লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, স্টে হোম স্টে সেফ, গত মাস দুয়েক ধরেই শব্দগুলো কানে বেজে চলেছে। আমরা বাড়িতে থাকছি, আমরা খাচ্ছি, আমরা খেলছি, আমরা ছবি দিচ্ছি আমরা সবকিছু করছি। এক ঘোষিত অবসর যাপন করছি। ওদিকে চাল ফুরিয়েছে রতন দাসের। যাও বা রেশন থেকে চাল,ডাল তেল নুন পাওয়া গিয়েছিল ফ্রি তে কিন্তু শুধু তাতেই তো রান্না হয় না। গ্যাস আছে, স্টোভ আছে, আনুষঙ্গিক আছে তরিতরকারি। রতন দাস রিক্সা চালায়। রতন দাসদের কোনো হোম কোয়ারেন্টাইন নেই, রতন দাসদের কোনো লকডাউন নেই। রিলিফ ফাণ্ড তৈরি হয়েছে রাজ্যে কেন্দ্রে। তৈরি হয়েছে বিশেষ পিএম কেয়ার ফান্ড। যার কোনো অডিট হবে না। এদিকে কেন্দ্রীয় ভান্ডারে মজুত ৭ কোটি টন অব্যবহৃত খাদ্য শস্য। সরকারের তানাশাহী আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু গত ১০ বছর যেনো সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে। সরকার তো সরকার, আধা সরকার, এমনকী সরকারের আওতায় থাকা বড়ো, মেজো, সেজো ছোটো সরকাররাও সরকারের ছেয়ে একধাপ এগিয়ে গিয়েছে।
রতন দাস (নাম পরিবর্তিত) এর কথা লিখেছিলাম শুরুতেই। কেনো লিখেছিলাম? রতন দাস একজন রিক্সা চালক। পাড়ার মধ্যেই ভাড়া খাটছে সে। এই দূর্যোগে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সময় বেঁধে দিয়েছে। এত সময় থেকে এত সময় পর্যন্ত রিক্সা চালানো যাবে। কিন্তু প্রশাসনের উপরেও আরো এক প্রশাসন আছে, তারা প্রশাসনের বাড়া। এদের কোনো বাঁধা পদ নেই। কয়েকদিন আগে শাশ্বতী লিখেছিল এদের কথা। মতিঝিলের ‘মোর’ বলে যে দোকানটা আছে সেটা থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে নাগেরবাজারে উর্দিহীন সিভিক পুলিশ তাদের রিক্সা আটকায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিক্সা চালানোতেও। থানায় আটকে রাখে, রিক্সাওয়ালার উক্তি ছিল ওরা টাকা খায়। আজ চাক্ষুষ করলাম। এই মুহূর্তে যখন এই অসংগঠিত শ্রমিকদের হাতে নুন্যতম টাকাটুকুও নেই, সেই সময় যেখানে সেখানে এই শ্রমিকদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। থানায় রিক্সা আটকে রাখার ভয় দেখিয়ে ১০০-১৫০ টাকা আদায় করছে সিভিক পুলিশের দল। হাওড়ায় বেলিলিয়াস রোডে পুলিশকে লাথি মারার ঘটনা ছিল অত্যন্ত অন্যায় কাজ, কিন্তু এই ঘটনা ঘটনা ন্যায়ও নয়। আমার বাড়ির পাশে স্বাভাবিকদিনে গোরু হাটার মোড়ে গেলে দেখা যাবে সকাল ৭টা থেকে ফুটপাতে উবু হয়ে বসে আছে সার সার মানুষ। ওরা কেউ রঙের মিস্ত্রি, কেউ প্লাম্বার, কেউ মোট বাহক। কন্ট্রাক্টররা ওখান থেকেই তাদের ডেকে নিয়ে কাজ দেয়। গতকালই তেমনই এক লেবারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তার দাবী দাদা এক মাস তবু চালিয়ে নিয়েছি, কিন্তু আর পারছি না। বিড়ি খেতে গেলেও দুবার ভাবতে হচ্ছে। আমার হাতে ধরা সিগারেটটা আপনা আপনি পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। ৯০টাকা দিয়ে কেনা গোল্ড ফ্লেক।
দমদম রোডে একটা কালো পাগলকে দেখা যায় প্রায়ই। পাতলা চুল, দীর্ঘদেহী, একটা ঝোলামতো নিয়ে হেঁটে চলে বেড়ায়। কথা বলে, আপন মনেই হেসে বেড়ায়, চিৎকার করে। গতকাল সিগারেট ফুরিয়েছিল বলে রাত নটায় বেড়িয়ে মতিঝিল থেকে হাঁটতে হাঁটতে গোরু হাটার দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম অন্ধকারে একটা রঙে দোকানের বন্ধ শাটারে হেলান দিয়ে বসে আছে। পাগলটাকে ওভাবে চুপ থাকতে দেখিনি কখনো, কী দিনে কী রাতে। কাল দেখলাম, হাঁ করে আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে, থমকে দাঁড়ালাম, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে চাইতেই চোখে পড়ল আধফালি চাঁদ, নাকি আধখানা ঝলসানো রুটি? আসলে খিদে তো মানসিক ভারসাম্যও মানে না। বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি। একটা দোকানে সিগারেট পেয়ে, চারটে কেক কিনি, ফিরতি পথে রেখে আসি ওর পায়ের কাছে, একটু এগিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করি কাগজ শুদ্ধই গোগ্রাসে গিলছে পাগল। সকালে একবার থানার দিকে গেছিলাম, রোজই যেতে হয়, তখনও একইভাবে বসে আছে সে।
ফিরে এসে ল্যাপটপ অন করতেই চোখে পড়ল ৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিশেষ প্লেন আসছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। নীচে সারি সারি লাশ, উপর দিয়ে সেই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে করতে উড়ে যাবে বিলাস বহুল প্লেন। ঠিক যেভাবে ভাগাড়ের উপর দিয়ে শ্যেন দৃষ্টি হেনে উড়ে যায় একটা কালো শকুন।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে আজ মে দিবস। ঠিক তার একদিন আগে গতকাল এক দিদি ফোনে জানিয়েছিলেন ধাপার মাঠে কবর দেওয়ার খবর। আমার এক গোপন সঙ্গী আছে। সেও এক পাগল। তার একটাই দাবী আমি যখন গোপন অভিযানে বেরবো সে আমার সঙ্গী হবে। তার বাইক আছে। যত রাতই হোক ফোন করলেই হাজির সে। গতকাল গেছিলাম ধাপার মাঠে। সেখানেও দেখলাম সরকারী শ্রমিক। রাত আড়াইতে হবে। পালসার বাইক একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি আর পাগল অন্ধকারে মিশে দাঁড়াই। প্রায় ১৫জন সরকারি শ্রমিক তখন মাটি খুঁড়ছে। সাড়ে তিন হাত। আরো প্রায় ৭ ৮ জন সরকারী শ্রমিক তখন নামিয়ে আনছে লাশ। গুনে দেখলাম সবশুদ্ধ ৩৫টি। বেওয়ারিশ। একদিন লকডাউন উঠে যাবে, একদিন শেষ হয়ে যাবে করোনা। সময় দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। একদিন ধাপার মাঠে গড়ে উঠবে সুদৃশ্য বাড়িঘর। বাড়ির মালিক জানবেন তার ভিতের উপর বিজ্ঞাপনে দেখানো টিমএটি বারের ভিত রয়েছে। আসলে তিনি জানবেন না তার মজবুত বাড়ির ভিত টিমটি বার দিয়ে নয় কিছু মানুষের বুকের হাড় দিয়ে তৈরি। কিংবা একদিন ওই ধাপার মাঠেই গড়ে উঠবে বিলাসবহুল শপিং মল। আমরা যাব, ব্র্যান্ডেড জিন্স কিনব, মাল্টিপ্লেক্সে বান্ধবী অথবা বউয়ের হাত ধরে পপকর্ণ খেতে খেতে কোনো রিয়েলেস্টিক সিনেমা দেখব, আর ভাবব বিষাদে ডুবে যাব, আর ওই মাল্টিপ্লেক্সের ভিতের ভেতর শুয়ে থাকা মানুষগুলো হাসবে। অথবা ওই ধাপার মাঠ যেমন আছে তেমনিই পড়ে থাকবে। এখন যেমন ওই মাঠের যেখানে সেখানে কিছু নেশাড়িদের দেখতে পাওয়া যায় গাঁজা গাছ খুঁজতে, তেমনই ওই লাশের সারে উর্বর জমিতে নিজে নিজেই জন্মাবে কিছু গাঁজা গাছ। আমরা যেমন যেতাম একসময়, তেমনি কোনো তরুণ কবি ও লেখক ওখান থেকে তুলে আনবে ফুরফুরে সতেজ গাঁজা গাছের চারা, সেই গাছের পাতায় নেশা করবে। মৃত্যুর গন্ধ মাখা ওই তামাকে নেশা আরো বেশি হবে, তারপর নেশাতুর কলমে লিখবে...
“সময় এখনো শাদা জলের বদলে বোনভায়ের
নিয়ত বিপন্ন রক্ত রোজ
মানুষকে দিয়ে যায়;
ফসলের পরিবর্তে মানুষের শরীরে মানুষ
গোলাবাড়ি উঁচু ক’রে রেখে নিয়তির
অন্ধকারে অমানব;
তবুও গ্লানির মতো মানুষের মনের ভিতরে
এই সব জেগে থাকে ব’লে
শতকের আয়ু— আধো আয়ু— আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতাব্দীকে তা’রা
কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচন ক’রে
আশায় উজ্জ্বল রাখে; না হ’লে এ ছাড়া
কোথাও অন্য কোনো প্রীতি নেই।
মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
আরো ভালো— আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার
পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ
কতো দূর অগ্রসর হ’য়ে গেল জেনে নিতে আসে।"
আমি আর পাগল ফিরে আসি চুপচাপ। পাগলকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। কাল বাইকের পেছনে বসে ফিরতি পথে, আমার মুখে হঠাত জলের ছাট লাগে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ নেই। বৃষ্টি পড়ছে না। আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেয় পাগল, তারপর হেলমেট খুলতেই দেখি সেই প্রথমবার পাগলের চোখে চুপচাপ ভাদরের নদী বয়ে চলেছে।
ভাগাড় ও শকুনের সংখ্যা বাড়ছে।
এপারেও রতন দাসেরা কেবলই টার্গেট গ্রুপ, না হয় শিকার।
ওদিকে লকডাউনও দফায় দফায় বাড়ছে, বাড়ছে ভাংগার প্রবনতাও।
৮ হাজার কোটি সামান্য তো পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন ভাড়ার চেয়ে অনেক.....অনেক কম !