দেশে লকডাউন এর এখন চতুর্থ পর্যায়। সাধারণ মানুষ, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকরা, অশেষ ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হলেও লকডাউনে আশাতীত সহযোগিতা করে চলেছেন। কোভিড সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুসংখ্যা যদিও ঊর্ধ্বমুখী, তবুও সাধারন মানুষের লকডাউনের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতাই এই ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে করোনাকে এখনো মাত্রাছাড়া আকার নিতে দেয়নি।
কিন্তু আর কত দিন? লক ডাউনতো আর চিরটা কাল চলতে পারে না, কাজকর্মও থেমে থাকতে পারেনা অনির্দিষ্টকাল। তাই প্রশ্ন একটাই, মানুষের এই অপরিসীম কষ্টযন্ত্রণাভোগের পাশাপাশি সরকারের যতটুকু কর্তব্য ছিল তা কি করা হচ্ছে? লকডাউন আমাদেরকে এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে সাময়িকভাবে একটা সামাজিক সুরক্ষা দিচ্ছে বটে, কিন্তু দেশে কোভিড-১৯ অতিমারি প্রতিরোধে এবং সম্ভাব্য মহামারি ঠেকাতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু এখনও সংক্রমণ নির্ণায়ক পরীক্ষা বা টেস্টিং-এর । নির্দিষ্ট ওষুধ এবং প্রতিষেধক না থাকায়, ইতিমধ্যেই দেখা গেছে দক্ষিণ কোরিয়া বা জার্মানির মত দেশ কিভাবে স্রেফ বেশি সংখ্যায় টেস্ট এর মাধ্যমে সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের টেস্টিং এর হার অনেকটাই কম।
কম টেস্টিং-এর পেছনে মৌলিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যখাতে কম খরেচ (জিডিপির মাত্র এক শতাংশ বা তারও কম), দুর্বল রোগ নজরদারি ব্যবস্থা, প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব, উপযুক্ত পরীক্ষাগারের অমিল, এরকম অনেক কিছুই দায়ী। তবে এটাও বলা প্রয়োজন যে মিডিয়া থেকে সোশাল মিডিয়া সবেতেই যেভাবে গড় টেস্টিং কভারেজ (প্রতি মিলিয়নে বা হাজার জনে টেস্টিং এর খতিয়ান) নিয়ে হাহাকার উঠছে তা আসলে বাজার-অর্থনীতির চাহিদা, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের আভিধান বহির্ভূত। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে যুক্তিসঙ্গত টেস্টিং এখনও পর্যন্ত ভারতের কাছে করোনা মোকাবিলার প্রধান কৌশল। ভারতের মত বিপুল জনসংখ্যার দেশে সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যযুক্তি মাস-টেস্টিংকে সমর্থন করেনা বরং পপুলেশনের রিস্ক বিশ্লেষণ করে টেস্টিং রেশনিং নির্ধারণ করে। যেমন ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরুর দিকে দিল্লির তুলনায় কলকাতার মানুষ অনেকটাই কম রিস্ক জোনে ছিল। আবার কলকাতার তুলনায় গুয়াহাটির মানুষ ছিল আরও কম রিস্ক জোনে, কারন সমগ্র বিশ্ব তথা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ গুয়াহাটির মানুষের কলকাতা বা দিল্লির তুলনায় অনেকটাই কম। পরিস্থিতি অবশ্য অনেকটাই পাল্টেছে ইতিমধ্যে। দেশের বিভিন্ন জেলা এখন লাল, কমলা, সবুজ zone এ বিভক্ত । হটস্পট বা হাই রিস্ক zone এ ইনফ্লুয়েঞ্জার রোগলক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকেও পরীক্ষার নির্দেশ এসেছে। rt-pcr পরীক্ষার পাশাপাশি rapid antibody টেস্টিং নিয়েও চলছে আলোচনা। সহজ কথায়, যতদিন না রোগের ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে, টেস্টিং এখনও কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র।এখন দেখার বিষয় যুক্তিসঙ্গত টেস্টিং কি দেশে আদৌ হচ্ছে।
যুক্তিসঙ্গত টেস্টিং-এর নিরিখে মহামারীর বিভিন্ন পর্যায়ে টেস্টিং যথাযথ সংখ্যায় হচ্ছে কিনা তা নির্ধারণে টেস্টিং কভারেজ খুব নির্ভরযোগ্য সূচক নয় কারণ সংক্রমণের হার বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই টেস্টের সংখ্যাও বাড়বে।বরং প্রতি পজিটিভ কেস নির্ণয়ের জন্য সর্বমোট কত জন বা কত স্যাম্পল পরীক্ষা হচ্ছে, তা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ। ভিয়েতনামে যেখানে প্রতি পজিটিভ কেস পিছু ৯০০’র (৯ই মে)বেশি টেস্ট করা হয়েছে ভারতে সে সংখ্যাটা মাত্র ২১.৮ (২৫শে মে, ২০২০)। এই সূচকমাত্রা কম হওয়ার অর্থ আমাদের দেশে টেস্ট এর ব্যাপ্তি অনেকটাই সীমিত। অর্থাৎ টেস্টিং–এর আওতায় সাধারণত প্রকট রোগলক্ষণযুক্ত ব্যক্তিরাই বেশি পরীক্ষিত হচ্ছেন, কিন্তু যাদের উপসর্গ কম বা নেই, অথচ সংক্রমিত হয়েছেন, তারা ততটা হচ্ছেন না। অথচ সংক্রমিত হয়েও যারা ধরা পরছেন না তারাই আসলে গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়ানোর পিছনে গুরুত্ত্বপূর্ণ। ফলত এদেরকে যথাযথভাবে চিন্হিত না করা গেলে লক ডাউন উঠলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণবৃদ্ধির আশংকা থেকেই যাচ্ছে।
টেস্টিং এর ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পার্থক্যও লক্ষনীয়। ২৫শে মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যেখানে মহারাষ্ট্রে টেস্ট ৩,৭৯,১৮৫, কেরালায় ৬৩,০০৯, পশ্চিমবঙ্গে সেই সংখ্যাটা ২০শে এপ্রিল অব্দি ছিল ৫৪৬৯ আর মে মাসের ২৫ তারিখে ১,৪৮,০৪৯। বিগত প্রায় এক মাসে পশ্চিমবঙ্গে টেস্টের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। প্রতি পজিটিভ কেস পিছু টেস্টের সংখ্যা এই মুহূর্তে চল্লিশের (৩৮.৮) কাছাকাছি। ১০ই এপ্রিল নাগাদ এই সংখ্যাটাই ছিল ১৮। তুলনায় কেরলে ১০ই এপ্রিল নাগাদ এই সংখ্যাটা ছিল ৩৬.৭ আর ২৫শে মে’র হিসাব অনুযায়ী, ৭০.২, দুক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দ্বিগুন। অর্থাৎ শুরু থেকেই পজিটিভ কেস পিছু বেশিমাত্রায় সন্দেহভাজন ব্যক্তির টেস্ট করে কেরলে যেখানে কোভিড প্রায় নিয়ন্ত্রণে, সেখানে এই রাজ্যে কম রোগলক্ষণযুক্ত বা উপসর্গহীন অথচ সংক্রমিত এমন অনেক মানুষ এখনও অধরা থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে টেস্টিং কিট এর সরবরাহ, মজুত এবং তার ব্যবহার নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক চাপান উতর সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সর্বজন বিদিত। কে ঠিক – কে ভুল তা ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তু অতিমারির কোপে যেখানে মানুষের জীবন-জীবিকা সংশয়ে সেখানে সব-পক্ষেরই আরেকটু দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। মনে রাখতে হবে কোভিড-১৯ কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন মরশুমি সংক্রামক রোগ নয় (এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় যা পাওয়া গেছে), তাই টেস্ট না করলে রুগি শনাক্ত করা মুশকিল এবং গোষ্ঠী সংক্রমণ ঠেকানো এবং মৃত্যুহার কমানো আরও মুশকিল। আশংকা পশ্চিমবঙ্গ সমেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যেই গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। সরকারী ঘোষণা না থাকলেও হটস্পট বা হাই রিস্ক জোন এর জন্য ICMR এর নির্দেশিকা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে টেস্টিং পদ্ধতিরও পরিবর্ধন প্রয়োজন। একদিকে যেমন বর্তমানে ব্যবহৃত rt-pcr টেস্টিং যথাযথ ভাবে করতে কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি চিন্তিত হটস্পট বা কন্টেনমেন্ট জোনে rapid serological টেস্টিং (IgM antibody) কেবলমাত্র কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরতেই সাহায্য করবে না, IgG antibody টেস্ট হটস্পট এলাকায় মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধী antibodyর উপস্থিতি পরীক্ষা করে লকডাউন তুলতেও দিশা দেখাবে।
কিন্তু মাথায় রাখতে হবে ঘোষিত হটস্পটগুলি ছাড়াও নতুন যে সমস্ত হটস্পট তৈরী হচ্ছে বা হবার সম্ভাবনা আছে সেগুলিও দ্রুত চিন্তিত করতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। হটস্পটের বাইরে যেসমস্ত সন্দেহজনক রোগলক্ষণ যুক্ত ব্যক্তি চিকিত্সাকেন্দ্রে আসছেন তাদেরও টেস্ট হওয়া আবশ্যক। Rapid টেস্টিং কিট স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রান্তিকতম শাখাতেও পৌছনোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং টেস্টিং আর syndromic approach (রোগলক্ষণের ভিত্তিতে রোগনির্ধারণ) এর যৌথ প্রয়োগে peripheral স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় সংক্রমণের প্রাথমিক শনাক্তকরণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আগেই চিন্হিত করে অন্যান্য নির্ণায়ক টেস্ট (rt-pcr) এবং চিকিত্সার ব্যবস্থা করা গেলে রোগীকে বিভিন্ন চিকিত্সা কেন্দ্র ঘুরতেও হবে না এবং তার থেকে অন্যান্যদের, বিশেষত স্বাস্থ্য-কর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমবে। ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই আশঙ্কার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
টেস্টিং নিয়ে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একথা বলতেই হচ্ছে যে জনস্বাস্থ্যের এই লড়াইতে অতিমারি রোধে তৈরি বিভিন্ন আমলা-চিকিৎসক সমৃদ্ধ কমিটিগুলোর জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধে অনভিজ্ঞতা তাদের দৈনন্দিন কাজের পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় বার বার টের পাওয়া যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য দেশে সব রাজ্যই অতিমারি রোধে সমানভাবে সফল হবে না। সেক্ষেত্রে কোন রাজ্য এখনকার মত কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল হলেও পরে পিছিয়ে পড়া রাজ্যের জন্য তার আবার সংক্রমণের আশংকা থেকেই যাবে। একমাত্র সঠিক মাত্রায় যুক্তিযুক্ত টেস্টিং-ই পারে সব রাজ্য গুলোকে তাড়াতাড়ি সংক্রমণ মুক্ত করতে। তাই টেস্টিং নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার শুধু গাইড লাইন নয়, জাতীয় পরীক্ষণ নীতি প্রনয়ণ করুক। জরুরি এই পর্যায়ে যা মানতে সমস্ত রাজ্য বাধ্য থাকবে এবং তা কার্যকর করতে কেন্দ্র সমস্তরকম সহযোগিতা করবে। অতিমারীকে অতিক্রম করতে এ পরীক্ষা তাই কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারেরও।
টেস্টিং এর কৌশলী এবং সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি ভুললে চলবে না সাধারণ মানুষের সাহায্য ছাড়া কিন্তু এ যুদ্ধ জেতা মুশকিল। চীন এর করোনা যুদ্ধের এই দিকটা তুলনায় স্বল্প আলোচিত। সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই চিনে নাগরিকদের পারস্পরিক সহায্য এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রতিবেশী কমিটি (juweihui) গুলি সক্রিয়। করোনা মোকাবিলায় উহানে এই কমিটির সদস্যেরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকের তাপমাত্রা মাপা, বয়স্কদের খাবার, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়া, জনে জনে সরকারী স্বাস্থ্যবিধির প্রচার করা ইত্যাদি নানান কাজে স্বেচ্ছায় নিযুক্ত হয়েছেন। পাড়া বা ক্লাব কালচার আমাদের রাজ্যেও কিছু কম নেই, এবং এদের অনেকেই এই সংকটকালে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। আরো একটু পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের মধ্যে থেকে ওয়ার্ড ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবকদের টিম তৈরী করা যায়। এলাকাতে সন্দেহজনক কেস খুঁজতে, স্থানীয় সংক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে কিনা তা জরুরি ভিত্তিতে জানতে বা বিপদের দিনে একে অপরের পাশে দাড়াতে এরা একটা বড় ভরসা হতে পারেন। এভাবেই করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও সমাজের পাশে দাড়ানো সম্ভব। তবেই হয়ত এই পরীক্ষায় আমরা সসম্মানে উত্তীর্ণ হব।
ভালো লিখেছেন।