শুধু ওই সবজিই রান্না হয়েছে,ঔ ফলই দেওয়া হয়েছে। সেদিন বাবার আর পেট ভরে খাওয়া হয়নি। সেই শুনে আমি আর মাও খেতে পারিনি। একদিন ফল পাঠানোর চেষ্টা করি কিন্তুু সিভিক ভলেন্টিয়াররা বারণ করে। এদিকে হাসপাতালকেই বা দোষ দিই কি করে? এত রোগী। চরম খারাপ পরিস্হিতি, এই অবস্হায় কিডনির রোগীদের আলাদা যত্ন নেওয়া হয়তো সত্যিই সম্ভব নয়। ডাক্তারের সাথে কথা বলার কোনও উপায়ও ছিলনা। কিন্তু আমরাই বা কী করব? খুব কাছের মানুষটার এত কষ্টে তার কাছে না যেতে পারার চেয়ে অসহায়তা কি কিছু হয়? হয়না বোধ হয়।
বাবার একের পর এক পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ আসতে থাকে। মা খুব ভেঙে পড়েন। একটাই আশা ছিল, আমাদের-বাবার কোভিডের কোনো উপসর্গ ছিলনা। এবং বাবা মানসিকভাবে একটুও ভেঙে পড়েনি। এই পঁচিশ দিন কিভাবে কাটে তা আমি লিখে বোঝাতে পারবনা।
হঠাৎ এক দিন বাবা জানায় বাবার নতুন রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। বাবা বলল "মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসব"। আরও একবার আমার মনে হল স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু এবার দারুণ একটা স্বপ্ন।
পঁচিশ দিন পর আমার বাবা বাড়ি ফিরলেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আমায় দেখেই বললেন "কিরে? মিষ্টি রেখেছিস আমার জন্য?" কেদে ফেলেছিলাম বাবাকে দেখে। এ তো বিশাল এক যুদ্ধ জয়। কিডনি ফেইলিওর এবং করোনা নিয়ে বেঁচে ফেরা, কোনো মিরাকলের চেয়ে কম কি?
যুদ্ধটা জিতিনি হয়তো এখনও। আবার বাবাকে যেতে হচ্ছে ডায়ালিসিসে। আর ১০০% নিরাপত্তার অঙ্গীকারপত্র তো এখন স্বয়ং ঈশ্বরও দিতে পারবেননা। তবে হ্যাঁ, এবার আর এই অধ্যায়টা পুরোপুরি সিলেবাসের বাইরে হবেনা।
ছোট থেকেই পড়ছি "মানুষ সমাজবদ্ধ জীব"। তবে এই "সমাজ" শব্দের আক্ষরিক অর্থ আমি এই পঁচিশ দিনে বুঝেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম লড়াইটা আমাদের একার। ভুল ভেঙে যায়, যখন দেখি কত মানুষ আমার বাবার জন্য প্রার্থনা করছে। অনেককে তো আমি চিনতামও না।
সবার প্রথমে ধন্যবাদ জানাব সেই সকল ডাক্তারবাবুদের, যারা বাবাকে সুস্হ করে তুলেছেন। বাবার কাছে শুনলাম অনেক নার্স দিদি দু'মাস বাড়ি যেতে পারেননি। নিজের পরিবারকে এক ঝলক না দেখে যারা দীর্ঘদিন ধরে আমার বাবার মত রোগীদের সেবা করছেন তাদের কুর্নিশ জানাই। আমাদের কাউন্সিলর স্যার এবং তার পুরো টিমকে অনেক ধন্যবাদ নিয়মিত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌছোনো ও পাড়া স্যানিটাইজ করার জন্য। সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ সেই সকল পরিবারকে যারা আমাদের জন্য একুশ দিন স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন। অনেকের অনেক অসুবিধা হয়েছে জানি, তবু সবাই সহমর্মিতা দেখিয়ে আমাদের পাশে ছিলেন ও নিয়মিত বাবার খোজ নিয়েছেন।
আমার বস এবং সহকর্মীরা এভাবে আমার পাশে না থাকলে লড়াইটা খুব কঠিন হত৷ আমার পরম সোভাগ্য যে এরকম অফিস পেয়েছি। এছাড়া আমাদের সকল আত্মীয়, মায়ের সহকর্মীরা, আমার স্কুলের বন্ধুরা, মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির শুভাকাঙ্ক্ষীরা, আমার আগের অফিসের সহকর্মীরা, আমার শিক্ষক-শিক্ষিকারা, কলেজের বন্ধুরা, যারা যারা পাশে থেকেছো তাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
কাছের বন্ধুদের আমি 'ধন্যবাদ' বলিনা। কেউ নিজের পরোয়া না করে হাস্পাতালে বাবাকে ফল পৌছে দিতে গেছে তো কেউ আমাদের ফ্ল্যাট unsealed হওয়ার দিনই এসে বাড়ির নিচে মাংস পৌছে দিয়ে বলেছে " তুই আর কাকিমা খাস ,তোদের এখন প্রোটিন দরকার"। 'ধন্যবাদ' টা বড় কম হয়ে যাবে।
তাহলে? এতগুলো মানুষ মিলে আমাদের জেতালো তো। কৃতিত্বটা একা কি করে নিই বলুন তো?
যারা আগামী দিনে আমার মত অবস্থায় পড়বে তাদের বলি ,সবসময় শক্ত থাকার উপদেশ আমি কখনও দেবনা। মানুুষ শক্ত হয়েই যায় যখন আর কোনো বিকল্প থাকেনা। সব অনুভূতি প্রকাশ কোরো। যখন কান্না পাবে কেঁদে নিও৷ এতে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ে বৈ কমেনা।
বাবার এখনও ডায়ালিসিস চলছে আগের মতোই। করোনাকে টেক্কা দেওয়ার লড়াই ও চলছে। দু'বার পরীক্ষা করানো হয়েছে এবং দু'বার ই রিপোর্ট নেগেটিভ এসছে। ফলে ডায়ালিসিস করাতে বিশেষ কোনও অসুবিধা হয়নি৷ খাওয়া দাওয়ায় যেগুলো বারণ ছিল তাও আগের মতই রয়েছে। শুধু মনের জোরটা অনেক বেড়ে গেছে।
সবশেষে একটা ছোট্ট গল্প বলি। আমার বাবা মার বেশি বয়সে বিয়ে হয়। বাবার সব চুল পাকা দেখে ছোটো থেকেই অনেকে আমার বাবাকে দাদু বলে আমায় খ্যাপাত। ছোট্ট আমি তখন লজ্জা পেতাম, বাবাকে বলতাম চুলে রং করতে। বাবা আমায় বলতেন যা প্রাকৃতিক তাই সুন্দর, আর চুলের রঙে কিছু যায় আসেনা। মনের শক্তিটাই আসল।
তুমি ঠিক ছিলে বাবা, তোমার সব চুল পেকে গেলেও লড়াই করার শক্তিটা একই আছে। তাই তুমি কিডনি খারাপ নিয়েও করোনাকে ক্লিন বোল্ড করে দিলে |
তুমি 'চ্যাম্পিয়ন'!
তোমার বাবা কেন, আমরাই যেন যুদ্ধ জয় করে এসেছি। তিনি সুস্থ থাকুন। হ্যা, তিনি প্রায় আমার বয়স। আমিও চুলে রং করিনি। দাদুর মতো বাবা। মঙ্গল হোক তোমার ও আর সকলের।
খুব ভালো লাগল পড়ে। আপনার বাবা ও আপনারা সবাই ভালো ্থাকুন।
আমার বাবার COPD তার সঙ্গে হার্টের সমস্যা এবং পেসমেকার বসানো। চারপাশে করোনাক্রান্ত প্রতিবেশী। অ্যাসিম্পটম্যাটিক কতজানি না। অফিস যেতে বাধ্য। অদ্ভুত আতংক পিছু ধাওয়া করছে সারাক্ষন। তার মধ্যে এই লেখাটা ....ভীষণ একটা শক্তি যোগালো ...!
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো ..... আগামীতে অনেকের প্রেরণা।
পড়ে খুব ভালো লাগলো। আপনারা সবাই ভালো থাকুন।
পড়ে খুব ভালো লাগলো। আপনারা সবাই ভালো থাকুন।
মনে জোর পেলাম তোমার কথা শুনে ।ভালো থেকো ।
ডাক্তারবাবু ও নার্সদের চিকিৎসা ও সেবায় সাথে নিজের মনের জোরে আপনার বাবা সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। ওনাদের সবাইকে কুর্ণিশ জানাই। আর এই সংকটের সময় যারা আপনাদের পাশে ছিলেন তাঁদেরও কুর্ণিশ।
সুন্দর! ভালো থাকুন!
আপনার বাবা দীর্ঘ জীবি হক